Wednesday 27 May 2020

গীতায় কি দীক্ষা, গুরু পূজা ও অবতারের উল্লেখ আছে?


#Dev_Kumar_Akash,

সনাতন ধর্ম বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে, সেই বিষয়টা আরো ভালো ভাবে জানা উচিত বা সেই বিষয়কে কি আরো ভালো করে উপলব্ধি করা উচিত নয় ?

গীতার রেফারেন্স দিয়ে তুমি বলেছো- "গীতার কোথাও গুরু দীক্ষা বা গুরু পূজার কথা বলা নেই। বলা হয়েছে তত্ত্বদর্শি জ্ঞানীর কাছে যেতে।"

তুমি কি মনে করো গীতার সাতশত শ্লোকের মাধ্যমে সব বিষয় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলা সম্ভব ? সব কিছু বিস্তারিত বলতে গেলে কি গীতা সাতশত শ্লোকে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হতো ? তখন তো এটা সাত লক্ষ শ্লোকে পৌঁছে যেতো। তুমি কি জানো না, গীতা মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে- এটা বেদ উপনিষদের সার ? এই কথাতেই তো প্রমাণিত যে গীতায় কোনো বিষয়ের বিস্তারিত থাকবে না, থাকবে বিষয় বা ঘটনার ইঙ্গিত মাত্র। এই বিষয়টা বোঝার মতো জ্ঞান কি তোমার আছে ? আমার তো মনে হয় নেই, থাকলে অযথা মূর্খের মতো সনাতন ধর্মেরর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ফটর ফটর করে সাধারণ হিন্দুদেরকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করতে না।

গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-

"তদ্বিদ্ধি প্রণিপপাতেন, পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্ততত্ত্বদর্শিনঃ।।"

এর অর্থ হিসেবে শ্রীজগদীশ চন্দ্র ঘোষ তার গীতায় লিখেছেন,

"গুরু চরণে দণ্ডবৎ প্রণাম দ্বারা, নানা বিষয় প্রশ্ন দ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর। জ্ঞানী তত্ত্বদদর্শী গুরুগণ তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন।"

বাংলাদেশের ইলা প্রকাশনীর একটি ছোট গীতাতেও এর অর্থ লিথা হয়েছে,

"সেই জ্ঞান পাইতে হলে গুরুকে প্রণাম করিয়া, সেবা করিয়া তাহাকে নানারূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করো। জ্ঞানী তত্ত্বদর্শী গুরু তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন।"

এ্ই শ্লোকের অর্থে কী বলা হয়েছে, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা কি তোমার আছে ?

এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- জ্ঞানের জন্য তত্ত্বদর্শী গুরুর সেবা করে তাকে প্রশ্ন করতে।

এবার আসি দীক্ষার ব্যাপারে।

"দীক্ষা" মানে কী ? দীক্ষার অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি হলো- উপদেশ। আর উপদেশ তার কাছ থেকে্ই নেওয়া হয়, যাকে পথপ্রদর্শক বলে মানা হয়; তো যিনি পথপ্রদর্শক, তিনি গুরু নয়তো কী ?

গীতার ৪/৩৪ নং শ্লোকের, "উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং" বাক্যের অর্থই হলো- 'তোমাকে জ্ঞান উপদেশ করিবেন''। এর মানে হলো- যার কাছ থেকে উপদেশ নেওয়া হয় তিনিই গুরু এবং সাধারণ একজন ব্যক্তি যখন কারো নিকট থেকে ধর্মীয় বিষয়ে উপদেশ নেন, তখন উপদেশ দাতা, সেই সাধারণ ব্যক্তির গুরুতে পরিণত হন। এই শ্লোকের "উপদেক্ষ্যন্তি" শব্দের মধ্যেই দীক্ষার ব্যাপারটি লুকিয়ে আছে।

সাধারণভভাবে দীক্ষা মানে উপদেশ এবং উপদেশদাতাই দীক্ষা গুরু। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- গুরু ধরার জন্য যে আনুষ্ঠানিকতা বা কাউকে গুরু হিসেবে স্বীকার করার জন্য যে অনুষ্ঠান, তার কি কোনো প্রয়োজন আছে ?
প্রকৃতির একটি নিয়ম হলো- যে ব্যক্তি, যে জিনিস যত সহজে এবং যত দ্রুত লাভ করবে, সেই ব্যক্তি, সেই জিনিস, তত দ্রুত হারাবে। একারণেই মুসলমানদের "কবুল" বলে হওয়া বিয়ে "তালাক" বললেই শেষ হয়ে যায়, আর তিনদিন ধরে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হওয়া হিন্দু বিবাহ আমৃত্যু টিকে থাকে; এর মূল কারণই হলো হিন্দুদেরে বিবাহ যেমন সহজে হয় না, তেমনি তা সহজে ভাঙ্গেও না বা কখনো ভাঙ্গে না ।

এ্ছাড়াও আমরা অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে থাকি, কিন্তু তাকেই শিক্ষক বলে মানি বা স্যার বলে সম্বোধন করি, যাদের কাছে আমরা স্কুল কলেজে পড়ি বা প্রাইভেট পড়ি।এই ব্যাপারগুলো আমাদেরকে এটা শিক্ষা দেয় যে- যেকোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন রয়েছে, না হলে সেই ব্যাপারটির গুরুত্ব আমাদের কাছে হালকা হয়ে যায় এবং সেটা আমাদের কাছে এক সময় মূল্য হারায়। যেমন অনলাইনে আামি সনাতন ধর্ম বিষয়ে নানা কিছু লিখে হিন্দুদেরকে জ্ঞান দিই ব'লে, অনেকেই আমাকে গুরু বলে মানে, এদের মধ্যে যারা আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকে বা আমার সাথে যোগাযোগ রাখে, তাদের মধ্যে হয়তো সেই ফিলিংস বজায় থাকে, কিন্তু যাদের সাথে কোনো কারণে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, তারা কিন্তু আমাকে আর সেভাবে মনে রাখে না বা রাখতে পারে না। এই ব্যাপারটি এজন্যই ঘটে যে, তাদের সাথে আমার যে গুরু শিষ্যেরে মতো সম্পর্ক, সেই সম্পর্কটি আনুষ্ঠানিক নয়, অনানুষ্ঠানিক। কিন্তু এই সম্পর্কটি যদি আনুষ্ঠানিক হতো, তারা কিন্তু কখনোই আমাকে ভুলতে পারতো না। এজন্যই যেকোনো সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকততার প্রয়োজন রয়েছে, এই বোধ থেকেই উৎপত্তি দীক্ষা অনুষ্ঠানের।

সুতরাং গুরু দীক্ষার ব্যাপারটা যে বাস্তবসম্মত, সেটা প্রমাণিত। এর পরের প্রশ্ন হচ্ছে- গুরুকে পূজা করা যাবে কি না ?

গুরুকে প্রণাম করতে হবে, তার সেবা করতে হবে, এটা গীতার নির্দেশ, না হলে গুরুর নিকট থেকে জ্ঞান লাভ করা যাবে না; কারণ, কথায় বলে- বিনয়ে বিদ্যা। কিন্তু কোনো মানুষকে যেহেতু দেবতার আসনে বসিয়ে দেবতাদের মতো পূজা করা যাবে না, তাই গুরুকেও পূজা করা যাবে না। গুরুকে দেবতার আসনে বসিয়ে যারা পূজা করে,, সেই ভুল বা পাপ সেই শিষ্যদের নয়, সেই ভুল বা পাপ সেই গুরুর, যার ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত সেই শিষ্যরা।
গুরুকে শ্রদ্ধা করা যাবে, সম্মান করা যাবে, ভক্তি করা যাবে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাকে দেবতার আসনে বসিয়ে দেবতার মতো ফুল জল দিয়ে পূজা করা যাবে না, এমন ভুল কথা তো গীতায় থাকতে পারে না, তাই এই ব্যাপারে আমি তোমার সাথে একমত।

এরপর আাসি অবতারের প্রশ্নে। তুমি কি শিউর যে গীতায় কোনো অবতারের কথা বলা নেই ?

তোমাকে আগেই বলেছি- গীতা হলো সনাতন ধর্মের সারগ্রন্থ, এখানে কোনো বিষয়ের ডিটেইলস নেই, আছে শুধুমাত্র বিষয়ের ইঙ্গিত।

গীতার ৪/৭,৮ নং শ্লোকে, "যদা যদা হি ধর্মস্য … সম্ভবামি যুগে যুগে"র মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ অবতারতত্ত্বের কথা বলেছেন, এর মাধ্যমে তিনি যে নিজেও অবতার, সেটা স্বীকার করেছেন এবং অন্যান্য অবতারণের মধ্যে একজন প্রধান অবতার রামের কথা বলেছেন গীতার ১০ম অধ্যায়ের ৩১ নং শ্লোকে, "রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্" অর্থাৎ অস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি রাম, এই কথা বলার মাধ্যমে। আর পুরাণসমূহে সকল অবতারের কথা যিনি বলেছেন, সেই বেদব্যাস মুনিও যে স্বয়ং তিনিই অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ, সেটা তিনি বলেছেন গীতার ১০/৩৭ নং শ্লোকে, "মুনিনামপ্যহং ব্যাসঃ" অর্থাৎ, মুনিগণের মধ্যে আমি ব্যাস, এই কথা বলার মাধ্যমে। তাহলে গীতায় অবতার বা অবতার তত্ত্বের কথা উল্লেখ থাকলো না কিভাবে ?

শোনো, অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করছি, ফেসবুকে তুমি সনাতন ধর্ম সম্পর্কে যা তা বলে যাচ্ছো, যার বেশির ভা্গেরই কোনো ভিত্তি নেই, যার প্রমাণ আজকের এই প্রবন্ধে দিয়ে দিলাম। আমি তোমাকে প্রথমত অনুরোধ করছি, সনাতন ধর্ম সম্পর্কে নিজের ভুল উপলব্ধিকে ফেসবুকে প্রচার না করতে, আমার অনুরোধের যদি তোমার কাছে কোনো মূল্য না খাকে, তাহলে তোমাকে হুমকি দিয়ে বলছি- এসব বাল ছালের প্রচার বন্ধ কর। না হলে সনাতন ধর্মের ব্যাপারে আমি যে কাউকে ছাড় দেওয়ার লোক নই, সেটা তুই হাড়ে হাড়ে নয় কোষে কোষে টের পাবি।

আশা করছি, কী বলছি, তা বুঝতে পেরেছিস।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment