Thursday 21 May 2020

প্রসঙ্গ- মহামন্ত্র; গায়ত্রী এবং হরেকৃষ্ণ


প্রসঙ্গ #  মহামন্ত্র; গায়ত্রী এবং হরেকৃষ্ণ :

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে", এটা প্রথম পাওয়া যায় কলিসন্তরণ উপনিষদে, যে উপনিষদ সনাতন ধর্মের মূল ১২টি উপনিষদের অন্তর্ভূক্ত নয়। মূল ১২টি উপনিষদের ছত্রছায়ায় পরবর্তীতে বিভিন্ন জনের হাতে প্রায় এক/দেড়শ উপনিষদ রচিত হয়েছে, যেকারণে হিন্দুধর্মীয় সাহিত্যে ১০৮টি উপনিষদ বলে একটা কথা চালু আছে, এই কলিসন্তরণ উপনিষদ সেগুলোরই একটি। বেদের সাথে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত উপনিষদের সংখ্যা ১২টি, কলিসন্তরণ উপনিষদ তার বাইরে। যা হোক, কলিসন্তরণ উপনিষদের এই শ্লোকটি,  চৈতন্যদেব, নাম সঙ্কীর্তনের মাধ্যমে সমাজে কৃষ্ণ নাম প্রচার করার জন্য গ্রহণ করেন এবং ভক্ত পারিষদসহ খোল করতাল সহযোগে এই লিরিককে গানে রূপান্তরিত করে সমাজে কৃষ্ণ নাম প্রচার করেন।

আমি চৈতন্যদেবের একজন কট্টর সমালোচক, চৈতন্যদেবের জন্মের পর থেকে ৫০০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমার মতো সমালোচনা সম্ভবত চৈতন্যদেবের কেউ করে নি এবং আমি ই প্রথম চৈতন্যদেবের অবতার তত্ত্বকে শুধু অস্বীকারই করি নি, তার ভগবান তত্ত্বকেও খারিজ করেছি এবং যুক্তি প্রমাণসহ সেগুলো তুলে ধরেছি।

আমার এই সমালোচনার মূল কারণ সমাজ থেকে মিথ্যাকে উপড়ে ফেলা; কারণ, মিথ্যাই সমাজের জন্য মূল ক্ষতির বিষয়। মানুষ যতদিন সনাতনী থাকবে ততদিন সে আত্মরক্ষা করে শুধু টিকেই থাকবে না বাড়তেও থাকবে; কিন্তু যখনই কেউ চৈতন্যদেবের আদর্শে নিজেকে বৈষ্ণব ভাবতে শুরু করে তথন নপুংসকতা তার উপর ভর করে এবং এটা তাকে আত্মরক্ষার শিক্ষা তো দেয় ই না, বরং আস্তে আস্তে তাকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যায়।
চৈতন্যদেবের জীবনী গভীরভাবে স্টাডি করবেন, আমার কথার সত্যতার প্রমাণ পাবেন।

চৈতন্যদেবের জীবনের কোনো আদর্শ সমাজের জন্য গ্রহনযোগ্য না হলেও বা সেগুলো আমার পছন্দের না হলেও, চৈতন্যদেব যেভাবে সমাজে কৃষ্ণনাম প্রচার করেছেন, সেটা কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দের। কারণ, চৈতন্যদেবের আগে সমাজে কেউ এভাবে গান কীর্তনের মাধ্যমে আকর্ষণীয়ভাবে কৃষ্ণনাম প্রচার করে নি। কিন্ত কথায় বলে, এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গো-মূত্র পড়লে যেমন পুরো দুধই নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি চৈতন্যদেবের কৃষ্ণনাম প্রচার ব্যর্থ হয়ে গেছে চৈতন্যদেব কর্তৃক রাধার অস্তিত্ব স্বীকার করায় এবং শ্রীকৃষ্ণের পাশে রাধাকে দাঁড় করানোয়। কিন্তু একটি পিঁপড়া বা মাছির কারণে যেমন পুরো এক গ্রাস দুধ ফেলে দেওয়া হয় না, পিঁপড়া বা মাছিকে তুলে ফেলে দিয়ে দুধটুকু যেমন পান করা হয়, তেমনি কৃষ্ণের পাশ থেকে রাধাকে তুলে ফেলে দিয়ে সমাজে কৃষ্ণনাম প্রচার করলেই কেবল কৃষ্ণ সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হবে এবং রাধার কারণে কৃষ্ণের যে বদনাম তা জনমানস থেকে অপসারিত হবে।

বৈষ্ণব সমাজের ব্যাপক মিথ্যা প্রচারের কারণে চৈতন্যদেবকে অনেকেই ভগবান বা কলিযুগের অবতার মনে করে, কিন্তু যখন প্রকৃত সত্য সবার কাছে উন্মোচিত হবে, তখন চৈতন্যদেবের থিয়োরিসহ চৈতন্যদেব মুখ থুবড়ে পড়বে; একই কারণে- র্বতমানে ইসকনের রমরমা চললেও, রাধার মতো মিথ্যাকে অবলম্বন করায়, যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করায় এবং চৈতন্যদেবকে আদর্শ ধরায়, এই বাংলাতে ইসকনও একদিন মুখ থুবড়ে পড়বে; ইসকনে লোকজন এখনও এই কারণে যাচ্ছে, কারণ লোকজনের কাছে প্রকৃত সত্য এখনও পৌঁছে নি এবং ইসকনের বিকল্প ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এখনও বাংলায় গড়ে উঠে নি ।

একসময় ইসকন বিলুপ্ত হলেও এবং চৈতন্যদেবকে কেউ অবতার বা ভগবান না মানলেও থেকে যাবে চৈতন্যদেব কর্তৃক প্রবর্তিত এই কৃষ্ণ নামের ধরণ এবং কালের অন্ত পর্যন্ত উচ্চারিত হবে-"হরে কৃষ্ণ, হরে রাম"; কারণ, এর শাস্ত্রীয় স্বীকৃতি আছে; কেননা, গীতার ৯ম অধ্যায়ের ১৩ নং শ্লোকে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

"হে পার্থ, মহাত্মাগণ আমার দৈবী প্রকৃতি আশ্রয় করিয়া, আমাকে সর্বভূতের আদি ও অব্যয় কারণ জানিয়া অনন্যচিত্তে আমার ভজনা করেন।"

এই ভজনা করার সিস্টেমটা কী, সেটা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ৯/১৪ নং শ্লোকে-

"সততং কীর্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।।"

এর অর্থ- তাঁহারা সর্বদায় আমার নামকীর্তন করিয়া, যত্নশীল ও দৃঢ়ব্রত হইয়া ভক্তিসহ আমাকে প্রণাম করিয়া নিত্য যোগ সহকারে আমার উপাসনা করেন।

গীতার এই শ্লোকই আসলে নামকীর্তন বা হরে কৃষ্ণ গানের মূল ভিত্তি বা উৎস, যাকে চৈতন্যদেব রূপ দেন ১৬ শব্দের ঐ গানে। ইসকনিরা যে এটাকে বলে মহামন্ত্র, ইসকনিদের এই দাবীও মিথ্যা নয়; কারণ শ্রীকৃষ্ণ পরবর্তী মানুষদের উদ্ধার ও মুক্তির জন্য শ্রীকৃষ্ণই শেষ কথা এবং তাকে কিভাবে ভজনা করতে হবে, সেটা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গীতার এই শ্লোকে বলে গিয়েছেন, সুতরাং "হরে কৃষ্ণ" যে মহামন্ত্র তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এই মন্ত্র বা গানের ভিত্তি যে স্বয়ং গীতা, সেটাও তো প্রমাণ করেই দিলাম।

অনেকেই নয়, প্রায় সবাই বলে থাকে যে "হরে কৃষ্ণ" নামের এই মহামন্ত্র নাকি ১৬ নাম ও ৩২ অক্ষরের। এদের চিন্তার দীনতা দেখলে আমি অবাক হয়ে যাই। এখানে ১৬টি নাম নয়, আছে ১৬টি শব্দ এবং ১৬টি শব্দে মাত্র ৩টি নামই বারবার ব্যবহার হয়েছে, সেই তিনটি নাম হলো- হরে, কৃষ্ণ ও রাম। আর এই ১৬টি শব্দে মোটেই ৩২ অক্ষর নেই, আছে আরো বেশি, সেগুলোর হিসাব নিচে দিচ্ছি।

এই প্রসঙ্গে বর্ণ ও অক্ষর সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। যারা কবিতার নাড়ী নক্ষত্র ভালো বোঝেন, তারা জানে ন যে, অক্ষর ও বর্ণ এক জিনিস নয়। বর্ণ কী, সেটা তো সবাই জানেন, কিন্তু বর্ণের সমর্থক শব্দ হিসেবে অক্ষরকে অনেকে মনে করলেও, আসলে অক্ষর হলো কোনো শব্দের যতটুকু অংশকে একবারে উচ্চারণ করা যায়, সেটা। কিন্তু এই ১৬ নাম ৩২ অক্ষর থিয়োরির প্রবক্তাদের এত গভীরে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই, তারা অক্ষর বলতে বর্ণকেই বুঝে থাকে, সেই হিসেবেই দেখুন এই ১৬ শব্দে মোট কতটি বর্ণ আছে-

হরে = হ+র+এ= ৩ গুনন ৮ = ২৪টি বর্ণ
কৃষ্ণ = ক+র+ষ+ণ = ৪ গুনন ৪ = ১৬ টি বর্ণ
রাম = র+আ+ম = ৩ গুনন ৪ = ১২ টি বর্ণ

এভাবে ১৬টি শব্দে মোট বর্ণ আছে ৫২ টি।

কিন্তু অক্ষর আছে,

হরে = হ+ রে= ২ গুনন ৮ = ১৬ টি
কৃষ্ণ = কৃষ + ণো = ২ গুনন ৪ = ৮ টি
রাম = ১ গুনন ৪ = ৪ টি

এভাবে 'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্রে অক্ষর সংখ্যা ২৮ টি।

সুতরাং হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রে নাম আছে ৩টি, অক্ষর ২৮টি এবং বর্ণ ৫২টি; যারা এই সাধারণ বিষয়টুকু না বুঝে গত ৫০০ বছর ধরে প্রচার করে আসছে ১৬ নাম ৩২ অক্ষর, তাদের হাতে আমরা আমাদের ধর্ম নামক সমাজের মূল চালিকাশক্তিকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি, ঘুমাচ্ছি,; হিন্দু সমাজের বর্তমান দূরবস্থা কি আর এমনি এমনি ?
এই মূর্খ, অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত গুরু নামক বৈষ্ণব দিব্যজ্ঞানীদের হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করে, ধর্মের প্রকৃত রূপ রক্ষা ও সনাতন ধর্মের প্রকৃত সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরে সনাতন ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটাতেই আমার এই নিরন্তর যুদ্ধ। এই যুদ্ধকে সাংগঠনিক রূপ দিতে আমি একটি ধর্মীয় সংগঠনের পরিকল্পনা করেছি, যারা তাতে সশরীরে যোগ দিতে চান এবং যারা দূর থেকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চান, তারা দয়া করে ইনবক্সে যোগাযোগ করবেন, উপযুক্ত সময় উপস্থিত হলে সংগঠনের পক্ষ থেকে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করা হবে।

হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রের একটি ব্যাখ্যা ফটোপোস্টের আকারে দিয়েছি, এর অন্য যে ব্যাখ্যা তা হলো- 'হরে' শব্দটি 'হরি' শব্দের বিবর্তিত রূপ, আর হরি অর্থ বিষ্ণু বা ভগবান; অন্যদিকে বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হিসেবে শ্রীকৃষ্ণও হরি বা হরে (গীতা, ১৮/৭৭); ফলে - হরে, কৃষ্ণ এবং রাম আসলে ভগবানেরই তিনটি নাম- হরে (বিষ্ণু/কৃষ্ণ), কৃষ্ণ(শ্রীকৃষ্ণ) এবং রাম (রামচন্দ্র)।

সুতরাং হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের মাধ্যমে এই তিনটি নাম বার বার উচ্চারণ বা স্মরণ ক'রে আমরা আসলেই ঈশ্বরেরই আরাধনা করি, গানের সুরে সুরে; কারণ, কলিযুগের মানুষ সুরে বশ এবং মোহিত, যেকারণে শ্রীকৃষ্ণের হাতে সব সময় থাকে বাঁশি, যা সুরের প্রতীক।

অনেকে, বিশেষ করে আর্যরা বেদের গায়ত্রী মন্ত্রকে মহামন্ত্র বলে মনে করে এবং যেহেতু তারা শ্রীকৃষ্ণ ও গীতাকে সহ্য করতে পারে না, তাই গীতা থেকে উৎসারিত হরেকৃষ্ণকে মহামন্ত্র বলে স্বীকার করে না।

গায়ত্রী অবশ্যই মহামন্ত্র, কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের জন্য নয়, সেটা সাধকদের জন্য; কারণ, গায়ত্রী মন্ত্র- নির্জনে, নিঃশব্দ পরিবেশে, ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কঠিন মনোযোগ সহকারে একাকী জপ করতে হয়, না হলে এর যে বৈজ্ঞানিক উপকারিতা, সেটা পাওয়া যাবে না এবং এই পরিবেশে গায়ত্রী মন্ত্র থেকে উপকারিতা পাওয়া শুধু একনিষ্ঠ সাধকদের পক্ষেই পাওয়া সম্ভব, সাধারণ মানুষ, যারা গায়ত্রী মন্ত্রের শক্তি ও ক্ষমতার ব্যাপারে কিছু জানে না, তারা এ থেকে কোনো উপকার লাভ করতে পারবে না।

কিন্তু চৈতন্যদেবের টার্গেট ছিলো সাধারণ মানুষ, যারা ভগবানের সান্নিধ্য থেকে প্রচারের অভাবে এবং পরিবেশগত কারণে দূরে ছিলো, তাদেরকে ভগবানের সান্নিধ্যে আনার জন্য তিনি খুব সহজ সরলভাবে এটা প্রচার করেন, যাতে সাধারণ মানুষ খুব সাধারণভাবে, বেশি পরিশ্রম, বেশি মনোযোগকে কাজে না লাগিয়েও ভগবানের সান্নিধ্যে আসতে পারে; কারণ, তারা যখন ভগবানের সান্নিধ্যে আসবে, তখন অটোমেটিক্যালি সনাতন ধর্মের আরো গভীরতত্ত্বে প্রবেশ করবে, তখন তারা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে তা থেকে উপকার নিতে পারবে। তাই হরেকৃষ্ণ যেমন মহামন্ত্র, তেমনি গায়ত্রীও মহামন্ত্র; একটি সাধারণের জন্য, অপরটি অসাধারণদের জন্য।

আর্যরা যেহেতু খানিকটা মূর্খ এবং যেহেতু তারা এই দুই মন্ত্র নিয়ে আমি যা বললাম তা কখনো উপলব্ধিই করতে পারে নি, তাই হরেকৃষ্ণকে হটিয়ে গায়ত্রীকে মহামন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে, কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে হরেকৃষ্ণকে যদি মহামন্ত্র হয়, গায়ত্রী আসলে মহামহামন্ত্র।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment