Monday 10 August 2020

কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে ‘রাধা’ কেনো ?


কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে ‘রাধা’ কেনো ?

যুবতী রাধার সাথে যুবক কৃষ্ণের প্রেমের কোনো ঘটনার প্রমান, হিন্দু শাস্ত্রের প্রামান্য কোনো গ্রন্থ, যেমন- চার বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ১২টি উপনিষদ, মূল সংস্কৃত ভাগবত, বেদব্যাসের নামে চালানো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ছাড়া বেদব্যাস প্রণীত  অন্য ১৭টি পুরাণ এবং ৬টি মহাপুরাণের কোথাও নেই; আছে ভারতের মুসলিম শাসনামলে লেখা বেদব্যাসের নামে চলা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে, জয়দেবের ‘গীত গোবিন্দে’, বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে এবং কয়েকজন বৈষ্ণব কবির লেখা বৈষ্ণব পদাবলীতে। এসব থেকে বোঝা যায়, কৃষ্ণের জন্ম প্রায় ৫ হাজার দুইশ বছর আগে হলেও, রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের জন্ম আসলে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পর ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ রচনার মাধ্যমে।

শ্রীকৃষ্ণ হলেন হিন্দুধর্মের প্রধান পুরুষ, এই কৃষ্ণের চরিত্রকে খারাপ দেখিয়ে, হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাসকে খেয়ে ফেলে, হিন্দুধর্মকে বিলুপ্ত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুসলমান শাসকরা বেদব্যাসের নাম ব্যবহার করে কোনো হিন্দু ব্রাহ্মণকে দিয়েই রচনা করায় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, এই পুরাণে কৃষ্ণ চরিত্রকে সম্পূর্ণ লম্পটভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যে সম্পূর্ণ অনৈতিক পরকীয়া প্রেম ও যৌনতায় লিপ্ত।

যেহেতু ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বেদব্যাসের নাম দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিলো, সেহেতু বেদব্যাস প্রণীত ২৪টি পুরাণের মধ্যে এই পুরাণ খুব সহজেই মিশে যায় এবং লোকজন এটা বিশ্বাস করা শুরু করে যে, সত্যিই রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেম ছিলো; এর ফলে মুসলমানদের এই ষড়যন্ত্রকে বুঝতে না পেরে,ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের বিষয়বস্তু, রাধা কৃষ্ণের প্রেমকে ভিত্তি করে সংস্কৃত ভাষার কবি জয়দেব লিখে ‘গীত গোবিন্দ’, এবং তারপর একই ভুল ক’রে বড়ুচণ্ডীদাস লিখে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’। 

এরপর আবির্ভাব ঘটে চৈতন্যদেবের এবং তিনি রাধা কৃষ্ণের প্রেমকে সত্য মনে করে নিজেকে রাধা কৃষ্ণের যুগল অবতার হিসেবে তুলে ধরেন এবং তার কয়েকজন অনুসারী কবি, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে পুঁজি করে রচনা করে বৈষ্ণব পদাবলী; এসবের মাধ্যমে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের ৪০০ বছরের এই মিথ্যা কাহিনী হিন্দুদের মাথায় শেকড় গেড়ে বসে, যা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে হিন্দু সমাজকে; কারণ, রাধা হচ্ছে হিন্দুধর্ম ও সমাজের জন্য একটি স্লো পয়জন ।

হিন্দুশাস্ত্রের প্রাচীন কোনো গ্রন্থে রাধার উল্লেখ না থাকলেও, বৈষ্ণবদের মূল ভিত যেহেতু রাধা-কৃষ্ণ, সেহেতু তারা রাধার অস্তিত্বকে শাস্ত্রের মাধ্যমে প্রমান করার জন্য দুটি খেলা খেলে, খেলা দুটি হলো- গীতামাহাত্ম্যে এবং কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধাকে ঢোকানো।

গীতা মাহাত্ম্যে রাধাকে যে বাইরে থেকে ঢোকানো, এ ব্যাপারে বিস্তারিত প্রমান দিয়ে লেখা আমার একটি পোস্ট আছে, যারা পড়েছেন তারা বিষয়টি জানেন, তাই সে ব্যাপারে এখানে আর কিছু বলবো না, এখানে আজ ব্যাখ্যা করবো- কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধা আসলে এলো কোথা থেকে- এই বিষয়টি।

কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধার ফাঁকি আসলে কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রেই আছে, শুধু একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই তা চোখে পড়বে, তাই নিচে গভীর দৃষ্টি দিয়ে পড়ুন মন্ত্রটা:

হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে।

গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে ।। ১

ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।

জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।। ২

এখন প্রথম দুই চরণ এবং শেষ দুই চরণের পার্থক্যটা খেয়াল করুন। ভালো করে লক্ষ্য করুন, শেষ দুই চরণ পুরোটাই সংস্কৃত এবং প্রথম দুই চরণ- ‘নমহস্তুতে’ শব্দ ছাড়া পুরোটাই বাংলা। কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র, কৃষ্ণের লীলা প্রকাশের পর সেই মহাভারতের যুগ থেকেই আছে, তাই সেটা পুরোটা সংস্কৃতে হওয়ায় স্বাভাবিক এবং তাই আছে এবং সেটা হলো-

ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।

জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।। ২

কিন্তু এর আগে- হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে - এলো কোথা থেকে ? এটাই হলো বৈষ্ণবদের খেলা। তারা রাধার অস্তিত্বকে প্রমান করতে গিয়ে সংস্কৃত কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রের আগে নিজেদের রচিত মন্ত্র জুড়ে দিয়েছে; কিন্তু অপরাধীরা যেমন অপরাধের সূত্র তাদের অপর্কমের সাথে রেখে যায়, তেমনি বৈষ্ণবরাও তাদের অপরাধের সূত্র, তাদের রচিত শ্লোকের মধ্যে রেখে দিয়েছে, আর সেটা হলো- মন্ত্রটা সংস্কৃতে না লিখে বাংলায় লিখে। 

খেয়াল করুন- হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে- এর প্রত্যেকটা শব্দ বাংলা এবং এই শ্লোকের- ‘রাধা কান্ত’ শব্দের মাধ্যমে তারা কৃষ্ণকে, রাধার স্বামী বানিয়ে দিয়েছে; কারণ, কান্ত শব্দের অর্থ স্বামী। বৈষ্ণবদের অপরাধের মাত্রাটা খেয়াল করুন, অস্তিত্বহীন রাধাকে তারা শুধু কৃষ্ণের অনৈতিক প্রেমিকা হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় নি, রাধাকে কৃষ্ণের স্ত্রীও বানিয়ে দিয়েছে, বাস্তবে যার ভিত্তিই নেই; কারণ, কৃষ্ণের ১০ বছর ২ মাস বয়সের পরবর্তী ১১৫ বছরের জীবনে রাধা বলে কেউ ছিলোই না।

সুতরাং কৃষ্ণকে প্রণাম করতে হলে প্রচলিত কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র থেকে প্রথম দুই চরণ বাদ দিয়ে-

ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।

জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।। ২

এটা বলতে হবে। এছাড়াও গীতা মাহাত্ম্যের ৬ নং শ্লোকটিকে কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সেটি হলো-

সারথ্যমর্জুনস্যাদৌ কুর্বন্ গীতামৃতং দদৌ।

লোকত্রয়োপকারায় তস্মৈ কৃষ্ণাত্মনে নমঃ।

এর অর্থ হলো- যিনি অর্জুনের সারথি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে জগতের উপকারার্থে গীতা রূপ অমৃত দান করেছেন, সেই পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার করি। 

আশা করছি, উপরের এই আলোচনার মাধ্যমে- কৃষ্ণ প্রণাম রাধা কিভাবে এলো এবং প্রকৃত কৃষ্ণপ্রণাম মন্ত্র কোনগুলো হওয়া উচিত, তা আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার করতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment