Thursday, 13 August 2020

"সর্বধর্মান পপরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ" বলতে, গীতায়- শ্রীকৃষ্ণ কী বুঝিয়েছে ?


শ্রীকৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে বলেছেন, 

"সর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে আমার শরণাগত হও (১৮/৬৬) "। মহাভারত ৫ হাজার বছর আগে হয়ে থাকলে তখন তো আর ইসলাম, বৌদ্ধ, খিষ্টান এসব ধর্ম ছিলনা। এখানে শ্রীকৃষ্ণ কোন ধর্ম ত্যগ করার কথা বলছেন ?

উপরের এই প্রশ্নটি করেছে ‘মাধোবের মোহন বাঁশি’ নামে আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড। শুধু তারই নয়, এই ধরণের প্রশ্ন উঠে বা উঠতে পারে অনেকের মনেই, তাদের সবার জন্য এই পোস্টে দিলাম এই প্রশ্নের উত্তর:

ধর্ম বলতে এখানে ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এসব ধর্মকে বোঝানো হয় নি, আর এগুলো তো কোনো ধর্মই নয়, এগুলো একেকটি ব্যক্তিগত মতবাদ। কারণ, ধর্ম কোনো ব্যক্তি সৃষ্টি করতে পারে না, ধর্ম সৃষ্টি করতে পারে প্রকৃতি বা প্রকৃতি নামের ঈশ্বর। যেমন তিনি যখন পৃথিবীতে লোহা বা জলের সৃষ্টি করেছেন, তখনই সাথে সাথে লোহা বা জলের ধর্মও সৃষ্টি করে দিয়েছেন; এইভাবে জীব বা পদার্থ পদার্থ সৃষ্টির সাথে সাথে তাদের ধর্মও তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। 

ধর্ম হলো কোনো কিছুর গুন বা বৈশিষ্ট্য, যেমন- জলের ধর্ম হলো তারল্য এবং নিচের দিকে গমন করা এবং লোহার ধর্ম হলো কাঠিন্যতা। সেই রকম, বিবর্তনের ধারায় পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভবের হওয়ার পর এবং মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি পরিণত হওয়ার পর, মানুষের যে ধর্ম দাঁড়ায়, সেটা হলো পরের সম্পদ এবং পরের নারীর দিকে চোখ না দেওয়া, যে কথা বলা আছে হিন্দু শাস্ত্রে, এই ভাবে-

“পরদ্রবেষ্যু লোষ্ট্রবৎ”

অর্থাৎ, পরের দ্রব্যকে মাটির ঢেলা বিবেচনা করবে। 

এবং

“মাতৃবৎ পরদারেষু, কন্যাবৎ পরকন্যাষু”

অর্থাৎ, পরের স্ত্রী কন্যাদের মায়ের মতো দেখবে।

পৃথিবীতে সকল প্রকার অপরাধের মূলে হলো এই দুই জিনিস- পরের সম্পদনারী। হিন্দু শাস্ত্রে এই দুটির দিকেই তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে, তার মানে এটা মেনে চললেই কোনো ব্যক্তিকে আর কোনো ধরণের অপরাধ করতে হবে না এবং যারা প্রকৃতপক্ষে মানুষ, তারা সব সময় এই নীতিটি মেনে চলে, তার মানে সে সনাতনী কালচার পালন করে।

এছাড়াও বেদব্যাসের মতে মানুষের ধর্ম হলো-

“পরোপকারঃ পুন্যায়, পাপায় পরপীড়নম্।”

অর্থাৎ, অন্যের উপকার করা ধর্ম, অন্যের উপকার করা অধর্ম।

এগুলোই হলো মানুষের ধর্ম। প্রতটি মানুষ সাধারণভাবে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের এই রীতিগুলো মেনে চলে বলেই সনাতন ধর্মকে বলা হয় সনাতন মানব ধর্ম। তাই সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, 

“সনাতন মানবধর্মমূলং হি প্রকৃতি”

অর্থাৎ, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সনাতন ধর্ম নিয়েই জন্মগ্রহণ করে বা মানুষের ধর্ম হোক সনাতন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় যখন গীতার বাণী আসে, তখন পৃথিবীতে মানুষের ধর্ম ছিলো একটি ই, তা সনাতন এবং এখনও আছে একটি ই, তা সনাতন। ইসলাম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ বা আরও নানা জনের নামে যা চলছে, তা কোনো ধর্ম নয়, সেগুলো ব্যক্তিগত মতবাদ যা উপরে বলেছি। মানুষের ধর্ম একটি ই তা হলো মানব ধর্ম বা সনাতন মানব ধর্ম। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে গীতার মধ্যে,

“সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ” দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ কী বললেন ?

এই বিষয়টি বুঝতে হলে, তার আগে বুঝতে হবে গীতার ১৮ অধ্যায়েরই আরও দুইটি শ্লোকের অর্থ।

গীতার ১৮/৭ এর প্রথম শ্লোকে বলা আছে, 

‘নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণো নোপপদ্যতে’

অর্থাৎ, নিত্যকর্ম বা স্বধর্ম বলে যার যে কর্ম নির্দিষ্ট আছে, তার সেই কর্ম ত্যাগ করা অনুচিৎ।

আবার, ১৮/৪৭ এর প্রথম শ্লোকে বলা আছে,

“শ্রেয়ান্ স্বধর্ম বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ”

অর্থাৎ, স্বধর্ম বা নিজের কাজ দোষ বিশিষ্ট হলেও তা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম বা অন্য জাতির কাজ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। 

এই দুই শ্লোকে নিত্যকর্ম বলতে বোঝানো হয়েছে স্বধর্মকে এবং স্বধর্ম বলতে বোঝানো হয়েছে নিজের কাজকে।

পৃথিবীতে সভ্যতার সূচনা লগ্ন হতেই চার শ্রেণির মানুষ রয়েছে, গীতার মাধ্যমে যাকে প্রকাশ করা হয়েছে- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যশুদ্র হিসেবে। মানুষের এই বর্ণ বিভাজন সমাজের জন্য বাস্তব; কারণ, তা না হলে সমাজ চলবে না। এই সমাজে যেমন শিক্ষকরূপী ব্রাহ্মণের দরকার, তেমনি রাজনৈতিক নেতা ও তাদের অনুগত বাহিনী রূপ ক্ষত্রিয়ও দরকার, এরপর সকলের জন্য খাদ্য ও অর্থ সরবরাহের জন্য দরকার স্বাধীন পেশায় নিযুক্ত কৃষক এবং ব্যবসায়ী, যাদের বলা হয় বৈশ্য এবং উপরের তিন শ্রেণিকে সেবা প্রদানের জন্য দরকার চাকর রূপ শুদ্র।

সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে এভাবেই সমাজ চলছে এবং শেষ পর্যন্ত এভাবেই চলবে। গীতায় জাতি বিভাজন বলতে এই চার শ্রেণিকেই বোঝানো হয়েছে এবং নিত্যকর্ম বা স্বধর্ম বলতে এদের নিজস্ব কাজকেই বোঝানো হয়েছে।

তাই গীতার ১৮/৭, এ

‘নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণো নোপপদ্যতে’ 

বলতে বোঝানো হয়েছে- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র, যার জন্য যে কাজ নির্দিষ্ট আছে তার সেই কাজ ত্যাগ করা চলবে না, অর্থাৎ তাকে তার কাজটাই ঠিকভাবে করে যেতে হবে।

আবার ১৮/৪৭ এ,

“শ্রেয়ান্ স্বধর্ম বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ” 

বলতে বোঝানো হয়েছে, নিজের সেই কাজ দোষ বিশিষ্ট হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম বা অন্য জাতির কাজ অপেক্ষা তা শ্রেষ্ঠ, সুতরাং সেই কাজ তাকে করে যেতেই হবে।

এভাবে সবসময়, যার যে কাজ, তাকে সেই কাজ করতেই গীতাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বা উৎসাহিত করা হয়েছে।

গীতার সূত্রানুযায়ী, অর্জুনের জন্ম ক্ষত্রিয় হিসেবে, তাই শ্রীকৃষ্ণ তাকে বার বার তার ক্ষত্রিয়ের ধর্মকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে নির্দেশ দিয়েছে যুদ্ধ করতে; কারণ, তার যুদ্ধ করার উপরই নির্ভর করছিলো অধর্মকে বিনাশ করে ধর্ম প্রতিষ্ঠার বিষয়।

এছাড়াও ধর্ম মানে হলো মত বা পথ। এজন্যই রামকৃষ্ণ দেব বলেছেন, ‘যত মত তত পথ’। তার এই বাণী অন্য কোনো ধর্ম সম্পর্কে ছিলো না, ছিলো সনাতন ধর্মেরই নানা মত পথের ব্যাপারে।

কিন্তু আমাদের সেকুলাররা তার এই বাণীর ভুল ব্যাখ্যা করে ‘যত মত তত পথ’ বলতে সনাতন ধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যক্তিমতগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে বা করে এবং এসব ব’লে, সনাতন ধর্মের মতো সকল ধর্মই সমান ব’লে প্রচার করে হিন্দু ছেলে মেয়েদেরকে বিভ্রান্ত ক’রে অন্যান্য ধর্মের দিকে ঠেলে দিয়ে হিন্দু সমাজের সর্বনাশ করেছে বা করছে। কারণ, যখন আপনার ছেলে মেয়েক রামকৃষ্ণ মিশনে নিয়ে গিয়ে এটা শেখাবেন যে, সকল ধর্মই সত্য, আর এটা শিখে যখন আপনার ছেলে মেয়ে কোনো মুসলমান বা খ্রিষ্টানকে বিয়ে করে মুসলমান বা খ্রিষ্টান হয়ে যাবে, তখন তাকে কি আপনি তাকে দোষ দিতে পারবেন ? পারবেন না। সুতরাং যারা সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে, রামকৃষ্ণ মিশনের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে থেকে শুধু সাবধান নয়, ১০০ গজ দূরে থাকুন। কারণ, এরা আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। 

যা হোক, এই ‘যত মত তত পথ’ এর উৎপত্তি, হিন্দু সমাজের বহু দেব-দেবীর কারণে। এই কারণে কেউ কালীর ভক্ত, কেউ শিবের ভক্ত, কেউ দুর্গার ভক্ত, কেউ বিষ্ণুর ভক্ত, এভাবে সবাই কোনো না কোনো কিছুর ভক্ত। কেউ আবার কালীর ভক্তের ভক্ত অর্থাৎ রামকৃষ্ণদেবের ভক্ত, আবার কেউ কৃষ্ণের ভক্তের ভক্ত অর্থাৎ চৈতন্যদেবের ভক্ত। এই সব নানা মত পথ বা নানা ধর্মকে ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে বলেছেন, তুমি শুধু আমারই আশ্রয় নাও, অন্য আর কিছুরই আর প্রয়োজন নেই। এজন্য শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে তার বিশ্বরূপ প্রদর্শন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, সকল দেব-দেবীর আশ্রয় তার মধ্যেই এবং গীতাতেও বলেছেন, কোনো দেব-দেবী, তার ইচ্ছা ছাড়া তার ভক্তদের জন্য কিছুই করতে পারে না (৭/২১,২২)। মূলত “সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ” বলতে শ্রীকৃষ্ণ, সকল দেব-দেবীকে ছেড়ে তারই শরণ নেওয়ার কথা বলেছেন এবং স্বধর্ম বলতে চার শ্রেণির মানুষের যেই কাজ, সেই কাজকে বুঝিয়েছেন।

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ

--------------------------------------

পরিশিষ্ট : 

এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা পরিষ্কারভাবে মনে রাখা দরকার যে, জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র নয়; জন্ম সূত্রে সবাই সনাতনী। জন্মের পর গুরুগৃহে বা আজকের স্কুল কলেজে শিক্ষালাভের পর তা্র নিজ যোগ্যতা অনুসারে, সে লাভ করে তার স্ট্যাটাস অর্থাৎ সে হয়ে উঠে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শুদ্র এবং এই স্ট্যাটাস লাভের পর নির্ণীত হয় তার কর্ম এবং সেই কর্মই তার জন্য নিত্যকর্ম বা স্বধর্ম। সকল পরিস্থিতিতেই প্রত্যেক্যের স্বধর্ম ঠিকঠাকভাবে পালনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে খুব জোরালোভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

সেই সাথে এটাও আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, পৃথিবীতে ধর্ম একটাই, আর সেটা হলো সনাতন ধর্ম বা সনাতন মানব ধর্ম, যার বর্তমান নাম হিন্দু ধর্ম। পৃথিবীতে কোনো কালে আর কোনো ধর্ম ছিলো না বা ভবিষ্যতে থাকবেও না; আছে বা থাকবে হয়তো কিছু ব্যক্তিগত মতবাদ, যাকে ধর্ম বলে কিছু লোক চালাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো চালাবে; এই ব্যক্তিমতগুলো কখনোই ধর্ম নয়, তাই গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যে বলেছেন, “সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ” এখানে ইসলাম, খ্রিষ্টান বৌদ্ধধর্মের মতো ব্যক্তিমতের ধর্মের কথা যে বলা হয় নি, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ মনে রাখার দরকার নাই।

আবারও

জয় হিন্দ।

No comments:

Post a Comment