Tuesday 4 August 2020

অশৌচ চলাকালীন মন্দিরে পূজা বা প্রবেশ করা যাবে কি না ?


অশৌচ চলাকালীন মন্দিরে পূজা বা প্রবেশ করা যাবে কি না ?

কারো জন্ম হলে যে অশৌচ পালন করা হয়, তাকে বলে জননাশৌচ। মরণাশৌচ শোকের হলেও জননাশৌচ আনন্দের। তাই এতে সদ্য জাত শিশুর পিতা মাতা এবং শিশুর দেখা শোনার কাজে নিয়োজিত কেউ ছাড়া অন্য কারো কোনো অশৌচ হয় না। এই অশৌচে পিতা মাতাকে যা পালন করতে হবে, তা হলো- যেহেতু তারা সদ্যজাত শিশুর জন্মে আনন্দে আত্মহারা হয়ে থাকে এবং মা তো সব সময় শিশুর কাছে থাকেই এবং বাবাও যখন তখন শিশুকে কোলে নেয় বা আদর করে এবং এই সময় যেহেতু শিশুকে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মধ্যে রাখা যায় না বা স্বাভাবিকভাবেই সেটা সম্ভব নয়, তাই শুধু পিতা মাতাকেই নয়, যারাই শিশুটিকে দেখা শোনার জন্য সর্বদা নিয়োজিত থাকবে, তাদেরকেই পরিবারের বা অন্য লোকজনের সাথে মেলামেশায় একটু সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে, যাতে তাদের মাধ্যমে কোনো রোগ জীবানু অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে না পড়ে।

হিন্দু সমাজে আঁতুড় ঘর নামে একটা ব্যাপার আছে, যাতে, কোনো মহিলার বাচ্চা হলে তাকে ৬ দিন (এলাকা ভেদে ২/১ দিন পার্থক্য হতে পারে) ঐ ঘরে আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয় এবং আঁতুড় ঘরে কাটানো সময় শেষের পরের দিনের দিন কামানের মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তাকে বাড়ির অন্যদের সাথে মিশতে দেওয়া হয়; এটা এইজন্যই করা হয়, যাতে মা ও শিশুর দ্বারা রোগ জীবানু অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং আঁতুড় ঘর থেকে বের হওয়ার পর ঐ ঘরে থাকা সব কাপড় চোপড় পুড়িয়ে ফেলা হয়, এটাও করা হয় রোগ জীবানু নাশের জন্য। বর্তমানে বেশিরভাগ ছেলে মেয়ের জন্ম হচ্ছে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে এবং সেখানেই মা ও শিশুর চিকিৎসার সুবিধার্থে বেশ কয়েকদিন রাখা হচ্ছে; যদি ৫/৬ দিন সেখানে রাখতে বাধ্য হতে হয়, তাহলে বাড়িতে আর আলাদা করে আঁতুড় ঘর বানানোর প্রয়োজন নেই, কামানের দিন হসপিটাল বা ক্লিনিক থেকে বাড়িতে এনে কামান দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাড়িতে তুললেই হবে।

জননাশৌচের মূল কথা হলো- সদ্যজাত শিশু এবং তার মায়ের দ্বারা কোনো রোগ জীবানু যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তার ব্যবস্থা করা, এখানে আর অন্য কোনো ব্যাপার নেই, একারণেই জননাশৌচ হবে শুধু পিতা মাতার, এই কথাটিই বলা আছে মনুসংসহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের ৬২ নং শ্লোকে এই ভাবে-

"সর্বেষাং শাবমাশৌচং মাতাপিত্রোস্তু সূতকম্।
সূতকং মাতুরেব স্যাদুপস্পৃশ্য পিতা শুচিঃ।।

এর অর্থ- মৃত্যুজনিত অশৌচে অঙ্গাস্পৃশ্যত্বরূপ অশৌচ সকলেরই সমান। কিন্তু জন্ম সম্পর্কিত অশৌচে মাতা ও পিতার মাত্র সূতক অর্থাৎ অঙ্গাস্পৃশ্যত্ব হয়; ঐ অস্পৃশ্যত্যরূপ অশৌচ মাতার দশরাত্রি হয়ে থাকে, কিন্তু পিতা স্নান করলেই সেই অস্পৃশ্যতা দূর হবে।

যদিও আমি মনে করি না যে মনুসংহিতা হিন্দু ধর্মের কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ, তারপরও যেহেতু হিন্দু সমাজের বহু নিয়ম কানুন মনুসংহিতার থেকে উদ্ভূত, তাই মনুসংহিতাকে কিছুটা পাত্তা দিতেই হয়। এছাড়াও যে বিষয়গুলো ভালো এবং যুক্তিসম্মত, সেটা আমরা যেকোনো গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করতেই পারি।

অশৌচের মধ্যে পূজা পার্বন করা যাবে কি না বা মন্দিরের প্রবেশ করা যাবে কি না, এ সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন ফটোপোস্টে উত্থাপিত হয়েছে, এ সম্পর্কে বলছি-

বাড়িতে কেউ মারা গেলে তার উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ বা ভোগ পর্যন্ত প্রতিদিন গীতা পাঠ করা হয়; গীতা হলো হিন্দুধর্মের প্রধান গ্রন্থ, যে গীতা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখের বাণী এবং যে গীতার জ্ঞানকে অবলম্বণ করে শ্রীকৃষ্ণ ত্রিলোক পালন করে থাকেন, সেই গীতা যখন বাড়িতে মৃত্যুজনিত অশৌচ, যে অশৌচ শুধু বাড়ির লোকজনকেই নয়, বংশের এমনকি আত্মীয় স্বজনদের কাউকে স্পর্শ করে, সেই অশৌচে যদি গীতা স্পর্শ বা পাঠ করা যায়, তাহলে অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা করা যাবে না কেনো ? কোনো দেব-দেবী কি শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে বড় ? অশৌচে যেখানে গীতা পাঠ করা যায় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পূজা ও আরাধনা করা যায়, সেখানে অন্য দেব-দেবী তো তুচ্ছ ব্যাপার। তবে অশৌচের মধ্যে এই পূজা প্রার্থনা শুধু বাড়ির মন্দির এবং বাড়িতে স্থাপিত দেব-দেবীদের জন্য প্রযোজ্য, যেহেতু সেটা বাড়ির সীমানার মধ্যেই অবস্থিত, তাই বাড়ি অশৌচ হলে বাড়ির মধ্যে স্থাপিত মন্দিরও অশৌচ।

কিন্তু সাধারণভাবে মন্দির একটি পবিত্র জায়গা, তাই আমরা সব সময় স্নান করে পবিত্র হয়ে মন্দিরে যাওয়ার চেষ্টা করি, এটা মন্দিরের শুচিতা এবং পবিত্রতার জন্য প্রয়োজন, যাতে মন্দির সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে এবং লোকজন মন্দিরে গিয়ে যাতে পবিত্রতারভাব অনুভব করে, তাই অশৌচ অবস্থায় পাড়ার বা গ্রামের মন্দিরে না যাওয়াই ভালো, এতে মন্দিরের পবিত্রভাব বজায় থাকে এবং যা তা অবস্থায় মন্দিরে যেতে না পারায় মন্দিরের গুরুত্ব বজায় থাকে এবং মন্দিরের প্রতি সাধারণ মানুষের যে শ্রদ্ধা তা হারায় না বা বজায় থাকে, যেটা সমাজ ও মন্দিরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

উপরের আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে- গৃহে স্থাপিত মন্দিরে অশৌচ অবস্থায় পূজা করা যাবে, কিন্তু পাড়ার বা গ্রামের সার্বজনীন মন্দিরে করা যাবে না। এটা মরণাশৌচের ক্ষেত্রে; কিন্তু জননাশৌচের ক্ষেত্রে যেহেতু শুধু প্রসূতি মাতারই কেবল অশৌচ হয়, তাই বাড়ির অন্য সকল সদস্য যেকোনো প্রকার মন্দিরে যেতে পারবে এবং পূজা অর্চনা করতে পারবে। এই সময় প্রসূতি মায়ের কোনো রকম পূজা অর্চনা করার দরকার নেই; কারণ, তিনি কষ্ট করে একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে সমাজের যে পরিমাণ উপকার করেছেন, তা যেকোনো প্রকার দেব-দেবীকে পূজা দেওয়ার চেয়ে হাজার গুন বেশি পূণ্যের কাজ; তাই সন্তান জন্মদানকালীন অসুবিধার সময় কোনো প্রসূতি মাতার কোনো রকম ধর্মকার্য করার প্রয়োজন নেই।

আশা করছি আমার পাঠক বন্ধুদেরকে বিষয়টি বোঝাতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment