আর্য সমাজীরা নিজদেরকে মহান জ্ঞানী ভাবে, কিন্তু তারা কি গীতার বাণী বুঝে মূর্তি পূজার বিরোধিতা করে? মূর্তিপূজা বিরোধীদের কাছে তাই আমার প্রশ্ন-
বেদ, গীতায় কি মূর্তি পূজা নিষেধ ?
এই পোস্টের সাথে ফটো হিসেবে যা দেখছেন, তার জবাব দেওয়া ই আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য, তাই কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক-
ভুল বানানে সে শুরুতেই লিখেছে, "পবিএ (পবিত্র) বেদ শুধু মাএ (মাত্র) পরম আত্মার পূজা করতে বলেছে। তাছাড়া অন্য কারো পূজা করা বা মূএি (মূর্তি) পূজা করাকে পাপ বলে বিবেচিত করেছেন।"
- তো আমার কথা হচ্ছে বেদের যেসব মন্ত্রে পরম আত্মার পূজা করতে বলা হয়েছে এবং যেগুলোতে মূর্তি পূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে সেই মন্ত্রগুলোর উল্লেখ সে করে নি কেনো, শুধু রেফারেন্স দিয়েই সে তার দায় সেরেছে কেনো ?
এরপর তার দাবীর সাপেক্ষে সে প্রথমেই যে রেফারেন্স দিয়েছে, সেটা হলো ঋগ্বেদ ৩২/৩; আচ্ছা ঋগ্বেদের কি এরকম কোনো রেফারেন্স হয় ? ঋগ্বেদ সাজানো হয়েছে- মণ্ডল>সূক্ত>মন্ত্র, এভাবে। তার মানে ঋগ্বেদের রেফারেন্সে দিতে হলে পরপর তিনটি সংখ্যা লাগবে, তাহলে ৩২/৩ দ্বারা সে কী বুঝিয়েছে ?
দ্বিতীয় রেফারেন্সে সে বলেছে,
ভাগবত : ৩/২৭/২১,২২,২৩,২৪,২৭; এর মানে হলো ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধের ২৭ অধ্যায়ের ২১,২২,২৩,২৪ ও ২৭ নং শ্লোক।
আমার কাছে- কোলকাতার তুলি-কলম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ অনুবাদিত মূল সংস্কৃত ভাগবতের বাংলা গদ্য অনুবাদ রয়েছে, রেফারেন্সে উল্লিখিত অধ্যায়টি আমি তন্ন তন্ন করে পড়েছি, কিন্তু সেখানে এমন কোনো বিষয়ে কিছু বলা নেই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে এমন রেফারেন্স দিতে পারে, সে সেই শ্লোকগুলো উল্লেখ করতে পারে না কেনো ? নাকি ধান্ধাবাজি করার জন্য কিছু আড়াল করার প্রয়োজন হয় বলেই এই আড়াল করা ?
হিন্দুধর্মে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধের পক্ষে সে তৃতীয় রেফারেন্স হিসেবে দিয়েছে গীতা ৭/২০, এখানে বলা হয়েছে,
"কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।" (গীতা-৭/২০)
এর অর্থ- কামনার দ্বারা যাহাদের জ্ঞান নষ্ট হইয়াছে, তাহারা নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী নানা নিয়ম পালন করিয়া অন্যান্য দেবতার ভজনা করিয়া থাকে।
গীতা অনুযায়ী মানুষের কর্ম দুই প্রকার- সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম। সকাম কর্ম ক'রে মানুষ তার ফল চায়, এটা করে সাধারণ মানুষ এবং সমাজে ৯৯.৯৯% ই হলো এই সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে কিছু মানুষ নিষ্কামভাবে কর্ম করে, তারা তার ফল আশা করে না এই ভেবে যে ঈশ্বর তাকে দিয়ে কর্মটি করাচ্ছেন, সুতরাং এতে তার চাওয়া পাওয়ার কিছু থাকে না এবং এই কর্মের কোনো ফলও তাকে ভোগ করতে হয় না। আগেই বলেছি এটা ভাবতে পারে খুব কম লোক এবং সমাজে এদের সংখ্যা হাজারে নয়, লাখে একজন হতে পারে। এই নিষ্কাম কর্মের জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান এবং এই জ্ঞান যাদের নেই, তাদের উদ্দেশ্যেই শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৭/২০ নং শ্লোকে বলেছেন, কামনার দ্বারা যাহাদের জ্ঞান নষ্ট হইয়াছে, তাহারা নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী নানা নিয়ম পালন করিয়া অন্যান্য দেবতার ভজনা করিয়া থাকে।
কিন্তু ঈশ্বর হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ তো এটাও জানেন যে, সমাজে প্রায় সবাই সাধারণ মানুষ, তাদের পক্ষে ধর্মের এই চুড়ান্ত জ্ঞান সহজে লাভ করা সম্ভব নয়, এজন্যই তিনি গীতার ৭/৯ নং শ্লোকে বলেছেন, "বহু বহু জন্মের পর জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝিয়া থাকেন যে আমিই (শ্রীকৃষ্ণ) সব। তখন তিনি আমাকে পান। জগতে এইরূপ মাহাত্মা বড়ই দুর্লভ।" তাই সাধারণ মানুষদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন,
"যো যো যাং যাং তনুং ভক্ত শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।
তস্য তস্যাচলং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম।।"- (গীতা, ৭/২১)
এর অর্থ- যে যে স্বকামী ভক্ত যে যে দেবতার স্বরূপ শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করতে ইচ্ছুক, আমি তাদের শ্রদ্ধা সেই দেবতার প্রতি স্থির করি।
এরপর তিনি গীতার ৭/২২ নং শ্লোকে বলেছেন,
"স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হিতান্।"
এর অর্থ- সেই পুরুষ শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেব বিগ্রহের পূজায় তৎপর হন এবং সেই দেবতার মাধ্যমে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্য লাভ করেন।
এর মানে হলো শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, দেবতাদের পূজা করলেও ঘুরপথে হলেও সে আমারই পূজা করে, আমিই সেই পূজার ফল দিই এবং দেরিতে হলেও দেবতাদের মাধ্যমে সে আমাকেই লাভ করতে পারে।
এছাড়াও গীতার ১১/১৫ শ্লোকে, শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শনের পর অর্জুন বলেছে-
"পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্ ।
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থম্ ঋষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্।।"
এর অর্থ হলো, হে দেব, আপনার দেহে আমি সমস্ত দেবতা এবং বহুভূতের সমুদায়, পদ্মের আসনে অবস্থিত ব্রহ্মা, সমস্ত ঋষিগণ এবং দিব্যসর্পসমূহ দেখছি।
সমস্ত দেবতার অবস্থান যেহেতু কৃষ্ণে, তার মানে সমস্ত দেবতা ই শ্রীকৃষ্ণ, এই দেবতাদের পূজা করলে যে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করা হয়, সেকথা শ্রীকৃষ্ণই বলেছেন গীতার এই শ্লোকে-
"যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম।। -(গীতা, ৯/২৩)
এর অর্থ- হে কৌন্তেয়, যারা অন্য দেবতাদের ভক্ত এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাদের পূজা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা অবিধি পূর্বক আমারই পূজা করে।
সুতরাং গীতায় যে মূর্তি পূজা নিষেধ নয়- একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। মূর্তিপূজা সাধারণ মানুষের জন্য, যারা শ্রীকৃষ্ণকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে ন; আর যারা শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করতে পেরেছে, তাদের জন্য মূর্তি পূজার কোনো প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য শ্রীকৃ্ষ্ণের ভজনা্ই যথেষ্ট।
এরপর সে গীতার ১৮/২২,৩২ নং শ্লোকের কথা বলেছে, দেখা যাক সেই শ্লোকগুলোতে আসলে কী বলা হয়েছে-
১৮/২২ নং শ্লোকের অর্থ হলো- "প্রকৃত তত্ত্ব কি তাহা না জানিয়া, যে জ্ঞান দ্বারা কোনো একমাত্র বিষয়ে আসক্ত থাকে, সেই যুক্তিবিরুদ্ধ, অযথার্থ, তুচ্ছ জ্ঞানকে তামস জ্ঞান বলে।"
এবং ১৮/৩২ নং শ্লোকের অর্থ হলো- "হে অর্জুন, যে বুদ্ধি মোহাচ্ছন্ন থাকাতে অধর্মকে ধর্ম মনে করে এবং সকল বিষয়েই বিপরীত বা উল্টা বুঝে তাহা তামসী বুদ্ধি।"
এই দুটো শ্লোকের কথা বলে ফটোপোস্টকারী বলদা, এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে যারা মূর্তি পূজা করে তামসিক বুদ্ধি সম্পন্ন।
কিন্তু যারা শ্রীকৃষ্ণকে মানে না বা তার মতের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাদের তামস বুদ্ধি দূরে থাক, তারা যে মূর্খ এবং জ্ঞানভ্রষ্ট সে কথা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতার এই শ্লোকে-
"যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্।
সর্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ।।"
এর অর্থ- যে সকল ব্যক্তি আমার মতের দোষ ধরে এবং আমার মতানুসারে কাজ না করে, সে সকল ব্যক্তি মূঢ় ও জ্ঞানভ্রষ্ট বলিয়া জানিবে।"
অতএব হিন্দু ছদ্মবেশে থাকা কৃষ্ণের সমালোচনাকারী আর্য এবং মতুয়ারা যে মূর্খ এবং জ্ঞানভ্রষ্ট, সে কথা গীতা দ্বারাই প্রমাণিত।
রেফারেন্স দেওয়া শেষ করে সে লিখেছে,
"এগুতে (এগুলোতে) মূর্এি (মূর্তি) পূজা নিশেধ (নিষেধ)।
এগুলোতে মূর্তি পূজা যে নিষেধ নয়, সেটা তো তথ্য দিয়েই প্রমাণ করে দিলাম। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, যার এক লাইন বাংলা শুদ্ধ করে লিখার ক্ষমতা নেই, সে এসেছে সনাতন ধর্মের মতো একটি উচ্চতর জ্ঞান সম্পর্কে উপদেশ দিতে, একে তো থাপড়ানো দরকার।
শেষ প্যারায় আবারও ভুল বানানে সে লিখেছে, "সব ধরণের মূর্তি পূজাই নাস্তিকদের কাজ।"
এই মূর্খ তো নাস্তিক কাদেরকে বলে সেটাই জানে না। যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না সে ই তো নাস্তিক, তো যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, সে আবার ঈশ্বরের প্রতিরূপ মূর্তি পূজা করতে যাবে কেনো ?
এই সব উল্টাপাল্টা কথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করে অন্যদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য একে শুধু একবার দুইবার থাপড়ানো নয়, আধা ঘন্টা ধরে থাবড়ানো দরকার।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃ্ষ্ণ।
'ওঁ সহানা ভবতুঃ' (ঈশ্বর আমাদেরকে রক্ষা করুন।)
No comments:
Post a Comment