Wednesday, 29 July 2020

মহাভারত কি গোমাংস ভক্ষণকে সমর্থন করে ?


মহাভারত কি গোমাংস ভক্ষণকে সমর্থন করে ?

মহাভারতে রাজা রন্তিদেবের একটি কাহিনী আছে, যেখানে বলা হয়েছে, রাজা রন্তিদেব যজ্ঞে গরুকে ছেদন করাতে, গরুদের চামড়া খুলে কোনো একটি জায়গায় স্তুপীকৃত করে রাখায়, সেইসব চামড়া থেকে রস নির্গত হয়ে প্রবাহিত হওয়ায় একটি নদীর সৃষ্টি হয়, যার নাম চর্ম্মন্বতী নদী। রাহুল সাংকৃত্যয়ণ এর একটি বই, সম্ভবত "সিন্ধু থেকে গঙ্গা"তেও এরকম একটি কাহিনী পড়েছিলাম। এই রেফারেন্সগুলো এই প্রমাণ দেয় যে, অতীতে এক সময় গরুর মাংস খাওয়া হতো।

শুধু গরু কেনো, অতীতে, গুহায় বাসকালে মানুষ- বাঘ, সিংহ প্রভূতি হিংস্র প্রাণীর মাংসও খেয়েছে। আমরা হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ, আমাদের উৎপত্তি আফ্রিকায়। আমাদের উৎপত্তির প্রায় একই সময়ে ইউরোপে উৎপত্তি হয়েছিলো নিয়ানডার্থাল প্রজাতির মানুষ। কিন্তু হোমোস্যাপিয়েন্সরা ইউরোপে ঢুকে পড়লে নিয়ানডার্থাল প্রজাতির মানুষদের সাথে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং হোমোস্যাপিয়েন্সরা নিয়ানডার্থালদেরকে সেই যুদ্ধে পরাজিত ক'রে হত্যা ক'রে খেয়ে ফেলে। এরপর পৃথিবী থেকে নিয়ানডার্থাল প্রজাতির মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

জঙ্গলে ও গুহায় বাস করা কালে এবং কৃষিভিত্তিক সভ্যতা সৃষ্টির আগে পৃথিবীতে হত্যাই হতো নিহতদের মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে। বাঘ সিংহরা যদি মানুষকে হত্যা করতে পারতো, তাহলে তারা মানুষের মাংস খেতো, আর মানুষ যদি বাঘ সিংহকে হত্যা করতে পারতো, তাহলে মানুষ বাঘ সিংহের মাংস খেতো। সেই সময়ে বাঘ সিংহকে হিংস্র বলার কোনো সুযোগ নেই, কারণ, মানুষও বাঘ সিংহের মতো একই রকম হিংস্র ছিলো, আর সবারই বাস ছিলো জঙ্গলে। সুতরাং মানুষরূপী প্রাণী কর্তৃক পশুদেরকে হত্যা করে খাওয়া এবং পশু কর্তৃক মানুষের নিহত হয়ে তাদের পেটে যাওয়া, মানুষের উৎপত্তি থেকে শুরু করে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা শুরুর আগে পর্যন্ত ছিলো নরম্যাল ব্যাপার।

শুরু থেকেই মানুষ ছিলো স্বভাববশতই আরামপ্রিয় এবং ঝুঁকিহীন জীবন যাপনে আগ্রহী। কৃষি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর মানুষ দেখলো যে, খাদ্য যোগানে পশু শিকার করতে গেলে যে পরিশ্রম এবং জীবনের ঝুঁকি, মাটি থেকে খাবার উৎপাদনে জীবনে ঝুঁকি তো নেই ই, অতটা পরিশ্রমও নেই। এই উপলব্ধি থেকেই মানুষ আস্তে আস্তে কৃষিভিত্তিক জীবন যাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার এই উন্নয়ন সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এক সাথে হয় নি, এই দৌড়ে কোনো এলাকা এগিয়ে গেছে আবার কোনো এলাকা ছিলো অনেক পিছিয়ে। এই যেমন এখনও অস্ট্রেলিয়ার পাশের পাপুয়া নিউগিনির মানুষের জীবন যাপন আধুনিক উন্নত সভ্যতা থেকে প্রায় কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে আছে। ১৮৬০ সালে ফিজির আদিবাসীরা এক খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারককে হত্যা করে তাকে পুড়িয়ে তার মাংস খেয়ে ফেলেছিলো, জোরপূর্বক কাউকে হত্যা করে মাংস খাওয়ার সেই ঘটনা ই ফিজির শেষ মানুষ খাওয়া ঘটনা, এরপর ব্রিটিশদের প্রভাবে তারা সভ্য হতে শুরু করে এবং মানুষে মাংস খাওয়ার ঘটনা আর ঘটে নি। কিন্তু ফিজি দ্বীপপুঞ্জের কিছু কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী এখনও পরলোকগত পিতা মাতার মাংস খায়। শুধু তাই নয় অস্ট্রেলিয়ার আবিষ্কারক ক্যাপ্টেন জেমসকুকের দলবলকে তাহিতি দ্বীপের আদিবাসীরা হত্যা করে খেয়ে ফেলেছিলো। তার মানে মানুষ যে অন্যান্য প্রাণীর মাংস খেতো বা খায়, সেটা তো নরম্যাল ব্যাপার, মানুষ প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত মানুষের মাংসও ব্যাপকভাবে খেয়েছে। এই মানুষ প্রাচীন কালে যদি গরুর মাংস খায়, সেটা কোনো ঘটনা নাকি ?

এখন দেখা যাক, মহাভারতে গরুর মাংস খাওয়ার ঘটনাটির উল্লেখ কিভাবে আছে ?

এই প্রবন্ধের সাথে আমি যে ফটোদুটি যুক্ত করেছি, সেগুলো কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদিত মহাভারত থেকে নেওয়া, যে মহাভারত সংস্কৃত মহভারতের হুবহু গদ্য অনুবাদ, মানে এই মহাভারতই সবচেয়ে অথেন্টিক।

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, এই মহাভারতের অনুবাদ সম্পর্কে আরেকটি তথ্য পাঠকবন্ধুদেরকে দিয়ে রাখি।

এটা কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত নামে পরিচিত হলেও, এটির অনুবাদক কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহ নয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন জমিদারের ছেলে জমিদার। তিনি কিছু বেতনভূক্ত সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিয়োগ করেছিলেন মহাভারত অনুবাদের জন্য, কালী প্রসন্ন সিংহের হয়ে তারাই এই কাজটি করে দিয়েছিলেন, এজন্য শুরু থেকেই এটা কালীপ্রসন্ন সিংহের নামেই চলে। কালী প্রসন্ন সিংহের এই অনুবাদের জন্য ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাভারত অনুবাদে হাত দিয়েও সেটা আর এগিয়ে নিয়ে যান নি।

যা হোক, এই অনুবাদের একটি স্থানে লিখা হয়েছে- "পূর্ব্বকালে মহাত্মা রন্তিদেব স্বীয় যজ্ঞে গো সমুদায়কে পশুরূপে কল্পিত করিয়া ছেদন করাতে উহাদের চর্ম্মরসে চর্ম্মন্বতী নদী প্রবাহিত হইয়াছে। এক্ষণে উহারা যজ্ঞীয় পশুত্বে কল্পিত হয় না। উহারা এক্ষণে দানের বিষয় হইয়াছে।"

ভালো করে খেয়াল করুন, শুরুতেই বলা হয়েছে "পূর্ব্বকালে", এই পূর্বকালে, কত পূর্বে ? যখন গরু, দেবতা হিসেবে কল্পিত হয় নি, তখন; তার মানে বেদ সম্পূর্ণভাবে রচিত হওয়ারও পূর্বে। কারণ, যখন থেকে বেদে গরুকে দেবতা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে, তখন থেকে গোহত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে এবং তখন থেকে গরুকে সাধারণ পশু হিসেবে কল্পনা না করে তাদেরকে দানের বিষয় হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে এবং তারপর থেকে যজ্ঞে আর পশু হিসেবে গরুকে হত্যা করা হয় না।

তাহলে ঘটনা কী দাঁড়ালো, মহাভারতে কি গো হত্যা করে তার মাংস খাওয়াকে সমর্থন করা হয়েছে ? প্রাচীনকালে রন্তিদেব নামে কোনো এক রাজা কী করতো, সেই বিষয়টি মহাভারতে বলা হয়েছে।

ইসকনের প্রভুপাদ নিশ্চয় নিরামিষ খেতো এবং ধরে নিলাম যে তার দাদু মাছ মাংস খেতো, যেটা অসম্ভব কিছু নয়। এখন প্রভুপাদের জীবনী লিখতে গিয়ে তো তার দাদুর কথা লিখতেই হবে, এখন প্রভুপাদের জীবনীতে যদি লেখা হয় যে প্রভুপাদের দাদু মাছ মাংস খেতো, এর মানে কি প্রভুপাদও মাছ মাংস খেতো ? নিশ্চয় নয়। মহাভারত শুধু বিশাল কাহিনী নয়, এটি একটি বিশাল ব্যাপারও, এই বিশালত্বে নানা কাহিনী নানা ভাবে এসেছে, সেখানে যদি কোনো প্রসঙ্গে প্রাচীন কালের রাজা রন্তিদেবের কথা বলা হয়ে থাকে এবং তার সম্পর্কে যদি বলা হয় যে যজ্ঞে সে গো হত্যা করতো এবং অতিথিদেরকে গো মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করতো, তাহলে সমস্যা কোথায় ? গরু তো একটা সাধারণ তৃণভোজী প্রাণী, মানুষ এক সময় বাঘ সিংহের মতো হিংস্র প্রাণীকে হত্যা করে খেয়েছে, এমনকি মানুষ, মানুষের মাংসও খেয়েছে, যেগুলো সবই অতীত, তাহলে কোনো এক অতীতে রন্তিদেব গোহত্যা করেছে এবং তার মাংস দিয়ে অতিথিদেরকে আপ্যায়ণ করেছে, এটা কি খুব বড় কোনো মাথা ব্যথার বিষয় ?

রন্তিদেবের কাহিনীতে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেখানে বলা হয়েছে- অতিথিরা যে রাত্রি রন্তিদেবের গৃহে বাস করিত, সেই রাত্রিতে তথায় বিংশতি সহস্র একশত গো ছেদন করা হইত।" তারপরও নাকি পাচকেরা পর্যাপ্ত মাংস খেতে পেতো না !

এই বিষয়টি যে প্রক্ষিপ্ত বা অতিরঞ্জিত, তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমরা জানি যে বেদব্যাস মাত্র ২৪ হাজার শ্লোকে মহাভারত রচনা করেন, কিন্তু বর্তমানে মহাভারতে শ্লোকের সংখ্যা এক লক্ষ, ফলে মহাভারতের কাহিনীতে যে কত বেনোজল ঢুকে স্থান করে নিয়েছে, সেটা একবার কল্পনা করুন; এই ২০ হাজার ১০০ গো ছেদনও আমার মতে সেকরমকই একটি বেনো জল। কারণ যে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর অনায়াসে চার পাঁচ মন মাংস হয়, ধরে নিলাম একটি গরু থেকে গড়ে ৪ মন মাংস পাওয়া যায়, এই হিসেবে ২০,১০০ টি গরুর মাংস হবে ৮০,৪০০ মন, কেজির হিসেবে তা ৩২ লক্ষ ১৬ হাজার কেজি, প্রতিটি মানুষ গড়ে ২৫০ গ্রাম করে মাংস খেলে, এক বেলায় এই মাংস খেতে লোক লাগবে ১ কোটি ২৮ লক্ষ ৬৪ হাজার জন। অতিথিরা রন্তিদেবের গৃহে তিন বেলা খেলেও এই পরিমান মাংস খেতে লোক লাগবে প্রায় ৪৩ লক্ষ, এটা যে সময়ের ঘটনা সেই সময় সারা ভারত মিলেও ৪৩ লক্ষ লোক ছিলো না। আর ঘটনাটি মহাভারতে এমনভাবে লিখা হয়েছে যেন যখনই অতিথিরা রন্তিদেবের গৃহে আসতো, তখনই তারা সংখ্যায় ঠিক এই ৪০/৪৫ লক্ষই হতো এবং গুনে গুনে ঠিক ২০,১০০টি গরুই কাটা হতো তাদের খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে ? এই নির্দিষ্ট সংখ্যা ই সন্দেহজনক ব্যাপার। বাড়িতে অতিথিরা আসবে, এটা একটা নরম্যাল ব্যাপার, কিন্তু তাদের সংখ্যা তো কখনো নির্দিষ্ট হতে পারে না। একেকদিন, একেক সময় বা একেক বছর তো অতিথিদের সংখ্যা কম বেশি হবেই, তাদের জন্য খাবার দাবারের আয়োজনও নিশ্চয় কমবেশি হবে, তাহলে নির্দিষ্ট করে গরুর সংখ্যা ২০,১০০টি বলা হলো কেনো ? সুতরাং ২০,১০০ গরুর ব্যাপারটি যে মিথ্যা, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

আর যজ্ঞে রন্তিদেবের কাটা গরুর চামড়ার রস থেকে যে চর্ম্মন্বতী নদীর উৎপত্তি হয়েছে, এটি নিয়ে আমার ঘোর সংশয় আছে। কারণ, নদীর উৎপত্তি হয় পাহাড় পর্বত থেকে, আর সেই নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে জীবিত থাকতে হলে তার নিয়মিত জলপ্রবাহ দরকার, যেটা পাহাড়-পর্বত ছাড়া সম্ভব নয়। তাহলে প্রাচীনকালে কোনো এক স্থানে স্তুপীকৃত পচা চামড়ার রস থেকে উৎপন্ন নদী কিভাবে তার প্রবাহ ঠিক রাখলো এবং দীর্ঘসময় ধরে জীবিত থাকলো, যা ইতিহাসে স্থান পেয়ে গেছে ?

সব মিলিয়ে- রন্তিদেব, তার গো হত্যা এবং তার দ্বারা অতিথি আপ্যায়ণ, পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে সন্দেহজনক, আর সন্দেহ নিশ্চয়তায় পরিণত হয়, যখন জানি যে মহাভারতের ৭৬ হাজার শ্লোকই প্রক্ষিপ্ত।
সনাতন ধর্মে কাহিনীর শেষ নেই, তাই যদি দেখা যায়, কোনো একটি কাহিনী অপর কাহিনীর সাথে ম্যাচ করছে না, তখনই বুঝে নিতে হবে যে এতে কোনো না কোনো ভেজাল আছে। যেমন- বেদে, গো হত্যা নিষেধ, কিন্তু রন্তিদেব, তার যজ্ঞে গো হত্যা করছে। আবার বলা হচ্ছে, সেই সময় গরুকে পশু হিসেবে কল্পনা করা হতো, কিন্তু বর্তমানে তা আর হয় না। তার মানে এটাও হতে পারে যে রন্তিদেবের সময় যজ্ঞ চালু হলেও যজ্ঞে গরুকে হত্যা করার নিয়ম ছিলো, কিন্তু পরে গরুকে দেবতার মর্যাদা দান করায় আর যজ্ঞে গরু হত্যা করা হয় না। একটু আগে পিছে ভেবে নিলে এই কাহিনীটা মানান সই, কিন্তু অতিথিদের জন্য সব সময় নির্দিষ্ট সংখ্যা ২০,১০০টি গরু হত্যা, এটা কিছুতেই সুস্থ মস্তিষ্কে মেনে নেওয়া যায় না; কারণ, অতিথিদের সংখ্যা কম বেশি হতে পারে, তাই তাদের জন্য আয়োজনও কম বেশি হবে এবং গরুর চামড়ার রস থেকে যে চর্ম্মন্বতী নদীর উৎপত্তি এটাও ভৌগোলিক কারণেই বিশ্বাস করা যায় না।

সুতরাং মহাভারতের কাহিনীতে রন্তিদেবের কাহিনী থাকলেই যে সেটা অথেন্টিক, এমনটা নয়; আবার রন্তিদেব অতিথিদের জন্য গরু মাংস খাওয়ার ব্যবস্থা করলেই যে মহাভারত, গরুর মাংস ভক্ষণকে সমর্থন করছে, ব্যাপারটি তেমনও নয়।

আশা করছি উপরের আলোচনা থেকে মহাভারতে গরুর মাংস ভক্ষণের প্রকৃত রহস্যটি আমার বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার করতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment