Thursday, 30 July 2020

পৌরাণিক কাহিনীগুলো আসলে কী ?


পৌরাণিক কাহিনীগুলো আসলে কী ?

পুরাণে বেশ কিছু চরিত্রকে খারাপ হিসেবে, অর্থাৎ ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে; এদের মধ্যে প্রধান হলো ইন্দ্র এবং ইন্দ্রের সাথে রয়েছে সূর্য পত্নী- সংজ্ঞা, রাহু, কেতু, মঙ্গল, রাহু-কেতুর মা সিমহিকা, নরকাসুর, অন্ধক, জলন্ধর, প্রহ্লাদের বাবা হিরণ্যক শিপু, অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য এবং অসংখ্য অসুর; এদের মধ্যে ইন্দ্র হলো দেবরাজ, অর্থাৎ সে দেবতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, অন্যরা দেবতাদের শত্রু অসুর; এই অসুরদের ভিলেন চরিত্র নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই, কিন্তু দেবতা হয়েও ইন্দ্রের ভিলেনের মতো চরিত্র কেনো, এই প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব অনেকের কাছেই নেই, তাই ইন্দ্রের চরিত্র প্রসঙ্গে হিন্দুরা, মুসলমানদের কাছে হেয় হয়, ইন্দ্রের প্রসঙ্গ তুললেই হিন্দুদের মুখের কথা হারিয়ে যায়।

এই সমস্যা থেকে আপনি তখনই মুক্তি পাবেন, যখন জানবেন যে পৌরাণিক কাহিনীগুলো আসলে কী ?
পৌরাণিক কাহিনীগুলো হলো পৃথিবীর সকল ঘটনার সার সংক্ষেপ; অর্থাৎ পৃথিবীতে এমন ঘটনা ঘটে নি বা ভবিষ্যতে ঘটবে না, যেগুলো কোনো না কোনো ইঙ্গিত পুরাণে নেই। পুরাণের ঘটনাগুলো কাল্পনিক এবং এই কাল্পনিক ঘটনাগুলোর মাধ্যমে পুরাণ রচয়িতা মুনি ঋষিরা মানুষকে এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, কোন পরিস্থিতিতে কোন ব্যবস্থা নিতে হবে বা কোন ব্যবস্থা নিলে কোন পরিস্থিতিকে এড়ানো যাবে।

মানুষের জীবনে নানা ঘটনা ঘটে থাকে, এগুলোর কিছু ঘটায় ভালো মানুষেরা, কিছু ঘটায় খারাপ মানুষেরা; এভাবে জগতে মানুষ দুই প্রকার- ভালো ও খারাপ; ভালো মানুষেরা দেব বা দেবতা স্বভাবের, আর খারাপ মানুষগুলো অসুর স্বভাবের। সৃষ্টির শুরু থেকেই এই দুই শ্রেণীর মানুষ পৃথিবীতে আছে এবং সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত তা থাকবে।

গল্প-সিনেমায় যেমন নায়কের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটানোর জন্য ভিলেনদেরক দুর্ধর্ষ খারাপ হিসেবে তুলে ধরা হয়, তেমনি পৌরাণিক কাহিনীগুলোর গল্পকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং দেবতাদের ক্ষমতার প্রকাশ দেখানোর জন্য ইন্দ্রসহ কিছু চরিত্রকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন কৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের যদি শত্রুতা না থাকতো এবং কৃষ্ণ যদি ইন্দ্রের পূজা বন্ধ করতে উদ্যোগী না হতো, তাহলে কিন্তু পৃথিবীবাসী কৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বত উত্তোলনের লীলা কখনোই দেখতে পেতো না এবং মানুষ, কৃষ্ণের এই ক্ষমতার প্রদর্শন থেকে বঞ্চিত হতো; আমরা কৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বত উত্তোলনের ঘটনার কথা জানি শুধু ইন্দ্রের কারণে।

একইভাবে স্বর্গীয় বা দেব-দেবীদের কাহিনীর মধ্যে দেবরাজ ইন্দ্রকে ভিলেন হিসেবে তুলে ধরে তাকে দিয়ে নানারকম দুষ্কর্ম করানোর কারণ হচ্ছে অন্যান্য দেব-দেবীর সাথে তার দ্বন্দ্ব ঘটিয়ে সেই সব দেব-দেবীর ক্ষমতার প্রকাশ ঘটানো।

এছাড়াও ইন্দ্র কিছু খারাপ ঘটনা ঘটিয়েছে দেবতাদের ভালোর জন্যই, যেমন- গৌতমের স্ত্রী অহল্যার সাথে সেক্স, যদিও হিন্দুধর্ম বিদ্বেষীরা একে ধর্ষণ বলতেই মজা পায়. কিন্তু আসল ঘটনা হলো- গৌতম মুনি তার তপস্যার ফলে এমন শক্তি অর্জন করতে যাচ্ছিলো, যে শক্তি দিয়ে সে স্বর্গ অধিকার করতে পারতো, যদি গৌতম মুনি এটা করতে পারতো, তাহলে দেবতাদের বাসস্থান ও অস্তিত্ব বিপন্ন হতো; তাই স্বর্গের রাজা হিসেবে ইন্দ্রকে গৌতম মুনির ছদ্মবেশে ঐ ঘটনা ঘটাতে হয়, যাতে গৌতম মুনি ক্রোধিত হয় এবং ক্রোধের বশে অভিশাপ বাণী উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়, যার ফলে গৌতম মুনির ঐ তপস্যার শক্তি ব্যর্থ হয় এবং দেবতারা তাদের বাসস্থান রক্ষা করতে সমর্থ হয়। ইন্দ্রের এই দুষ্কর্ম বা কর্মের পেছনে যে সকল দেবতার সমর্থন ছিলো, তার প্রমান হলো গৌতম মুনির অভিশাপে ইন্দ্র তার পুরুষত্ব হারালে সকল দেবতা মিলে তার পুরুষত্ব আবার ফিরিয়ে দেয়। "দেবরাজ ইন্দ্রের অহল্যা ধর্ষণ! প্রকৃত ঘটনাটা কী ?" নামে আমার এক পোস্টে এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে, সেটা যারা পড়েছেন, তারা বিষয়টি জানেন, আর যারা এখনও সেটা পড়েন নি, সেটা পড়ে ঘটনার মূল কারণ জানবেন বলে আশা রাখি।

হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষীরা আরেকটা অভিযোগ করে যে, বিষ্ণু, জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দাকে ধর্ষণ করেছে; পোরাণিক কাহিনী মতে এই ঘটনাটির ডিটেইলস হলো-

শিবের মস্তকস্থিত ক্রোধ অগ্নিরূপে সমুদ্রের জলে নিক্ষিপ্ত বা পতিত হলে, তা থেকে এক পুত্রের জন্ম হয়, যাকে সমুদ্রের দেবতা লালন পালন করে বড় করে, এই পুত্রের নামই জলন্ধর। যৌবনে পদার্পন করলে জলন্ধর, শিবের স্ত্রী বলে কল্পিত পার্বতীকে কামনা করে, কিন্তু এতে যে বিপদ আছে, সেটাও জলন্ধর ভালো করেই জানতো, তাই সে প্ল্যান করে কালনেমী দানবের কন্যা বৃন্দাকে বিয়ে করে, যে বৃন্দার উপর এই বর ছিলো যে, সে যতদিন তার সতীত্বকে রক্ষা করতে পারবে, ততদিন তার স্বামীর মৃত্যু হবে না। বৃন্দাকে বিয়ের করার পর জলন্ধর যখন নিশ্চিত হলো যে কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না, তখন সে ইচ্ছে মতো দেবতা ও দানবদের উপর অত্যাচার শুরু করলো, তার এই অত্যাচার থেকে সকলকে রক্ষা করার জন্য, বিষ্ণু, জলন্ধরের রূপ ধরে বৃন্দার কাছে যায় এবং বৃন্দাকে স্পর্শ করে তার সতীত্ব নাশ করে, এর ফলেই শিব , জলন্ধরকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। বৃন্দা যখন বিষ্ণূর এই ছদ্মবেশের ঘটনা জানতে পারে, তখন সে বিষ্ণুকে পাথরে পরিণত হওয়ার অভিশাপ দেয়, যার ফলে বিষ্ণু শালগ্রাম শিলায় পরিণত হয়, যাকে নারায়ণ শিলাও বলা হয়। কিন্তু বৃন্দা যখন অন্যান্য দেবতার নিকট থেকে জলন্ধরকে হত্যার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে, তখন বৃন্দা, বিষ্ণুকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে দেয় এবং প্রাণ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বিষ্ণু, বৃন্দাকে এই আশীর্বাদ দেয় যে, তার দেহত্যাগের পর তার চিতার ছাইভস্ম থেকে এক গাছের জন্ম হবে, যার নাম হবে তুলসী, যার মধ্যে স্বয়ং তিনি অর্থাত বিষ্ণু বাস করবেন এবং গাছ রূপেই তুলসী জগতে পূজিতা হবেন; এরপর বৃন্দা নিজেকে জ্বলন্ত চিতায় আহুতি দিয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করে, যার চিতার ছাই থেকে অনেকগুলো তুলসী গাছের জন্ম হয় এবং এক বনে পরিণত হয়, যেই বনের নাম বৃন্দাবন। বৃন্দার বন বলেই আসলে কৃষ্ণের বাল্যলীলার ঐ স্থানের নাম বৃন্দাবন।

এই ভাবে দেবতারা যে দু একটি ঘটনা ঘটিয়েছে, সাধারণ দৃষ্টিতে যেগুলোকে খারাপ বলে অনেকে মনে করে, সেগুলো ঘটানোর পেছনে আসলে ছিলো কোনো মহৎ উদ্দেশ্য, সেই ব্যাপারগুলোকে না বুঝে, হিন্দুধর্ম বিদ্বেষীরা তো বটেই, আমাদের হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে মন্তব্য করে যে- ইন্দ্রের চরিত্র তো খারাপ, বিষ্ণু অমন কাজ কেনো করলো ? ইত্যাদি ইত্যাদি। আর মুসলমানরা ডাইরেক্ট বলে ইন্দ্র ও বিষ্ণু ধর্ষক, এছাড়াও তারা কোনো ক্লু পেলেই দেব-দেবীদের চরিত্রে কালিমা লেপন করতে ছাড়ে না। কিন্তু তারা এটা বোঝে না যে মুহম্মদের চরিত্রের মতো দেব-দেবীদের চরিত্র ঐতিহাসিক নয়, তাই মুহম্মদের ধর্ষণের সাথে, দেবতাদের ধর্ষণে অনেক পার্থক্য আছে। কারণ, মুহম্মদ যাদেরকে ধর্ষণ করেছে, সেগুলো বাস্তব, কিন্তু দেবতারা যাদেরকে ধর্ষণ করেছে বলে বলা হয়, সেগুলো শুধুই গল্প, সেই ঘটনাগুলো কখনোই বাস্তব পৃথিবীতে ঘটে নি; কিন্তু এই কাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে কোনো না কোনো শিক্ষা; তাই এগুলোর মূল রহস্য বুঝতে পারলে মানুষের মঙ্গল নিশ্চিত।

শুরুতেই বলেছি, পৌরাণিক কাহিনীগুলো হলো পৃথিবীর সকল ঘটনার সার সংক্ষেপ, পৃথিবীতে যেমন খুন ধর্ষণ অপহরণসহ নানা অপরাধের ঘটনা রয়েছে, তেমনি পৌরাণিক কাহিনীগুলোতেও পৃথিবীর ঘটনার প্রতীকী হিসেবে এই ঘটনাগুলো রয়েছে। কেননা, আমাদের মুনি ঋষিরা তো আর মুহম্মদের মতো মূর্খ বা অবাস্তব চিন্তাধারার মানুষ ছিলো না যে, ভালো কাজের দায় শুধু আল্লার উপর বর্তাবে, আর খারাপ কাজের দায় শয়তানের উপর? আর এই একটি তথ্যের ভিত্তিতেই যে আল্লার সর্বশক্তিমানত্ব খারিজ হয়ে যায়, সেটা মূর্খ মুসলমানেরা বুঝবে কিভাবে ? কেননা, ভালো কাজের মালিক আল্লা, আর খারাপ কাজের মালিক শয়তান হলে, আল্লা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক এবং সবকিছুর স্রষ্টা হয় না, তাহলে এই আল্লা সর্বশক্তিমান হয় কিভাবে ? কিন্তু হিন্দুর ঈশ্বর জগতের ভালো মন্দ সবকিছুকেই স্বীকার করে, এজন্যই তিনি গীতায় বলেছেন, জগতের সবকিছুই আমি বা এমন কিছু নেই যা আমি নই, দুর্যোধনও আমি আবার অর্জুনও আমি।

হিন্দুধর্ম হলো বাস্তবতার ধর্ম এবং বাস্তবতাকে স্বীকার করে বলেই হিন্দুধর্ম কোনো কিছুকেই অস্বীকার করে না। আর বাস্তবতার প্রতিফলন হলো পৌরাণিক কাহিনীগুলো, তাই পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে খুন-ধর্ষণ-অপহরণের মতো ঘটনাগুলো এসেছে, অসুররা যে খুন-ধর্ষণ-অপহরণের মতো ঘটনা ঘটাবে তাতে তো কোনো সন্দেহ বা সমস্যা নেই, কিন্তু দেবতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ইন্দ্র যখন এই ধরণের ঘটনা ঘটায় তখন, খালি চোখে কিছু প্রশ্ন তোলাই যায়, সেটা হলো- দেবরাজ ইন্দ্র এই ধরণের ঘটনা ঘটাবে কেনো ?

দেবরাজ ইন্দ্র হলো পৃথিবীর খল রাজাদের প্রতীক, যারা দেবতার মতো শক্তিশালী কিন্তু মন দুষ্টবুদ্ধিতে পূর্ণ। খল রাজারা যেমন নিজের রাজ্য বাঁচাতে অনেকে নানারকম ছলা করা করে এবং ভোগ বিলাস করতে ছাড়ে না, ইন্দ্রের চরিত্রও তেমন।

তাই পৌরাণিক দেবতাদেরকে, তাদের কিছু কর্মের জন্য, যারা তাদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে বা তাদের সমালোচনা করে; তারা আসলে হিন্দুধর্মের সামগ্রিকতাকে বুঝে না বা সেটাকে উপলব্ধি করতে পারে না; তাই তারা দেবতাদের সমালোচনা করে তাদের মূর্খতাকে প্রকাশ করে মাত্র।

আশা করছি দেব-দেবীদের গল্পগুলো যে আসলে কী এবং সেগুলো কেনো লিখা হয়েছিলো, সেই বিষয়টা আমার পাঠক বন্ধুদেরকে বোঝাতে পেরেছি, কিন্তু পুরাণগুলোতে যে অশ্লীলতা এবং উদ্ভট কাহিনী যুক্ত হয়েছে , সেটা প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে নানা জনের হাতে বিকৃতির ফল। এই বিকৃতিটা ঘটেছে এভাবে-

আগে থেকেই প্রচলিত পুরাণের কাহিনীগুলো বেদব্যাসের হাতে লিপিবদ্ধ হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশ হওয়ার পর, নানা জনের প্রয়োজনে সেই গ্রন্থগুলো কপি হতে শুরু করে, এই কাজের জন্য প্রাচীনযুগেই লিপিকার নামে একটি পেশার উদ্ভব হয়েছিলো, যাদের কাজ ছিলো- কারো প্রয়োজনে, মূল মালিকের নিকট থেকে কোনো একটি গ্রন্থ নিয়ে, সেই গ্রন্থ হাতে লিখে, নতুন একটি গ্রন্থ তৈরি করে নতুন মালিককে দেওয়া, এই কাজ তারাই করতো, যাদের হাতের লেখা ভালো ছিলো এবং যারা কিছু পড়াশোনা জানতো, এই লিপিকারদের কেউ কেউ গ্রন্থ কপি করার সময় তাতে অনেক সময় কিছু তথ্য সংযোজন বিয়োজন করতো, যার খবর জানতো না গ্রন্থের পুরাতন বা নতুন মালিকদের কেউই। এই বিকৃত গ্রন্থ থেকে পরে আরো কপি হতো এবং তা থেকে আরো, এভাবে গ্রন্থের বিকৃতি ঘটেছে ভারতে ইংরেজ আগমনের পর ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে, এজন্যই গনেশের মাথা কাটার ঘটনা আপনি যতগুলো পুরাণে পাবেন, দেখবেন সবগুলোই ভিন্ন কাহিনী। তাই পুরাণের অশ্লীল এবং উদ্ভটকাহিনী নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কিছু নেই; কারণ, সেগুলো সনাতন ধর্মের অংশ নয়, সেগুলো পুরাণ বিকৃতির ফসল।

আশা করছি বিষয়টি আমার বন্ধুদেরকে বোঝাতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment