Tuesday 18 August 2020

পশুবলি শাস্ত্রসম্মত, কিন্তু মনসা পূজায় নয় :


পশুবলি শাস্ত্রসম্মত, কিন্তু মনসা পূজায় নয় :

পশুবলির কথা উঠলেই কিছু কিছু সস্তা মানবতাবাদী এবং কপট পশুপ্রেমী মুরগীর মতো ক্যাঁ ক্যাঁ করে উঠে, এদের চোখে দুচারটা বলি চোখে পড়ে, কিন্তু লাখ লাখ কুরবানী চোখে পড়ে না।

যা হোক, এর আগের একটি পোস্টে আমি পশুবলির সামাজিক কারণ এবং উপযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছি, এই পোস্টে আলোচনা করছি পশুবলির শাস্ত্রীয় রেফারেন্স নিয়ে-

প্রথমেই রেফারেন্স দিচ্ছি ঋগ্বেদ থেকে, ঋগ্বেদের ১/১৬২/১১ নং ঋকে বলা আছে,

"যত্তে গাত্রাদগ্নিনা পচ্যমানাদিভি শূলং নিহতস্যাবধাবতি। 

মা তদ্ভুম্যামা শ্রিষন্মা তৃণেষু দেবভ্যস্তদুশদ্ভ্যো রাতমস্তু।।"

এর অর্থ- হে অশ্ব। রন্ধনকালে তোমার মাংস হইতে যে রস (ঝোল)নির্গত হয় এবং তোমার যে অংশ শূলে বিদ্ধ থাকে,তাহা যেন মৃত্তিকাতে পতিত বা তৃণাদির সহিত একত্রিত না হয়। দেবগণ মাংস লোলুপ হইয়াছেন,অতএব সমস্ত মাংসই তাহাদিগের তৃপ্তার্থে প্রদত্ত হউক।

এরপর ১/১৬৩/১২ ঋকে বলা হয়েছে-

" উপ প্রাগাচ্ছসনং বাজ্যর্বা দেবদ্রীচা মনসাদীধ্যানঃ।

অজঃ পুরো নীয়তে নাভিরস্যানু পশ্চাৎকবয়ো যন্তি রেভাঃ।।" 

এর অর্থ - এই তুর্ণগামী অশ্ব একমনে দেবগণকে ধ্যান করতে করতে বধ্যস্থানে গমন করিতেছে। উহার বন্ধুতুল্য ছাগলকেও বলির জন্য অগ্রে লইয়া যাওয়া হইতেছে এবং স্তোত্রপাঠক কবিগণ উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছে।

এরপর ১/১৬২/২১ নং ঋকে বলা হয়েছে-

"ন বা উ এতন্রিয়সে ন রিষ্যসি দেঁবা ইদেষি পথিভিঃ সুগেভিঃ।"

এখানে বলিপ্রদত্ত পশুর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে-

"তুমি মরিতেছো না এবং আমরাও তোমার অনিষ্ট করিতেছি না, বরঞ্চ তুমি এই কার্য্য দ্বারা সৎপথে গমন করিতেছো।"

পশুবলি সম্পর্কিত এরকম আরো কয়েকটি ঋক হলো- ১/১৬২/৩,৯,১০

অনেকে ভাবতে পারেন, হরফ প্রকাশনীর বেদ যেহেতু মুসলমান কর্তৃক প্রকাশিত, সেহেতু এটাতে কিছু সমস্যা থাকতে পারে, তাই এই রেফারেন্সের উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না, তাদের জন্য নিবেদন করছি ভাগবত থেকে কিছু রেফারেন্স, যেখানে বেদের সপক্ষেই পশুবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে-

"বেদে যে পশুবধ আছে, তা দেবতাদের উদ্দেশ্যে, তা আনম্ভন মাত্র, হিংসা নয়। ভক্ষণের উদ্দেশ্যে যে পশুহত্যা, তাই হিংসা।" (একাদশ স্কন্ধ, পঞ্চম অধ্যায়, তুলি-কলম প্রকাশিত, সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ অনুবাদিত)

অর্থাৎ, এখানে বলা হচ্ছে- দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত পশুর মাংস খাওয়া যাবে, দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন না করে খেলে তা পশুহত্যাজনিত পাপ হবে। এমন কথা তো গীতার ৯/২৭ নং শ্লোকেও বলা হয়েছে যে- তুমি যা কিছু আহার করো, তা আমায় নিবেদন করে করো। 

আবার ভাগবতের ১ম স্কন্ধের দ্বাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে-

"পশু মানুষের ভক্ষ্য, আবার পশুর ভক্ষ্য তৃণগুল্মাদি। এই রূপে সকল প্রাণীই ক্ষুদ্রতর জীবকে আপনা হতে ভক্ষণ ক'রে জীবনধারণ করে।"

অর্থাৎ বিজ্ঞানের যে খাদ্যশৃঙ্খল, তা ভাগবতে ৫ হাজার বছর আগেই বলে দেওয়া হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি পশুবলি হয় কালীপূজায়, আর কালীপূজা সম্পর্কিত শাস্ত্র হলো "শ্রীশ্রীচণ্ডী", এবার দেখা যাক শ্রীশ্রীচণ্ডীতে পশুবলি সম্পর্কে কী বলা হয়েছে-

শ্রীশ্রীচণ্ডীর দ্বাদশ অধ্যায়, যার নাম দেবীস্তব মাহাত্ম্য, তার ১০, ১১ এবং ২১, ২২ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে-

"বলিদান, পূজা, যজ্ঞ, ইত্যাদি ও বিবাহ মহোৎসবে আমার এই সমগ্র চরিত্র পাঠ করিবে এবং শুনিবে। কেহ জ্ঞানে বা অজ্ঞানে আমার উদ্দেশ্যে বলিদান, পূজা এবং বহ্নিহোম করিলে তাহা আমি প্রীতির সহিত গ্রহন করিয়া থাকি। সারা বছর দিন রাত পশুবলি, পুষ্প, অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, ব্রাহ্মণভোজন, যজ্ঞ, নানাপ্রকার ভোগ ও সোনা রূপা উৎসর্গে আমার যে প্রীতি লাভ হয়, এই মাহাত্ম্য একবার শুনিলে আমি সেই প্রীতি লাভ করি।"

অর্থাৎ কালী পূজায় বলিপ্রদান করলে মা কালী খুশি হোন এবং তার কাছে বলি একটি সাধারণ বিষয়। আর বেদ ভাগবতের রেফারেন্স দিয়ে আগেই তো বলেছি যে, দেবতার উদ্দেশ্যে বলিপ্রদান করলে কোনো পশুর হত্যা হয় না, বরং সেই পশুর মঙ্গল করা হয়। জীবন হলো আত্মার ভ্রমণ, এই ভ্রমণে আত্মা এক দেহ ছেড়ে অন্য দেহ ধারণ করে। কোনো পশুরদেহ যখন কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়, তখন সেই পশুর আত্মার সদগতি হয় এবং পরের জন্মে সে আরো উন্নততর জন্মলাভ করে। এজন্যই বেদ ভাগবতে বলা হয়েছে- দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা বলি, পশুহত্যা নয়।

আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, কোনো দেব-দেবীর মূর্তির মধ্যে কোনো শক্তি নেই, শক্তি আছে সেই দেব-দেবীর আদর্শের মধ্যে। কালী পূজা করে কেউ যদি তার নিজের মধ্যে কালীর হিংস্রতাকে ধারণ করতে পারে, তাহলেই কালী কেবল তাকে রক্ষা করতে পারে। 

সরাসরি কালী নয়, কালীর হাতের অস্ত্রই যে আমাদেরকে রক্ষা করবে, সে কথা বলা আছে শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের ২৬ ও ২৮ নং মন্ত্রে, এখানে বলা হয়েছে-

"সমস্ত অসুর বিনাশকারী, অতি উগ্র, ভীষণ শিখাযুক্ত তোমার এই ত্রিশুল আমাদেরকে ভয় হতে রক্ষা করুক। হে দেবী চণ্ডীকে, অসুরগণের রক্ত ও মেদরূপ কর্দম মাখা তোমার উজ্জ্বল ঝকঝকে খড়গটি আমাদের মঙ্গল করুক।"

-তো দেবী কালীর এই ত্রিশুল এবং খড়গটি কিভাবে তার ভক্তদেরকে রক্ষা করবে ? বিপদে পড়ে দেবী কালীকে ডাকলে তিনি কি সশরীরে এসে তার ভক্তদেরকে রক্ষা করবে ? কখনোই নয়। এজন্যই আমি বলি দেব-দেবীর মূর্তির মধ্যে কোনো শক্তি নেই, শক্তি আছে সেই দেব-দেবীর আদর্শের মধ্যে। কেউ যদি চায় কালীর ত্রিশুল এবং খড়গ তার মঙ্গল করুক, তাহলে তাকে নিজেকেই সেই ত্রিশুল এবং খড়গ চালাতে শিখতে হবে, এগুলোর ব্যবহার শিখতে হবে এবং এই ব্যবহার শেখার জন্য মাঝে মাঝে এগুলো নিয়ে চর্চা করতে হবে। এজন্যই চালু বলির সিস্টেম, এক কোপে পশুর গলা কাটতে কাটতে অভ্যাসে পরিণত হয়ে অসুররূপী সন্ত্রাসীদের গলা কাটতে যেন হাত, পা এবং বুক না কাঁপে; তাহলেই আপনি রক্ষা পাবেন মা কালীর আশীর্বাদে।

সনাতন ধর্ম মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং এতে মানুষের আত্মরক্ষার ব্যাপারটি নিয়েও ভাবা হয়েছে। কিন্তু সনাতন ধর্মের মধ্যে চৈতন্যদেবের হিজড়া নীতি বৈষ্ণব মতবাদ অনুপ্রবেশ করে হিন্দু সমাজকে নপুংসকে পরিণত করে ফেলেছে এবং ফেলছে। কারণ, বৈষ্ণব মতবাদ অনুযায়ী একজন মানুষ হবে দীন হীন, তার কোনো অহংকার, রাগ জেদ, বিদ্বেষ থাকবে না, কেউ তার গালে একটা চড় মারলে, সে পাল্টা আঘাত করার পরিবর্তে বলবে- তোমার হাতে লাগে নি তো, এর মানে হলো- মেরেছো কলসীর কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবো না ? কোনো বৈষ্ণব কোনোদিন কিছু সঞ্চয় করবে না, প্রতিদিন সে মাধুকরী করে অর্থাৎ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তার জীবিকা অর্জন করবে; এই হলো একজন বৈষ্ণবের চরিত্র, এর বাইরে বৈষ্ণব মতবাদের মূল থিয়োরি মোতাবেক বৈষ্ণবের কোনো বিয়ে শাদী ঘর সংসার ছেলে মেয়ে নেই, ফলে বৈষ্ণব সমাজ বলেও কিছু নেই। যার স্ত্রী নেই, তার যেমন স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ এবং রক্ষার কোনো ব্যাপার নেই, বৈষ্ণব মতবাদেও তেমনি বৈষ্ণব সমাজ বলেই কিছু নেই, ফলে সেই সমাজ রক্ষার তাগিদ তার মধ্যে থাকবে কেনো ? তাই বৈষ্ণব মতবাদে আত্মরক্ষার কোনো ব্যাপার নেই, ব্যাপার আছে শুধু মার খাওয়ার এবং কান্নাকাটি করার।

আজ যারা বলির বিরুদ্ধে কথা বলছে বা বলে, তারা হয় এই বৈষ্ণব, না হয় চৈতন্যের বৈষ্ণব মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত নপুংসক। বৈষ্ণব মতবাদে সাধারণভাবে মাছ মাংস খাওয়াই অন্যায়, সেখানে তারা পশুবলির বিরুদ্ধে কথা বলবে না কেনো ? বৈষ্ণব মতবাদ, বিয়ে-শাদির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে, পরিবার গঠনের বিরুদ্ধে কাজ করে একদিকে যেমন হিন্দু সমাজের জনসংখ্যা কমাচ্ছে, অন্যদিকে হিন্দু সমাজকে নিরামিষ খাইয়ে হিন্দুদের কাম ক্রোধ ও দৈহিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়ে হিন্দু সমাজকে তার বিরোধী মুসলিম শক্তির কাছে মার খাওয়াইয়ে হিন্দু সমাজকে বিলুপ্ত করার জন্য তারা তাদের অজ্ঞাতেই কাজ করে চলেছে।

হিন্দুত্রাতা লেখক ড. রাধেশ্যাম ব্রহ্মচারী, পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসনের ভয়াবহ কুফল উপলব্ধি করে তার সে সম্পর্কিত একটি বইয়ের নাম রেখেছেন, "বামপন্থা : বাংলার সর্বনাশ", একইভাবে আমি বলছি- বৈষ্ণব মতবাদ হলো সনাতন হিন্দুধর্মের সর্বনাশ। বামপন্থাকে ঝেড়ে ফেলেই যেমন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা একটু একটু করে উঠে  দাঁড়াচ্ছে, তেমনি বৈষ্ণব মতবাদকে মাথা থেকে সম্পূর্ণভাবে ঝেড়ে ফেললেই কেবল হিন্দুরা কোমড় সোজা করে উঠে দাঁড়াতে পারবে, তারপর কারো ক্ষমতা নেই হিন্দুদেরকে কোনোভাবে দাবিয়ে রাখে।

মোদী-অমিত শাহ বর্তমানে ভারত শাসন করছেন সনাতন ধর্মের ক্ষত্রিয় নীতিতে, এর ফলে পাকিস্তান তো কোন ছাড়, সারা বিশ্ব বর্তমানে ভারতকে কুর্নিশ করতে বাধ্য হচ্ছে, একইভাবে প্রতিটি হিন্দু যখন বৈষ্ণবীয় হিজড়া নীতিকে পরিত্যাগ করে সনাতনী নীতিতে চলবে, তখন পৃথিবীর সমগ্র জাতি হিন্দুদের কাছে মাথা নত করে চলতে বাধ্য হবে। আর সনাতন ধর্মেরই একটি বিধি বা নীতি হলো দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে পশুবলি, যা হিন্দুদেরকে দেয় মানসিক শক্তি এবং দৈহিক ক্ষমতা, যে মানসিক শক্তি এবং দৈহিক ক্ষমতার বলে পৃথিবীতে টিকে থাকে এবং রাজ করে কোনো জাতি।

আশা করছি- উপরের আলোচনা থেকে পশুবলির মূল কারণ এবং তার শাস্ত্রীয় রেফারেন্স সম্পর্কে, আমার বন্ধুদেরকে অবগত করাতে পেরেছি। 

এবার নিচের পোস্টে দেখে নিন, কেনো মনসা পূজার বলি শাস্ত্র সম্মত নয়।

মনসা পূজায় 'বলি'  প্রদান- অশাস্ত্রীয় এবং নিরর্থক :

No comments:

Post a Comment