Tuesday, 2 June 2020

দেব-দেবীর পূজা করে মুক্তি পাওয়া সম্ভব কি না ?


দেব-দেবীর পূজা করে মুক্তি পাওয়া সম্ভব কি না ?

পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৭ম অধ্যায়ের ২১ ও ২২ নং শ্লোকে বলেছেন-

"যে যে ভক্ত ভক্তিযুক্ত হইয়া যে যে দেবমূর্তি অর্চনা করিতে ইচ্ছা করে, আমি সেই সকল ভক্তের সেই সেই দেবমূর্তিতে অচলা ভক্তি সৃষ্টি করিয়া দিই। সেই ভক্তি নিয়া সে সেই দেবমূর্তির অর্চনা করিয়া থাকে এবং সেই দেবতার নিকট হইতে যে কাম্যবস্তু লাভ করিয়া থাকে, প্রকৃতপক্ষে আমিই সেই কামনা পূর্ণ করিয়া থাকি, কেননা সেই সকল দেবতা আমারই অঙ্গস্বরূপ।"

গীতার এই দুইটি শ্লোক হতে একথা স্পষ্ট যে- সকল দেবতা, শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গস্বরূপ অর্থাৎ অধীনস্থ এবং দেবতারা তাদের ভক্তদের জন্য যা করে, তা শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি এবং অনুগ্রহ বলেই করে। যেকোনো নদীর জল যেমন এক সমুদ্রেই যায়, তেমনি সকল দেব-দেবীর পূজা ঘুরপথে হলেও শ্রীকৃষ্ণের কাছেই যায় বা যাবে, কিন্তু এই মনোভাব নিয়ে সেই সকল দেব-দেবীর পূজা করতে হবে যে এই সকল দেব-দেবীর মাধ্যমে আমি আসলে শ্রীকৃ্ষ্ণেরই পূজা করছি। সকল দেব-দেবীর উৎস শ্রীকৃষ্ণ এবং দেব-দেবীদের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণেরই পূজা করা হয়, যদি এই মনোভাব নিয়ে দেব-দেবীর পূজা করা হয়, তাহলে দেব-দেবীর পূজা করে মুক্তি পাওয়া গেলেও যেতে পারে; কিন্তু মুক্তি বা মোক্ষলাভের এটি প্রত্যক্ষ পথ নয়, পরোক্ষ পথ।

কোনো মানুষ যখন এটা উপলব্ধি করতে পারে যে- শ্রীকৃষ্ণই সব, তখন তিনি সবকিছুকে ছেড়ে, গাছের পরিচর্যার জন্য গাছের মূলে সার জল দেবার জন্য গাছের গোড়ায় জল ঢালার মতো এক শ্রীকৃষ্ণেরই আরাধনা করেন এবং এইভাবে তিনি মোক্ষ বা মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু এই উপলব্ধি মানুষের এক জনমে হয় না। এই কথাই শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৭/১৯ নং শ্লোকে বলেছেন এভাবে-

"বহু বহু জন্মের পর জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝিয়া থাকেন যে আমিই সব। তখন তিনি আমাকে পান। এই রূপ মহাত্মা জগতে বড়ই দুর্লভ।"

কেনো বহু বহু জন্মের পর জ্ঞানী ব্যক্তিরা বুঝতে পারেন যে শ্রীকৃষ্ণই সব, নিচের আলোচনার মাধ্যমে মাধ্যমে তা বোঝানোর চেষ্টা করছি-

কোনো মানুষ- যে লিঙ্গে, যে পরিবারে, যে সমাজে, যে দেশে জন্ম গ্রহন করে, সেটাই তার ভাগ্য। এই ভাগ্যচক্রে সব মানুষ একইরকম জ্ঞান ও ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নেয় না। যেমন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে মেয়ে বা নিকট আত্মীয়রা, চাইলেই প্রধানমন্ত্রীর দেখা সাক্ষাত পেতে পারে, এর জন্য তাদেরকে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না, কিন্তু গ্রামের একজন সাধারণ মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করার জন্য উপযুক্ত কারণ সৃষ্টি করতে হয়, তারপর তাকে গ্রামের সরকার দলীয় নেতাকে ধরতে হয়, গ্রামের সেই নেতা গিয়ে ধরে শহরের কোনো পাতি নেতাকে, পাতি নেতা গিয়ে ধরে নেতাকে, নেতা গিয়ে ধরে এম.পিকে, এম.পি গিয়ে ধরে কোনো মন্ত্রীকে এবং সেই মন্ত্রী যদি চায়, তাহলে সেই গ্রামের সাধারণ লোককে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করালেও করাতে পারে। এইভাবে একটি দীর্ঘ প্রসেসের মাধ্যমে গ্রামের কোনো সাধারণ লোক সরাসরি প্রধান মন্ত্রীর সাক্ষাত পেলেও পেতে পারে। গ্রামের কোনো সাধারণ লোককে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরাসরি সাক্ষাতের জন্য এই যে দীর্ঘ অনিশ্চিত একটি প্রসেসের মাধ্যমে যেতে হয়, এটাই তার জন্মের পাপ, যদি সে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বা মেয়ে হিসেবে বা তার কোনো নিকট আত্মীয় হিসেবে জন্ম নিতো, তাকে এই কষ্ট স্বীকার করতে হতো না।

শ্রীকৃষ্ণ যে গীতাই বলেছেন- জ্ঞানী ব্যক্তিরা বহু জন্মের পর বুঝিয়া থাকেন যে আমি বাসুদেবই সব। সে্ই রূপ কোনো আত্মা ইতর প্রাণী থেকে এক জন্মেই জ্ঞানী, জনপ্রিয় ও ক্ষমতাবান মানুষ হিসেবে জন্ম নেয় না। জ্ঞানী, জনপ্রিয় ও ক্ষমতাবান হিসেবে জন্ম নেওয়ার জন্য প্রতিটা জন্মে মানুষকে সুকর্মের মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করার সাধনা করতে হয়। জন্ম জন্মান্তর ধরে এই সাধনা করার ফলেই কোনো এক জন্মে মানুষ হয়ে উঠে জ্ঞানী, জনপ্রিয় বা ক্ষমতাবান এবং এই ধরণের মানুষ জগতে খুব দুর্লভ, এই কথাই শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতার ৭/১৯ নং শ্লোকে

তো একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে যেমন সরাসরি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সাক্ষাত পাওয়া সম্ভব নয়, তাদের সাক্ষাত পাওয়ার জন্য তাকে বিশেষ জ্ঞান ও ক্ষমতা অর্জন করতে হয়, তেমনি শ্রীকৃষ্ণকে বোঝা ও জানার জন্য বিশেষ জ্ঞান ও ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, ভাগ্যচক্রে যার সেই জ্ঞান ও ক্ষমতা থাকে তিনি সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করতে পারেন, কিন্তু ভাগ্যচক্রে সাধারণ মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার মতো, জন্মসূত্রে যার সেই জ্ঞান ও ক্ষমতা থাকে না, তাকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অংশীদার পাতি নেতা, নেতা, এম.পি, মন্ত্রীদেরকে তুষ্ট করে কিছু পাওয়ার মতো নানা দেব-দেবীকে পূজা করে কোনো কিছু পেতে হয়। কোনো এম.পি বা মন্ত্রী যেমন সাধারণ পাবলিকের জন্য রাস্তা, ব্রিজের মতো যা কিছু করে, তা যেমন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমেই করে, তেমনি সকল দেব-দেবী, তাদের ভক্তদের জন্য যা করে, তা শ্রীকৃষ্ণের অনুমতিক্রমে, শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমেই করে।

সকলে যেহেতু একইরকম সুকর্ম করে না, সেহেতু সকলে একইরকম ভাগ্য নিয়েও জন্ম নেয় না, এই জন্য সকলে শ্রীকৃষ্ণকে বুঝতে পারে না। যার যার অবস্থান থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বোঝার জন্য চেষ্টা ও সাধনা করে যেতে হবে, তাহলে হয়তো কোনো এক জন্মে শ্রীকৃষ্ণকে বুঝে উ্ঠা সম্ভব হবে, তখন শ্রীকৃ্ষ্ণের ভজনা করে মোক্ষ লাভ করা যাবে, যতদিন সেই জ্ঞানের জন্ম না হচ্ছে ততদিন সামনে যেই দেব-দেবী পাওয়া যায়, তারই পূজা অর্চনা করে যেতে হবে; কারণ, এটা্ই শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার বা তার কাছে পৌঁছার একমাত্র পথ।

দেব-দেবীর পূজা করে মোক্ষ লাভ করা যাবে কি না বা কিভাবে মোক্ষলাভ করা যাবে, আশা করছি উপরের আলোচনা থেকে আমার বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার হয়েছে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment