Monday 17 August 2020

মনসা পূজায় 'বলি' প্রদান- অশাস্ত্রীয় এবং নিরর্থক :


মনসা পূজায় 'বলি' প্রদান- অশাস্ত্রীয় এবং নিরর্থক :

হিন্দু সমাজে তিন ধরণের দেব দেবী আছে- বৈদিক, পৌরাণিক এবং লৌকিক। যে দেব-দেবীর উল্লেখ বেদে আছে, তাঁরা বৈদিক; যাঁদের উল্লেখ শুধু পুরাণে আছে, তাঁরা পৌরাণিক এবং যাদের উল্লেখ বেদে বা পুরাণে নেই, কিন্তু দেব-দেবী হিসেবে লোকসমাজের পূজিত, তাদেরকে বলে লৌকিক দেব-দেবী। লৌকিক দেব-দেবীদের মধ্যে প্রধান হলেন- মনসা

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ(১২০০-১৮০০)এর শুরুর দিকে মঙ্গলকাব্য নামে এক ধরণের কাব্য রচিত হয়েছিলো, এগুলো পড়লে বা শুনলে মানুষের মঙ্গল হয়, এই বিশ্বাস থেকেই এগুলোর নামকরণ হয়েছিলো মঙ্গলকাব্য। এই মঙ্গলকাব্যগুলোর মধ্যে একটি হলো মনসামঙ্গল, এ সম্পর্কে উইকিপিডিয়া বলছে-

"বিশিষ্ট মঙ্গলকাব্য বিশারদ আশুতোষ ভট্টাচার্য মনসামঙ্গল কাব্যের আখ্যানভাগটিকে “রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-নিরপেক্ষ একটি স্বাধীন লৌকিক কাহিনী” বলে বর্ণনা করেছেন। খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় মনসার মূর্তিনির্মাণ শুরু হয়। মনসামঙ্গল কাব্যের মূল লৌকিক কাহিনিটি তারও আগে থেকে পল্লিগীতি ও ছড়ার আকারে বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত ছিল বলে অনুমান করা হয়। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে এই লোককথাটি শক্তিশালী কবিদের নিপুণ হাতে পড়ে কাব্যকৃতির রূপ নেয়। ক্রমে তার মধ্যে নানা উপকাহিনি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের সমাবেশ ঘটে।"

মনসামঙ্গলের কাহিনী নিয়ে মধ্যযুগে পাঁচজন কবি কাব্য রচনা করেন, এরা হলেন-

1. কানাহরি দত্ত

2. বিপ্রদাস পিপলাই

3. বিজয়গুপ্ত

4. নারায়ণদেব

5. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ

এদের মধ্যে মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি হরিদত্ত এবং এই কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন বিজয়গুপ্ত

এই তথ্যগুলো থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, শুরু থেকেই বেদ বা পুরাণের সাথে মনসার কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও কবিদের হাতে কাহিনীর ডালপালা মেলতে মেলতে মনসা, পুরাণের সাথে যুক্ত হয়ে শিবের কন্যাতে পরিণত হয়েছে; মঙ্গলকাব্য বিশারদ আশুতোষ ভট্টাচার্য যে কথাটি বলেছেন, এভাবে- 

"খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে এই লোককথাটি শক্তিশালী কবিদের নিপুণ হাতে পড়ে কাব্যকৃতির রূপ নেয়। ক্রমে তার মধ্যে নানা উপকাহিনি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের সমাবেশ ঘটে।"

এবার আসি আলোচনার মূল বিষয় মনসা পূজায় বলি প্রসঙ্গে।

ঋগ্বেদ, শ্রীমদ্ভাগবত এবং শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে বলি প্রদানের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে, তাই আমি বলি প্রথার বিরুদ্ধে নই। কারণ, এর সামাজিক উপযোগিতা রয়েছে। দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে বলি প্রদানের মূল উদ্দেশ্যে হলো মানুষের ক্ষাত্র শক্তিকে জাগ্রত করে তাকে আত্মরক্ষায় সক্ষম করা, এখানে মানবিকতার চেয়ে আত্মরক্ষার বিষয়টি বড়; যেহেতু নিজে না বাঁচলে আপনার নিজের মানবধিকারই তুচ্ছ হয়ে যাবে; কারণ বিচারে হত্যাকারীর ফাঁসি হলে তাতে পূর্বেই হত্যাকারীর হাতে নিহত ব্যক্তির কোনো লাভ হয় না। তাই আগে বেঁচে থাকতে হবে, টিকে থাকতে হবে, তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। পৃথিবীতে অসুররূপী মুসলমানদের থেকে এই বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার জন্যই পশুবলির ন্যায় প্রথার চর্চা করে কালীর ন্যায় হিংস্র রূপ ধারণ করার ক্ষমতা প্রতিটি হিন্দুর থাকতে হবে এবং এজন্যই বলি প্রথা চালু রাখা প্রয়োজন, কিন্তু এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে- যার বলি তাকেই দিতে হবে, একজনের মানত করা বলি অন্যকে দিলে হবে না, এতে পশুবলি প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

ঋগ্বেদ, শ্রীমদ্ভাগবত এবং শ্রীশ্রীচণ্ডীতে যাদের উদ্দেশ্যে বলি প্রদানের নির্দেশ আছে, তারা হলেন বৈদিক বা পৌরাণিক দেব-দেবী, এদের পূজা করলে যে স্বয়ং শ্রীকৃ্ষ্ণেরই পূজা করা হয়, যেটা গীতায় বলা আছে(৯/২৩)। তাই ঐসব দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দিলে, বলি প্রদত্ত পশুদের আত্মার উন্নয়ন ঘটে, পরের জন্মে তারা আরো উন্নত প্রাণী, এমনকি মানুষ হিসেবেও জন্ম নিতে পারে, ফলে দেবতাদের উদ্দেশ্যে কোনো পশুকে বলি দিলে ঐ পশুদের আত্মাকে সাহায্য করা হয় বিভিন্ন পশু জীবনের স্তর দ্রুত পার হয়ে মানুষ রূপে জন্ম নিয়ে মোক্ষে পৌঁছার জন্য। এজন্য বলি প্রথা খারাপ কিছু নয়, কিন্তু মনসা পূজার 'বলি' ?

আগেই বলেছি মনসা কোনো বৈদিক বা পৌরাণিক দেবী নয়, মনসা মানুষের ভয় থেকে সৃষ্ট লৌকিক দেবী, তাই মনসার সাথে সনাতন ধর্মের প্রকৃত দেব-দেবীদের কোনো সম্পর্ক নেই, মনসাকে যে শিব পার্বতীর কন্যা বলা হয় বা কোনো উপাখ্যানে ঋষি কাশ্যপের মানসী কন্যা বলা হয়, এটা কবিদের কল্পনার ডালপালা মেলার ফল। তাই মনসার উদ্দেশ্যে বলি দিলে সেই পশুর আত্মার কোনো উন্নয়ন ঘটবে না, সেটা করা হবে ঐ পশুর সাথে নৃশংসতা।

ফটোপোস্টে দেখুন, 'বাইশকবি পদ্মাপুরাণ' নামের একটি কাব্যে মনসার পূজায় বলির কিছু নিদর্শন আছে। কিন্তু এই কাব্যটি তো কোনো মুনি ঋষিদের দ্বারা রচিত নয়, এর রচয়িতা আপনার আমার মতোই সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ অনেক কিছুই লিখতে পারে বা বলতে পারে, কিন্তু সেটাকে যদি শাস্ত্রগ্রন্থ ধরে নিয়ে ধর্মীয় আচরণ করা হয়, সেটা ধর্ম হবে না, হবে-অধর্ম। 

শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের একটি হাতে একটি সাপ আছে, অনেকে এটাকে মনসার দেবী হিসেবে স্বীকৃতি বলে ধরে নিতে পারেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ গীতার ১০/২৮ নং শ্লোকে বলেছেন- সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকী, সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপে প্রদর্শিত সাপ যে মনসা নয়, সেটা প্রমাণিত।

মনসার যে কাহিনী, সেখানেও বলি গ্রহণের প্রতি তার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। মনসার একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিলো, পৃথিবীতে যেভাবেই হোক, তার পূজা প্রচলিত হোক। এজন্য সে সওদাগর চাঁদকে টার্গেট করে এবং একের পর এক ক্ষতিসাধন করে শেষ পর্যন্ত তার কাছ থেকে পূজা আদায় করে, এই পূজায় চাঁদ সওদাগর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্য দিকে তাকিয়ে বাম হাতে শুধু একটি ফুল মনসার প্রতিমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলো, মনসা তাতেই খুশী ছিলো, চাঁদ সওদাগরের সেই পূজা, যার মাধ্যমে মনসার পূজা প্রচলন হয়েছে, সেখানে বলির কোনো ব্যবস্থা বা ইঙ্গিত ছিলো না।

এই সব দিক বিচারে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মনসার পূজায় 'বলি' সম্পূর্ণ অশাস্ত্রীয় এবং নিরর্থক।

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment