Tuesday, 2 June 2020

স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পুনর্জন্মে শ্রাদ্ধের ভূমিকা কী ?


স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পুনর্জন্মে শ্রাদ্ধের ভূমিকা কী ?

গীতার ১/৪১ এবং গীতা মাহাত্ম্যের ৬৩ ও ৬৪ নং শ্লোক অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ না করলে সে স্বর্গে যেতে পারে না, সরাসরি নরকে পতিত হয়। একটি প্রবন্ধে আমি এই কথা বলার পর #Arjun_Das প্রশ্ন তুলেছে- মৃত্যুর পর তো আত্মা কর্মফল অনুযায়ী জন্মগ্রহন করে, তাহলে শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা কী, আর শ্রাদ্ধ করলেই যদি স্বর্গে যায়, তাহলে কর্মফলের ভূমিকা কী ?

#Arjun_Das,

কোনো মৃত ব্যক্তি পৃথিবীতে তার যে বংশধর রেখে যায়, সেটাও তার কর্ম এবং তারা যে আচরণ করে, তাদের সেই কর্মের ফল তাকেও ভোগ করতে হয়। এজন্য পৃথিবীতে পূর্ণ আয়ু ভোগ করে যাওয়া কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর সাথে সাথেই স্বর্গে বা নরকে যায় না, মৃত্যুর পর প্রথমে যায় যমরাজের অধীন পিতৃলোকে, সেখানে সে পৃথিবীতে তার রেখে যাওয়া বংশধরদের তৃতীয় প্রজন্মের কোনো একব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সেই তৃতীয় প্রজন্মের কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে পিতৃলোকে অবস্থিত সিনিয়র আত্মাটি মুক্ত হয়ে তার নিজের এবং তার পরবর্তী তিন প্রজন্মের বংশধরদের কর্মফলের ভিত্তিতে সে স্বর্গে বা নরকে যায় এবং স্বর্গ-নরক ভোগ শেষে সামগ্রিক কর্মফলের ভিত্তিতে পুনরায় পৃথিবীতে জন্ম গ্রহন করে।

বিষয়টি সহজ করে বোঝানোর জন্য কিছু কল্পিত নামের আশ্রয় নিচ্ছি। ধরা যাক- কোনো এক ব্যক্তির নাম A, তার ছেলের নাম B, B এর ছেলের নাম C, C এর ছেলের নাম D। এখন A মারা যাওয়ার সাথে সাথে তার কর্মফল অনুযায়ী সে স্বর্গে বা নরকে যাবে না। পৃথিবীতে তার তৃতীয় বংশধর D মারা যাওয়া পর্যন্ত সে পিতৃলোকে অবস্থান করবে, যখন D মারা যাবে, তখন A, পিতৃলোক থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের এবং B,C,D এর কর্মফল অনুযায়ী স্বর্গে বা নরকে যাবে এবং তার স্বর্গ বা নরক ভোগ শেষে নিজের এবং পৃথিবীতে তার রেখে যাওয়া তিন পুরুষের কর্মফল অনুযায়ী সে পৃথিবীতে পরের বার জন্ম লাভ করবে। এজন্য গীতা মাহাত্ম্যের ৬৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে- 'শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে গীতা পাঠের ফলে পিতা সন্তুষ্ট হন এবং পুত্রগণকে আশীর্বাদ করিতে করিতে পিতৃলোকে চলিয়া যান।' এই তথ্য থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট যে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ না করা পর্যন্ত তার আত্মা পৃথিবী থেকে মুক্তি পায় না; ক্ষুধায় আত্মা যাতে কষ্ট না পায়, সেজন্যই শ্রাদ্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিদিন তাকে পিণ্ড প্রদান করতে হয়।

কোনো মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে যদি বিধি মোতাবেক শ্রাদ্ধ করা না হয়, তাহলে তার পিতৃলোকে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, সে সরাসরি নরকে যাবে এবং নরক ভোগ শেষে তার নিজের এবং তার বংশধরদের কর্মফল অনুযায়ী পরের বার জন্ম নিয়ে সে কর্মফল ভোগ করবে। কিন্তু শ্রাদ্ধ করার ফলে পিতৃলোকের মাধ্যমে নরকে গেলেও, পৃথিবীতে তার বংশধরগণ যদি তাদের স্মরণে প্রতিবছর তাদের মৃত্যু তিথিতে গীতা পাঠ করে এবং লোকজনকে অন্ন-জল সেবা দেয়, যা প্রথম বছরের শ্রাদ্ধের ন্যায় তুল্য ক্রিয়া-কর্ম, তাহলেও নরকে পতিত পিতৃপুরুষ স্বর্গে স্থান পেতে পারে, যে কথা বলা হয়েছে গীতা মাহাত্ম্যের ৬৩ নং শ্লোকে, এভাবে- "পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধে যিনি গীতা পাঠ করেন, তাঁহার পূর্বপুরুষগণ অতীব সন্তুষ্ট হইয়া নরক হইতে উদ্ধার পাইয়া স্বর্গে গমন করেন।"

তার মানে কোনো ব্যক্তির শুধু নিজের কর্মফল দ্বারা স্বর্গ ভোগ বা পরের জন্মে ভালো ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেওয়া সম্ভব নয়, পৃথিবীতে তার রেখে যাওয়া বংশধরদের কর্মও তাদেরকে ভোগ করতে হবে। এজন্য সন্তানকে সুশিক্ষার সাথে সাথে প্রকৃত সনাতন ধর্মীয় শিক্ষাও প্রদান করতে হবে, যাতে তারা গর্বিত সনাতনী হিসেবে জীবনকে অতিবাহিত করে; কারণ, ধর্ম শিক্ষার অভাবে বংশের কোনো একজন যদি সনাতন ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য কোনো মতবাদে দীক্ষিত হয়, সেই বংশের পূর্বপুরুষদের নরক বাস নিশ্চিত; কারণ, সে তার বংশধরদেরকে সুশিক্ষা প্রদান না করেই মারা গেছে, যার কারণে তার বংশ থেকে শ্রাদ্ধ তর্পন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যে কথা বলা হয়েছে, গীতার ১/৪১ নং শ্লোকে, এভাবে- 'কূলনাশকারীরা কূলের নরকের কারণ হয়, শ্রাদ্ধ তর্পনাদি লোপ পাওয়া তাহাদের পিতৃগপুরুষগণও নরকে পতিত হয়।'

তাই শুধু মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ করলেই সে স্বর্গে যাবে না, তবে শ্রাদ্ধ, স্বর্গে যাবার অনেকগুলো শর্তের মধ্যে একটি শর্ত। শ্রাদ্ধ করলে মৃতব্যক্তি প্রথমে পিতৃলোকে যাবে, পিতৃলোক থেকে স্বর্গে যাবার চান্স আছে, কিন্তু শ্রাদ্ধ না করলে মৃত ব্যক্তি পিতৃলোকেও যাবে না, সরাসরি যাবে নরকে। আবার শ্রাদ্ধ করে পিতৃলোকে যাবার পর নরকে গেলেও পৃথিবীতে তার রেখে যাওয়া বংশধরেরা যদি সৎকর্মের মাধ্যমে সনাতনধর্ম মতে জীবন যাপন করে, পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর গীতা পাঠ বা তর্পন করে, যেটা প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে পিতৃপক্ষে করতে হয়, তাহলেও নরকে পতিত পিতৃপুরুষগণের স্বর্গে যাবার চান্স আছে।

সনাতন ধর্ম মতে, যেকোনো ব্যক্তি, তার পরবর্তী তিন প্রজন্ম পর্যন্ত তাদের সুকর্ম এবং কুকর্মের জন্য দায়ী। এজন্য সন্তানদেরকে ধর্মের মাধ্যমে সুশিক্ষা দেওয়া খুবই জরুরী। নিজের শ্রাদ্ধ যেহেতু নিজে করা যায় না, তাই শ্রাদ্ধ হলো বংশধরদের কর্ম, যে কর্মের ফল মৃত ব্যক্তি ভোগ করে; তাই যেকোনো আত্মা শুধু তার নিজের কর্মফল অনুযায়ী পরের বার জন্ম লাভ করে না, এতে তার বংশধরদের কর্মও জড়িত, যার সাথে জড়িত তাদের কৃত শ্রাদ্ধও।
আবার শুধু বংশধরদের দ্বারা কৃত শ্রাদ্ধ দ্বারাই কেউ স্বর্গ লাভ করতে পারে না, আগেই বলেছি, বংশধরদের দ্বারা কৃত শ্রাদ্ধ, স্বর্গ প্রাপ্তির অনেকগুলো শর্তের মধ্যে একটি; যেমন পরীক্ষায় পাস করার প্রথম শর্ত হলো- পরীক্ষায় বসা। কেউ নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে যদি পরীক্ষায় না বসে, সারা বছর দিন রাত পড়াশোনা করে, পরীক্ষার জন্য ফর্মফিলাপ করেও কোনো লাভ নেই, কারণ সে পরীক্ষায় পাস করার প্রথম শর্ত পরীক্ষাতেই বসে নি। তেমনি স্বর্গ প্রাপ্তির প্রথম শর্ত, বংশধরদের দ্বারা কৃত শ্রাদ্ধ, এর সাথে নিজের কর্মফল তো অবশ্যই জড়িত।

আশা করছি- উপরের আলোচনা থেকে অর্জুন দাস তার প্রশ্নের জবাব পেয়েছে এবং অর্জুন দাসের সৌজন্যে আমার অনেক সনাতনী বন্ধু জন্ম-মৃত্যু চক্রের একটি গোপন ও জটিল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পেরেছে, যা তাদেরকে সনাতনী জীবন সঠিকভাবে যাপন করতে সাহায্য করবে এবং এই বিষয়টি স্মরণে রেখে সন্তানদেরকে সঠিক সনাতনী শিক্ষা প্রদান করবে, যাতে তারা সনাতন ধর্ম থেকে বিচ্যুত না হয়।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment