Wednesday 27 May 2020

যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ কি ঈশ্বর নন ?


যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ কি ঈশ্বর নন ?

Susanta Das এর উদ্দেশ্যে বলছি,

তুমি তো এক পাতা বাংলা ই শুদ্ধ করে লিখতে পারে না, তুমি এসেছো আমার জ্ঞানের সমালোচনা করতে ! পোষ্ট (পোস্ট), কারন (কারণ), প্রমান (প্রমাণ), সন্জয় (সঞ্জয়), দারকা (দ্বারকা), শখা (সখা), আচরন (আচরণ), যোগি (যোগী)- এই বানানগুলো আগে শুদ্ধ করে লিখতে শেখো, অনুচ্ছেদের মধ্যে বিরামচিহ্নের ব্যবহার শেখো, বাক্যগুলো সঠিকভাবে লিখতে শেখো; "শ্রী কৃষ্ণ" নয়, "শ্রীকৃষ্ণ", এটা আগে জানো; তারপর এসো আমার জ্ঞানের সমালোচনা করতে; কারণ, তখন সেটা কিছুটা গ্রহনযোগ্য হবে।

তোমার রেফারেন্সগুলোর জবাব পরে দিচ্ছি, তার আগে বলছি- তুমি যদি 'যোগ' শব্দের অর্থ জানতে এবং বেদব্যাস আসলে কে, এটা জানতে, আমার বিশ্বাস তুমি এই কমেন্ট করতে না।

লোকজনকে প্রকৃত সত্য জানানোর জন্যই, আমার ধারণা, ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করেছেন; এ কারণেই হাইস্কুল পাশ করার পর থেকেই আমি জাত শিক্ষক; আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করি লোকজনকে প্রকৃত সত্য জানাতে বা শেখাতে; এর বাইরে যারা আমার কাছে জানতে চায়, তাদেরকে তো আমি শেখাই ই, আর যারা আমার জ্ঞানের সমালোচনা করে, তাদেরকেও আমি উচিত শিক্ষা দিই, যেটা আজ তোমাকে দেবো।

তুমি প্রথমেই উল্লেখ করেছো গীতার ৩/৩০ নং শ্লোকের কথা এবং তুমি বলেছো, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয়, দেখা যাক সেই শ্লোক এবং তার অর্থ-

"ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীর্নির্মমো ভুত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বর।।"

বাজারে প্রচলিত ছোটখাটো গীতায় নানারকম ছোটোখাটো ভুল ত্রুটি আছে এবং ইসকনের গীতাও উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনুবাদিত, তাই কোনো শ্লোকের অনুবাদ আমি ইসকনের গীতা থেকে বা বাজারে প্রচলিত ছোটো গীতা থেকে দেবো না, আমার বিচারে- ছোট হোক বা বড় হোক- গীতার শুদ্ধ অনুবাদ হলো জগদীশ চন্দ্র ঘোষের অনুবাদ করা গীতা, সেখান থেকেই আমি এই পোস্টে উল্লিখিত শ্লোকগুলোর অনুবাদ তুলে দেবো। যা হোক, ৩/৩০ নং শ্লোকের অনুবাদ জগদীশ চন্দ্র ঘোষ লিখেছেন,

"আমাতে সমস্ত কর্ম বিবেকবুদ্ধি দ্বারা সমর্পণ করিয়া নিষ্কাম মমতাশুন্য এবং শোকশুন্য হইয়া যুদ্ধ কর।"

- এই শ্লোকটি কিভাবে প্রমাণ করে যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয় ? বরং সবকিছু শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অর্পণ করার কথা বলায়, এটাই তো প্রমাণ হচ্ছে যে শ্রীকৃষ্ণই ঈশ্বর।

দ্বিতীয় রেফারেন্স দিতে গিয়ে তুমি বলেছো, "যোগ এর মাধ্যমে তিনি ঐশ্বরিক যোগ দেখিয়েছেন তার প্রমাণ গীতা ৯/৫ দেখুন।"

উপরেই বলেছি, তুমি যদি 'যোগ' শব্দের অর্থ জানতে তাহলে শ্রীকৃষ্ণকে এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ক'রে নিজের পাপ বাড়াতে না।

গণিতের ক্ষেত্রে 'যোগ' এর অর্থ 'প্লাস' বলতে যা বোঝায তা। কিন্তু 'যোগ' এর সাধারণ অর্থগুলো হলো- মিলন, সংসর্গ, সংস্রব, সহযোগিতা, ধ্যান, উপায়, অবলম্বন, মারফত, সাধনার পন্থা, সময়, শুভ কাল, ঔষধ, সুবিধা, সংকলন, সমষ্টি; আবার জ্যোতিষ শাস্ত্রের ক্ষেত্রে 'যোগ' মানে সম্ভাবনা; কিন্তু গীতায় যোগ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে অঘটন ঘটানোর ক্ষমতা হিসেবে। জগদীশ চন্দ্র ঘোষের গীতা বের করে গবেষণা শুরু করুন আমার কথার সত্যতার প্রমাণ পাবেন।

গীতার ৯/৫ নং শ্লোকে ব্যবহৃত হয়েছে "পশ্য মে যোগশ্বৈরম" শব্দগুচ্ছটি; এর অর্থ হলো- তুমি আমার ঐশ্বরিক যোগ দর্শন করো।

এই যোগকে সাধারণ অর্থে ধরে নিয়ে মূর্খরা মনে করে- শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন একজন মানুষ, খুব বেশি হলে বিষ্ণুর কালো চুল থেকে সৃষ্টি হওয়া একজন অংশ অবতার, যিনি তার যোগশক্তির দ্বারা কিছু অলৌকিক কাজ কারবার দেখিয়েছে, তাই শ্রীকৃষ্ণকে একজন যোগী পুরুষ বলা যায়, কোনোভাবেই শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয় !

একটু আগেই বলেছি, গীতায় যোগ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে অঘটন ঘটনার ক্ষমতা হিসেবে এবং গীতায় "যোগশ্বৈরম" শব্দটি ব্যবহার করে এটা বলে দেওয়া হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণ হলেন যোগের ঈশ্বর অর্থাৎ যোগ সম্পর্কিত ক্ষমতায় শ্রীকৃষ্ণ হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ, তাহলে সমস্যা কোথায় ? যোগের ক্ষমতা প্রদর্শনে শ্রীকৃষ্ণের তুলনায় শ্রেষ্ঠ কে বা শ্রীকৃষ্ণের তুল্য পৃথিবীতে আর কে আছে ?

Susanta অবশ্য দিব্যদৃষ্টি দানের ঘটনায় শ্রীকৃষ্ণের সাথে ব্যাসদেবের তুলনা করেছে, এ প্রসঙ্গেও আগে বলেছি সুশান্ত যদি জানতো যে ব্যাসদেব আসলে কে, তাহলে সে এই কথা বলতোই না। গীতার ১০ম অধ্যায়ের ৩৭ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "মুনিনামপ্যহং ব্যাসঃ", এর অর্থ হলো- মুনিদের মধ্যে আমি ব্যাস। তো যেখানে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন আমিই ব্যাসদেব, তাহলে ব্যাসদেবের সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টি প্রদান করতে সমস্যা কোথায় ? শুধু দিব্যদৃষ্টি প্রদানই নয়, শ্রীকৃষ্ণ, হস্তিনাপুরের রাজসভায় জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কিছুক্ষণের জন্য দৃষ্টি প্রদান করেছিলেন, ৭ বছর বয়সে হাতের কণিষ্ঠা আঙ্গুলের উপর গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরেছিলেন, এগুলো ছাড়া্ও সমগ্র জীবনে শ্রীকৃষ্ণ বহু অলৌকিক লীলা দেখিয়েছেন, পৃথিবীতে জন্মগ্রহনকারী আর কে শ্রীকৃষ্ণের মতো এরকম অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করতে পেরেছে ? সুশান্তকে বলছি শ্রীকৃষ্ণের মতো অলৌকিক লীলা প্রদর্শনকারী আরো দু চারজনের নাম বলতে, যদি তা না পারে, তাহলে তাকে বলছি এই সব ঘেউ ঘেউ বন্ধ করতে; যদি তা না করে এবং এভাবে শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করে কথা বলে, সামনে পেলে ওকে এমন মার মারবো যে, ও ওর বাপের নয়, নিজের নামই ভুলে যাবে।

যা হোক, শ্রীকৃষ্ণকে এক সাধারণ যোগী পুরুষ প্রমাণ করতে এরপর সুশান্ত উল্লেখ করেছে গীতার ১৮/৭৮ নং শ্লোকের কথা, যেখানে সঞ্জয় শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে বলেছেন- "যোগেশ্বরঃ"; তো সমস্যা কী ? যোগ মানে তো আগেই বলেছি যে- অঘটন ঘটনার ক্ষমতা, তো যোগেশ্বর মানে- অঘটনা ঘটনার ক্ষমতার ঈশ্বর, তার মানে শ্রীকৃষ্ণই ঘটনা ঘটানোর দিক থেকে সর্বশক্তিমান, আর যিনি সর্বশক্তিমান, তিনিই তো ঈশ্বর।

এরপর সুশান্তের অভিযোগ হলো অনুগীতা মোতাবেক শ্রীকৃষ্ণ দ্বিতীয়বার অর্জুনকে দিব্যচক্ষু দান করতে পারে নি।
বিষয়টি এখানে দিব্যচৃক্ষু হবে না, হবে গীতার জ্ঞান। গীতার জ্ঞান দিতে দিতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছিলেন তার বিশ্বরূপ দর্শনের জন্য। সুতরাং সমগ্র ব্যাপারটা হলো গীতার জ্ঞান এবং এর অংশ বিশেষ হলো দিব্যদৃষ্টি; কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণের কাছে পুনরায় এই গীতার জ্ঞানের আবদার করেছিলেন বলে মহাভারত দাবী করেছে।

এটার দুই রকম ব্যাখ্যা আছে। অনুগীতাকে স্বীকার করে নিয়ে প্রথম ব্যাখ্যায় বলছি- শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কিত যোগেশ্বর ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য কিন্তু আমি এ প্রবন্ধটি লিখেছি, এটা পড়ার পরও কেউ যদি ব্যাপারটি বুঝতে না পারে এবং একই বিষয়ে আবার প্রশ্ন করে, তাহলে কিন্তু আমার মেজাজ খারাপ হবে এবং সে যদি আমার একান্ত অনুগত ভক্তও হয়, যার উপর আমি রাগ করতে পারবো না, তাহলে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি কিন্তু কোনো না কোনো অজুহাত দেবো, যাতে আমাকে ঐ কষ্ট আবার স্বীকার করতে না হয়; অসময়ে এবং অস্থানে পুনরায় গীতার জ্ঞান প্রদানের অনুরোধ করায়, বিরক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ আসলে অর্জুনকে যোগের ব্যাপারটি বলে এড়িয়ে গেছেন মাত্র। তাছাড়া গীতার জ্ঞান অর্জুনকে দেওযার প্রয়োজন ছিলো তাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার জন্য, সেটা হয়ে গিয়েছিলো, তাই পুনরায় সেই ব্যাপারটি ঘটানোর আর কোনো প্রয়োজন ছিলো না; কারণ, শ্রীকৃষ্ণ তার সমগ্র জীবনে কোনো কথা দুই বার বলেন নি, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন নি; তিনি যেহেতু ঈশ্বর এবং সর্বজ্ঞানী, সেহেতু তিনি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জানতেন, তাই তাঁর পক্ষে নিজের কথা ও কাজে স্থির থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো।

ঈশ্বর হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ যে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণই জানতেন, সেটা আমি বলছি না, বলছে গীতা, দেখুন নিচের এই শ্লোক-

"বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন।।- (গীতা, ৭/২৬)

এর অর্থ : হে অর্জুন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে আমি অবগত।

শ্রীকৃষ্ণ যদি ঈশ্বর না হন, তাহলে তিনি কিভাবে এই কথা বলতে পারেন ? আর তিনি যে অযথা বুলি ঝাড়েন নি, তার প্রমাণ তো তাঁর সমগ্র জীবনীর অসংখ্য অলৌকিক ঘটনাতেই রয়েছে।

অনুগীতা সম্পর্কে পরের যে ব্যাখ্যা, তাতে শুধু এই উপাখ্যানই নয়, মহাভারতের মূল কাহিনী ছাড়া সমস্ত উপাখ্যানকেই পরিত্যাগ করা যায়; কারণ, বর্তমান মহভারতের আদি পর্বেই বলা আছে- বেদব্যাস মাত্র ২৪ হাজার শ্লোকে এই সংহিতা রচনা করেছেন, তার সাথে বেদব্যাস হয়তো আরো দু চারটি উপাখ্যান রচনা করে জুড়ে দিয়েছিলেন, এই উপাখ্যান বাড়ানোর সুযোগ নিয়ে মূল ২৪ হাজার শ্লোকের মহাভারত কিভাবে ১ লক্ষ শ্লোকে উন্নীত হলো, সে সম্পর্কে রাজ শেখর বসু, তার অনুবাদিত মহাভারত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন,

"মহাভারত সংহিতা গ্রন্থ, এতে বহু রচয়িতার হাত আছে এবং একই ঘটনার বিভিন্ন কিংবদন্তী গ্রথিত হয়েছে। মূল আখ্যান সম্ভবত একজনেরই রচনা, কিন্তু পরে বহু লেখক তাতে যোগ করেছেন। এমন আশা করা যায় না যে তারা প্রত্যেকে সতর্ক হয়ে একটি পূর্ব নির্ধারিত বিরাট পরিকল্পনার বিভিন্ন অংশ গড়বেন, মূল প্ল্যান থেকে কোথাও বিচ্যুত হবেন না।"

রাজশেখর বসু আরো বলেছেন, "বর্তমান মহাভারতের সমস্তটা এক কালে রচিত না হলেও এবং তাতে বহু লোকের হাত থাকলেও সমগ্র রচনাই এখন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের নামেই চলে।"

এতে বোঝা যাচ্ছে মহাভারতের বিভিন্ন উপাখ্যান, বিভিন্ন লোক, বিভিন্ন সময় লিখে মহাভারতের সাথে জুড়ে দিয়েছে, সুতরাং অনুগীতা সম্পর্কিত উপাখ্যানটি যে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই, তাই এই উপাখ্যানগুলির উপর ভিত্তি করে কৃষ্ণের কাজ ও কথা সম্পর্কে সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না বা উচিতও নয়।

এই তথ্যগুলি যদি সুশান্ত জানতো, তাহলে সে মহাভারতের অনুগীতা উপাখ্যানের উপর ভিত্তি করে- কৃষ্ণ ঈশ্বর নয়- এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করতোই না।

শ্রীকৃষ্ণ, গীতার কয়েকটি শ্লোক, যেমন- হে অর্জুন, ঈশ্বর সর্ব জীবের হৃদয়ে অবস্থান করিয়া মায়া দ্বারা যন্ত্র চালিত পুতুলের ন্যায় ভ্রমণ করাইতেছেন (গীতা, ১৮/৬১)- দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে না বুঝিয়ে পরোক্ষভাবে নিজেকে বুঝিয়েছেন, এগুলোর দ্বারাও কিছু মূর্খ এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, গীতার শ্রীকৃষ্ণ যোগী পুরুষ, তিনি ঈশ্বর নন, তিনি যোগের দ্বারা যুক্ত হয়ে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করেছিলেন, যেই যোগের দ্বারা যুক্ত হতে না পারায় অনুগীতা মোতাবেক তিনি আর অর্জুনকে গীতার জ্ঞান পুনরায় দিতে পারেন নি!

এই প্রবন্ধে আমি শুরুর দিকে সরাসরি যা বলেছি, তা সুশান্তকে উদ্দেশ্য করে বলেছি; কিন্তু পরে কিছু অনুচ্ছেদে সুশান্তকে ডাইরেক্ট না বলে ইনডাইরেক্ট বলেছি, তার মানে কি আমি সুশান্তকে সেটা বলি নি ?

যা হোক, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ, পরোক্ষভাবে কয়েকটি শ্লোকে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে প্রকাশ করলেও প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে প্রকাশ করেছেন অসংখ্য শ্লোকে, যেগুলো কৃষ্ণ বিরোধীদের চোখে পড়ে না, নিচে সেরকম কিছু শ্লোকের বাংলা অনুবাদ কৃষ্ণ ভক্তদের জন্য উল্লেখ করছি-

গীতার ৭ম অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"হে অর্জুন, তুমি আমাতে নিবিষ্ট চিত্ত ও একমাত্র আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত হইলে যেভাবে আমার সমগ্রস্বরূপ জানিতে পারিবে, তাহা বলিতেছি শোনো।"

'একমাত্র আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত'  হওয়ার কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ কি এটা বোঝান নি যে তিনিই ঈশ্বর ?

৬ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "আমিই জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ।"

৭ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমাতেই এই সমস্ত জগৎ গাঁথা রহিয়াছে।"

১০ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমাকে সর্বভূতের সনাতন বীজ বলিয়া জানিবে।"

সুশান্তদের মতো মূর্খদের জন্য এই ৭ম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ আরো কিছু বলেছেন, সেগুলো আলোচনা করবো এই প্রবন্ধের শেষে, এখন ৯ম অধ্যায়ে যাই-

৯ম অধ্যায়ের ২৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"যাহারা অন্য দেবতার পূজা করে, তাহারাও না জানিয়া আমাকেই পূজা করে।"

২৪ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমিই সর্বযজ্ঞের ভোক্তা ও ফলদাতা।"

২৭ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি যাহা যাহা কার্য করো- ভোজন, হোম, দান, তপস্যা সেসব আমাতেই অর্পণ করো।

৩৪ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি সর্বদা আমাতে মন দাও, আমাকে ভক্তি করো, আমার উদ্দেশ্যেই যজ্ঞ করো, আমাকেই নমস্কার করো।"

১০ম অধ্যায়ের ৮ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ, আমা হতেই সমস্ত জগত প্রবর্তিত হয়।"

২০ নং শ্লোকে বলেছেন, "সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আত্মা আমিই, আমিই সর্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহারস্বরূপ।"

৩৯ নং শ্লোকে বলেছেন, "সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি। এই বিশ্বচরাচরে কোনো কিছুই আমা ছাড়া হইতে পারে না।"

এছাড়াও চতুর্দশ অধ্যায়ের ২৭ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "আমি অব্যয় অমৃতস্ববরূপ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা; শাশ্বত ধর্ম, ঐকান্তিক সুখ- এই সকলেরই একমাত্র আশ্রয় বা প্রতিষ্ঠা আমিই।"

পঞ্চদশ অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "আমি সকল প্রাণীর হৃদয়ে অন্তর্যামীরূপে আছি, আমা হতেই প্রাণীগণের স্মৃতি ও জ্ঞান হয় এবং আমা হতেই প্রাণীগণের স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপ সাধিত হয়;

এরপর অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৫৭ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "তুমি মনে মনে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া, মৎপরায়ন হইয়া, সাম্য বুদ্ধির যোগ অবলম্বন করিয়া, সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখো এবং যথাধিকার কর্ম করিতে থাকো।"

৬৫ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি একমাত্র আমাতেই মন দাও, আমাকে ভক্তি করো, আমাকে পূজা করো, আমাকে নমস্কার করো।"

৬৬ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি একমাত্র আমার শরণ লও।"

শ্রীকৃষ্ণের এই সব ডাইরেক্ট স্পিচে কি প্রমাণ হয় না যে শ্রীকৃষ্ণই ঈশ্বর ? এরকম অসংখ্য ডাইরেক্ট স্পিচ বাদ দিয়ে দু' একটি ইনডাইরেক্ট স্পিচ নিয়ে বালার্যদের এত লাফালাফি কেনো ?

আর্য, যাদের বলদামির কারণে লোকজন এখন তাদেরকে বালার্য বলে সম্বোধন করে, তারা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানে না, তাদের স্বরূপ কী, সে সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গীতাতে বলেছেন, দেখুন নিচের কয়েকটি শ্লোক-

"ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়া প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ।
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।"- (গীতা, ৭/১৫)

এর অর্থ- পাপিষ্ঠ ও বিবেকহীন নরাধমেরা মায়া দ্বারা হতজ্ঞান হইয়া অসুর স্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে ভজনা করে না।

সুশান্তর মতো কেনো কিছু ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মনে করে না, সে কথা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলে গেছেন, দেখুন নিচের এই শ্লোক-

"অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম।"।- (গীতা, ৭/২৪)

এর অর্থ- অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ আমার পরমভাব না জানিয়া অব্যক্তরূপ আমি ব্যক্তিরূপে জন্ম লইয়া থাকি, এরূপ বিবেচনা করে।

এই মূর্খতার জন্যই সুশান্ত এবং তার মতোরা মনে করে যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয়, একজন যোগী পুরুষ মাত্র!
যারা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মানে না তাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই, এই সূত্রে সুশান্ত এবং তার মতোদের কোনো পারলৌকিক মুক্তি নেই; তবে সুশান্তদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই; কেননা, গীতার ১০ম অধ্যায়ের ১০ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ তাদের পথ দেখিয়ে বলেছেন-

"যে সব ভক্ত সর্বদা আমাতে মন রাখিয়া আমার ভজনা করেন, আমি সেই সব ব্যক্তিকে সেইরূপ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যাহা দ্বারা তাহারা আমাকে লাভ করিয়া থাকেন।"

শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সুশান্তর মন নেই, তাই সে মূর্খ; সুতরাং সুশান্তরা যদি পরমপ্রভু শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবে তারা নিশ্চয় শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারবে এবং বুঝতে পারবে যে যারা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মনে

করে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী, তারা সুশান্তর মতো কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে অবিশ্বাসী ইতর শ্রেণীর পশু নয়।

আশা করছি- এই প্রবন্ধ পড়ার পর দুর্যোধনের উত্তরসূরী সুশান্তরা শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান এবং শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করে কথা বলায় উচিত শিক্ষা পেয়েছে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment