Tuesday 11 August 2020

যোগমায়ার গল্প এবং ব্রহ্মের সাথে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের সম্পর্ক বা এদের প্রকৃত রহস্যটা আসলে কী ?


যোগমায়ার গল্প এবং ব্রহ্মের সাথে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের সম্পর্ক বা এদের প্রকৃত রহস্যটা আসলে কী ?

শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাতের কাহিনী লিখতে গেলেই ‘যোগমায়া’ শব্দটি আসবেই। কারণ- গল্পে, বসুদেব, নন্দের কাছ থেকে যে কন্যা শিশুটিকে নিয়ে কারাগারে ফিরে আসে, তার নাম হিসেবে যেমন বলা হয় যোগমায়া; তেমনি বলা হয় যোগমায়ার প্রভাবেই সেই রাতে ঝড়-বৃষ্টিপূর্ণ দুর্যোগময় আবহাওয়ার সৃস্টি হয়েছিলো এবং কংস সহ কারাগারের রক্ষীরা সবাই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু এই যোগমায়া সম্পর্কে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। যাদের এ বিষয়ে ধারনা নেই, আমি চেষ্টা করছি, এ বিষয়ে তাদেরকে কিছু ধারণা দিতে; সেই সাথে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরেরও প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করবো।

হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস মতে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা হলেন পরমব্রহ্ম। এই ব্রহ্মের কোনো আকার বা রূপ নেই এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান। এজন্যই ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩/১৪/১) এবং বেদান্ত দর্শনে বলা হয়েছে,

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”

এর অর্থ - সবকিছু বা সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম বিদ্যমান। 

এই ব্রহ্মের তিনটি রূপ হলো- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। খেয়াল রাখতে হবে যে, এরা কোনো আলাদা সত্ত্বা নয়, এরা পরম ব্রহ্মেরই তিনটি আলাদা রূপ। পরমব্রহ্ম যখন সৃস্টি করেন তিনি ব্রহ্মা, যখন পালন করেন তখন তিনি বিষ্ণু এবং যখন ধ্বংস করেন তখন তিনি মহেশ্বর, রুদ্র বা শিব। যেমন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যদি তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় থাকে, তিনি যখন যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেই সিগনেচার করেন কিন্তু বাস্তবে তিনি সাধারণ মন্ত্রী নন, প্রধানমন্ত্রী। পরমব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের ব্যাপারটা ঠিক সেই রকম; একই সত্ত্বা, কিন্তু কর্ম ও গুণে আলাদা আলাদা রূপ। 

কিন্তু স্থূলদৃষ্টিজনিত কারণে আমরা এসব বিবেচনা না ক’রে পরমব্রহ্ম থেকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে আলাদা করে ফেলে পরমব্রহ্মকেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছি। ভুল শিক্ষার ফলে আমরা মনে করি, যিনি সৃষ্টি করেন তিনি ব্রহ্মা; যিনি পালন করেন তিনি বিষ্ণু; আর যিনি ধ্বংস করেন তিনি শিব বা মহেশ্বর। এটা সত্য হলে, বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ- তিনি পালন না করে কিভাবে কংস ও শিশুপালকে হত্যা করে বা জরাসন্ধ এবং দুর্যোধনকে হত্যা করায় ? প্রকৃতপক্ষে পরম ব্রহ্মের সৃষ্টিকারী রূপ হলো ব্রহ্মা, পালনকারী রূপ হলো বিষ্ণু এবং ধ্বংসকারী রূপ হলো শিব; যেমন প্রধানমন্ত্রী তার অধীনে থাকা মন্ত্রণালয়গুলোতে যখন যান, তখন সেই তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, যে উদাহরণটা একটু আগেই দিলাম।

যা হোক- আজকের বিষয় যোগমায়া, এবার সেই দিকে নজর দিই। পৃথিবীতে চেতনাগত শক্তি দুই প্রকারের- এক. নারীর, দুই. পুরুষের এবং এই দুই শক্তির মিলনের ফল ই হলো সৃষ্টি। কোনো পুরুষের যেমন একা কোনো কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই, তেমনি সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই একা কোনো নারীর। প্রকৃতির এই বিধানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই বা প্রকৃতির এই বিধানকে মেনে ব্রহ্মার নারী শক্তি যেমন সরস্বতী, তেমনি বিষ্ণুর নারী শক্তি হলো যোগমায়া। 

পুরুষের নারী শক্তিকে যেমন আমরা তার স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করি, তেমনি আমরা কল্পনা করে নিয়েছি যে ব্রহ্মার নারী শক্তি সরস্বতী হলো ব্রহ্মার স্ত্রী এবং বিষ্ণুর নারী শক্তি যোগমায়া বা লক্ষ্মী হলো বিষ্ণুর স্ত্রী, একইভাবে মহাদেবের নারী শক্তি বা স্ত্রী হলো দুর্গা। এই ভাবে সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং দুর্গাকে আমরা আলাদা আলাদা সত্ত্বা হিসেবে তৈরি করে নিয়েছি। শুধু তাই নয় দুর্গার গল্পে সরস্বতী এবং লক্ষ্মীকে দুর্গার মেয়েও বানিয়ে দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং দুর্গা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বররই নারী শক্তির প্রতীক এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, কর্মের ভিত্তিতে পরম ব্রহ্মেরই পৃথক পৃথক তিনটি রূপ, যা আগেই উল্লেখ করেছি। 

লক্ষ্মী, সরস্বতী যে দুর্গার মেয়ে নয়, এ বিষয়ে যদি আপনার কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে নিজেকেই প্রশ্ন করবেন যে, হিন্দুশাস্ত্রের গল্পের ইতিহাসে প্রথম আবির্ভাব বিষ্ণুর, তারপর ব্রহ্মার ও শিবের। দুর্গার আবির্ভাব বহু পরে, যখন অলরেডি বহু দেবতার সৃষ্টি হয়ে গেছে, তাদের মিলিত শক্তির ফলেই দুর্গার সৃষ্টি, তাহলে সেই দুর্গা কিভাবে প্রথম দিকে সৃষ্টি হওয়া ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর নারী শক্তির প্রতীক সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মা হয় ?

কারো মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে যে ব্রহ্মার নারী শক্তির নাম কেনো সরস্বতী ? তত্ত্ব মতে ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, তো সৃষ্টি করতে কী লাগে ? জ্ঞান। সরস্বতী সেই জ্ঞানের দেবী বা প্রতীক। একজন পুরুষ যেমন তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে একটি সন্তান সৃষ্টি করে, তেমনি ব্রহ্মা তার নারী শক্তির সাহায্যে সকল সৃষ্টি কর্ম সম্পাদন করে। প্রকৃত অর্থে যদি ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী হতো, তাহলে কিন্তু সরস্বতীরও ছেলে মেয়ে থাকতো। কিন্তু তা কি আছে ? নেই। অন্যদিকে কিন্তু ব্রহ্মার ছেলে মেয়ে আছে। তাহলে এই ছেলে মেয়েগুলো এলো কোথা থেকে ? আসল ব্যাপার হচ্ছে, ব্রহ্মা, সৃষ্টির সময় তার নিজেরই নারী শক্তির রূপ সরস্বতীর জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টিকর্ম সমাধা করে থাকে।

একই ভাবে বিষ্ণুর নারী শক্তি হলো ধনের প্রতীক লক্ষ্মী, কারণ কী ? বিষ্ণু পালন কর্তা। তো পালন করতে কী লাগে ? ধন-সম্পদ। এজন্যই বিষ্ণুর নারী শক্তির প্রতীক হলো ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী।

মহাদেবের নারী শক্তির প্রতীক হলো দুর্গা, কালী, চণ্ডী; যাদের হাতে ভয়ংকর সব মারণাস্ত্র, যাদের কাজই হলো অসুরদের ধ্বংস করা, কারণ আর কিছুই নয়- সৃষ্টি বা পালন করার জন্য যেমন নারী শক্তির দরকার, তেমনি ধ্বংস করার জন্যও নারী শক্তির দরকার। দুর্গা, কালী, চণ্ডী আসলে মহাদেবের সেই নারী শক্তিরই প্রতীক, যাদের আমার মহাদেবের স্ত্রী রূপে কল্পনা করে নিয়েছি।

এমন প্রশ্নও কারো মনে আসতে পারে যে- লক্ষ্মী, সরস্বতী যে দুর্গার মেয়ে এই তথ্যটা হিন্দু সমাজে প্রচলিত হলো কিভাবে, আর কেনোই বা একসাথে তাদের পূজার করা হয় ?

দুর্গাপূজা হলো হিন্দু সমাজের মহাশক্তির মহাপূজা। ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন, হিন্দুধর্মের এমন কোনো দেবতা বা তার প্রতিনিধি নেই যা, যা দুর্গাপূজায় নেই। শিবের প্রতিনিধি হিসেবে স্বয়ং দুর্গা; বিষ্ণু ও ব্রহ্মার প্রতিনিধি হিসেবে লক্ষ্মী ও সরস্বতী, এছাড়াও রয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং যোদ্ধার প্রতীক হিসেবে কার্তিক। এর সাথে আরও আছে প্রকৃতির প্রতিনিধি হিসেবে- সাপ, ময়ূর, সিংহ, ইঁদুর, পেঁচা, হাঁস এবং কলা গাছসহ নব পত্রিকার নামে নানা গাছপালার উপাদান। এভাবে দুর্গা পূজা এক মহাপূজা যা প্রতিনিধিত্ব করে সমাজের বিন্দু থেকে সিন্ধু সকল কিছুর।

আপনারা শুনে থাকবেন যে দুর্গা পূজায় বেশ্যার ঘরের মাটি লাগে, এর মানে হলো দুর্গাপূজা করতে গেলে সমাজের উচ্চ শ্রেণী থেকে শুরু করে একেবারে সমাজের নিম্ন দলিতশ্রেণী, যারা অস্পৃশ্য, এমনকি যারা যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়ে সমাজের চোখে ঘৃণিত, দুর্গাপূজা করতে গেলে তাদেরকেও ঘৃণা বা অবহেলা করা যাবে না। সমাজ ও প্রকৃতির সব কিছুকে নিয়ে দুর্গাপূজা এভাবে এক মহাশক্তির ও মহা আয়োজনের পূজা।

এতসব তথ্য তো সাধারণ মানুষ আর জানে না, আর আমাদের শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণ সমাজও তাদের প্রতিপত্তি খর্ব হবে ভেবে সাধারণ মানুষকে এসব জ্ঞান দেয় নি। এই প্রেক্ষাপটে - মা, বাবার সাথে তাদের ছেলে মেয়েরা পূজা দেখতে গিয়ে তাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করেছে বা এখনও করে যে, লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ, দুর্গার কে হয় ? মা, বাবাও জানে না আসল ঘটনা, কিন্তু ছেলে মেয়েদেরকে তো উত্তর কিছু একটা দিতে হবে, তাই তারা সহজ সমাধান হিসেবে বলে দিয়েছে এবং এখনও বলে ওরা মা দুর্গার ছেলে মেয়ে। ব্যস, সমস্যার সমাধান।এভাবেই কার্তিক, গণেশের সাথে সাথে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী যারা দেবী হিসেবে দুর্গার সিনিয়র তারাও দুর্গার মেয়ে হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, দুর্গা কেনো অসুরকে মেরেছে, ছোট বেলায় এর একটা ব্যাখ্যা শুনেছিলাম এরকম:

অসুর হলো দুর্গার ভাগিনা, আর ভাগিনা হয়ে অসুর তার মামী দুর্গাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো, এজন্যই ক্ষেপে গিয়ে দুর্গা অসুরকে মেরে ফেলেছে। হিন্দু সমাজের অজ্ঞানতার অবস্থাটা একবার কল্পনা করুন।

যা হোক, ফিরে যাই যোগমায়ার গল্পে, কংসের অত্যাচার থেকে পৃথিবীবাসীকে বাঁচানোর জন্য বিষ্ণু, কংসকে বিনাশের প্ল্যান ক’রে প্রাকৃতিক নিয়মে তার বাস্তবায়ন শুরু করে দেয়; খেয়াল করুন ধ্বংসের দেবতা যদি আলাদা কেউ হতো তাহলে কিন্তু এই দায়িত্ব পড়তো গিয়ে শিবের উপর; কারণ আমাদের স্থূল বিশ্বাস মতে ধ্বংসের মন্ত্রণালয়ের মালিক হচ্ছে মহাদেব শিব। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব আসলে আলাদা আলাদা কেউ নন, একই শক্তির আলাদা আলাদা নাম মাত্র, আর এই শক্তির উৎস হলো পরমব্রহ্ম, যিনি হলেন প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা।

কংসের হাতে দেবকীর সন্তানকে হত্যা এবং অষ্টমগর্ভে কৃষ্ণরূপে তার নিজের জন্ম, সব কিছুই ছিলো বিষ্ণুর সেই প্ল্যানেরই অংশ। তাছাড়া কী দরকার ছিলো কংসকে ঐ দৈববানী শোনানোর যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে কংসের মৃত্যু হবে ? এই দৈববাণীর শোনানোর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো অত্যাচারিত মথুরাবাসীকে এই বার্তা দেওয়া যে তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে একজন আসছে। কিন্তু কেনো দেবকীর অষ্টম সন্তানের হাতে কংসের মৃত্যু হবে, কেনো প্রথম সন্তানের হাতে নয় ? 

অষ্টম সন্তানের কথা বলে কংসকে তার অত্যাচারী রূপ আরো বেশি করে মানুষের সামনে তুলে ধরার সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো। কেননা, কংসের নিয়তি নির্ধারণ করেই বিষ্ণু তাকে দৈববানী শুনিয়ে দিয়েছিলো এবং বিষ্ণু জানতো যে এই দৈববাণী শুনে কংস তো শুধরাবেই না, উল্টো তার অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে এবং পৃথিবীতে তার নিজের আগমনের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেটা প্রতিটি মহামানবের আবির্ভাবের  ক্ষেত্রে হয়েছে।

কংসের কারাগারে একে একে দেবকীর টি সন্তান নিহত হলে ৭ম সন্তান হিসেবে বিষ্ণুর আংশিক অবতার বলরাম আসেন এবং সেখানে তার জন্ম হলে তার কংসের হাতে তার মৃ্ত্যু হবে এজন্য গর্ভাবস্থাতেই বিষ্ণু তার নারী শক্তি যোগমায়ার বলে বসুদেবের আরেক স্ত্রী রোহিনীর গর্ভে সেই ৭ম সন্তানকে স্থানান্তরিত করে। ফলে সন্তানের জন্ম না হওয়ায় কংস মনে করে দেবকীর ৭ম গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে। বলরামকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখার কী প্রয়োজন ছিলো ? প্রয়োজন ছিলো গোকূলে কৃষ্ণের বাল্যকালে কৃষ্ণের মাথার উপর ছাতা হয়ে কাউকে থেকে তাকে সুরক্ষা দেওয়ার, যেহেতু গোকূলে কৃষ্ণের আপন রক্ত বলতে কেউ ছিলো না। খেয়াল করুন, গোকূলে কৃষ্ণ লালিত পালিত হয়েছে তার পালক পিতা মাতার কাছে, সেখানে বলরামই ছিলো তার একমাত্র রক্তের সম্পর্কের কেউ, যে ছিলো কৃষ্ণের বড় ভাই, যে বড় ভাইরা ছোটদেরকে শত বিপদের মাঝেও আগলে রাখে, বলরামের ভূমিকা ছিলো সেটাই এবং এই কারণেই বলরামের জন্ম নিয়ে এত নাটক করতে হয় বিষ্ণুকে। 

৭ম গর্ভে বলরামের জন্মের পর আসে অষ্টম গর্ভে পূর্ণ শক্তি নিয়ে বিষ্ণুর নিজের জন্ম নেওয়ার সময়। এই একই সময় বিষ্ণু জন্ম নেয় দেবকীর কোলে আর অন্য দিকে গোকূলে নন্দপত্নী যশোদার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় বিষ্ণুর নারী শক্তি যোগমায়া। তারপর বিষ্ণু পরিকল্পনা মতো ঝড়-বৃষ্টির দুর্যোগের রাত সৃষ্টি করে কংসসহ কারারক্ষী সবাইকে গভীর ঘুমে অচেতন করিয়ে কৃষ্ণ ও যোগমায়ার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করে। তারপরও কংস তাকে হত্যা করতে গেলে কংসের হাত থেকে ফসকে উপরে উঠে গিয়ে বলে, তোমাকে যে মারবে সে এখন গোকূলে বাড়ছে, বলেই  সে শুন্যে মিলিয়ে যায়। পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে সদ্যজাত একটি সাধারণ  শিশুর পক্ষে এভাবে    হাত  ফসকে উপরে উঠে যাওয়া এবং কথা বলা অসম্ভব। কিন্তু ঐ কন্যা কোনো সাধারণ শিশু ছিলো না, তাই  তার পক্ষে ঐসব ঘটনা ঘটানো  সম্ভব হয়েছে, যেমন সম্ভব হয়েছে শিশু কৃষ্ণের দ্বারা অসম্ভব রকমের সব কাণ্ড ঘটানো।

যা হোক, যোগমায়ার মাধ্যমে কংস যখন জেনেই যায় যে গোকূলে তার শত্রু বেড়ে উঠছে,  তারপরও কংস, গোকূলে কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য প্রকাশ্য কোনো পদক্ষেপ সম্ভবত এজন্য নিতে পারে নি যে, আগের অষ্টম সন্তানের হাতে মৃত্যুর দৈববানীটা ছিলো প্রকাশ্যে, সেটা কংস ছাড়াও দেবকী, বসুদেব সহ অনেকে শুনেছিলো, তাই তাদেরকে বন্দী করে তাদের সদ্যজাত সন্তানদেরকে হত্যা করাটাকে এক রাজার আত্মরক্ষা হিসেবে প্রজারা মেনে নিয়েছিলো, কিন্তু যোগমায়ার দৈববানী শুনেছিলো মাত্র তিন জন- কংস, দেবকী ও বসুদেব। যেহেতু যোগমায়ার দৈববানী কংস ছাড়া কারাগারের বাইরে আর কোনো প্রজা জানতো না, তাই ঐ দৈববানীর উপর ভিত্তি করে দেবকীর অষ্টম সন্তানকে খুঁজে বের করে হত্যা করার অভিযান গোকূলে পরিচালনা করলে সেটা রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে বলে কংস সম্ভবত প্রকাশ্য অভিযান পরিচালনা না করে গোপন অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করে এবং শেষ পর্যন্ত সবই ব্যর্থ হয়।

যা হোক, একদিন বয়সী যোগমায়ার গল্প কংসের কারাগারেই শেষ। কিন্তু বিষ্ণুর নারী শক্তি এই যোগমায়া, পরে, কারগার থেকে বসুদেব ও দেবকী মুক্ত হলে বসুদেবের ঔরসে বসুদেবের অপর স্ত্রী, যার গর্ভে বলরামের জন্ম হয়েছিলো, সেই রোহিনীর গর্ভে জন্ম নেয় এবং তার নাম হয় সুভদ্রা, যে সুভদ্রার সাথে অর্জুনের বিয়ে হয় এবং যার গর্ভে অভিমন্যুর জন্ম হয়।

 সুতরাং যেসব নারীবাদী এই বলে বিলাপ করছে যে, কৃষ্ণের জন্মের রাতে এক কন্যাকে বলি দিয়ে এক পুত্রকে বাঁচানো হয়েছে, তারা প্রকৃতপক্ষে জানেই না যে যোগমায়া আসলে কে ? তার জন্মের কী উদ্দেশ্যে ছিলো ? আ কে ই বা তাকে জন্ম দিয়েছিলো ? 

যোগমায়া এবং কৃষ্ণ আলাদা কেউ নয়, এঁরা অভিন্ন; বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হলেন শ্রীকৃষ্ণ, আর বিষ্ণুর নারী শক্তি হলেন যোগমায়া। তাই বিষ্ণু যখন মানবরূপে পৃথিবীতে আসেন, তখন তার লীলাতে ভূমিকা রাখতে যোগমায়াও আসেন পৃথিবীতে, যেমন কৃষ্ণের জন্মের রাতে এসে কংসকে ধোকা দিয়েছেন, তেমনি পরে আবার সুভদ্রা হিসেবে জন্ম নিয়ে অভিমন্যুর জন্ম দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ধর্ম প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন। একই সময়ে এই যোগমায়াই আবার ভীষ্মক রাজার কন্যা রুক্মিণী হয়ে জন্ম নিয়ে কৃষ্ণকে বিবাহ করে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন। সুতরাং যোগমায়াকে একজন সাধারণ নারী এবং শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ পুরুষ বিবেচনা করে, এক কন্যার বলিদানে এক পুত্রকে বাঁচানো হয়েছে বলে পুরুষতন্ত্রকে হয়তো বিদ্ধ করা যায়, কিন্তু তাতে বাস্তব জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে না।

শেষে আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি- এই যোগমায়াই আসলে দেবী দু্র্গা

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment