Sunday 10 May 2020

প্রসঙ্গ : শ্রাদ্ধ বাড়িতে খাওয়া বা না খাওয়া


২০১৬ সালে গ্রামের বাড়িতে আসার পর হঠাৎ একদিন কানে এলো শ্রাদ্ধ বাড়িতে নাকি বৈষ্ণব বা বৈরাগীদের খাওয়া নিষেধ। হয়তো এটা অনেক আগে থেকেই প্রচার হচ্ছে, দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকায় হয়তো সেটা আমার কানে আসে নি। যা হোক, এটা বুঝতে আমার দেরি হলো না যে- গ্রামে মাঝে মাঝে যেসব অল্পশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বা মূর্খ বৈষ্ণব গুরুরা আসে, তাদেরই প্রচার এটা। তাই এটা শোনার পরই আমি আমার অনুগত কিছু ছেলে পেলেকে বলে রাখলাম, এই গুরুরা যদি গ্রামে আসে, তাহলে আমাকে জানাস, তারপর দেখবো তার বিদ্যার দৌড় কতদূর। কিন্তু তার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো গুরুর সাক্ষাত আমি পাই নি, তাই বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে ডিসকাস করার সুযোগও হয়ে উঠে নি।

যা হোক, শ্রান্ধ বাড়িতে বৈষ্ণবদের খাওয়া নিষেধ, যেহেতু এই বিষয়টি সমাজে প্রচার হয়ে গেছে, সেহেতু এটার সাইড এফেক্টও সমাজে পড়তে শুরু করেছে। যেমন- ২০১৮ সালে আমাদের গ্রামে একজন জন্মসূত্রে নমঃশুদ্র মারা গেলো, তার ছেলেরা এটা জানতো যে বৈষ্ণবদের নিমন্ত্রণ করলে তারা খাবে না, তাই বৈষ্ণবদেরকে বাদ দিয়ে গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করলো, এভাবে তারা অনুষ্ঠান পার করলো, এই বিষয়টি আমার কানে এলো অনুষ্ঠান পার হয়ে যাবার পর, তাই সেটাতে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারলাম না। এই ঘটনার পর গ্রামের এক কায়স্থ পরিবার, এক বৈষ্ণবকে ধরে বললো, আমরা কেউ মারা গেলে আমাদের বাড়িতে তো আপনারা খাবেন না, এটা নিয়ে সেই বৈষ্ণব অপদস্থ হলো। গ্রামে যেহেতু- দাস, মহন্ত, রায়, সরকার, মণ্ডল, শীল, পাল, ঘোষ পদবীর লোকজনের একত্রে বসবাস এবং দাস, মহন্ত ছাড়া অন্য সবাই অবৈষ্ণব, সেহেতু গ্রামে শ্রাদ্ধের সংখ্যা বেশি এবং সেই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে, রাত পোহালেই মুখ দেখাদেখির কারণে, অবৈষ্ণবরা, বৈষ্ণবদের নিমন্ত্রণ করে থাকে এবং সেই শ্রাদ্ধ বাড়ির খাওয়ার অনুষ্ঠানে বৈষ্ণব বাড়ির মহিলারা একদম না গেলেও, শ্রাদ্ধ বাড়িতে খাওয়া উচিত কি উচিত না, এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে চক্ষু লজ্জার খাতিরে বৈষ্ণব বাড়ির অনেক পুরুষই যেতে বাধ্য হয় এবং খেতেও বাধ্য হয়। বৈষ্ণবদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটাতে এবং তাদেরকে খাওয়াতে অনেক অবৈষ্ণব আবার আগের দিন শ্রাদ্ধ করে পরের দিন চৈতন্যদেব মানে তথাকথিত মহাপ্রভুর ভোগ দেয়, এর ফলে সারা গ্রামবাসীকে তারা একসাথে খাওয়াতে পারে এবং তৃপ্তিবোধ করে।

এই শ্রাদ্ধ বাড়িতে খাওয়া উচিত কি উচিত না, এই বিষয়টি ক্লিয়ার করতেই আমার আজকের এই প্রবন্ধের অবতারণা।

যা হোক, শ্রাদ্ধবাড়িতে খাওয়ার অপকারিতা বোঝাতে বৈষ্ণব গুরুরা যে গল্পটি বলে, সেটি হলো-

এক সন্ন্যাসী পদব্রজে কোথাও যাচ্ছিলো, রাতে সে এক ব্রাহ্মণ বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে, খাওয়া দাওয়া করে এবং ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ব্রাহ্মণ বাড়ির ঠাকুরঘরে ঠাকুরের মূর্তিতে ছিলো নানারকম সোনার অলংকার। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই ব্রাহ্মণ দেখে সেই সন্ন্যাসী আর নেই, ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখে ঠাকুরের মূর্তিতে সোনার অলঙ্কারও নেই। সেই সন্ন্যাসীই সেই অলঙ্কারগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে, এটা ধরে নিয়ে সেই ব্রাহ্মণ, সেই সন্ন্যাসীকে ধরার জন্য দিকে দিকে কয়েকজন লোক পাঠায়।

ইতোমধ্যে কিছুদূর যাওয়ার পর সেই সন্ন্যাসীর সম্বিত ফিরে আসে এবং সে ভাবতে লাগে, আমি সোনার অলঙ্কারগুলো চুরি করে আনলাম কেনো, এটা তো আমার কর্ম নয়। এই ভেবেই সে সেই ব্রাহ্মণের বাড়ির দিকে আবার হাঁটতে শুরু করে, ইতোমধ্যে ব্রাহ্মণের পাঠানো লোকও তাকে দেখতে পায়, তারা সেই সন্ন্যাসীকে নিয়ে ব্রাহ্মণের বাড়িতে ফিরে আসে।

দেবমূর্তির সোনার অলঙ্কার সন্ন্যাসী চুরি করে নিয়ে গেছে, এই খবর গ্রামের মধ্যে প্রচার হওয়ার পর দলে দলে লোক ব্রাহ্মণের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় এবং তারা নানা আলোচনা সমালোচনার মাঝে সেই সন্ন্যাসীকে আসতে দেখে, তাকে মারতে উদ্যত হয়। এতে সন্ন্যাসী বলে, আমিই সোনার অলঙ্কারগুলো চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই এবং এরা আমাকে ধরে আনে নি, আমি স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছি, আমার আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে, সেগুলো জিজ্ঞেস করার পর আপনারা যা খুশি শাস্তি আমাকে দিতে পারেন।

সবাই সন্ন্যাসীর কথা শুনতে আগ্রহী হয় এবং এতে সন্ন্যাসী সেই ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করে, গতকাল রাতে আপনি যে আমাকে খাবার দাবার দিয়েছেন, সেগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করা ?

ব্রাহ্মণ বলে- গতকাল আমি এক বাড়িতে শ্রাদ্ধ করেছি, সেখান থেকেই ওগুলো পেয়েছি।

সন্ন্যাসী বলে- সেই শ্রাদ্ধ কার ছিলো ?

ব্রাহ্মণ বলে- সেই লোক খুব ভালো ছিলো না, সে এক চোর ছিলো, মাঝে মাঝে চুরি করতো।

সন্ন্যাসী বলে- আমার এই মতি বিভ্রমের কারণ এটাই। শ্রাদ্ধবাড়ির অন্ন আমাকে খাইয়েছেন এবং সেই শ্রাদ্ধ ছিলো এক চোরের। এই কারণেই চৌর্যবৃত্তি আমার ভেতরে জেগে উঠেছে এবং আমি চুরি করতে বাধ্য হয়েছি।

এটা শুনে ব্রাহ্মণ তার ভুল বুঝতে পারে।

এই গল্প ব'লে, বক্তারা এটা বোঝাতে চায় যে, শ্রাদ্ধ বাড়িতে খাওয়া যাবে না, খেলে যে লোকের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ করা হয়েছে, তার কর্মফলের ভাগ নিতে হবে এবং এই গল্পের মধ্যে চোরকে আনার উদ্দেশ্য হলো সাধারণ হিন্দুদের মনে গল্পের গভীর একটা প্রভাব ফেলা এবং এটা বিশ্বাস করানো যে শ্রাদ্ধ বাড়িতে খেলে চোর হয়ে যেতে হবে।

এখন এই গল্পের পোস্টমর্টেম করে দেখাচ্ছি যে এই গল্পটা আসলে সত্য কি না এবং এই গল্পের বিষয়বস্তু বাস্তব হতে পারে কি না ?

যারা এই গল্পটি বলে, তাদের কেউ কেউ বলে এটি পুরাণের গল্প, কিন্তু কোন পুরাণের গল্প সেটা বলে না বা বলতে পারে না, আবার কেউ বলে এই ঘটনাটি বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার। ফলে শুরুতেই গল্পের সোর্স নিয়ে একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়, যেটি ইঙ্গিত করে যে গল্পটি মিথ্যা হতে পারে।

এই গল্পের ফোকাস পয়েন্ট দুটি- একটি হলো চোর ব্যক্তির শ্রাদ্ধ, অন্যটি হলো শ্রাদ্ধবাড়ির খাবার খেলে মৃত ব্যক্তির কর্মফলের ভাগ নিতে হয়।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে- যাদের শ্রাদ্ধ করা হয়, তারা সবাই কি চোর ? নিশ্চয় নয়। যাদের শ্রাদ্ধ করা হয়, তাদের মধ্যে ভালো মন্দ সব ধরণের মানুষই আছে এবং যে বৈষ্ণবরা মনে করে শ্রাদ্ধ বাড়িতে খেলে তাদের ধর্ম নষ্ট নষ্ট হবে বা তাদের আত্মার অধঃপতন হবে, তারাও কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না যে তারাও সবাই ১০০% ভালো মানুষ। তাহলে শ্রাদ্ধ বাড়িতে খেলে যদি মৃতব্যক্তির কর্মফলের ভাগ নিতে হয়, তাহলে ভালো কর্ম বা খারাপ কর্ম উভয়েরই ভাগ পাওয়া যাবে এবং সমাজে খারাপ মানুষের চেয়ে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি, এই সূত্রে গড়ে সুকর্মের ফলই বেশি পাওয়া যাবে, তাহলে সমস্যা কোথায় ?

শ্রাদ্ধবাড়িতে খেলে কর্মফলের ভাগ নিতে হয়, এটা ধরে নিয়ে উপরের অনুচ্ছদটি লিখলাম, কিন্তু বাস্তবে কারো কর্মের ফল কেউ নেয় না বা নিতে পারে না, যার কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে মৃতব্যক্তির পুত্ররা কী জন্য শ্রাদ্ধ করে এবং কী জন্য শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে গ্রামবাসী বা আত্মীয় স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায় ?
শ্রাদ্ধ হলো পিতৃঋণ পরিশোধের উপায়ের একটি অংশ এবং মৃত ব্যক্তির পারলৌকিক মঙ্গলের একটি উপায়। মৃত ব্যক্তির আত্মার সদগতির জন্য তার পুত্রদেরকে এই শ্রাদ্ধ করতে হয়। কারণ, কোনো ব্যক্তির সন্তান যদি না থাকে এবং তার মৃত্যুর পর তার উদ্দেশ্যে যদি পিণ্ডদান ও শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান না করা হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির আত্মার সদগতি হয় না বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই মৃত ব্যক্তির আত্মার সদগতির জন্য পিণ্ডদান এবং শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করলেই হয়, তাহলে লোকজনকে খাওয়ানোর দরকারটা কী ?

লোকজনকে খাওয়ানো আসলে সামাজিক সহযোগিতার প্রতিদান। কোনো বাড়ির কোনো লোক মারা গেলে সেই বাড়ির লোকজন একা একা তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে পারে না, পাড়ার বা গ্রামের সকলে মিলে তাকে সমাধিস্থ বা দাহ করতে কেউ প্রত্যক্ষভাবে কেউ পরোক্ষভাবে সহায়তা করে, আবার কেউ শোকগ্রস্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মানসিক শক্তি যোগায়। এই যে পাড়া প্রতিবেশি বা গ্রামবাসী বা আত্মীয় স্বজনদের সহানুভূতি বা সহযোগিতার মনোভাব, এই মনোভাবেরই প্রতিদান দেওয়া হয় তাদেরকে একবেলা ভরপেট খাইয়ে, যেহেতু কোনো কিছু খাওয়ানোর মাধ্যমেই লোকজনকে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট করা যায় এবং তাদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা আদায় করা যায় এবং এইভাবে একবেলা খেয়ে লোকজন যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র কন্যাদের উপর সন্তুষ্ট হয়, তাহলে তাদের আশীর্বাদ ঐ পরিবারের এবং ঐ পরিবারের মৃত ব্যক্তিদের উপর বর্ষিত হয়, যেটা মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য কল্যানকর এবং মৃত ব্যক্তির স্বর্গ প্রাপ্তি এবং আত্মার উন্নতির জন্য সহায়ক।

তাই শ্রাদ্ধবাড়িতে খেলে মৃত ব্যক্তির কর্মফলের ভাগ নিতে হয়, এটা একটা বোগাস কথা। কারো কর্মফলের ভাগ কাউকে নিতে হয় না। বরং বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে লোকজনকে সেবা দিয়ে তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারলে, তাদের আশীর্বাদ মৃত ব্যক্তি এবং তার পরিবারের উপর বর্ষিত হয়, যেটা মৃত ব্যক্তির পুত্র কন্যারা তাদের পূর্বপুরুষ এবং নিজেদের জন্য অর্জন করে, এই সিস্টেমের মাধ্যমে তারা কারো কাছ থেকে তাদের পূণ্যকে ছিনতাই করে না বা কাউকে তাদের পিতার কর্মফলকে চাপিয়ে দেয় না।

শ্রাদ্ধ বাড়িতে খাওয়া উচিত কি উচিত নয়, এই প্রশ্ন আমাকে একজন করলে তাকে আমি বলেছিলাম, শ্রাদ্ধ: বাড়িতে খেলে কী হয়, সেটা জানার আগে, আগে শোন, শ্রাদ্ধবাড়িতে না খেলে কী হয় ? শ্রাদ্ধ বাড়িতে না খেলে প্রতিবেশী বা শুভানুধ্যায়ীদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়, যেটা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, শ্রাদ্ধ বলে যে লোকের নিমন্ত্রণ রক্ষা করা হলো না, সে লোক যেমন আপনাকে আর আগের মতো সুনজরে দেখবে না, তেমনি আপনার মঙ্গল কামনাও করবে না এবং আপনার বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ দিলেও সে আসবে না, এভাবে সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হবে, সামাজিক বন্ধনগুলো শিথিল হবে, বিপদে আপদে একে অপরকে সহযোগিতা করবে না, এভাবে হিন্দু সমাজ আস্তে আস্তে ক্ষতির মুখে পড়ে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে।

তাই শ্রাদ্ধ বাড়ির খাওয়া না খাওয়া নিয়ে অবাস্তব বৈষ্ণব মতবাদের ধারক বাহক বৈষ্ণবগুরুদের কোনো কথা কানে না নিয়ে নির্দ্বিধায় শ্রাদ্ধবাড়িতে যান এবং খান, এতেই আপনার মঙ্গল, সমাজের মঙ্গল, যা সনাতন ধর্মের রীতি এবং যা বেদদ্রষ্টা মুনি-ঋষিদের বিধান।

শ্রাদ্ধ বাড়িতে খাওয়া উচিত কি উচিত নয়, এই সমস্যার সমাধান, আশা করছি উপরের আলোচনা থেকে আমার বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার হয়েছে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment