শ্রীমদ্ভগ্বদগীতায় ভাগবান শ্রীকৃষ্ণ, সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্মের কথা বলেছেন। সাধারণ অর্থে সকাম কর্ম হলো যে কর্মের ফল আশা করা হয় এবং নিষ্কাম কর্ম হলো যে কর্মের ফল আশা করা হয় না। গীতার মতে, নিষ্কাম কর্মই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্ন জাগে যে, কাজ করে ফল আশা করা যাবে না, এটা আবার কেমন কথা! তাহলে কর্ম করে কী লাভ বা মানুষ এত পরিশ্রম করে কর্মই বা করবে কেনো ?
হিন্দু ধর্মের প্রত্যেকটা বিষয় অত্যন্ত উচ্চস্তরের জ্ঞান; তাই সাধারণ মানুষ সব সময় এগুলো ঠিক মতো বুঝতে পারে না। আর আমাদের হিন্দু সমাজে এমন কোনো আত্মস্বার্থ ত্যাগকারী ব্যক্তি বা ধর্মীয় সংগঠন নেই, যে বা যারা ঘরে ঘরে বা পাড়ায় পাড়ায় বা গ্রামে গ্রামে গিয়ে হিন্দুদেরকে এগুলো বোঝাবে বা শেখাবে।
হিন্দু পূজারী ব্রাহ্মনরা নির্দিষ্ট পূজার দিন দেবতার পায়ে দুচারটি ফুল তুলশী পাতা ছিটিয়ে, নমঃ নমঃ করে দুচারটি সংস্কৃত মন্ত্র, যা সাধারণ হিন্দুদের কাছে অবোধ্য, তা আবৃত্তি ক’রে- চাল, কলা আর দক্ষিণা নিয়েই বিদায় হয়, তারা হিন্দুদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান প্রদানের কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না; এমন কি যে পূজা তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা পাড়ার মন্দিরে গিয়ে করে সেই পূজা কেনো করা হচ্ছে, সেটাও তো তারা ৫/১০ মিনিট সময় ব্যয় ক’রে ভক্তদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বোঝাতে বা শোনাতে পারে, সেটাও তারা করে না। ফলে, বছর বছর টাকা পয়সা খরচ করে পুরো ছাত্রজীবন ধরে সরস্বতী পূজা করে এলেও, সরস্বতী বিদ্যার দেবী, আর সরস্বতী পূজা করা হয় জ্ঞান অর্জনের জন্য- এতটুকু ছাড়া বেশির ভাগ হিন্দু আর সরস্বতী পূজা সম্পর্কে কিছু জানে না। দেবী সরস্বতীর মূর্তি শুভ্র কেনো, তার বাহন রাজহাঁস কেনো, তার হাতে বীণা কেনো, এই সব প্রশ্নের উত্তর তার আজীবন আজানা ই থেকে যায়।
এছাড়াও হিন্দু সমাজে বৈষ্ণব নামধারী কিছু গুরু আছে, এরা মাঝে মাঝে শিষ্যদের বাড়িতে সঙ্গ-পাঙ্গো নিয়ে দল বেঁধে যায়, দু চার দিন থাকে আর শিষ্যকে নিঃস্ব করে নিজেদের পেট ও পকেটের পূজা করে। ছোটো বেলা থেকে আমাদের বাড়িতে আমি অনেকবার গুরুর আগমন দেখেছি, কিন্তু একবারও দেখি নি, সন্ধ্যার পর সে বা তারা আমাদের বাড়ির বা আশে পাশের লোকজনকে ডেকে নিয়ে তাদেরকে কোনো ধর্মীয় উপদেশ বা জ্ঞান প্রদান করেছে। তাদের মুখে শুধু একটা কথাই বারবার শুনেছি, গুরু তোমাকে ধরতেই হবে, শিক্ষামন্ত্র বা দীক্ষামন্ত্র তোমাকে নিতেই হবে, না হলে তোমার আত্মার কোনো মুক্তি হবে না। এটা তারা এজন্যই বলে যে, যাতে তাদের শিষ্যসংখ্যা বাড়ে আর গুরুগিরির বিজনেসটা ঠিক থাকে।
আর আমাদের আশ্রমের সাধু-সন্ন্যাসী-মহারাজ, যাদের কাজই হলো হিন্দুদের দুর্দশা দেখেও জপ ধ্যানের নামে চোখ বন্ধ করে থাকা আর হিন্দুদের পকেট ফাঁকা করে বড় বড় মন্দির বানানো; কিন্তু তাদের উদাসীনতার ফলে, হিন্দুধর্মের জ্ঞান না পেয়ে, ইসলামী আগ্রাসনের মুখে পড়ে, হিন্দু ছেলে মেয়েরা যদি লাভ জিহাদের ফাদেঁ পড়ে বা মুসলমানদের মিথ্যা প্রচারণায় মুগ্ধ হয়ে আস্তে আস্তে মুসলমান হয়ে যায় এবং দেশে বা কোনো নির্দষ্টি এলাকায় যদি হিন্দুদের সংখ্যা কমে যায়, তাহলে ঐসব আশ্রম বা মন্দির মুসলমানরা একদিন দখল ক’রে সেটাকে মসজিদ বানিয়ে সেখান থেকে যে আজান দেবে আর সেই আশ্রম বা মন্দিরে নামাজ পড়বে, সেটুকু বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞানও এদের নেই, কিন্তু এরা নিজেদের মনে করে দিব্যজ্ঞানী এবং এদের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে হিন্দুরা নিজেদেরকে ধন্য মনে করে, হায়রে হিন্দু সমাজ!
যা হোক ফিরে যাই সকাম ও নিষ্কাম কর্মের আলোচনায়, গীতার জ্ঞান এসেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে, যুদ্ধ শুরুর আগে। তাই গীতার বাণীগুলো যুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করতে হবে।
আধ্যাত্মিক অর্থে সকাম কর্ম সেটাই, যেটা মানুষ মনে করে যে সে নিজে তা করছে; এই কর্মের ফল মানুষকে ভোগ করতে হয় জন্ম জন্মান্তর ধরে। আর নিষ্কাম কর্ম সেটাই, যেটা মানুষ মনে করে যে, ঈশ্বর তাকে দিয়ে ঐ কাজটি করাচ্ছেন; এমন কর্মের কোনো কর্মফল নেই, তাই তা ভোগ করতেও হয় না।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, স্বজনদেরকে হত্যা করতে হবে ভেবে অর্জুন যখন যুদ্ধ করবে না বলে পিছিয়ে আসছিলো, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, " তুমি নিষ্কামভাবে যুদ্ধ করো " অর্থাৎ ঈশ্বর তোমাকে দিয়ে এই যুদ্ধ করাচ্ছেন, এমনটা ভাবো; তাহলেই তোমার দ্বারা যে হত্যা হবে তাতে তোমার কোনো পাপ হবে না, আর তোমাকে সেই হত্যার কর্মফলও ভোগ করতে হবে না।
এই হলো, সকাম ও নিষ্কাম কর্মের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা।
নিষ্কাম কর্মের অর্থ "কর্ম করে ফলের আশা না করা নয়” ঈশ্বর তাকে দিয়ে কর্মটি করাচ্ছেন, এই মনোভাব নিয়ে কর্মটি করা।
সুতরাং হিন্দু ধর্ম রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো হিন্দু যদি নিষ্কামভাবে যুদ্ধ করে অর্থাৎ পার্থিব কোনো লাভের কথা চিন্তা না ক’রে ঈশ্বর তাকে দিয়ে ঐ কর্মটি করাচ্ছেন, এমন মনোভাব নিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা বা বিনাশও করে, তাহলেও ঐ ব্যক্তির কোনো পাপ বা অন্যায় হবে না এবং এই কর্মের কোনো ফলও তাকে ভোগ করতে হবে না; কিন্তু সবই করতে হবে ধর্ম ও সমাজ রক্ষার জন্য, বৈষয়িক কোনো লাভের কথা চিন্তা না করে।
উপরে সরস্বতী পূজা প্রসঙ্গে তিনটি প্রশ্নের কথা বলেছি, যারা উত্তরগুলো জানেন না, তাদের জন্য বলছি- মূর্তি পূজা প্রসঙ্গে একটা কমন ব্যাপার সব হিন্দুকে মাথায় রাখতে হবে যে, যেকোনো মূর্তি- তা মাটির, পাথরের বা সোনার হোক, কোনো মূর্তির মধ্যে কোনো শক্তি নেই, যদি থাকতো তাহলে গজনীর সুলতান মাহমুদ ১৭ বার সোমনাথ মন্দির আক্রমন করে মহাদেবের মূর্তি ভেঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেগুলো দিয়ে মসজিদে উঠার সিঁড়ি বানাতে পারতো না আর বর্তমানেও বাংলাদেশের মুসলমানরা প্রতি বছর শত শত মূর্তি ভাঙতে পারতো না। তাহলে মূর্তির মধ্যে শক্তি কোথায় ? মূর্তি পূজা কী বৃথা ?
মূর্তি প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, মূর্তি একটি জড় পদার্থ এবং বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে জড় পদার্থের যে সহ্য শক্তি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, মাটি বা পাথর বা অন্য যে ধাতু দিয়ে তৈরি কোনো মূর্তির মধ্যেও ঠিক সেই শক্তিই থাকে বা আছে। এই মূর্তির মধ্যে এমন কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা নেই যে, কেউ আপনাকে আক্রমন করলে, সেই আক্রমন প্রতিহত করে আপনাকে সে বাঁচাবে। তাহলে মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যই বা কী আর তার স্বার্থকতা ই বা কোথায় ?
মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যও ঠিক আছে আর তার স্বার্থকতাও আছে, যদি সেই উদ্দেশ্যকে আমরা হিন্দুরা ঠিক মতো বুঝতে পারি।
আপনি শিবের ভক্ত এবং নিয়মিত শিবের পূজা করেন, কিন্তু বাড়িতে শিবের অস্ত্র ত্রিশুল নেই, শিব আপনাকে রক্ষা করবে কিভাবে ?
মেয়েদের বলছি, আপনি কালীর মহাভক্ত এবং দু্ই বেলা মন্দিরে গিয়ে মা মা বলে কান্নাকটি করেন, কিন্তু একবারও ভাবেন না কেনো কালীর গলায় নরমু্ণ্ডের মালা আর কেনো তার হাতে খড়গ, কালী আপনার ধর্ষিতা হওয়া ঠেকাবে কিভাবে ?
একবারও কি ভেবে দেখেছেন, কেনো দুর্গার ১০ টি হাত, আর কেনো প্রায় সব হাতে অস্ত্র ? প্রতিবছর যে দুর্গা এবং তার ১০ হাত ও তার অস্ত্রের পূজা করেন, আপনার বাড়িতে সেরকম কয়টি অস্ত্র রেখেছেন যে, মুসলমানদের হামলা বা আক্রমন থেকে আপনি নিজেকে এবং আপনার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদেরকে রক্ষা করতে পারবেন ?
বাড়ির প্রত্যেক সদস্যদের জন্য একটি করে শিবের ত্রিশুল রাখুন, মা কালীর হিংস্রতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করুন আর শক্তির চর্চা করে দেবী দুর্গার ১০ হাতের শক্তি নিজের বাহুতে সঞ্চয় করুন, কোনো অশুভ শক্তির ক্ষমতা নেই আপনার বা আপনার পরিবারের দিকে চোখ তুলে তাকানোর।
দেব-দেবীর মূর্তিকে আমরা হিন্দুরা যত শ্রদ্ধা ভক্তি ই করি না কেনো, মূর্তি সম্পর্কে চরম সত্য কথা হলো- কোনো মূর্তির মধ্যে কোনো শক্তি নেই, শক্তি আছে তার রূপ ও আদর্শের মধ্যে এবং সকল মূর্তি পূজা প্রতীকী পুজা মাত্র।
ফিরে যাই জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর কাছে, কারণ হিন্দুদের কাণ্ডজ্ঞানের খুবই অভাব।
দেবী সরস্বতীর শুভ্রমূর্তি নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক। এটা এই শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে হতে হবে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী। আর বাল্যকাল থেকে এই শিক্ষা নিয়ে যে বড় হবে, সে সারাজীবন তার সকল কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে পারবে। হিন্দুরা যে মুসলমানদের মতো জাত ক্রিমিনাল নয়, এটা তার একটা বড় কারণ।
রাজহাসেঁর মধ্যে এমন ক্ষমতা আছে যে, এক পাত্রে থাকা জল মিশ্রিত দুধের থেকে সে শুধুমাত্র দুধ শুষে নিতে পারে। এটা শিক্ষার্থীদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, সমাজে ভালো মন্দ সব কিছুই থাকবে, তার মধ্যে থেকে তোমরা শুধু ভালোটুকু শুষে নাও। অধিকাংশ হিন্দু ছেলে-মেয়েরা যে মেধাবী এবং চরিত্রবান বা চরিত্রবতী, এই শিক্ষাই তার কারণ।
হিন্দু ধর্ম হচ্ছে নাচ, গান সমৃদ্ধ শিল্পকলার ধর্ম। দেবী সরস্বতীর হাতের বীণা হচ্ছে সেই শিল্পকলার প্রতীক। আর এটা সুধীজন স্বীকৃত যে, যারা- নাচ, গান, কবিতা লেখা বা নাট্যচর্চার মতো শিল্পকলার সাথে জড়িত, তারা সাধারণত কখনো মিথ্যাও বলে না; চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ তো দূরের কথা। সাধারণভাবে সকল হিন্দুই যে সৎ প্রকৃতির, তার কারণ এটাই।
সুতরাং এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, হিন্দুধর্ম ও কালচারের কোনো কিছুই অযথা বা নিরর্থক নয়, সব কিছুরই সুষ্পষ্ট কারণ এবং তার কার্যকারিতা অর্থাৎ উপকারিতা রয়েছে । যারা জানে না, সেটা তাদের দুর্বলতা, কিন্তু সনাতন তথা হিন্দু ধর্মের কোথাও কোনো দুর্বলতা নেই।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রী কৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment