Sunday, 24 May 2020

তুলসী দেবীর প্রতি সীতার অভিশাপের ঘটনা : একটি চরম কৃত্তিবাসী মিথ্যাচার


তুলসী দেবীর প্রতি সীতার অভিশাপের ঘটনা : একটি চরম কৃত্তিবাসী মিথ্যাচার

তুলসী গাছে কেনো কুকুরে প্রস্রাব করে ? বটগাছ কেনো অমর এবং ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ফল্গু নদী কেনো অন্তঃসলিলা ? এই ঘটনাগুলোর কারণ ও ব্যাখ্যা হিসেবে কৃত্তিবাস ওঝা তার অনূদিত রামায়ণে একটি সুন্দর মিথ্যা গল্প ফেঁদেছেন, যে গল্পটি গত ৫/৬ শ বছর ধরে বাঙ্গালি হিন্দুরা বিশ্বাস করে আসছে, যার সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের চেষ্টা বাংলায় আজ পর্যন্ত কেউ করে নি; এক পাঠকের প্রশ্নের ক্ষুধা মেটাতে এই বিষয়টি নিয়েই আজ আলোচনা করছি-

এ প্রসঙ্গে- বাংলায় রামায়ণের সফল অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা যা বলেছেন, সেই গল্পটি আগে আপনাদেরকে সংক্ষেপে বলে নিই-

বনবাসকালে রাম যখন তার পিতার মৃত্যুর সংবাদটি জানতে পারে, তখন তারা তাদের মৃত পিতার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং পিণ্ডের সামগ্রী সংগ্রহের জন্য রাম ও লক্ষ্মণ বাইরে গেলে সীতা ফল্গু নদীর তীরে বালি নিয়ে খেলতে শুরু করে। এমন সময় সেখানে সীতার শ্বশুর দশরথ এসে বলে,

শুন ওমা সীতে।
ক্ষুধার জ্বালায় আমি না পারি তিষ্ঠিতে।।
তুমি বধূ, আমি তব শ্বশুর-ঠাকুর।
দিইয়া বালির পিণ্ড ক্ষুধা কর দূর।।
এরপর দশরথ ও সীতার কথোপকথন এরকম-
দেব কহি যে তোমারে।
কি মতে দিইব পিণ্ড রাম অগোচরে।।
মনে কিছু না করিও, ওমা চন্দ্রমুখি।
লোক জন ডাকি আনি করে রাখ সাক্ষী।।
ভাল ভাল কহিলেন সীতা চন্দ্রমুখী।
আদ্যের তুলসী তুমি হয়ে থাক সাক্ষী।।
জিজ্ঞাসা করেন রাম আসিয়াই যদি।
বটবৃক্ষ কহিবেক আর ফল্গুনদী।।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া সীতা করেন জ্ঞাপন।
দশরথ-কথা সব কহিবে ব্রাহ্মণ।।
ইহা শুনি দশরথ হর্ষে উঠি রথে।
লইয়া বালির পিণ্ড গেলা স্বর্গপথে।।

-পদ্যের আকারে, এখানে কৃত্তিবাস যা বলেছেন, তার মূর কথা হলো- সীতা যখন ফল্গু নদীর তীরে বালি নিয়ে খেলছিলো, তখন সেখানে দশরথ এসে উপস্থিত হয়ে সীতার কাছে পিণ্ড চায়, যাতে দরশথের ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। কিন্তু রামের অগোচরে সীতা পিণ্ড দিতে ইতস্তত বোধ করলে দশরথ বলে কউকে সাক্ষী রেখে পিণ্ড দাও, রাম ফিরে এলে ওরা রামের কাছে সাক্ষ্য দেবে। সীতা তাই করে এবং দশরথ পিণ্ড নিয়ে পুনরায় স্বর্গের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করে।
এরপর রাম ফিরে এলে, সীতা বলে, সে দশরথকে পিণ্ড দিয়েছে, রাম বলে তার প্রমাণ কী ? তখন সীতা তার সাক্ষীদেরকে হাজির করে, কিন্তু এক রহস্যময় কারণে চার সাক্ষীর তিনজন- এক ব্রাহ্মণ, একটি তুলসী গাছ এবং ফল্গু নদী বলে যে তারা দশরথকে দেখে নি; এই ঘটনাগুলোর বর্ণনা কৃত্তিবাস করেছে, এভাবে-

সীতা কহিলেন, গোঁসাই করি নিবেদন।
জিজ্ঞাসা করহ তুমি ডাকিয়া ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ বলেন, খর্ব্ব দিব রঘুনাথে।
মিথ্যা বাক্য কব আজি রামের সাক্ষাতে।।
ডাকিয়া ব্রাহ্মণে জিজ্ঞাসেন রঘুনাথে।
তোমরা দেখেছ মোর পিতা দশরথে।।
ব্রাহ্মণ কহেন তবে রামের সাক্ষাতে।
আমরা না দেখিয়াছি রাজা দশরথে।।
এ কথা শুনিয়া রাম কন হাসি হাসি।
লজ্জায় মলিন হৈল সীতা সুরূপসী।।
মিথ্যা কৈয়া ব্রাহ্মণ এতেক দিলে তাপ।
ক্রোধে তনু থর থর, দিনু তোমা শাপ।।
লক্ষ তঙ্কার দ্রব্য যদি থাকে তব ঘরে।
ভিক্ষার লাগিয়া যেও দেশ-দেশান্তরে।

-এর সারাংশ হলো- সীতা যখন ব্রাহ্মণকে বলতে বলে যে ঘটনা কী ঘটেছিলো, তখন ঐ ব্রাহ্মণ বলে যে, দশরথকে সে দেখে নি; এতে আপাতদৃষ্টিতে সীতা মিথ্যা বলার অপরাধে রামের কাছে অপদস্থ হয়, ফলে রেগে গিয়ে সীতা, ঐ ব্রাহ্মণকে এই বলে অভিশাপ দেয় যে, ঘরে যতই অর্থ সম্পদ থাক না কেনো, তাকে অপরের কাছে হাত পাততেই হবে।

তারপর সীতা সাক্ষী হিসেবে হাজির করে তুলসীকে, কিন্তু তুলসীও মিথ্যা বলে এভাবে-

শ্রীরাম বলেন, তুলসী শুন মোর কথা।
সাক্ষাতে দেখেছ মোর দশরথ পিতা।।
তুলসী বলেন তবে প্রভু রঘুবরে।
আমরা না দেখিয়াছি তোমার পিতারে।।
কথা শুনি জানকীর জন্মে মনস্তাপ।
যা রে যা তুলসী আমি তোরে দিনু শাপ।।
এত দুঃখ দিলি তুই আমার অন্তরে।
আভূমি জন্মিও তুমি হৈয়া সর্ব্বত্তরে।।
ক্রোধভরে সীতা দেবী কহেন এমন।
তোর পত্র শ্রীহরির আদরের ধন।।
অপবিত্র স্থানে তোর অবস্থিতি হবে।
শৃগাল কুক্কুর মূত্র পুরীষ ত্যজিবে।।

-এর সারমর্ম হলো তুলসী মিথ্যা বললে, সীতা তাকে এই বলে অভিশাপ দেয় যে- তোর গায়ে শিয়াল কুকুর প্রস্রাব ও পায়খানা করবে।

যা হোক, তারপর সীতা তার কর্মের সাক্ষী হিসেবে হাজির করে ফল্গু নদীকে, কিন্তু ফল্গু নদীও বলে-

শুন প্রভু রঘুনাথ।
আমি নাহি দেখিয়াছি রাজা দশরথ।।

এতে সীতা ক্ষেপে গিয়ে ফল্গু নদীকেও অভিশাপ দিয়ে বলে-

আমি আজি দিব শাপ এ ফল্গুনদীরে।।
অন্তঃশীলা হয়ে তুমি বহিও সর্ব্বকাল।
তোমারে ডিঙ্গিয়া যাবে কুক্কুর শৃগাল।।

যা হোক, তারপর সীতা সাক্ষী হিসেবে হাজির করে বটগাছকে; বটগাছ, রামকে বলে পূর্বের তিনজন মিথ্যা বলেছে, আমি রাজা দশরথকে সীতার হাত থেকে পিণ্ড নিয়ে স্বর্গে গমন করতে দেখেছি। এতে সীতা খুশি হয়ে বটগাছকে আশীর্বাদ দেয় যে, সে চির অমর হবে। এই ঘটনাটিকে কৃত্তিবাস বলেছেন এভাবে-

বটবৃক্ষ কহে, শুন কমল-লোচন।
মিথ্যা সাক্ষ্য ইহারা দিলেক সর্ব্বজন।।
ধনলোভে মিথ্যা কথা কহিল ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণের অনুরোধে অন্য দুই জন।।
-------------------
বালি-পিণ্ড লয়েছিলা সীতা ডান হাতে।
আপনি লইলা তাহা রাজা দশরথে।।
খাইয়া সীতার পিণ্ড প্রফুল্ল-অন্তরে।
দেখিতে দেখিতে রাজা গেলা স্বর্গপুরে।।
শুনিয়া বৃক্ষের কথা কন রঘুবর।
চিরজীবী হও বট অক্ষয় অমর।।
পিণ্ড-দান করি মনে ভাবেন জানকী।
বারে বারে সবাকারে করিয়াছি সাক্ষী।।
তুষ্ট হয়ে বর দিব তোমায় কেবল।
শীতকালে উষ্ণ হবে, গ্রীষ্মেতে শীতল।।
পুনর্ব্বার সীতা তারে দিলা এই বর।
ডালে ডালে হবে তব পল্লব বিস্তর।।
মনোহর সুশীতল রবে আনিবার।
নিষ্পত্র না হবে শাখা কদাপি তোমার।।
সুশীতল রাখিবে, যে যাবে তব তলে।
সর্ব্বদা আনন্দে রবে নিজ পত্র-ফলে।।
এইরূপে বটবৃক্ষে আশীর্ব্বাদ করি।
বিদায় দিলেন তারে রামের সুন্দরী।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কথা সুধাভাণ্ড।
পরম পবিত্র এই অযোধ্যার কাণ্ড।।

কৃত্তিবাসের বলা গল্প এতক্ষণ শুনলেন, এবার দেখুন ঘটনার সাপেক্ষে আমার বিশ্লেষণ:

এখানে আসলে কেউ মিথ্যা বলে নি, মিথ্যা বলেছে কৃত্তিবাস। কারণ, মূল রামায়ণে এই ধরণের ঘটনার কোনো নামগন্ধও নেই। রামের পিণ্ডদানের ঘটনার বিবরণ আপনারা পাবেন রাজশেখর বসু অনূদিত গ্রন্থের অযোধ্যা কাণ্ডের ২৫ তম অধ্যায় "রাম ভরত মিলন" পর্বে। এখানে রামের পিণ্ডদান সম্পর্কে বলা আছে-

"দশরথের মৃত্যুবৃত্তান্ত শুনে রাম সীতা লক্ষ্মণ কাতর হয়ে অশ্রুপাত করতে লাগলেন। সুমন্ত্র রামকে মন্দাকিনীর তীরে নিয়ে গেলেন। রাম জলে অবতরণ করে দক্ষিণাস্য হয়ে অঞ্জলিপূর্ণ জল নিয়ে সরোদনে বললেন, পিতৃলোকগত হে রাজশার্দুল, আমার প্রদত্ত এই নির্মল জলে তৃপ্তিলাভ করুন। তারপর তিনি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে তীরে উঠে এসে কুশের উপরে বদরীমিশ্রিত ইঙ্গুদীপিণ্ড রেখে বললেন, মহারাজ, প্রীত হয়ে এই পিণ্ড ভোজন করুন। এই বস্তুই এখন আমাদের আহার্য, সেজন্য আপনাকেও নিবেদন করছি। তর্পণ ও পিণ্ডদান শেষ করে সীতা ও ভ্রাতৃগণের সঙ্গে রাম তাঁর কুটিরে ফিরে এলেন।"

রাম, তার পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে ভরতের কাছে। কিন্তু ভরত একা, বনে, রামের কাছে যায় নি, ভরতের সাথে গিয়েছিলো তাদের প্রধানমন্ত্রী সুমন্ত্র, রামের কয়েকজন বিমাতাসহ বিশিষ্ট প্রজাগণ; তাদের উদ্দেশ্য ছিলো রামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে এনে রাজপদে অভিষিক্ত করা। কিন্তু এই সিচুয়েশনকে কৃত্তিবাস কিভাবে বর্ণনা করেছে, সেটা উপরে আপনার দেখেছেন। দশরথের মৃত্যু সংবাদে যেখানে রাম সীতা লক্ষ্মণ কাতর হয়ে অশ্রুপাত করছে, সেখানে কৃত্তিবাস কিভাবে সীতাকে দিয়ে ফল্গু নদীর তীরে বালি নিয়ে খেলালেন ? আর এখানে যে নদীটির কথা বলা আছে, সেটা হলো মন্দাকিনী নদী, ফল্গু নদী নয়। আর এই মন্দাকিনী নদী ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে, মোটেও উড়িষ্যাতে নয়।

তাছাড়া কোনো এক ব্রাহ্মণের না হয় সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু বটগাছ, তুলসী গাছ ও নদীর কি সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষমতা আছে যে তারা সাক্ষী দিয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানাবে ?

বিবর্তনবাদ অনুযায়ী সৃষ্টি প্রক্রিয়ায়, প্রথম, জলে প্রাণের উৎপত্তি হলেও, জলে জলজ প্রাণীর বিকাশের সাথে সাথে স্থলে ঘটে উদ্ভিদের বিকাশ। এই সূত্রে ধরে নেওয়া যায় সৃষ্টির আদি থেকেই স্থলে উদ্ভিদ জাতীয় তুলসী এবং বটগাছ আছে এবং কৃত্তিবাস, বটগাছের যে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছে, বটগাছের সেই বৈশিষ্ট্য, বটগাছ সৃষ্টির পর থেকে বটগাছের সাথে আছে; কৃত্তিবাসের বর্ণনা অনুযায়ী সীতার আশীর্বাদ থেকে বটগাছ যদি এই বৈশিষ্ট্য লাভ করে, তাহলে বটগাছের আগের বৈশিষ্ট্য কী ছিলো ?

একই কথা বলা যায় তুলসী গাছের ক্ষেত্রে। তুলসী একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। দেখতে একইরকম হলেও পুঁটি মাছ যেমন কখনো ইলিশের সমান হতে পারবে না; তেমনি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদেরা কখনো বৃক্ষ অর্থাৎ শক্ত ও বিশাল গাছে পরিণত হতে পারবে না। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যই এরকম, এই গাছগুলো কখনো খুব বড় হয়ে মানুষের নাগালের বাইরে যেতে পারবে না, এরা হবে ঝোপঝাড় বিশিষ্ট; আর কুকুরের স্বভাব হলো ঝোপঝাড় জাতীয় কিছুতেই ঠ্যাং তুলে প্রস্রাব করা, এর শিকার শুধু তুলসী গাছই নয়, সব ধরণের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ; তাহলে এর জন্য শুধু তুলসীর বদনাম কেনো ? শুধু গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদই নয়, এক দেড় হাত উঁচু যেকোনো কিছুই কুকুরের মূত্র ত্যাগের শিকার, এমনকি যে কোনো দেয়াল এবং দেয়ালের মতো করে দাঁড়িয়ে থাকা রোদে শুকাতে দেওয়া শাড়ি কাপড়ও কুকুরের মূত্র ত্যাগের জায়গা, তাহলে কুকুরের এই স্বভাবের জন্য তুলসী দায়ী হবে কেনো ?

এবার আসি ফল্গু নদীর কথায়। ফল্গু নদীকে বলা হয় অন্তঃসলিলা নদী, এর মানে হলো মাটির নিচ দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো নদী নেই। ট্রেন যোগে মথুরা থেকে কোলকাতা আসার এই নদী আমি নিজে দেখেছি, দেখেছি এই নদী খুব গভীর নয়, বালি দ্বারা পূর্ণ, সেই বালি কয়েক হাত খুঁড়লেই নাকি জল পাওয়া যায়, এ আর আশ্চর্য কী ? শুধু নদীর তলা কেনো, পৃথিবীর সর্বত্র যেকোনো সমভূমিতে কিছু দূর খুঁড়লেই জল পাওয়া যাবে। তাই বলে মাটির নিচের সেই জল কি নদীর মতো এদিক থেকে ওদিকে প্রবাহিত হয় ? মোটেই না। মাটির নিচে জল স্থির থাকে মাত্র, মাটি খুঁড়লেই সেই জল পাওয়া যায়। ফল্গু নদীর তলদেশেও ঘটে সেই ঘটনা। কিন্তু মানুষ এত গভীরে না ভেবে কৃত্তিবাসের রামায়ণে যেহেতু সীতার অভিশাপে ফল্গু নদীর এই পরিণতির কথা বলা হয়েছে, আবার যেহেতু রামায়ণ হিন্দুদের একটি ধর্মগ্রন্থ এবং ফল্গু নদীর দেশ ভারত হিন্দু অধ্যুষিত এবং ফল্গু নদীর পিণ্ড দানের জন্য একটি তীর্থ স্থান, সেহেতু হিন্দু মানসে এই মিথ্যা গল্পটি খুব সহজে ঢুকে গেছে এবং হিন্দুরা তা ৫/৬শ বছর ধরে বিশ্বাস করে আসছে। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি মিথ্যা গল্প; কারণ, নদীর কোনো ক্ষমতাই নেই সাক্ষ্য দেওয়ার, সেখানে সত্য মিথ্যা তো দূরের কথা।

প্রাচীনকালে ফল্গু নদী নিশ্চয় প্রবাহিত হতো, কিন্তু আধুনিক যুগের মতো প্রাচীনকালে নদী খননের কোনো যন্ত্র না থাকায় নদীর জলের সাথে প্রবাহিত হয়ে আসা বালি, নদীর তলায় জমতে জমতে, সাধারণভাবে মাটির নিচে যে উচ্চতায় জল থাকে, ফল্গু নদীর তলদেশ সেই উচ্চতার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে বলেই নদীতে আর জল থাকে না, কিন্তু নদীর তলদেশে কয়েক হাত বালি খুঁড়লেই তা পাওয়া যায়। এটা আর কিছুই নয়, নদীর তলদেশে বালি জমার ফল। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এই ড্রেজিং করে দিলেই আবার যে স্বাভাবিক নদীতে পরিণত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, সীতার তথাকথিত অভিশাপকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে উড়িষ্যার সরকার এই প্রকল্প কোনোদিনই হাতে নেবে না; কারণ, এর সাথে ধর্ম বিশ্বাস জুড়ে আছে।

এবার আসি ব্রাহ্মণের কথায়, ব্রাহ্মণকে দিয়ে কেনো কৃত্তিবাস ওঝা এমন মিথ্যা বলালেন ?

প্রথমেই বলি- কৃত্তিবাস সম্ববত ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি রাম সীতার কোন সিচুয়েশনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। রাম, তার পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে ভরতের কাছে, সেই সময় ভরতের সাথে অন্তত কয়েকশত লোক ছিলো, আর রাম যেখানে কুটির বানিয়ে বাস করছিলো, তার পাশেই ছিলো ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রম; ফলে ভরতের আগমনের সময় ঋষি বশিষ্ঠও এই ঘটনার সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলো। এমন পরিস্থিতি থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে রাম লক্ষ্মণকে কৃত্তিবাস পাঠিয়েছেন পিণ্ড দানের সামগ্রী খুঁজতে এবং সীতাকে তিনি খেলতে লাগিয়েছেন ফল্গু নদীর তীরে তাও আবার বালু নিয়ে, যেটা শিশুমানসের অর্থহীন বিনোদনমূলক খেলা!

যা হোক, ব্রাহ্মণদের উপর কোনো সুপ্ত ক্রোধ থেকে যে কৃত্তিবাস এখানে এক ব্রাহ্মণ চরিত্র সৃষ্টি করে তাকে দিয়ে মিথ্যা বলিয়ে ব্রাহ্মণদেরকে ছোট করে ও ভিক্ষুক বানিয়ে তার প্রতিশোধ নিয়েছেন, এটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। সেই কারণটা হতে পারে এরকম :

ওঝাও একটি ব্রাহ্মণ পদবী এবং এর প্রাচীন অর্থ ছিলো উপাধ্যায়। আর উপাধ্যায়রা ছিলো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। সুতরাং প্রাচীন কালে যারা শিক্ষাদানের মতো কাজে নিয়োজিত ছিলো, তাদের নামের সাথেই যুক্ত হয়েছিলো উপাধ্যায়, আর তাদের বসবাসের এলাকার নাম যুক্ত হয়ে তারা হয়েছিলো অমুক- বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়; এই উপাধ্যায় থেকেই উপাধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষ শব্দের উৎপত্তি।

যা হোক, কর্মগুনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে উপাধ্যায় পদবীওয়ালা ব্রাহ্মণরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে সমাজে তারা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে এবং অপ্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা- ঝাঁড়, ফুঁক তন্ত্র মন্ত্রকে আঁকড়ে থাকায় ওঝারা সামাজিক সম্মানের দিক থেকে সমাজের তলানিতে এসে পড়ে। চিরদিনই সমাজের উঁচু শ্রেণির লোক, সমাজের নীচু শ্রেণিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে এবং নীচু শ্রেণিরা উঁচু শ্রেণিতে উঠার চেষ্টা করলে, কথা বার্তায় আকার ইঙ্গিতে নীচু শ্রেণি, উঁচুর শ্রেণির মাধ্যমে ছোট বা হেয় হয়েছে। ওঝা গোত্রের, সমাজের নীচু শ্রেণির একটি লোক, ধর্ম জ্ঞানের মাধ্যমে কাব্যচর্চা করে সমাজের উঁচু শ্রেণিতে বিশিষ্ট স্থান পেতে চাচ্ছে, এটা কি উ্ঁচু শ্রেণি ব্রাহ্মণরা সহজভাবে নিতে পেরেছে ? পারে নি। তাই কৃত্তিবাস, তার প্রতি ব্রাহ্মণদের কটূক্তির প্রতিশোধ নিয়েছে সীতার মাধ্যমে তাদেরকে অভিশপ্ত করে এবং সমাজে ছোট করে।

আর একটা ব্যাপার, সনাতন ধর্ম মতে বিশ্বাস করা হয় তুলসী গাছে স্বয়ং বিষ্ণু বা নারায়ণ বাস করেন। আর সীতা হলেন নারায়ণের নারী শক্তি লক্ষ্মীর অবতার, তাহলে সীতা রূপ লক্ষ্মী কিভাবে বিষ্ণুর আধার তুলসীকে কোনো কারণে অভিশাপ দিতে পারে ? এটা কখনোই বাস্তব নয়। তাছাড়া যে তিনজন মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, তারও তো কারণ থাকতে হবে। এমন তো কোনো কারণও নেই। অবশ্য কৃত্তিবাস বলেছে- ধনের লোভে ব্রাহ্মণ মিথ্যা বলেছে; কিন্তু এই মিথ্যা বলে সেই ব্রাহ্মণ কার কাছ থেকে ধন লাভ করার প্রত্যাশা করেছিলো, তারও তো কোনো বর্ণনা কৃত্তিবাস দেয় নি। আসলে মিথ্যা কারো না কারো কাছে কোনো না কোনোভাবে ধরা পড়েই, কৃত্তিবাসের মিথ্যাও এই ভাবে আমার কাছে ধরা পড়েছে এবং আমি মনে করি এই প্রবন্ধ পড়ার পর আপনাদের কাছেও তা পড়বে।

আশা করছি উপরের এই অলোচনা থেকে সীতার তথাকথিত অভিশাপের কাহিনী যে মিথ্যা তা আমার পাঠক বন্ধুদেরকে বোঝাতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

বি.দ্র # যদি বাংলাদেশে অবস্থিত কারো গদ্যে রচিত রামায়ণ, মহাভারত প্রয়োজন হয়, ইনবক্সে যোগাযোগ করবেন, স্বল্পমূল্যে কুরিয়ারের মাধ্যমে সেগুলো আপনাদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।

No comments:

Post a Comment