সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ গুন বলতে আসলে কী বোঝায় ?
এই তিনটি গুন সম্পর্কিত বহু লেখা নেট ফেসবুকে রয়েছে, কিন্তু কোনো লেখাই স্পষ্ট করে বলতে পারে না বা এ পর্যন্ত বলতে পারে নি যে এই তিনটি গুন আসলে কী ? তাই এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা এত দিন আমারও ছিলো না। আমার ধারণা, আমার মতো অবস্থা আরো অনেকের।
কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকায় এ বিষয়ে কোনো লেখা এতদিন পর্যন্ত আমি লিখি নি; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে আমার কিছু লিখার চেষ্টা করা উচিত, তারপর দেখা যাক ঈশ্বর আমাকে দিয়ে কী লিখায় ? এই ভাবনা এবং সেই প্রচেষ্টা থেকেই হলো এই পোস্টের জন্ম।
সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ- এই শব্দগুলোর সঠিক অর্থ আমরা অনেকেই এতদিন জানতাম না ব’লে, এই শব্দগুলো থেকে উৎপন্ন- সাত্ত্বিক, তামসিক ও রাজসিক শব্দের সঠিক ব্যাখ্যাও আমরা এতদিন বুঝতে পারি নি এবং প্রকৃত মূল না বুঝে প্রথমত যা বলা হয়- সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ হলো প্রকৃতির তিনটি গুন এবং তারপর অনেকে যা বলে বা বলার চেষ্টা করে, সেটা তো তার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়, তাহলে তা অন্যের কাছে ক্লিয়ার হবে কিভাবে ? তাই এ সম্পর্কিত যে লেখাগুলো এতদিন লেখা হয়েছে, তা শুধু শব্দের কচকচানি ছাড়া আর কিছুই নয়।
সত্ত্ব শব্দের অর্থ হলো ধর্মীয় জ্ঞানের প্রকাশ এবং সাত্ত্বিক শব্দের মানে হলো ধর্ম জ্ঞানী। সত্ত্ব শব্দটির রুট বা মূল হলো সৎ এবং সৎ শব্দের অর্থ হলো সাধু। অর্থাৎ সত্ত্ব বা সাত্ত্বিক বলতে সর্বদায় মহৎ বা উন্নত জ্ঞানসম্পন্ন উপকারী ভালো কিছুকে বোঝায়। যখন কোনো ব্যক্তি প্রতিটি পরস্থিতিতে ধর্ম, সত্য ও ন্যায়ের বিচার করে আচরণ ক’রে থাকে, তখন তাকে সাত্ত্বিক এবং তার জীবনাচরণকে সাত্ত্বিক জীবন বলা হয়।
তমঃ শব্দের অর্থ হলো অন্ধকার এবং তমঃ থেকেই তামসিক শব্দের উৎপত্তি। ভালো মন্দের বিচার ব্যতীত জীবন নির্বাহ করা অথবা কারো সকল আদেশকে বিনা দ্বিধায় পালন করাকে তামসিক আচরণ বলা হয়। অন্যভাবে, কেবল শারীরিক চাহিদা অর্থাৎ ক্ষুধা ও যৌনতার চাহিদাকে পূর্ণ করার জন্য যখন কেউ জীবন কাটায়, তখন তা তামসিক আচরণ, ইতর প্রাণীরা সাধারণত স্বভাববশতই এই ধরণের জীবন কাটায় বা কাটাতে বাধ্য হয়।
রজঃ শব্দ থেকে উৎপত্তি ‘রাজসিক’ শব্দটির। সত্ত্বঃ মানে এক কথায় ভালো এবং তমঃ মানে এক কথায় খারাপ, এই দুটো বিষয় আমরা অনেকেই অল্প পরিসরে সহজে বুঝলেও, রজঃ শব্দের সঠিক মানে কী, তা অনেকেই জানি না এবং এজন্যই বুঝতে পারি না যে রজঃ থেকে উৎপন্ন ‘রাজসিক’ শব্দটির মধ্যে আসলে খারাপ কী আছে বা ‘রাজসিক’ শব্দ দ্বারা যদি রাজকীয় কিছুও বোঝায়, তাহলেই বা এর মধ্যে খারাপ কী ? আর রাজসিক শব্দের মধ্যে যদি খারাপ কিছু না থাকে, তাহলে একে সত্ত্বঃ গুনের পরেই বা স্থান দেওয়া হলো কেনো ? পুরোটাই একটা গোলক ধাঁধাঁ, শুধু মাত্র রজঃ শব্দের সঠিক অর্থ না জানার জন্য।
রজঃ শব্দের অর্থ হলো অহঙ্কার বা গর্ব। রজোগুনী ব্যক্তির মধ্যে ধর্ম বা সত্যের জ্ঞান থাকে, কিন্তু শরীর ও মন বাসনার দ্বারা আবদ্ধ থাকে এবং অহঙ্কার পূর্ণ মন নিয়ে বেঁচে থাকে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে- সত্ত্ব মানে ধর্ম জ্ঞান, রজঃ মানে অহঙ্কার এবং তমঃ মানে অন্ধকার। এখন এই তিনটি শব্দ নিয়ে এক সাথে ভাবুন, সমস্ত বিষয়টা আপনার সামনে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
গীতায় বলা হয়েছে, এই তিনটি গুনের সমন্বয়ে সমস্ত মানুষের সৃষ্টি। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষ এই তিনটি গুনের এক বা একাধিক নিয়ে সৃষ্টি। মহাভারতের কয়েকটি চরিত্র বিশ্লেষণ করে এই বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি।
মহাভারতের দুর্যোধন- ধর্ম কী, তা জানে, কিন্তু পালন করে না; অর্থাৎ তার সত্ত্ব গুন আছে, কিন্তু তার কোনো প্রভাব তার মধ্যে নেই; দু্র্যোধন কারো আদেশ পালন করে না অর্থাৎ তমঃগুনের একটি বিষয় তার মধ্যে নেই, কিন্তু সে ভয়াবহ রকম অহঙ্কারী; তাই তার মধ্যে রজোগুন অধিক এবং রজোগুন তার মধ্যে তমোগুনের অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোকে জাগ্রত করেছে। সংক্ষেপে বললে, দুর্যোধনের মধ্যে সত্ত্বগুন নেই বললেই চলে, তার মধ্যে রজোগুন অর্থাৎ অহঙ্কার অধিক মাত্রায় এবং অহঙ্কার তাকে তমোগুনের কাছে নিয়ে গেছে এবং যখন কেউ তমমোগুন দ্বারা আবিষ্ট থাকে, তখন সে অপরের প্রতি কঠোর, নির্দয় ও স্বার্থপর হয়ে থাকে; নিজের সুখের জন্য অপরকে দুঃখ দেয়, যা দুর্যোধন প্রতি পদে পদে পাণ্ডবদের সাথে করেছে; এই ভাবে রজঃগুনের আধিক্যের সাথে সত্ত্বগুনের অনুপস্থিতি, দুর্যোধনের মধ্যে তমোগুনের প্রভাবকে বাড়িয়ে দিয়ে তাকে এক খল চরিত্রে পরিণত করেছে।
দুঃশাসন কোনো বাছ-বিচার না করে কেবল দুর্যোধনের আদেশ পালন করেছে, তাই তার মধ্যে সত্ত্ব বা রজঃ কোনো গুনই নেই, সে শুধু তমোগুনের অধিকারী এবং এর প্রভাবে সে যাবতীয় খারাপ কাজ করেছে।
ভীষ্মের মধ্যে কোনো অহঙ্কার নেই, তাই তার মধ্যে কোনো রজোগুন নেই; তার ধর্ম জ্ঞান রয়েছে তাই সে সত্ত্বগুনী; কিন্তু, সে সব সময় রাজমাতা সত্যবতী বা ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ পালন করে চলেছে, তাই সে সত্ত্ব ও তমোগুণের মিশ্রণে তৈরি এবং এই তমোগুন ভীষ্মকে দিয়ে তার অজান্তেই কিছু অধর্ম করিয়েছে, যার কারণে সংঘটিত হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং সারাজীবন ব্যক্তিগত প্রতিজ্ঞা পালন করেও সে ভোগ করেছে যথেষ্ট দুঃখ।
গুরুদ্রোণের মধ্যে ধর্ম জ্ঞান ছিলো, সেই সাথে ছিলো তার জ্ঞানের অহঙ্কার; কিন্তু সে কারো আদেশ মেনে চলে নি, তাই তার মধ্যে কোনো তমোগুন নেই, আছে শুধু সত্ত্ব ও রজোগুন। কিন্তু যেহেতু ভূমিস্থ জল ও মাটির মতো রজঃ ও তমঃ গুনের অবস্থান পাশাপাশি, সেহেতু পুত্রকে নিয়ে গুরুদ্রোণের পার্থিব কামনা বাসনা ছিলো এবং একারণে সে ও জীবনে যথেষ্ট দুঃখ ভোগ করেছে।
সত্ত্ব, তমঃ, রজঃ- এগুলো হলো গুন বা বৈশিষ্ট্য, যা জীবের আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় এবং এই শব্দগুলো থেকে উদ্ভূত সাত্ত্বিক, তামসিক ও রাজসিক শব্দ দ্বারা কোনো ব্যক্তি বিশেষকে বোঝায় এবং একারণেই এগুলো কোনো বস্তু বা পদার্থের গুন নয়, তাই এই শব্দগুলো থেকে উদ্ভূত সাত্ত্বিক, তামসিক ও রাজসিক শব্দ দ্বারা কোনো বস্তু বা খাদ্যকে বোঝায় না।
এই বিষয়টি আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবো যদি গীতার কয়েকটি শ্লোকের অর্থ ভালোভাবে বুঝতে পারি।
গীতার ১৭/৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,
“যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্ যক্ষরক্ষাংসি রাজসাঃ।
প্রেতান্ ভূতগণাংশ্চান্যে যজন্তে তামসা জনাঃ।।” -১৭/৪
এর অর্থ : সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা দেবতাদের পূজা করে, রাজসিক ব্যক্তিরা যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা করে এবং তামসিক ব্যক্তিরা ভূত ও প্রেতাত্মাদের পূজা করে।
এখানে- সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক শব্দ দ্বারা সবক্ষেত্রেই ব্যক্তি বিশেষকে বোঝানো হয়েছে, কোনো খাদ্য বা বস্তুকে বোঝানো হয় নি।
উপরের এই শ্লোকের অর্থে দেবতা বলতে কী বোঝানো হয়েছে, সেটা সম্ভবত আমরা সকলেই জানি, কিন্তু যক্ষ, রাক্ষস ও ভূত-প্রেত নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করা দরকার।
যক্ষ শব্দের অর্থ হলো অতিকৃপণ ব্যক্তি। এ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে যক্ষের ধন বাগধারার, যার অর্থ কৃপণের ধন। রাক্ষস বলতে বোঝায় অসংস্কৃত বা আনকালচারড মানুষদের, যারা বেশি মাত্রায় খেয়ে থাকে এবং শক্তি যাদের গর্ব বা অহঙ্কার। এই শ্লোকে বলা হয়েছে, রাজসিক ব্যক্তিরা যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা করে, কিন্তু কেনো ? কৃপন ব্যক্তিরা সাধারণত ধনী হয় এবং ধন নিয়ে তাদের অহঙ্কার থাকে এবং একই সাথে ধন হলো এক প্রকার শক্তি, এই জন্যই রাজসিক বা অহঙ্কারী ব্যক্তিরা ধন-শক্তির অহঙ্কারের প্রতীক হিসেবে যক্ষ ও রা্ক্ষসদের পূজা করে থাকে।
ভূত-প্রেত বলতে বোঝানো হয় অশরীরী আত্মাদের, যারা কোনো কারণে মারা গেছে, কিন্তু অতৃপ্ততার কারণে যাদের আত্মা পৃথিবী থেকে মুক্তি পায় নি। উপরের শ্লোকে বলা হয়েছে, তামসিক ব্যক্তিরা ভূত-প্রেতদের পূজা করে, কিন্তু কেনো ?
অশরীরী কিছু দুষ্ট আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় এবং নানা জনের ক্ষতি করে, এটাকে বিশ্বাস করে তামসিক অর্থাৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত জ্ঞানহীন ব্যক্তিরা তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভূত-প্রেতদেরকে পূজা করে থাকে; এখানে সেই কথা ই বলা হয়েছে।
যদিও বর্তমানে ভূত-প্রেত এবং যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজার প্রচলন তেমন নেই বা একদমই নেই, তাই এটা বুঝতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু প্রাচীন সমাজে এসব প্রচলিত ছিলো বলে গীতায় তা উল্লেখ করা হয়েছে।
যা হোক, উপরের শ্লোক থেকে আমরা বুঝলাম যে- সাত্ত্বিক, তামসিক ও রাজসিক শব্দ দ্বারা ব্যক্তি বিশেষকে বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কিত আরো কয়েকটি শ্লোক গীতায় আছে, দেখা যাক সেখানে এই শব্দগুলো দ্বারা কী বোঝায় ?
গীতার ১৭/৮ শ্লোকে বলা হয়েছে,
“আয়ুঃসত্ত্ববলারোগ্যসুখপ্রীতিবিবর্ধনাঃ।
রস্যাঃ স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ।।”
এর অর্থ : যে সমস্ত আহার- আয়ু, সত্ত্ব, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বর্ধনকারী এবং রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, স্থায়ী ও মনোরম, সেগুলি সাত্ত্বিক লোকেদের প্রিয়।
মানে সাত্ত্বিক লোকেরা কোন ধরণের খাবার পছন্দ করে, এখানে সেই কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হিন্দু সমাজের কিছু কিছু দিব্যজ্ঞানী, এই শ্লোকের দ্বারা মনে করে যে, গীতায় সাত্ত্বিক আহারের কথা বলা হয়েছে এবং সাত্ত্বিক মানে নিরামিষ!
যারা সাত্ত্বিক মানে নিরামিষ বুঝে থাক, তাদেরকে বলছি-
তুই নিরামিষ খাবি খা, কেউ তো তোকে আমিষ খেতে বাধ্য করছে না। কিন্তু গীতায় সাত্ত্বিক শব্দ দ্বারা নিরামিষ আহারের কথা বুঝিয়েছে, এটা তোকে কোন বলদে বুঝিয়েছে, আর গীতার বাণীর এরকম অপব্যাখ্যা করতে তোকে কে করতে বলেছে ?
সাত্ত্বিক বলতে যে কোনো দ্রব্য বা বস্তুকে বোঝায় না এবং সাত্ত্বিক বলতে যে সত্ত্বগুন বা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কোন ব্যক্তিকে বোঝায়, সেটা তো উপরেই উল্লেখ করেছি।
একই কথা প্রযোজ্য গীতার ১৭/৯ শ্লোকের ক্ষেত্রে-
“কট্বম্ললবণাত্যুষ্ণতীক্ষ্ণরূক্ষবিদাহিনঃ।
আহারা রাজসসেষ্ট্যা দুঃখশোকাময়প্রদাঃ।।”
এর অর্থ : যে সমস্ত আহার অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবনাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ণ, অতি শুষ্ক, অতি প্রদাহকর এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদনকারী, সেগুলি রাজসিক ব্যক্তিদের প্রিয়।
আবার গীতার ১৭/১০ শ্লোকেও বলা হয়েছে,
“যাতযামং গতরসং পূতি পর্যুষিতং চ ষৎ।
উচ্ছিষ্টমপি চামেধ্যং ভোজনং তামসপ্রিয়ম্।।”
এর অর্থ : যে খাদ্য অনেক আগে রান্না করা হয়েছে, যার রস শুকিয়ে গেছে, যা দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী, উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র, তা তামসিক লোকদের প্রিয় ।
অর্থাৎ এই দুটো শ্লোকে বলা হয়েছে- রাজসিক এবং তামসিক ব্যক্তিরা কোন কোন ধরণের খাবার পছন্দ করে এবং বলা হয় নি যে কোন কোনো খাবার রাজসিক বা তামসিক ?
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বর্তমানের কোনো সুস্থ ব্যক্তি কি এই ধরণের খাবার খায় ? খায় না। তার মানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই এমন ধরণের খাবার খাই যেগুলো সাত্ত্বিক লোকেদের প্রিয়। এর মানে কি এই যে, আমরা সবাই সত্ত্বঃগুন সম্পন্ন মানুষ ? নিশ্চয় নয়। পৃথিবীর সব লোক যদি সত্ত্বগুন সম্পন্ন মানুষ হতো, তাহলে কি পৃথিবীতে এত অধর্ম থাকতো না হতো ? থাকতোও না আর হতোও না।
পৃথিবীর যেখানেই মুসলমান, সেখানেই অধর্ম অর্থাৎ- মিথ্যাচার, দুর্নীতি, ছলনা, কপটতা এবং হানাহানিতে পূর্ণ; এসব তামসিক লোকেদের কাজ, তার মানে মুসলমানরা সব সময়, তামসিক লোকেদের প্রিয় খাদ্য বলে গীতায় যা বলা হয়েছে,
“যে খাদ্য অনেক আগে রান্না করা হয়েছে, যার রস শুকিয়ে গেছে, যা দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী, উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র”
সেসব খাবার খায় ? খায় না। এ থেকেও এটা স্পষ্ট যে, তামসিক শব্দ দ্বারা কোনো খাদ্য বা বস্তুকে নির্দেশ করা হয় নি, এই একই কথা প্রযোজ্য রাজসিক শব্দের ক্ষেত্রেও।
এই অংশের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, গীতায় খাবার দাবার সম্পর্কে বলা হয়েছে- সাত্ত্বিক, রাজসিক বা তামসিক ব্যাক্তিরা কোন ধরণের খাবার খায়; বলা হয় নি যে কোন খাবার সাত্ত্বিক, রাজসিক বা তামসিক? আর এসব বলা হবেই বা কেনো, আগেই তো বলেছি, এই তিনটি শব্দ দ্বারা কিছু গুন বা বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়, যেগুলো মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কোনো বস্তু বা দ্রব্যের বেলায় নয়।
তারপরও কিছু কিছু দিব্যজ্ঞানী গীতার এই শ্লোক-
“পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রযতাত্মনঃ।।”- ৯/২৬
অর্থ: যে বিশুদ্ধচিত্ত নিষ্কামভক্ত ভক্তি সহকারে আমাকে পত্র পুষ্প ফল ও জল অর্পন করে, আমি তার সেই ভক্তিপ্লুত উপহার প্রীতি সহকারে গ্রহণ করি।
উল্লেখ করে বলবে যে, গীতায় শ্রীকৃষ্ণকে- পত্র, পুষ্প, ফল নিবেদন করতে বলা হয়েছে, এর মানে তাকে নিরামিষ খাবার নিবেদন করতে হবে।
এইসব দিব্যজ্ঞানীর জন্য নিচের এই আলোচনা:
এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পত্র পুষ্প ফল ও জল তাকে অর্পন করতে, কিন্তু তিনি কি তার ভক্তদেরকে এগুলোই বা শুধু এগুলোই খেতে বলেছেন ? যদি শ্রীকৃষ্ণ তার ভক্তদেরকে এগুলোই খেতে বলে থাকেন, তাহলে তো আমাদেরকে শুধু পত্র পুষ্প ফল ও জল খেয়েই বেঁচে থাকতে হবে। ফল ও জল না হয় খাওয়া যায় বা যাবে, কিন্তু পত্র ও পুষ্প অর্থাৎ পাতা ও ফুল কিভাবে খাওয়া যাবে ? কিছু কিছু সবজিজাত পাতা ও ফুল অবশ্য মানুষ খায়, কিন্তু সেগুলো কি মানুষ কোনো দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে ? করে না। তার মানে, যে পাতা ও ফুলের কথা গীতায় বলা হয়েছে সেগুলো মানুষের খাদ্য নয়। এখন নিরামিষভোজীদের জন্য বাকি থাকলো ফল ও জল; এখন আপনারাই বলেন, আপনারা কি শুধু ফল ও জল খেয়ে থাকেন, অন্য কিছুও খান ?
গীতা শুধু পড়লেই হয় না, গীতার বাণীর মর্মকে উপলব্ধি করতে হয়। যেমন- এক জায়গায় বলা হয়েছে, কাম ক্রোধ নরকের দ্বার। তার মানে কি কাম ক্রোধকে ত্যাগ করতে বলা হয়েছে ? না, কাম ক্রোধকে কন্ট্রোল করতে বলা হয়েছে, যাতে তার দ্বারা কোনো অনর্থ না ঘটে। শ্রীকৃষ্ণ যদি কামকে ত্যাগ করতেন তাহলে কি তিনি বিয়ে করতেন ? ক্রোধকে ত্যাগ করলে কি তিনি শিশুপালকে হত্যা করতেন ? এভাবেই পত্র পুষ্প ফুল ও জল শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করার বিষয়টি হলো প্রতীকী, এর মাধ্যমে শুধুমাত্র সেগুলোই আমাদেরকে খেতে বলা হয় নি, বলা হয়েছে, দিনে অন্তত একবার হলেও তার উদ্দেশ্যে সেগুলো নিবেদন করে যেন তাকে স্মরণ করি; পত্র পুষ্প ফুল ও জল হলো শ্রদ্ধা প্রর্দশনের একটি মাধ্যম মাত্র, যেমন- শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধে বা মৃত কোনো বিখ্যাত মানুষের মূর্তির বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়।
আপনারা অনেকেই হয়তো করে থাকেন বা কাউকে করতে দেখেছেন যে, ভাত খাওয়ার পূর্বে কেউ কেউ গ্লাস থেকে হাতে জল নিয়ে থালার চারপাশে বৃত্তের মতো জল দিয়ে ভাতকে প্রণাম করে খাওয়া শুরু করে, এটাও এক প্রকারের নিবেদন এবং উপরের শ্লোকে জল নিবেদনের যে কথা বলা হয়েছে, এটাও তার এক প্রকারের রূপ।
আশা করছি- সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ গুনের ব্যাপারটা সবার কাছে ঈশ্বরের কৃপায় ক্লিয়ার করতে পেরেছি।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রী কৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment