Thursday 21 May 2020

প্রসঙ্গ : রাম কর্তৃক বালীকে আড়াল থেকে তীর মেরে হত্যা


প্রসঙ্গ : রাম কর্তৃক বালীকে আড়াল থেকে তীর মেরে হত্যা

রাম ছিলেন ভগবান, ঈশ্বর নন। এজন্যই বলা হয় ভগবান রামচন্দ্র, রামকে কখনো পরমেশ্বর রামচন্দ্র বলা হয় না, যেমন কৃষ্ণকে বলা হয় পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ। যশ, বীর্য, ঐশ্বর্য, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য- এই ছয়টি গুনের অধিকারীকে বলে ভগবান, কিন্তু সকল গুনের অধিকারীকে বলে ঈশ্বর। ভগবানের ক্ষমতা সীমিত, কিন্তু ঈশ্বরের ক্ষমতা অসীম। একারণেই শ্রীকৃষ্ণের জীবনীতে দেখা যায় কোনো কিছুর জন্য শ্রীকৃষ্ণকে কখনো কারো পরমুখাপেক্ষী হতে হয় নি, ১০০কে সম্পূর্ণ হিসেবে ধরে নিয়ে বলা যায় তিনি একাই একশো। কিন্তু ভগবানের ক্ষমতা সীমিত বলে ভগবানরূপী অবতারদেরকে নানা কারণে নানাসময়ে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং এমন অনেক ঘটনা তাদের সাথে ঘটেছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো না বা তারা তা বুঝতে পারেন নি। যেমন - মহাভারতের কর্ণ যখন মিথ্যা বলে নিজেকে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়ে পরশুরামের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করতে যায়, তখন কর্ণ যে মিথ্যা বলছে, সেটা পরশুরাম বুঝতে পারে নি, এটা পরশুরামের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। একইভাবে সীতা যে রাবন কর্তৃক হরণ হতে চলেছে, সেটাও রাম জানতে পারেন নি তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে; শুধু তাই নয়, রাবন যে সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে, সেই জ্ঞানও রামকে লাভ করতে হয়েছে জটায়ুর নিকট থেকে, তাই রাম অনেক দিক থেকেই অসম্পূর্ণ।

রাম যে কারণে বালীকে হত্যা করে সেই কাহিনীটা হলো- বানরদের রাজা বালী, সুগ্রীব তার ছোট ভাই। একদিন দুই ভাই মিলে এক মায়াবী রাক্ষসের সাথে যুদ্ধ করছিলো। এক পর্যায়ে রাক্ষস গিয়ে এক পাহাড়ের গুহার মধ্যে লুকায়। বালী, সুগ্রীবকে সেই গুহার মুখ পাহারা দিতে বলে রাক্ষসকে মারার জন্য গুহার মধ্যে ঢুকে, কিন্তু এক বছর অপেক্ষা করার পরও বালী গুহা থেকে বের হচ্ছে না দেখে সুগ্রীব মনে করে সে নিশ্চয় মারা গেছে, এখন এই রাক্ষস যদি গুহা থেকে বের হয়, তাহলে রাজ্যের নিশ্চয় অনেক ক্ষতি করবে। এই ভেবে সুগ্রীব বড় পাথর দিয়ে গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে।

স্বামীর মৃত্যু হয়েছে মনে করে বালীর স্ত্রী ‘তারা’ বিধবার বেশ ধরে। বড় ভাই এর স্ত্রী এভাবে সারাজীবন বিধবা বেশে কাটাবে ? এই কথা ভেবে সুগ্রীব তার বৌদিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে বালীর স্ত্রী ‘তারা’ শাস্ত্রীয় নির্দেশ(অথর্ববেদ ১৮/৩/২, বিধবাদের পুনর্বিবাহ) মেনে পুনরায় সুগ্রীবকে বিয়ে করে রাজরানী হিসেবেই তার কর্তৃত্ব বজায় রাখে।

এই ঘটনার কিছুদিন পর, রাক্ষসকে মেরে বালী গুহার মুখে ফিরে দেখে গুহার মুখ বন্ধ এবং সুগ্রীবও সেখানে নেই। রাজপ্রাসাদে ফিরে বালী আরও দেখে সুগ্রীব রাজা হয়ে বসে আছে এমনকি তার স্ত্রী তারাকে সে বিয়ে করে নিয়েছে। বালি মনে করে রাজ্যের লোভেই সুগ্রীব পরিকল্পনা করে তাকে গুহার মধ্যে আটকে রেখে মেরে ফেলার জন্য ঐভাবে গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। এরপর বালী, সুগ্রীবের কোনো কথা বিশ্বাস না করে তাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে বিয়ে করার জন্য রুমার উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং রুমা রাজী না হলে তাকে বন্দী করে রাখে।

রাজ্য থেকে বিতাড়িত সুগ্রীব ঘুরতে ঘুরতে বনের মধ্যে রামের দেখা পায় এবং রামচন্দ্রকে সব খুলে বলে। ইতোপূর্বে রাবন সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে লংকায় বন্দী করে রেখেছিলো এবং রাম তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছিলো। রাম বিবেচনা করে রাবনের মতো বালীও এক দূরাচারী, কেননা সে সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা না করে শুধু সন্দেহের বশে সুগ্রীবকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছে, এছাড়াও রাবণের সীতাকে বন্দী করে রাখার মতো বালীও সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে বিয়েতে রাজী না হওয়ার জন্য বন্দী করে রেখেছে। এভাবে রামের চোখে রাবন ও বালী ছিলো সমান অপরাধী। তাই রাম, বালীকে রাবনের আগেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়, একারণেই যে সুগ্রীব রাজা হলে লঙ্কা অভিযানের সময় সে তার সহায়তা পাবে, এই ঘটনাটিও রাম যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তা প্রমাণ করে।

যা হোক, এরপর রাম, বালীকে হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, সুগ্রীবকে বালির সাথে যুদ্ধ করতে পাঠায়; পরিকল্পনা হলো- সুগ্রীব ও বালি যখন যুদ্ধ করতে থাকবে, তখন রাম, আড়াল থেকে বালী কে তীর মেরে হত্যা করবে। কিন্তু সু্গ্রীব ও বালির বেশভূষা এবং চেহারা একই রকম হওয়ায় যুদ্ধ চলাকালীন, কোনটা সুগ্রীব এবং কোনটা বালী এটা বুঝতে না পারায় তীর নিক্ষেপ থেকে বিরত থাকে, ফলে সু্গ্রীবের কাছে পরাজিত হয়ে বালী পলায়ন করে; এই ঘটনাও রামের অসম্পূর্ণতারই প্রমাণ দেয়।

যা হোক, তারপর সুগ্রীবের দেহে একটি চিহ্ন লাগিয়ে দিয়ে, রাম, সুগ্রীবকে আবার বালীর সাথে যুদ্ধ করতে পাঠায়, এই বার রাম, বালীকে চিনতে পেরে, আড়াল থেকে তীর মেরে তাকে আহত করে। এরপর বালী, রামকে বলে-

"তুমি যদি প্রকাশ্যে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে তবে আজই নিহত হতে। সুগ্রীবের প্রিয় কামনায় আমাকে মেরেছ, কিন্তু যদি আমাকে বলতে তবে একদিনেই মৈথিলীকে (সীতা) উদ্ধার করতাম, দুরাত্মা রাবনের কণ্ঠ বন্ধন করে তাকে তোমার কাছে জীবিত এনে দিতাম।... তুমি আমাকে যে অধর্মত বধ করলে তা নিতান্তই অনুচিত।"

এর জবাবে রাম, বালীকে বলে,

"তুমি ধর্ম, অর্থ, কাম ও লোকাচার না জেনে কেন আমার নিন্দা করছ ? এই শৈলকানন সমন্বিত দেশ ইক্ষ্বাকুগণের অধিকৃত, ধর্মাত্মা ভরত এর শাসনকর্তা, আমি এবং অন্য রাজারা ধর্মের প্রসার কামনায় তাঁর আদেশে পৃথিবীর সর্বত্র বিচরণ করছি। তুমি কাম পরায়ণ, রাজধর্ম পালন কর না, তোমার বিগর্হিত কর্মে ধর্ম পীড়িত হয়েছেন। কেন তোমাকে বধ করেছি, তার কারণ শোন। তুমি সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ভ্রাতৃজায়াকে গ্রহণ করেছ। তুমি পাপাচারী, মহাত্মা সুগ্রীব জীবিত আছেন, তাঁর পত্নী রুমা তোমার পুত্রবধূস্থানীয়া, কামবশে তুমি তাকে অধিকার করেছ। বানর, তুমি ধর্মহীন, কামাসক্ত, ভ্রাতৃবধূকে ধর্ষণ করেছ, এজন্য এই বধদণ্ড তোমার পক্ষে বিহিত।... তুমি জেনো যে ধর্মসংহত মহৎ কারণেই তোমাকে শাস্তি দিয়েছি। মনু বলেছেন, পাপী রাজদণ্ড ভোগ করলে নির্মল হয়ে পুন্যবান সাধুর ন্যায় স্বর্গে যায়, কিন্তু রা্জা যদি পাপীকে শাসন না করেন তবে স্বয়ং পা্পগ্রস্ত হন। তোমাকে আমি ক্রোধবশে হত্যা করি নি, বধ করে আমার মনস্তাপও হয় নি।... বানরশ্রেষ্ঠ, রাজা দেবতাস্বরূপ, তিনি প্রজাদের ধর্মরক্ষা, প্রাণরক্ষা ও শুভসাধন করেন, তাকে হিংসা বা নিন্দা করা বা অপ্রিয় কথা বলা উচিত নয়। তুমি ধর্মের তত্ত্ব না জেনেই আমার দোষ দিচ্ছ।

তখন বালী কৃতঞ্জলি হয়ে বললেন, নরশ্রেষ্ঠ তুমি যা বলেছ তা যথার্থ, আমি প্রমাদবশে পূর্বে যা বলেছি তার জন্য দোষ নিও না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।"

মহাভারতের যুদ্ধে, উভয়পক্ষ বসে যুদ্ধের একটা নিয়ম ঠিক করেছিলো, সেই নিয়ম প্রথম ভঙ্গ করেছিলো কৌরবরা, এর ফলে পাণ্ডবরাও কিছু নিয়ম ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। ফলে নিয়ম ভাঙ্গার দোষে উভয় পক্ষই দোষী হয়। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "তাহলে কী পার্থক্য উভয় পক্ষের মধ্যে ? পার্থক্য শুধু উদ্দেশ্যে।" এর মানে হলো পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে যেহেতু ছিলো ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই উদ্দেশ্যে যদি তারা কিছু নিয়ম ভাঙ্গেও, সেটা দোষের কিছু নয়। এই একই বিষয় প্রযোজ্য রাম-বালীর প্রসঙ্গেও। রাম, সর্বক্ষমতাসম্পন্ন ঈশ্বর ছিলেন না, তাই তার মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলো, যে সীমাবদ্ধতার ফলে রাম, একাই রাবনকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারবে না বিবেচনা করে সুগ্রীবের সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা করে এবং যার কারণে অধর্মী বালীকে আড়াল থেকে তীর মেরে হত্যা করে। যদিও এই ঘটনার মধ্যে রামের বীরত্বের পরিচয়ের অভাব আছে, কিন্তু রামের উদ্দেশ্য ছিলো যেহেতু দুষ্টের দমন করা এবং সেটা যেকোনো কৌশলেই করা যেতে পারে, তাই এই ঘটনায় রামের কোনো দোষ নেই, সেটা বুঝতে পেরেই মৃত্যুর পূর্বে বালী, রামকে তার মৃত্যুর জন্য দোষ না দিয়ে রামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এইভাবে রাম, বিষ্ণুর অবতার হিসেবে বালীকে উদ্ধার করে তার স্বর্গ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে।

রাম জানতো যে বালী শক্তিশালী এবং বালী যে রামকে বলেছিলো, তুমি যদি আমাকে বলতে তাহলে এক দিনেই রাবণকে হত্যা করে সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতাম, এটাও সত্য এবং বালীর সেটা করার ক্ষমতা ছিলো। তারপরও রাম, বালীর সাহায্য না নিয়ে বালীকে হত্যা করতে গেলো কেনো ?

রাম একটা বিষয় জানতো যে বালী, রাবনের মতোই অধর্মী, দুরাচারী। তাই এক অধর্মীকে শাস্তি দিতে আরেক অধর্মীর সাহায্য নেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়; কারণ, এটা করলে পক্ষান্তরে অধর্মকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়; এজন্যই রাম, বালীর সাহায্য না নিয়ে দুষ্টের দমন এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্যই বালীকে একটি ছলনার মাধ্যমে হত্যা করে।

বীরত্বের দিক থেকে হয় তো এটা দোষের, কিন্তু ধর্ম প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্যের দিক থেকে এটা একটা জাস্ট কৌশল মাত্র এবং নিজের থেকে শক্তিশালী কোনো দুরাচারকে কিভাবে দমন করতে হয়, এটা সাধারণ মানুষের জন্য একটা শিক্ষাও।

রামচন্দ্র, শ্রী বিষ্ণুর অংশাবতার, তাই রাম, সকল প্রকার প্রশ্নের উর্ধ্বে থাকবেন, এমনটা আশা করা যায় না, তাই রামের জীবনে ঘটা অনেক বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যায়; কিন্তু শ্রী বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হলেন সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে, তাঁর জীবনের এমন কোনো ঘটনা নেই, যেখানে তাঁর চরিত্র, জ্ঞান এবং ক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যায়। যেসব প্রসঙ্গে শ্রীকৃ্ষ্ণকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, মনে রাখবেন সেই বিষয়টা হয় আপনি ভুলভাবে জানেন অথবা জানেন না। শ্রীকৃষ্ণকে সঠিকভাবে জানতে পারলে বুঝতে পারবেন আদর্শ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হলেন শ্রেষ্ঠ। যদিও সকল অবতারের শিক্ষাই মানুষের জন্য আদর্শ, কিন্তু কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণকে তাদের জীবনের সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে মেনে চলে, কেউ যেমন তাকে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করে কখনো বিব্রত বা অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে পারবে না; তেমনি তার জীবন সহজ, সরল ও সুন্দর হবে এবং সে মুক্তি বা মোক্ষপ্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে। এজন্য আদর্শ বা ইস্টদেব হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকে আশ্রয় করাই বেস্ট।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment