গরুর মাংস খেলে কি পুত্র সন্তান জন্মে ?
বৃহদারণ্যক উপনিষদের রেফারেন্সে ফটোপোস্টে যা বলা হয়েছে, সেটা যদি সত্য হতো, তাহলে তো মুসলিম সমাজে কোনো মেয়েই থাকতো না, সবই পুত্র সন্তান হতো; কারণ, পৃথিবীতে একমাত্র মুসলমানরাই রাক্ষসের জাত এবং তারা পাইকারী দরে গরুর মাংস খায়, যা পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি এত পরিমাণে খায় না।তাহলে সেই সমাজে ছেলে মেয়ের ব্যালান্স রক্ষা হচ্ছে কিভাবে ?
যা হোক, বর্তমানে প্রাপ্ত বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৬/৪/১৮ মন্ত্রে এরকম একটি কথা আছে যে গরুর মাংস খেলে পুত্র সন্তান জন্মে, কিন্তু এরকম একটি আজগুবী বা উদ্ভট কথা উপনিষদের মধ্যে এলো কিভাবে সেটা বোঝার জন্য আপনাকে উপনিষদের ইতিহাস এবং এই মন্ত্রের আগের আরো চারটি মন্ত্র খুব গভীর মনোযোগ সহ বুঝতে হবে, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, আসলফাঁকিটা কোথায় ?
যা হোক, বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৬/৪/১৮ মন্ত্রে বলা আছে-
"যে চায় আমার এমন পুত্র হোক যে পণ্ডিত, প্রখ্যাত, সভাসদ ও সুভাষ হইবে, সর্ববেদ অধ্যয়ণ করিবে এবং পূর্ণায়ু হইবে, তাহারা স্বামী স্ত্রী উভয়ে মাংষ মিশ্রিত অন্ন রন্ধন করিয়া তাহাতে ঘি মিশাইয়া খাইবে। এই মাংস তরুণ বা বয়স্কা বৃষের হইলে তাহারা ঐ রকম সন্তান জন্ম দিতে পারিবে।"
এর আগে ৬/৪/১৭ নং মন্ত্রে বলা আছে-
"যদি কেহ চায় আমার বিদুষী কন্যা জন্মলাভ করুক এবং সে পূর্ণায়ু হোক, তাহারা স্বামী স্ত্রী দুইজন তিলমিশ্রিত অন্ন রন্ধন করিয়া তাহাতে ঘি মিশাইয়া খাইবে। তাহা হইলে তাহারা ঐরকম কন্যা উৎপাদন করিতে পারিবে।"
এরও আগে ৬/৪/১৬ নং মন্ত্রে বলা আছে-
"যদি কেহ চায় আমার রক্তচক্ষু ও শ্যামবর্ণ পুত্র হউক, সে তিন বেদ অধ্যয়ণ করুক এবং পূর্ণায়ু লাভ করুক, তবে তাহারা স্বামী স্ত্রী দুজনে জলে সিদ্ধ অন্ন ঘি মিশাইয়া খাইবে। তাহা হইলে তাহারা ঐরকম সন্তান উৎপাদন করিতে পারিবে।"
এরও আগে ৬/৪/১৫ নং মন্ত্রে বলা আছে-
"যদি কেহ চায় আমার পিঙ্গলচক্ষুযুক্ত এবং কপিলবর্ণ পুত্র হউক, সে দুই বেদ অধ্যয়ন করুক এবং পূর্ণায়ূ লাভ করুক, তবে তাহারা স্বামী স্ত্রী দুজনে দধি দিয়া চরু বাঁধিয়া তাহাতে ঘি মিশাইয়া খাইবে। তাহা হইলে তাহারা ঐরকম সন্তান উৎপাদন করিতে পারিবে।
এরও আগে ৬/৪/১৪ নং মন্ত্রে বলা আছে-
"যদি কেহ চায় আমার গৌরবর্ণ পুত্র হউক, এক বেদ অধ্যয়ন করুক এবং পূর্ণায়ু লাভ করুক, তবে তাহারা স্বামী স্ত্রী দুইজন পায়স রাঁধিয়া তাহাতে ঘি মিশাইয়া খাইবে। তাহা হইলে তাহারা ঐরকম সন্তান উৎপাদন করিতে পারিবে।"
মূল ফাঁকিটা ধরতে এবার আসুন মন্ত্রগুলোর বিশ্লেষণে-
৬/৪/১৪ নং মন্ত্রে বলা আছে-"যদি কেহ চায় আমার গৌরবর্ণ পুত্র হউক, এক বেদ অধ্যয়ন করুক এবং পূর্ণায়ু লাভ করুক", ৬/৪/১৫ নং মন্ত্রে বলা আছে-"যদি কেহ চায় আমার পিঙ্গলচক্ষুযুক্ত এবং কপিলবর্ণ পুত্র হউক, সে দুই বেদ অধ্যয়ন করুক এবং পূর্ণায়ূ লাভ করুক", ৬/৪/১৬ নং মন্ত্রে বলা আছে- "যদি কেহ চায় আমার রক্তচক্ষু ও শ্যামবর্ণ পুত্র হউক, সে তিন বেদ অধ্যয়ণ করুক এবং পূর্ণায়ু লাভ করুক।"
গীতার ভাষ্যমতে বেদ মূলত তিনটি- ঋক, সাম ও যজু ( গীতা, ৯/১৭), তন্ত্র মন্ত্র চিকিৎসাবিদ্যার মতো ব্যবহারিক কিছু বিষয়ের তথ্য নিয়ে বেদব্যাস একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যা পরবর্তীতে তিন বেদের সাথে যুক্ত হয়ে বেদের মর্যাদা পায় এবং তার নাম হয় অথর্ববেদ। সুতরাং বেদ মূলত তিনটি এবং এই সর্বোচ্চ তিনটি বেদের কথাই বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৬/৪/১৬ নং মন্ত্রে বলা আছে। এই মন্ত্রে আরও খেয়াল করুন, বলা আছে- রক্তচক্ষু অর্থাৎ রাগী ও শক্তিমান, শ্যামবর্ণ মানে কৃষ্ণের গুণ সম্পন্ন এবং তিন বেদ মানে সর্বোচ্চ জ্ঞান ধারণকারী এবং পূর্ণ আয়ু, এই মন্ত্রের মধ্যে কিন্তু চাওয়া পাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু এর আগের দুটি মন্ত্রে তুলনামূলক কম গুন সম্পন্ন পুত্রের কথা বলা হয়েছে, তার মানে ৬/৪/১৬ নং মন্ত্রে যে পুত্রের কামনা করা হয়েছে, সেই পুত্রই মানুষের পরম আকাঙ্ক্ষিত; বাংলাদেশ বা ভারতের যেমন সর্বোচ্চ সম্মানিত পদ রাষ্ট্রপতির পদ, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর আর যেমন কারো কোনো চাহিদা থাকতে পারে না, তেমনি ৯/৪/১৬ নং মন্ত্রে যে পুত্র চাওয়া হয়েছে, সেটাই শেষ কথা, এর চেয়ে বেশি গুণ সম্পন্ন পুত্র হতে পারে না।
৬/৪/১৪ থেকে ৬/৪/১৬ পর্যন্ত তিনটি মন্ত্রে তিন রকম পুত্রের কথা ব'লে ৬/৪/১৭ তে বলা হয়েছে বিদুষী কন্যা কিভাবে জন্মাবে তার কথা, তার মানে পুত্র কন্যা বিষয়ক কথাবার্তা এখানে শেষ এবং এই চারটি মন্ত্রের কোথাও মাংস খাওয়ার কোনো কথা ই বলা নেই। কিন্তু এরপর আবার পুত্রের কথা বলা হচ্ছে এবং সেখানে মাংস খাওয়ার কথা বলা হচ্ছে এবং সেই মাংস তরুণ বা বয়স্ক গরুর হতে হবে বলে বলা হচ্ছে। রহস্যটা কী ? বাচ্চা গরুকে জবাই করে কেউ খায় নাকি ? যারা গরুর মাংস খায়, তারা তো তরুণ বা বয়স্ক গরুর মাংসই খায়।
যা হোক, যেখানে ৬/৪/১৬ নং মন্ত্রে সর্ব গুনান্বিত পুত্রের কথা বলাই হলো এবং তারপর কন্যার কথা বলে এই সম্পর্কিত আলোচনাই শেষ করে দেওয়া হলো, তার পর আবার পুত্রের কথা বলা হচ্ছে কেনো বা এমন পুত্র চাওয়া হচ্ছে কেনো, যে হবে- পণ্ডিত প্রখ্যাত সভাসদ ও সুভাষ অর্থাৎ রাজসভার ভাঁড় ? এর মানে হলো বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই মন্ত্রটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এখানে প্রক্ষিপ্ত, যেটা না বুঝেই অনুবাদকগণ অনুবাদ করে ফেলেছেন এবং হরফ প্রকাশনীর মুসলমান মালিক তা সানন্দে ছেপে ফেলছেন।
উপনিষদের মধ্যে যে নানা মন্ত্র প্রক্ষিপ্ত থাকতে পারে, এই বিষয়টি বুঝতে পারবেন উপনিষদ সম্পর্কিত ইতিহাস জানলে; এ প্রসঙ্গে বলে রাখি অনেকে মনে করে উপনিষদ ১০৮টি, কিন্তু বাস্তবে উপনিষদ ১২টি। ১২টি উপনিষদ কিভাবে ১০৮ বা তারও বেশি সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়ালো সে সম্পর্কে হরফ প্রকাশনীর মালিক তার উপনিষদ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন-
"যত দিন যাচ্ছে উপনিষদের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে। মোগল আমলেও অনেকগুলি উপনিষদ রচিত হয়েছে। হয়তো আরো কিছুদিন পর উপনিষদের সংখ্যা দ্বিশতাধিক দাঁড়াবে। এ উপনিষদগুলি আর যাই হোক বৈদিক যুগের উপনিষদ নয়। যে উপনিষদগুলি চারটি বেদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্ত, তাদের সংখ্যা ১২ খানি। এগুলি প্রাচীন, এগুলি বৈদিক উপনিষদ। সুতরাং এই ১২ট উপনিষদকে আমরা মূল উপনিষদ বলে ধরেছি।"
উপনিষদ যে ১২টিই তার আরেকটি প্রমাণ হলো শঙ্করাচার্য এই বারোটির মধ্যে ১১ টির ভাষ্য রচনা করেছেন। পরে নানা বিচার বিশ্লেষণে কৌষীতকি প্রাচীন উপনিষদ বলে প্রমাণিত হয়। ফলে কৌষিতকী এবং শঙ্করাচার্যের ১১টিসহ মোট ১২টিকে গবেষকগণ মূল উপনিষদ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এই ১২টি উপনিষদ হলো- ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, শ্বেতাশ্বতর, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, এবং কৌষিতকী।
১২ টি উপনিষদ যেখানে দুইশ এর বেশিতে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, সেখানে মূল ১২টির মধ্যে কোনো প্রক্ষিপ্ত হয় নি এবং ভাষ্যকার বা অনুবাদকদের বেখেয়ালে সেগুলো যে বর্তমান বাজার পর্যন্ত পৌঁছায় নি, একথা কি জোর দিয়ে বলা যাবে ? যাবে না। তাই বৃহদারণ্যক উপনিষদের ঐ গরুর মাংস খাওয়ার মন্ত্র যে সম্পূর্ণ প্রক্ষিপ্ত, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। যারা প্রক্ষিপ্ত শব্দের মানে জানেন না, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি- প্রক্ষিপ্ত হলো কোনো নির্দিষ্ট রচনার মধ্যে বিশেষ উদ্দেশ্যে বাড়তি কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া, যাতে ঐ ঢুকানো অংশটিও মূল রচনা বলে মনে হয় এবং লোকজন বিভ্রান্ত হয়।
আশা করছি- উপরের এই আলোচনা থেকে বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৬/৪/১৮ নং মন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা আমার বন্ধুদের কাছে আমি ক্লিয়ার করতে পেরেছি।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment