Friday, 8 May 2020

রাধা আছে, রাধা নাই :

রাধা আছে, রাধা নাই : আমি একটা পোস্ট লিখে এটা প্রমান করার চেষ্টা করেছি যে যৌবনবতী রাধার সাথে কৃষ্ণের যে প্রেমের কথা বলা হয় সেটা আসলে একটা কল্পকাহিনী। কিন্তু প্রাচীন কোনো প্রামান্য গ্রন্থে রাধার কোনো উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও যেহেতু রাধার জন্মস্থান বৃন্দাবনে রাধাকে নিয়ে নানা স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং তাকে নিয়ে নানা গল্প কাহিনী প্রচলিত আছে, সেই সূত্রে সেই পোস্টে আমি এটাও বলেছিলাম যে, কৃষ্ণের বাল্যকালে কৃষ্ণের খেলার সাথীদের মধ্যে রাধা বলে কেউ থেকে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু গোকূল-বৃন্দাবন ছেড়ে কৃষ্ণের চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণ যেহেতু কখনও কারো টানে আর বৃন্দাবনে যায় নি এবং কৃষ্ণের পরবর্তী ১১৫ বছরের জীবনে রাধার যেহেতু আর কোনো ভূমিকা নেই, সেহেতু কৃষ্ণের প্রামান্য জীবনীতে রাধার কোনো উল্লেখ হয় নি। যেমন গরীবের ছেলে নরেন্দ্র মোদী আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ভারত সম্রাট; যার ভূমিকা এখন প্রায় বিশ্বনেতার পর্যায়ে উন্নীত; সেই নরেন্দ্র মোদীর জীবনী লিখতে গিয়ে, নরেন্দ্র মোদী ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ার সময় কাদের সাথে পড়তো আর কাদের সাথে খেলা-ধূলা করতো সেটা উল্লেখ করার কি কোনো প্রয়োজন আছে ? রাধা থাকলেও কৃষ্ণের জীবন কাহিনী লেখার সময় ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু আমার ঐ পোস্ট পড়ে Ashok Dev নামের একজন আমাকে বলে রাধার অস্তিত্ব আছে, আমি ইনবক্সে তাকে বেশি কথা না বলে শুধু বলি তুমি রাধার অস্তিত্ব প্রমান করে একটা পোস্ট লিখে পোস্ট করো। অশোক দেব সেই পোস্ট লিখে তার টাইম লাইনে পোস্ট করেছিলো, খবর পেয়ে সেই পোস্টটি পড়েছিলাম, সেই পোস্টটি যদি এখানে হুবহু কপি পেস্ট করি, তাহলে সেটা পড়তে আপনাদের বিরক্তি আসতে পারে, তাই তার গল্পটি আমি আমার মতো করে বলছি, তার পোস্টটি হুবহু পাবেন আমার এই লেখার সাথে ফটো পোস্ট হিসেবে, প্রয়োজন মনে করলে সেখান থেকে তার সেই গল্পটি পড়ে দেখে নিতে পারেন যে তার গল্পটি বলার সময় আমি কোথাও কোনো বিকৃতি করেছি কিনা। যা হোক, অশোক দেব এর গল্পটি হলো – “রামের লঙ্কা অভিযানের সময়, ত্রেতাযুগে, নাগলোকে নাগরাজার কন্যা ছিলো চন্দ্রসেনা। এই চন্দ্রসেনা ভালোবাসতো রামকে। সেই সময় পাতাল পতি ছিলো দুই ভাই অহিরাবন ও মহীরাবন। এই দুই ভাই মিলে নাগরাজ্য দখল করে এবং নাগকন্যা চন্দ্রসেনাকে ধরে নিয়ে এসে বিয়ে করার চেষ্টা করে। এরপর রাম যখন সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় যাওয়ার চেষ্টা করছিলো, তখন রাবন তার অনুগত, অহিরাবন ও মহীরাবনকে তলব ক’রে রাম লক্ষ্মনকে হত্যার নির্দেশ দেয়। অহিরাবন তার মন্ত্রের শক্তি দ্বারা পাতাল থেকে রামের শিবিরে রামের ঘর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং মন্ত্রের শক্তিতে রাম লক্ষ্মণ ক’রে অজ্ঞান করে পাতালে নিয়ে যায়। হনুমান যখন বুঝতে পারে যে রাম লক্ষ্মণকে অপহরণ করা হয়েছে, তখন সেই সুড়ঙ্গ পথেই হনুমান পাতালে নেমে যায় এবং দুই নারীর কথাবার্তা আড়ালে থেকে শুনে বুঝতে পারে যে রাম লক্ষ্মণকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। হনুমান সেখানে পোঁছে যায় এবং রাম লক্ষ্মণকে উদ্ধার করে। সেই সময় সেখানে অহিরাবন ও মহীরাবন এসে উপস্থিত হয় এবং তাদের সাথে রাম লক্ষ্মণের যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু যতবারই তাদের হাতে অহিরাবণ ও মহীরাবন মরে ততবারই তারা জীবিত হয়ে উঠে। এই রহস্য জানার জন্য হনুমান সেই নারীর কাছে যায়, যার কথা আড়াল থেকে শুনে হনুমান রাম লক্ষ্মণকে খুজেঁ বের করেছিলো। তার কাছে হনুমান জিজ্ঞেস করে, কিভাবে অহিরাবন ও মহীরাবন মরবে ? মহিলাটি বলে, কেনো বলবো ? বললে আমি কী পাবো ? হনুমান বলে, তুমি কী চাও ? নারীটি বলে, যুদ্ধ শেষে তুমি তোমার প্রভুকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আমি উনাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি, আমি উনাকে চাই। হনুমান কাজ উদ্ধারের জন্য রাজী হলে নারীটি বলে, সঞ্জীবণী ভ্রমর, অমৃত এনে উনাদের ক্ষত স্থানে দিলে উনারা জীবিত হয়ে যায়। তুমি যদি ঐ ভ্রমরদের আসা বন্ধ করতে পারো তাহলেই অহিরাবন ও মহীরাবন মারা যাবে। এরপর হনুমান ভ্রমরদেরকে মারা শুরু করলে, ভ্রমররা আর অমৃত এনে তাদেরকে বাঁচাবে না এবং ভ্রমররা গিয়ে ঐ নারীর ঘরের খাটের কাঠ খেয়ে ঘোগলা করবে, এই শর্তে হনুমান ভ্রমরদেরকে ছেড়ে দেয়। এরপর যুদ্ধে মহিরাবন ও অহীরাবণ পরাজিত ও নিহত হলে হনুমান তার প্রতিশ্রুতি মতো রামকে নিয়ে চন্দ্রসেনা নামের ঐ নারীর ঘরে এলে চন্দ্রসেনা রামকে তার বিছানায় বসতে বলে, রাম বসা মাত্র খাট ভেঙ্গে পড়লে রাম ক্ষেপে যায় এবং চন্দ্রসেনা রামের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে, প্রভু, আমার এই অশুচি দেহ আপনাকে আমি সমর্পন করতে যাচ্ছিলাম, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি। সব শুনে রাম বলে আমি সীতার স্বামী, এই জন্মে আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারবো না, পরজন্মে আমি যখন কৃষ্ণ হয়ে জন্ম নেবো, তখন তুমি রাধা হয়ে জন্ম নেবে, সেই জন্মে আমি তোমার প্রেমের প্রতিদান দেবো এবং আমাদের যুগল রূপকে পৃথিবীর লোকজন পৃথিবীর অন্তিম কাল পর্যন্ত পূজা করবে। এইভাবে কৃষ্ণের সময়ে নাগকন্য চন্দ্রসেনার রাধা রূপে জন্ম হয় এবং কৃষ্ণ তার সাথে লীলা করে।” এই গল্প কোথা থেকে কিভাবে এলো, সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবেন। তার আগে যে গল্পের উপর ভিত্তি করে অশোক দেব রাধার অস্তিত্বকে প্রমান করার চেষ্টা করেছে, সেই গল্পের পোস্টমর্টেমটা করে নিই। গল্পের প্লট- লঙ্কা, সমুদ্রের এপারের ভারত এবং পাতাল। লঙ্কা এবং ভারত এখনও আছে কিন্তু পাতালটা কোথায় ? চন্দ্রসেনা রামকে ভালোবাসতো, সেই রাম তার প্রাসাদে বন্দী অবস্থায়, কিন্তু তাতে চন্দ্রসেনার মধ্যে কোনো উদ্বেগ তো নেই ই, উল্টো হনুমান যখন তার কাছে সাহায্য চায়, তখন চন্দ্রসেনা নাটক করে বলে, কেনো বলবো, বললে আমি কী পাবো ? কোনো মেয়ে কি তার পছন্দের মানুষের প্রাণ বাঁচাতে বা তাকে সাহায্য করতে এরকম ন্যাকামী করতে পারে ? শেষ পর্যন্ত হনুমান যখন রামকে নিয়ে চন্দ্রসেনার ঘরে যায় এবং বসতে গিয়ে রাম খাট ভেঙ্গে পড়ে যায়, তখন চন্দ্রসেনা রামের কাছ ক্ষমা চেয়ে বলে, আমি আমার অশুচি দেহ আপনাকে সমর্পন করতে যাচ্ছিলাম, আমাকে ক্ষমা করুন। খাট ভাঙার সাথে অশুচি দেহ সমর্পনের সম্পর্ক কী ? খাট তো ভাঙতেই পারে, আর এর জন্য রাম ক্ষেপেই বা উঠবে কেনো, রাম কি অবুঝ ছেলে ? সর্বোপরি চন্দ্রসেনার আচরণ এখানে একজন যৌনকর্মীর মতো এবং রাম তার কাস্টমার, রামকে নিয়ে এই রকম দৃশ্য যে রচনা করতে পারে সে- রাম নাম জপ ক’রে পাপ থেকে মুক্ত হওয়া মুনি বাল্মিকী, না অন্য কেউ ? চন্দ্রসেনা বলেছে, সঞ্জিবণী ভ্রমররা অমৃত এনে তাদের ক্ষত স্থানে দিলে তারা পুনরায় জীবিত হয়ে উঠে, ভ্রমরদের এই অমৃত এনে দেওয়ার দৃশ্যটা যুদ্ধের সময় রাম, লক্ষ্মণ এবং হনুমান দেখতে পেলো না কেনো ? ভ্রমররা কি অদৃশ্য ছিলো ? যদি অদৃশ্যই থাকে তাহলে পরে হনুমান তাদেরকে মারতে পারলো কিভাবে ? যা হোক, শেষ পর্যন্ত রাম, চন্দ্রসেনাকে এই কথা দেয় যে পরজন্মে কৃষ্ণ হয়ে জন্ম নিয়ে সে তার প্রেমের প্রতিদান দেবে। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে দেখা যাক রাম কাকে কাকে কী কী প্রতিশ্রতি দিয়েছিলো, সেগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত হলো, আর রাধার জন্যই বা সে কতটুকু করলো ? রাম, বালিকে ভুল সিস্টেমে আড়াল থেকে তীর মেরে হত্যা করেছিলো বলে, সে বালির পুত্র অঙ্গদকে কথা দেয় পরবর্তী জন্মে তারও আড়াল থেকে নিক্ষেপ করা তীর তার মৃত্যুর কারণ হবে। ঘটনা ঘটেছেও তাই। জিরু নামক এক ব্যাধ, যে ছিলো পূর্ব জন্মে বালির পুত্র অঙ্গদ, সে বনে শিকার করতে গিয়ে দেখে সুন্দর একটি পাখি, আড়াল থেকে তীর মারার পর পাখির কাছে এসে দেখে সেটা পাখি নয়, একজন মানুষ; কৃষ্ণ তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে পূর্বের সব ঘটনা খুলে বলে এবং বনের মধ্যে অবস্থিত বিষ্ণুর মন্দিরে গিয়ে মূর্তির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এভাবে রাম, কৃষ্ণ রূপে তার আগের জন্মের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ণ ঘটায়। মহাভারতে, পাণ্ডবদের বনবাসকালে, একদিন বনের মধ্যে দ্রৌপদী ও যুধিষ্ঠিরের কুঠিরে এসে উপস্থিত হয় দুর্বাসা ঋষি তার অসংখ্য শিষ্য নিয়ে। বলে, আমাদের খেতে দাও। তারা বলে, ঘরে আমাদের তেমন কিছু নেই। ক্ষেপে গিয়ে ঋষি বলে, গৃহী হয়েছো আর সন্ন্যসীদের সেবা দিতে পারো না ? এরকম নানা কথা বললে, দ্রৌপদী ও যুধিষ্ঠির তাদেরকে শান্ত করার জন্য বসতে বলে এবং খাবারের অনুসন্ধান করতে থাকে; কিন্তু ঘরে তো কোনো খাবার নেই। এমন সময় সেখানে কৃষ্ণ উপস্থিত হয় এবং দেখে সব সন্ন্যাসী পাতা পেরে নিয়ে খাবারের জন্য বসে অপেক্ষা করছে। কৃষ্ণ তো জানেই ঘরে কিছু নেই। তারপরও সে বলে, দেখি ভাতের হাঁড়িতে কোনো ভাত অবশিষ্ট আছে কিনা ? এই বলে দ্রৌপদীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৃষ্ণ ভাতের হাঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় এবং দেখে একটি মাত্র ভাত অবশিষ্ট আছে, কৃষ্ণ সেটা খায় এবং সাথে সাথে সব সাধু-সন্ন্যাসীর পেট ভরে যায়। এই গল্প এখানে এই শিক্ষার জন্য বললাম যে, দ্রৌপদী ছিলো কৃষ্ণের একান্ত অনুগত, তাই দ্রৌপদীর বিপদ টের পেয়েই কৃষ্ণ সাথে সাথে তার কাছে উপস্থিত হয়েছে, সুতরাং আমরাও কৃষ্ণের অনুগত হলে বিপদে তার সাহায্য পাবো এবং কৃষ্ণের একটি মাত্র ভাত খেয়ে সবার পেট ভরানোর মানে হলো, কৃষ্ণকে নিবেদন করে খেলে সাধু-সন্ন্যাসীর ভরা পেটের মতো আমাদেরও ধানের গোলা ভরা থাকবে, এক কথায় কোনো অভাব অভিযোগ থাকবে না। দ্রৌপদী কিন্তু কৃষ্ণের প্রেমিকা নয়, শুধু ভক্ত; তারপরও দ্রৌপদীর প্রতি কৃষ্ণের কতটা খেয়াল সেটা একটু লক্ষ্য করুন। একদিন কোনো একটি কারণে কৃষ্ণের হাতের একটি আঙ্গুল কেটে যায়, দ্রৌপদী তার শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের আঙ্গুল বেঁধে দেয়। দ্রৌপদীকে যখন হস্তিনাপুরের রাজসভায় বিবস্ত্র করা হচ্ছিলো, কোনো উপায় না দেখে দ্রৌপদী শুধু, গোবিন্দ আমাকে রক্ষা করো, ব’লে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো। কৃষ্ণ তখন কোনো একটা যুদ্ধের জন্য ছিলো হস্তিনাপুর থেকে বহু দূরে। দ্রৌপদীর সেই প্রার্থনা শুনে কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে এত বড় শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলো যে, দুঃশাসন সেই শাড়ি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। কৃষ্ণ এটা করেছিলো, দ্রৌপদী যে একদিন তার শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের আঙ্গুল বেঁধে দিয়েছিলো, তার প্রতিদান হিসেবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী এটা বুঝতে পেরেও কৃষ্ণ শান্তি স্থাপনের জন্য একদিন হস্তিনাপুরের রাজসভায় যায় এবং বলে যুদ্ধ হবে না যদি দুর্যোধন পাণ্ডবদেরকে মাত্র ৫ টি গ্রামের অধিকার দেয়। এটা শোনার পরই দুর্যোধন বলেছিলো তার সেই বিখ্যাত সংলাপ, “বিনা যুদ্ধ নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী।” মানে হলো যুদ্ধে পরাজিত হওয়া ছাড়া সূচের মাথার পরিমান আয়তনের মাটিও দুর্যোধন পাণ্ডবদেরকে দেবে না। শুধু তাই নয়, শকুনি ও দুর্যোধনের ধারণা ছিলো কৃষ্ণকে বন্দী করে রাখতে পারলে পাণ্ডবরা যুদ্ধে হারবেই। তাই আগে থেকেই কৃষ্ণকে বন্দী করার প্ল্যান তারা করে রেখেছিলো এবং শেষ পর্যন্ত বিরাট লোহার শিকল দিয়ে কৃষ্ণকে বন্দী করে নিয়ে যেতে যেতে, ‘আয় গোয়ালা’ ব’লে কৃষ্ণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে করতে কারাগারে ঢোকানোর পর দুর্যোধন দেখে সেখানে কৃষ্ণ নেই, কৃষ্ণের বদলে দুঃশাসন। কৃষ্ণ এভাবে হস্তিনাপুরের রাজসভায় অপমানিত হওয়ার পর নিজের মায়ার বলে মুক্ত হয়ে এলেও, যুদ্ধে, সেই দুর্যোধনকেই তার নারায়নী সেনা দিয়ে দিয়েছিলো। কৃষ্ণের নিরপেক্ষতা কতটা, সেটা একবার চিন্তা করুন। উপরে উল্লেখ করা তিনটি ঘটনার কথা স্মরণ করুন আর ভাবুন, ত্রেতাযুগে রাম হিসেবে সে যদি চন্দ্রসেনা নামের কোনো নারীকে পরজন্মে কৃষ্ণ হিসেবে জন্ম নিয়ে তার প্রেমের প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তাহলে সে কি তা দিতো না ? এরকম কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে কৃষ্ণ কি ১০ বছর ২ মাস বয়সে রাধাকে ছেড়ে চলে যেতো ? কর্ম ও দায়িত্ব পালনের জন্য যে কেউ যেকোনো জায়গায় যেতে পারে তাতে কোনো প্রব্লেম নেই, কিন্তু কৃষ্ণ কি আবার কোনো এক সময় বৃন্দাবনে রাধাকে দেখার জন্য যেতে পারতো না ? কৃষ্ণ কি তা গিয়েছে ? কৃষ্ণ যদি রাম হিসেবে চন্দ্রসেনাকে কথা দিয়েই থাকে, তাহলে সে রাধাকে বাদ দিয়ে রুক্মিনীকে বিয়ে করলো কেনো ? এসব ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, চন্দ্রসেনা নামে কাউকে কেউ কোনো প্রতিশ্রুতি দেয় নি আর কৃষ্ণের ছোটবেলার খেলার সাথীদের মধ্যে রাধা নামের কেউ কৃষ্ণের উপর এতটা প্রভাব ফেলতে পারে নি যে, যার জন্য কৃষ্ণকে বড় হয়ে তার জন্য কিছু ভাবতে যাবে। তাই কৃষ্ণ, রাধা নামের কারো জন্য কিছু ভাবে নি। আমার তো এখন এই সন্দেহ হচ্ছে যে, রাধা বলে যে কোনো মেয়ে কোনোদিন কোথাও ছিলো বা আছে, কৃষ্ণ সেই তথ্যটাও জানতো কি না ? জানলে নিশ্চয় তাকে দ্বারকায় নিয়ে যেতো, সারাজীবন রাধাকে কৃ্ষ্ণের বিরহে পুড়তে হতো না। অশোক দেব এর সৌজন্যে যে গল্পটি আপনাদের শোনালাম, এখন দেখা যাক সেই গল্পটি কৃত্তিবাস ওঝা, তার রামায়ণে কিভাবে বলেছে : গল্পের বিষয়বস্তু তো আপনারা জেনেছেন ই, এখন আমি শুধু অশোক দেব আর কৃত্তিবাসের গল্পের মধ্যের পার্থক্যটুকু ধরিয়ে দিচ্ছি। অশোক দেব বলেছে, অহিরাবণ ও মহীরাবন দুই ভাই, কিন্তু কৃত্তিবাসের মতে এরা পিতা পুত্র। অশোক দেব পাতাল নিবাসী এই দুইজনের সাথে রাবনের কোনো সম্পর্কের কথা বলে নি, কিন্তু কৃত্তিবাস বলছে, মহিরাবন, রাবনের মানসপুত্র। হিন্দু শাস্ত্রে মানসপুত্র শুধু ব্রহ্মারই আছে, কিন্তু কৃত্তিবাস রাবনেরও মানসপুত্র বানিয়ে দিয়েছে। অশোক দেব যে চন্দ্রসেনার কথা বলেছে, কৃত্তিবাসে তার উল্লেখই নাই। অশোক দেব এর গল্পে মহিরাবন, রামকে অপহরণ করে সমুদ্রের এপারে ভারতের অংশ থেকে, কিন্তু কৃত্তিবাসের গল্পে রাম তখন অলরেডি লঙ্কায় এবং রামের সকল পুত্রকে যুদ্ধে হত্যা করে ফেলেছে। এটা ছাড়া রাম লক্ষ্মণকে পাতালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অশোক দেব যা বলেছে, তা কৃত্তিবাসও বলেছে। তারপরে কৃত্তিবাসের বর্ণনা এরকম- সুড়ঙ্গ অনুসরণ করে হনুমান মহিরাবনের মন্দিরে চলে যায় এবং সেখানে রাম লক্ষ্মণকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পেয়ে দেবী পাতাল ভৈরবীর মূর্তির পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। এরপর মহিরাবন সেখানে আসে এবং রাম লক্ষ্মণকে দেবীর কাছে বলি হওয়ার আদেশ দিয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে হাড়িকাঠে মাথা রাখতে বললে- রাম বলে, “আমরা তো রাজপুত্র, কোনোদিন কাউকে প্রণাম করি নি, সবাই আমাদেরকেই প্রণাম করতো, তাই কিভাবে প্রণাম করতে হয় সেটা আমরা জানি না, তুমি শিখিয়ে দাও।” মহিরাবন বলে, “এই কথা, দাঁড়াও শিখিয়ে দিচ্ছি,” এই ব’লে মহিরাবন যেই প্রণামের ভঙ্গিতে হাড়িকাঠে মাথা রেখেছ, অমনি হনুমান মূর্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে হাড়িকাঠের শিক আটকে দিয়ে এক কোপে মহিরাবনের গলা কেটে ফেলেছে। মহিরাবন শেষ। এরপর অহিরাবন সহ অন্যান্যরা এলে তাদেরকেও রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমান মেরে সাফ করে দেয়। মূল গল্প মোটামুটি এটাই। এরপর কৃত্তিবাস মৎস্য কন্যা বলে হনুমানের এক স্ত্রীর এবং মকরধ্বজ নামে এক পুত্রের আবির্ভাব ঘটায়, যে পুত্রের হাতে পাতাল শাসনের ভার দিয়ে রাম-লক্ষ্মন-হনুমান ফিরে আসে; অশোক দেব এর গল্পে হনুমানের এই স্ত্রী পুত্রের কোনো কথা নেই, আবার কৃত্তিবাসের গল্পেও সঞ্জিবনি ভ্রমর, অমৃত, চন্দ্রসেনার খাট ভাঙ্গার গল্পের কিছুই নেই। এখানে রামের মুখে বলানো-“আমরা তো রাজপুত্র, কোনোদিন কাউকে প্রণাম করি নি, সবাই আমাদেরকেই প্রণাম করতো, তাই কিভাবে প্রণাম করতে হয় সেটা আমরা জানি না, তুমি শিখিয়ে দাও”- এটা পড়ার পর আমার মনে হলো, এ্যাডাল্ট সিনেমাগুলোতে যেমন সতর্কবাণী থাকে যে প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচের কারো দেখা নিষেধ, তেমনি কৃত্তিবাসের রামায়ণের উপর লিখে দেওয়া দরকার যে, “ছোটদের রামায়ণ, ১০ বছরের উর্ধ্বের কেউ পড়বেন না।” কারণ কেচ্ছার মতো ঐ গল্প বড়দের জন্য নয়, শিশুদের জন্যই মানায় ভালো। বিয়ে শাদী করা প্রাপ্ত বয়স্ক একজন লোক বলছে যে, ‘প্রণাম কিভাবে করতে হয় আমরা জানি না’, আর সেটা আরেক প্রাপ্ত বয়স্ক রাজা বিশ্বাস করছে, কৃত্তিবাস এখন বেঁচে থাকলে এসব লেখার জন্য পাবলিকের মার খেয়ে হাত পা ভেঙ্গে ওকে হসপিটালে ভর্তি হতে হতো। যা হোক কৃত্তিবাস তো এক প্রকার ছেলে ভুলানো রামায়ন লিখে হিন্দু সমাজের মহা উপকার করে গেছে! কিন্তু কৃত্তিবাসের চেয়ে এককদম এগিয়ে গিয়ে অশোক দেব এর “চন্দ্রসেনা ও খাট ভাঙ্গার রামায়ণ” কে লিখলো, সেটা আমার কাছে এক মহা চিন্তার বিষয়; কারণ, এত আবর্জনা সাফ করবো কিভাবে, কখন ? অশোক দেব এর মতো অনেকেরই হয়তো জানা নাও থাকতে পারে যে, কৃত্তিবাস, রামায়ণ অনুবাদ করার সময় মূল রামায়ণ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে যা খুশি তাই রামায়নের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে রামের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে। শুধু অহিরাবণ মহীরাবনের পাতালের ঘটনাই নয়, বীরবাহুর বীরত্ব ও যুদ্ধ, তরণীসেনের কাহিনী, রামের অকাল বোধন বা দুর্গা পূজা, হনুমান কর্তৃক রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ, সীতার রাবণমূর্তি অঙ্কন, মৃত্যুপথযাত্রী রাবণের কাছে রামের শিক্ষা, লব ও কুশের যুদ্ধ সব কৃত্তিবাসের বানানো, এগুলোর একটিও সংস্কৃত রামায়ণে নেই। এভাবে কৃত্তিবাসের রাম ত্রেতাযুগের কোনো ত্রাতা নয়, বিষ্ণুর কোনো অবতার নয়, এক পিতৃপরায়ণ সন্তান, স্নেহপরায়ণ পিতা এবং একই সঙ্গে দ্বিধাগ্রস্ত ও সন্দেহে পর্যুদস্ত এক স্বামী । এ থেকে খুব সহজেই উপলবব্ধিকরা যায় যে, কৃত্তিবাস রামায়ণ ‘অনুবাদ’কালে বাল্মীকির প্রধান প্রধান কয়েকটি আখ্যান ও উপাখ্যান গ্রহণ করলেও সেগুলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রচনার শুরু থেকেই অগাধ স্বাধীনতা নিয়েছে এবং নিজের প্রয়োজনে বাল্মীকি থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে নিজের ইচ্ছা মতো যা খুশি তাই লিখেছে। কৃত্তিবাসের এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবকে বুঝতে পেরেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃত্তিবাসের উদ্দেশ্য রচনা করেছিলেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যাহা তাহা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি, রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ অর্থাৎ কবিগুরু এখানে বলেছে, কবিরা যা লিখবে সেটাই সত্য, কবির মনে যা আসবে, সে যদি অযোধ্যা কোনোদিন নাও যায়, রামের সম্পর্কে সে যা লিখবে তাই সত্য হয়ে যাবে। কিন্তু কবিগরুও হয়তো ভাবতে পারে নি যে, কবিদের সেই দিন আর চিরদিন থাকবে না, আমরা একদিন তাদের লুকানো মিথ্যেগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে বের করবো। হিন্দু ধর্মের প্রাচীন কোনো গ্রন্থে রাধার কোনো উল্লেখ নেই, এই কথা সর্বপ্রথম বলেন বঙ্কিমচন্দ্র, তার ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ গ্রন্থে ১৮৬০/৭০ সালের দিকে। একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, আমি আপনি হয়তো ভালো করে সংস্কৃত পড়তে জানি না বা পারি না, বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু সংস্কৃত পড়তে ঠিকই জানতেন। চৈতন্যদেবের সময় থেকে শুরু হয় রাধার ঝড়, সেই ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে বঙ্কিমচন্দ্র যখন এই মত ব্যক্ত এই ভাবে রাধাকে অস্বীকার করেছেন, তখন তিনি যে আন্দাজে কোনো কথা বলেন নি, এটা কিন্তু খুব সহজেই ধরে নেওয়া যায়। শুধু তাই নয়, বঙ্কিমের আগে উইলসন নামের ইংরেজ ভদ্রলোক রাধার উপর গবেষণা করেছিলেন, বঙ্কিম তারও রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন যে, “রাধাকে প্রথমে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেখিতে পাই। উইলসন সাহেব বলেন যে, ইহা পুরাণগণের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলিয়াই বোধ হয়। ইহার রচনাপ্রণালী আজিকালিকার ভট্টাচার্যদিগের রচনার মত। ” অবস্থাটা বোঝেন আজিকালিকার ভট্টাচার্যদিগের মতো। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিম আরো বলেছেন, “উপনিষদে এইরূপ গোপীর অর্থ আছে, কিন্তু রাসলীলার কোন কথাই নাই। রাধার নামমাত্র নাই। এক জন প্রধানা গোপীর কথা কাছে, কিন্তু তিনি রাধা নহেন, তাঁহার নাম গান্ধর্বী। তাঁহার প্রাধান্যও কামকেলিতে নহে—তত্ত্বজিজ্ঞাসায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আর জয়দেবের কাব্যে ভিন্ন কোন প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নাই।” কেউ কেউ, ভাগবতে রাধার উল্লেখ আছে বলে মত প্রকাশ করে, হতে পারে সেটা প্রক্ষিপ্ত, কিন্তু মূল ভাগবত সম্পর্কে বঙ্কিম কী মত প্রকাশ করেছে দেখুন- “ভাগবতের এই রাসপঞ্চাধ্যয়ের মধ্যে ‘রাধা’ নাম কোথাও পাওয়া যায় না। বৈষ্ণবাচার্যদিগের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট। তাঁহারা টীকাটিপ্পনীর ভিতর পুনঃ পুনঃ রাধাপ্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়াছেন, কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নাই।…রাসপঞ্চাধ্যায়ে কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নাই। ভাগবতে কেন, বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশে বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নাই। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণনাম নাই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নাই বা মূর্তি নাই। বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্যলাভ করিয়াছেন। যদি মহাভারতে, হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে বা ভাগবতে ‘রাধা’ নাই, তবে এ ‘রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে ?” হিন্দু ধর্মের প্রাচীন কোনো গ্রন্থে রাধার কোনো উ্ল্লেখ না থাকলেও মুসলিম শাসনামলে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষ্ণ চরিত্রকে কলুষিত করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, যে পুরাণ হিন্দু শাস্ত্রের প্রামাণ্য কোনো গ্রন্থ নয়, রাধার জন্ম সেই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে; আর তার পর চৈতন্যদেবের প্রভাবে বৈষ্ণবদের মনে রাধার বেড়ে উঠা। এই হলো যৌবনবতী রাধার কাল্পনিক জীবনী। স্মরণ রাখবেন, আমি কিন্ত কৃষ্ণের বাল্যকালের সম্ভাব্য গুরুত্বহীন খেলার সাথী শিশু রাধার অস্তিত্বকে আগেও একেবারে অস্বীকার করি নি, আর এখনও করছি না, আমার অবজেকশন শুধু যৌবনবতী রাধাকে নিয়ে। জয় হিন্দ। জয় শ্রীরাম। জয় শ্রীকৃষ্ণ। --------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment