Friday 7 August 2020

চৈতন্যদেব কি মধ্যযুগে হিন্দুদেরকে মুসলমান হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে হিন্দুসমাজকে বাঁচিয়েছিলো ?


চৈতন্যদেব কি মধ্যযুগে হিন্দুদেরকে মুসলমান হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে হিন্দুসমাজকে বাঁচিয়েছিলো ?

যারা বলে চৈতন্যদেব হিন্দুদেরকে ধর্মান্তরের হাত থেকে বাঁচিয়ে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করেছে, তাদের কোনো ধারণাই নেই সেই সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে। তিনি যে হিন্দু ধর্ম থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি মতবাদ বৈষ্ণব ধর্ম চালু করেছিলেন, সেটাও অনেকে জানে না। কিন্তু বৈষ্ণবরা হিন্দু সমাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে নি শুধু কৃষ্ণের জন্য; কারণ, চৈতন্যদেবের আরাধ্য দেবতা যেমন কৃষ্ণ, তেমনি হিন্দুদেরও আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণ; কিন্তু বর্তমান বৈষ্ণব সমাজে চৈতন্যদেবের গুরুত্ব, কৃষ্ণের চেয়েও বেশি এবং একারণে মহাপ্রভুর ভোগের অনুষ্ঠানে চৈতন্যই সবকিছু, কৃষ্ণ সেখানে ফোর সাবজেক্ট। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণকে অল্প হলেও মানে ব’লে এবং বৈষ্ণব থিয়োরি যেহেতু জীবন যাপনের জন্য সম্পূর্ণ বাস্তব বা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এবং নানা প্রয়োজনে যেহেতু তাদেরকে সনাতন ধর্মের নানা বিধি বিধানকে ধার করতে হয়, তাই তারা এখনও হিন্দু সমাজ থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে নি এবং আর কখনো পারবেও না।

শুধু বৈষ্ণবরা কেনো, পৃথিবীর কোনো ব্যক্তিমতের ধর্মের অনুসারীদের ক্ষমতা নেই সনাতন মানব ধর্মের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আলাদা জীবন যাপন করার। যদি কেউ তা চেষ্টা করে, তাকে হয় জঙ্গীদের মতো অন্যদেরকে মারতে হবে, না হয় মারতে গিয়ে নিজেকে মরতে হবে। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, মানুষ যে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে সেটাই সনাতন মানব ধর্ম। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে সনাতন ধর্মে যে বিভিন্ন প্রকার দেব-দেবীর পূজা যুক্ত হয়েছে, সেগুলো ধর্মের মোড়কে হলেও কোনো ধর্ম নয়, সেগুলো এক একটি হিন্দু উৎসব মাত্র।

যা হোক, বৈষ্ণবরা কিন্তু কাগজ পত্রেও সনাতন ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেকারণে কেউ যদি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হতে চায়, তাকে সরকারিভাবে এফিডেফিট করে তা করতে হয়। আর যে বৈষ্ণবরা কাগজপত্রে ধর্মের জায়গায় সনাতন ধর্ম লিখে, তারা আসল থিয়োরি জানে না বলেই লিখে। আর এই অজ্ঞতার ফলে প্রতিদিনের জীবন যাপনে বৈষ্ণবরা যেমন সনাতন মানবধর্মের নানা বিধি-বিধান পালন করে, তেমনি অনেক সনাতনী হিন্দুরাও না বুঝে বিভিন্ন কারণে মহাপ্রভুর ভোগের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নিজের অজান্তেই অল্পমাত্রায় হলেও বৈষ্ণব মতবাদকে পালন করে।

যা হোক, মধ্যযুগে মুসলমানদের প্রভাব থেকে হিন্দুদেরকে রক্ষা করতে চৈতন্যদেব যে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে নি,  এবার নজর দিই সেদিকে-

সম্রাট অশোকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহনের ফলে অখণ্ড ভারতের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ হিন্দু বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। খ্রিষ্টীয় ৮ম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য, কুমারিল ভট্ট সহ আরো কয়েকজন মহাত্মার চেষ্টায় বাংলা ছাড়া প্রায় সমগ্র ভারতের বৌদ্ধরা আবারও হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে। কিন্তু বাংলা, শঙ্করাচার্য এর জন্মস্থান গুজরাট থেকে প্রায় ২ হাজার কি.মি দূরে হওয়ায় এবং তার জীবনীকাল মাত্র ৩২ বছর হওয়ায় তার কর্মের প্রভাব এই বাংলায় এসে পৌঁছায় নি, ফলে এখানকার বৌদ্ধরা, বৌদ্ধই থেকে যায়; সেই সময় থেকে মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত বাংলায় হিন্দু ছিলো এক তৃতীয়াংশ এবং বৌদ্ধ ছিলো দুই তৃতীয়াংশ।

ভারতে ইসলামি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর মুসলমানদের একটাই লক্ষ্য ছিলো যেকোনো প্রকারে হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করে পুরো ভারতকে ইসলামিক করা। এজন্য ক্ষমতা দখল করে মাথার উপর চেপে বসার পর, মুসলমান শাসকরা শর্ত দিয়েছিলো, হয় ইসলাম গ্রহন করো, না হয় মৃত্যু বরণ করো। শতকরা ৯৯ জন হিন্দু এ শর্তকে না মেনে মৃত্যু বরণ করছিলো বা করার জন্য প্রস্তুত ছিলো। এভাবে সব লোক মারা গেলে রাজ্য চালাবে কাদের নিয়ে ? এই সমস্যার সমাধানে মুসলমান শাসকরা, সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী হলেও হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর চাপিয়ে তাদেরকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেয় এবং এই অপশান রাখে যে, কেউ যদি ইসলাম গ্রহন করে তাহলে তাদেরকে আর জিজিয়া কর দিতে হবে না। এই আর্থিক চাপে পড়েও কিছু দরিদ্র হিন্দু পরে মুসলমান হয়, কিন্তু সেটাও সব মিলিয়ে ১% এর বেশি নয়।

এরপর ১২০৪ সালে, বাংলা, বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে মুসলমানদের দখলে এলে নানামুখী অত্যাচার এবং সুযোগ সুবিধার জন্য এই বৌদ্ধরা আবার ইসলাম গ্রহন করে মুসলমান হয়ে যায়। বৌদ্ধদের জাতীয় পোষাক হলো লুঙ্গি, সেকারণেই বাঙ্গালি মুসলমানদের পোষাক লুঙ্গি হয়ে যায় এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ন্যাড়া হয়ে থাকতো ব’লে, ইসলামে ধর্মান্তরিত বৌদ্ধরা ন্যাড়া মুসলমান নামে পরিচিত হয়। বাংলায় মুসলমান শাসকদের ক্ষমতা এবং অত্যাচারের মাত্রা এত বেশি ছিলো যে, এক এলাকার মানুষদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের কাহিনী শুনে, সেই অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাঁচতে অন্য এলাকার মানুষরা দলে দলে ইসলাম গ্রহন করে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো, এভাবে যারা মুসলমান হয়, তারা পরিচিত হয় “শুইন্যা মুসলমান” নামে। কিন্তু সকল অত্যাচার সহ্য করে, মৃত্যুকে বরণ করে এবং জিজিয়া কর দিয়ে হলেও বাংলার হিন্দুরা দলে দলে তাদের ধর্ম ত্যাগ করে নি, প্রবল স্রোতের মুখে দু’চারটা খড়কুটো হয়তো ভেসে গিয়েছে এবং তা যেতেই পারে, বর্তমানে যেমন নানারকম ফাঁদে পড়ে দু’চার জন হিন্দু ধর্মান্তরিত হয় বা হচ্ছে।

বাংলার যে এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, সম্রাট অশোকের আমলেও ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ হয় নি, তারা মুসলমান শাসনামলেও ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহন করে নি, সেই এক তৃতীয়াংশ হিন্দু এখনও হিন্দুই আছে, তাই দুই বাংলা মিলিয়ে টোটাল জনসংখ্যার ওয়ান থার্ড লোক এখনও হিন্দু। তাহলে চৈতন্যদেব কোন হিন্দুদেরকে ধর্মান্তরের হাত থেকে রক্ষা করেছে ? এরা তো আগে থেকেই ধর্ম ত্যাগ না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো। চৈতন্যদেব মধ্যযুগে হিন্দুদেরকে মুসলমান হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে, আসলে এই কথা বলে তাকে হিন্দু সমাজে মহান বানানোর চেষ্টা করা হয় বা হয়েছে; কিন্তু প্রকৃত সত্য তা নয়, বাংলায় ধর্মান্তরের ঝড় ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে রাজা গনেশ এর পুত্র যদুর রাজত্বকালের(১৪১৮-১৪৩১)সময় পর্যন্ত ছিলো, যেটা চৈতন্য দেবের সময়ের (১৪৮৬-১৫৩৩) পূর্বেই শেষ হয়ে যায় এবং যে প্যাঁচে পড়ে যদুকেও মুসলমান হয়ে বাঁচতে ও রাজ্য চালাতে হয়।

মূলত ধর্মান্তরের ঝড় স্তিমিত হওয়ার পর চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং তারপর কিছু সনাতনী হিন্দু চৈতন্যদেবের আদর্শে প্রভাবিত হয় এবং বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। এরা সব সময়ই ছিলো সনাতনী হিন্দু এবং এখনও নিজেদেরকে বৈষ্ণব বললেও জীবনাচরণের প্রতিটা ক্ষেত্রেই তারা সনাতনী হিন্দু। কারণ, বৈষ্ণব হতে হলে আপনাকে ভিক্ষা করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হবে, সেটা কয়জন লোক করে বা করতে পারে বা করার ইচ্ছা রাখে ? আর বর্তমান সমাজে কে বৈষ্ণব ? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি একজনও বৈষ্ণব নেই, সবাই সনাতনী হিন্দু।

সুতরাং চৈতন্যদেবের কারণে মধ্যযুগে বাঙ্গালি হিন্দু সমাজ ধর্মান্তরের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, এটা যে একটা ডাহা মিথ্যা প্রচার, আশা করছি- আমার বন্ধুদের কাছে তা ক্লিয়ার করতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment