Thursday, 21 May 2020

অশৌচ কী ও কেনো ? ( পর্ব- ১)


অশৌচ কী ও কেনো ? ( পর্ব- ১)

পিতা মাতা মারা গেলে কেনো শ্রাদ্ধ বা ভোগের পূর্ব পর্যন্ত একবস্ত্রে থাকতে হবে বা কেনো এই উপলক্ষ্যে মাথা মুণ্ডন করতে হবে ?

এই ধরণের প্রশ্ন অনেক মুসলমানই করে থাকে, আর আমরা হিন্দুরা, মূল বিষয় না জানার কারণে তার যথাযোগ্য জবাব তো দিতে পারিই না, উল্টো হিন্দু ধর্ম ও কালচার নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগি এবং এইভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগতে ভুগতে এক সময় মনে করি হিন্দুধর্ম আসলে ভুয়া ধর্ম এবং এই ধর্ম বাদ দিয়ে অন্য কোনো ধর্ম পালন করাই ভালো!

আমি আমার গবেষণায় দেখেছি হিন্দুধর্ম ও কালচারের কোনো কিছুই অহেতুক বা অযথা নয়, প্রত্যেকটা আচার অনুষ্ঠানের পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তব কারণ, যেগুলো পালন করলে মানুষের কোনো না কোনো উপকার নিশ্চিত, কিন্তু এই ব্যাপারগুলোর মূলতত্ত্ব না জানলে, সাধারণভাবে সেগুলোকে যেকোনো মানুষের কাছে অহেতুক বলে মনে হবে, আর এমন মনে হলে হিন্দুরা তাদের বিধিবিধান নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগবে, আর মুসলমানরা করবে কটূক্তি বা টিটকারী। এই সব সমস্যার কিঞ্চিৎ সমাধানে, আমার আজকের এই প্রবন্ধে আলোচনা করবো অশৌচ বা কোনো মানুষের মৃত্যুর পর তার পরিবার ও জ্ঞাতিবর্গের পালনীয় আচার অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে।

কোনো বাড়িতে কারো মত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবার ও তাদের জ্ঞাতিবর্গকে পাড়া প্রতিবেশিরা অশৌচ বলে গণ্য করে এবং তাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা প্রায় এক রকম বন্ধই করে দেয়। যে বাড়িতে কেউ মারা যায়, সেই বাড়িকেও লোকজন অশৌচ মনে করে এবং সেই বাড়িতে ঢুকলেই স্নান করতে হবে, এমন প্রায় সবাই মনে করে, ফলে যাদের স্নান করার ইচ্ছা নেই বা স্নান করতে অসুবিধা আছে, তারা ইচ্ছা থাকলেও মৃতের বাড়িতে যেতে পারে না বা যায় না, এটা সামাজিক সহযোগিতা, না অসহযোগিতা ?

‘অশৌচ’ শব্দের অর্থ অনেকে ‘অপবিত্র’ বলে মনে করলেও, আসলে অশৌচ শব্দের অর্থ অপরিষ্কার বা অপরিচ্ছন্ন; কেননা, মলত্যাগ করার পর মানুষ জল খরচ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার যে কর্মটি করে তাকে বলে ‘শৌচ’, এজন্য ‘শৌচ কর্ম’ করার মানে হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া; এই সূত্রে অশৌচ মানে হলো অপরিষ্কার বা অপরিচ্ছন্ন থাকা। এই থিয়োরি অনুযায়ী, কেউ মারা গেলে তার পরিবার এবং জ্ঞাতিবর্গ অপরিষ্কার বা অপরিচ্ছন্ন হয় কিভাবে, আর কিভাবেই বা সেই মৃত ব্যক্তির বাড়ি অপরিষ্কার/অপরিচ্ছন্ন হয় ?

‘অশৌচ’ শব্দের বাস্তব অর্থ অপরিষ্কার/অপরিচ্ছন্ন থেকে এটাকে আমরা নিয়ে গেছি অধ্যাত্মিক অর্থ ‘অপবিত্র’ তে, যার কোনো অস্তিত্বই নেই; কারণ, কোনো বস্তু অপরিষ্কার বা অপরিচ্ছন্ন হতে পারে, কিন্তু কোনো বস্তু অপবিত্র হতে পারে না; কেউ কোনো দিন প্রমান করতে পারবে না যে এই বস্তুটি অপবিত্র; মূলত পবিত্র বা অপবিত্র একটি আধ্যাত্মিক শব্দ, যা কিনা সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ব্যাপার, যার কোনো বাস্তব ভিত্তিই নেই।

যারা এই অশৌচ থিয়োরির আধ্যাত্মিকতাকে বিশ্বাস করে এবং যাদের অসময়ে স্নান করতে অসুবিধা আছে বা স্নান করতে চায় না, তারা কেউ মৃতের বাড়িতে যায় না বা মৃতের পরিবারের লোকজনকে ছোঁয় না, এতে মৃতের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতার পরিবর্তে সামাজিক অসহযোগিতা ই প্রকাশ পায়, যা সমাজের একত্বের জন্য ক্ষতিকর এবং সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হওয়ার পথে বাধা।

যদিও অপবিত্র বলে কিছু হয় না, তারপরও জনমানসে যেহেতু অপবিত্রের ব্যাপারটি ঢুকে গেছে, সেহেতু অপবিত্রকে একটা সত্ত্বা হিসেবে ধরে নিয়ে বলছি, মাটি কখনো অপবিত্র হয় না, মাটি সর্বদায় পবিত্র; কারণ, মাটি মানে পৃথিবী, আর পৃথিবী হলো বসুন্ধরা, যিনি একজন দেবী; আর কোনো দেব-দেবীকে অপবিত্র করার ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই, বরং দেব-দেবীকে স্পর্শ করেই কোনো মানুষ পবিত্র হয়, যেমন-গঙ্গা একজন দেবী এবং সেই গঙ্গাজল স্পর্শ করে বা গায়ে ছিঁটিয়ে মানুষ পবিত্রতার ভাব অনুভব করে।

উপরের এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মাটি কখনো অশৌচ হয় না, তাই মৃতের বাড়িতে যেতে কোনো বাধা নেই এবং এজন্য মৃতের বাড়িতে গেলেই তাকে স্নান করতে হবে, এমন বিশ্বাসেরও কোনো ভিত্তি নেই। একই কথা প্রযোজ্য মৃতের পরিবারের লোকজন এবং তার জ্ঞাতিবর্গের বেলাতেও; কারণ, কোনো লোক যদি শারীরিকভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে তাহলে সরাসরি তার হাত থেকে কোনো কিছু নেওয়া বা দেওয়ায় কোনো বাধা নেই।

কোনো লোক মারা গেলে দ্রুত তাকে সমাধিস্থ করার বা পুড়িয়ে ফেলার একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে দেখা যায়, এটা ভালো; কারণ, সাধারণভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় মৃত্যুর ২৪ ঘন্টা পর থেকে লাশ পচতে শুরু করে, তার আগে তাকে সমাধিস্থ করা বা পুড়িয়ে ফেলা অপেক্ষাকৃত ভালো। কিন্তু এই তাড়াহুড়া যখন সামাজিক কুসংস্কারে পরিণত হয়, তখন সেটা সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বাসি খাবার যেমন স্বাভাবিকভাবে খারাপ, তেমনি বাসি লাশকেও অনেকে খারাপ মনে করে এবং সূর্যোদয়ের পূর্বেই সেই লাশকে বাড়ি থেকে বের করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়াকে বিধি বলে মনে করে। কিন্তু মূলতত্ত্বকে উপলব্ধি না করার ফলে এই ধরণের বিধি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে, যেমন- কেউ যদি রাতে মারা যায়, আর তাকে সূর্যোদয়ের পূর্বেই বাড়ি থেকে বের করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে দূর দূরান্তে থাকা তার আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়েরা তাকে আর শেষ দেখা দেখতে পায় না; এটা শোকসন্তপ্ত লোকজনের প্রতি এক ধরণের মানসিক অত্যাচার। এর বিপরীতে, দূর দূরান্তে থাকা ছেলে মেয়ে আত্মীয় স্বজন সবাই বাড়িতে এলে, তার পর তাদের শোকপ্রকাশ শেষে যদি লাশকে বাড়ি থেকে বের করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটাই বাস্তব এবং মানবিক।

সূ্র্যোদয়ের পূর্বেই লাশকে বাড়ি থেকে বের করতে হবে, এটা যে অযৌক্তিক, সে ব্যাপারে একটা উদাহরণ দিচ্ছি-

বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ লোকেরই একটা বা দুইটা সন্তান এবং এরা চাকরির সূত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে বাড়ির বা দেশের বাইরে। এমন যদি হয় কোনো লোকের একটি মাত্র পুত্র এবং সে থাকে দেশের বাইরে, এই অবস্থায় তার পিতা বা মাতা যদি হঠাৎ মারা যায়, তাহলে সেই লাশকে, অবশ্যই, ঐ পুত্র বাড়ি আসা পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে; কেননা, সে না আসলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াই শাস্ত্রমতে সম্পন্ন করা যাবে না; কারণ, নিজ পুত্র বা কন্যা থাকতে অন্য কেউ মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে পারে না। এমতাবস্থায় লাশকে হিমঘরে রেখে দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে দুই চারদিন এমনকি তার বেশি সময়ও লাশকে রাখতে বাধ্য হতে হয়, এক্ষেত্রে কিন্তু কেউ লাশের বাসি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না। তাই লাশ বাসি হওয়া বড় ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হচ্ছে লাশের পচন ধরার পূর্বেই তাকে সমাধিস্থ করা বা পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা এবং এই সময়ের মধ্যে মৃতের- ছেলে, মেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনকে মৃত ব্যক্তিকে শেষ দেখার জন্য উপস্থিত করার চেষ্টা করা এবং তার জন্য যৌক্তিক সময় পর্যন্ত লাশকে বাড়িতে রেখে দেওয়া।

লাশকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় হরিধ্বনি দিতে দিতে লাশের আগে আগে ভুট্টা বা খই জাতীয় কিছু ছিটানো হয় এবং তার সাথে ছিটানো হয় পয়সা। এই বিষয়টা এটা প্রকাশ করে যে, আমি খালি হাতে পৃথিবীতে এসেছিলাম, কিন্তু যাওয়ার সময় অনেক খাবার এবং ধন সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে যাচ্ছি। এটা একটা প্রতীকী ব্যাপার। নিয়ম মনে করে ধনী গরীর সকলের ক্ষেত্রেই এটা করা হয়, কিন্তু যার সমাজে কোনো অবদান নেই এবং যে ক্ষুধা তৃষ্ণায় বা দারিদ্রতায় চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মারা গেছে তার ক্ষেত্রে এই বিধান পালন করার কোনো যুক্তি নেই, বরং তার ক্ষেত্রে এই নিয়ম পালন করলে তাকে উপহাস ই করা হয়।

যখন মৃতদেহকে কবরে নামানো হয়, তখন মৃতের পুত্র এবং জ্ঞাতিবর্গকে, মৃতকে শেষবারের মতো দেখে, লবন মিশ্রিত মাটি, বাম হাত দিয়ে, অন্যদিকে তাকিয়ে মৃতদেহের উদ্দেশ্য ছিঁটিয়ে দিতে হয় এবং তারপর তাকে নিষেধ করা হয়, যাতে সে আর ঐ মৃতের দিকে না তাকায়। এই সংস্কারের মনস্তাত্ত্বিক কারণ হলো- মৃতের প্রতি তোমার আর মায়া করা চলবে না, তাকে এখন তোমার ত্যাগ করতে হবে, অতএব তার দিকে এখন আর তাকিও না, নিজেকে শক্ত করো। আর বাম হাত দিয়ে লবন মাটি দেওয়ার কারণ হলো- ডান হাত দিয়ে যখন আমরা কাউকে কিছু দিই, সেটা আগ্রহের সাথে দিই যাতে তার সাথে আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়, বাম হাতে কিছু প্রদান ঠিক এর উল্টোটা প্রকাশ করে; বাম হাত দিয়ে লবন মাটি দেওয়া এটা প্রকাশ করে যে, তোমাকে আমরা যেতে দিতে চাই না, কিন্তু যেতে দিতে বাধ্য হচ্ছি, তাই অনাগ্রহের সাথে তোমাকে বিদায় জানাচ্ছি।

মৃতের উদ্দেশ্যে লবন দেওয়ার কারণ হলো- যখন আমরা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে যাই, তখন মিষ্টি নিয়ে যাই এবং আত্মীয় বা বন্ধুরা যখন বাসায় আসে, তখন  সাধারণভাবে মিষ্টি খেতে দিই, এর মূল কারণ, তার সাথে আমাদের সম্পর্ক যেন মিষ্টি মধুর হয়। এর বিপরীতে যদি তাদেরকে লবন খেতে দেওয়া হয়, ঘটনা ঠিক উল্টো ঘটবে, অর্থাৎ সম্পর্ক খারাপ হবে বা দূরত্ব তৈরি হবে; মৃতের উদ্দেশ্যে লবন দেওয়ার উদ্দেশ্য এটাই, তার সাথে আস্তে আস্তে আমাদের দূরত্ব তৈরি হোক; কারণ, যা ঘটে গেছে তাকে বদলানোর ক্ষমতা আমাদের নেই, আবার মৃতের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলেও আমরা সামনের দিকে এগোতে পারবো না, পুরোনোকে পেছনে ফেলে আমাদেরকে সামনের দিকে এগোতেই হবে, এজন্যই মৃতের সাথে একটা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি করতে আমাদেরকে সাহায্য করে লবন। যারা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং অন্ধ আবেগে বিশ্বাসী, তাদের কাছে এই বিষয়টি খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা যে মৃতের সাথে আস্তে আস্তে আমাদের দূরত্বই তৈরি হয় এবং এক সময় তাকে প্রায় আমরা সম্পূর্ণই ভুলে যাই, এই বিষয়টিরই একটি প্রতীকী ব্যাপার হলো মৃতের উদ্দেশ্যে লবন দেওয়া। আর লবনের সাথে মাটি দেওয়ার মানে হলো- লবনের পরিমান কমানো এবং পৃথিবী নামক দেবী বসুন্ধরার কাছে তাকে সমর্পণ করা। কেউ কেউ বলতে পারেন, লবন পচন রোধ করে, সেজন্যও লবন দেওয়া হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে দুই চার মুঠ লবন দিয়ে হবে না, দুই চার বস্তা লবন লাগবে এবং লবনের মধ্যেই মৃতকে রাখতে হবে; কিন্তু মৃতদেহকে টিকিয়ে রাখা প্রকৃতির উদ্দেশ্য নয়, মৃতদেহকে পঞ্চভূতে বিলীন করাই প্রকৃতির উদ্দেশ্য, তাই মৃতদেহের পচন রোধ করার জন্য লবন দেওয়ার কোনো ভিত্তি নেই।

একই ধরণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ঘটানো হয় পোড়ানোর ক্ষেত্রেও, মৃতের যে পুত্র বা কন্যা, মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা পালন করে, তাকে, মৃতের মুখে, অন্য মুখ হয়ে বাম হাতে আগুন দিতে হয় এবং পোড়ানোর শেষ পর্যন্ত তাকে চিতার দিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়, এই বিধি মৃতের সমস্ত পুত্র কন্যাদের জন্য।

হিন্দু সমাজের আরেকটি কুসংস্কার হলো- শ্মশানে গেলেই তাকে স্নান করতে হবে এবং স্নান না করে কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। অসময়ে এই স্নান করার ভয়ে অনেক লোক শ্মশানে যায় না বা যেতে পারে না; এটা সামাজিক সহযোগিতা, না অসহযোগিতা ? সমাধিস্থ করা হোক বা পুড়িয়ে ফেলা হোক, শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পর সব কাজ সম্পন্ন হতে মোটামুটি ৩/৪ ঘণ্টা সময় লাগে, এই কাজ যদি সকালে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত সারা হয়, তাহলে স্নান করা নিয়ে কারো কোনো সমস্যা থাকে না, এক্ষেত্রে যাদের সময় থাকে তারা প্রায় সবাই শ্মশানে যায় এবং সমাধিস্থ করতে বা পোড়াতে সাহা্য্য করে; কিন্তু বিকালে যদি লাশকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সেই কাজ শেষ হতে হতে রাত হয়ে যায় এবং তারপর শ্মশানে উপস্থিত সবাইকে স্নান করে বাড়িতে ঢুকতে হয়। অসুখ বিসুখ বা নানা সমস্যায় মানুষ রাতে স্নান করতে ভয় পায়, যারা রাতে স্নান করতে ভয় পায়, তারা এই ধরণের শ্মশান যাত্রায় সামিল হতে চায় না; এটা সামাজিক সহযোগিতা, না অসহযোগিতা ?

আমি অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল লোক এবং সবিকছুকে বাস্তবতার নিরীখে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকি এবং সেই মতো সিদ্ধান্ত নিই ও কাজ করি। শ্মশান একটি পবিত্র জায়গা এবং বিশ্বাস করা হয় যে, শ্মশানে শিব বাস করেন; তাহলে সেই শ্মশানে গেলেই মানুষকে স্নান করতে হবে কেনো ? হ্যাঁ, স্নান করবে তারা, যারা প্রত্যক্ষভাবে লাশকে পোড়ানোর বা সমাধিস্থ করার কাজে জড়িত থাকবে; যেমন- যারা লাশকে ছোঁবে, লাশকে স্নান করাবে, মাটি খুঁড়বে এবং লাশকে কবরে নামাবে, আর পোড়ানোর ক্ষেত্রে যারা বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকবে, তারা; শুধু তারাই সব কাজ শেষে স্নান করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হবে; অন্যরা, যারা শুধু লাশের সহযাত্রী হতে শ্মশানে উপস্থিত হয়েছে, তাদেরকে স্নান করতে হবে কেনো ? হিন্দু সমাজের অনেক বিধি বিধান আছে, যেগুলো মানুষকে কাছে টেনে আনে না, দূরে ঠেলে দেয়; শ্মশানে গেলেই স্নান করতে হবে বা মৃতের বাড়িতে ঢুকলেই স্নান করতে হবে, এগুলো সেই ধরণের বিধান, যার কোনো বাস্তবতা নেই, তাই এগুলো মানারও কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই; কারণ, এগুলো কোনো সংস্কার নয়, কুসংস্কার।

যা হোক, শ্মশানের কাজ শেষ করেই, স্নান শেষে শ্মশানে উপস্থিত লোকজনকে মিষ্টি খাইয়ে বিদায় করানো হয় বা সামর্থ্য থাকলে বসিয়ে দই চিড়া মিষ্টি খাওয়ানো হয়, কিন্তু এই বসিয়ে খাওয়ানোর আয়োজন করা হয় মৃতের গোষ্ঠীর বাইরে অন্য একটি বাড়িতে এবং এই কাজে মৃতের পরিবার ও গোষ্ঠীর কোনো সদস্যকে কাজ করতে দেওয়া হয় না। অশৌচ মানে অপবিত্র, এই ধারণা থেকে এই ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছে, যা অমানবিক; কারণ, এই দই মিষ্টি চিড়া খাওয়ার পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয় তা করতে হয় মৃতের পরিবারকেই, কিন্তু মৃতের পরিবারের কোনো সদস্যকে এই কাজে অন্তর্ভূক্ত হতে দেওয়া হয় না; ব্যাপারটা এমন- মৃতের পরিবারের টাকায় খাওয়া বৈধ, কিন্তু তাদের স্পর্শ বৈধ নয়, এটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কী ?

আগেই ব্যাখ্যা করেছি, অশৌচ মানে অপবিত্র নয়, আর অপবিত্র বলে কিছু হয়ও না, অশৌচ মানে অপরিষ্কার বা অপরিচ্ছন্ন এবং একটু আগেই ব্যাখ্যা করেছি যে কেউ মারা গেলেই তার বাড়ি এবং তার পরিবার-গোষ্ঠীর লোক অশৌচের নামে তথাকথিত অপবিত্র হয় না, তাই আগের মতোই সব সময় মৃতের বাড়িতে আসা যাওয়া করা যাবে এবং তাদের হাতে বা তাদের সাথে উঠা-বসা খাওয়া যাবে; এতে শুধু মহাভারত কেনো, বেদ বা গীতাও অশুদ্ধ হবে না। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, কোনো লোক মারা যাওয়ার পর, তার আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ শান্তি বা মহাপ্রভুর ভোগের ব্যবস্থা করার পূর্ব পর্যন্ত যে ঐ গোষ্ঠীর ছাড়া বাইরের কোনো লোকজন, কেউ ঐ মৃতের বাড়িতে যায় না বা তাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া উঠা বসা করে না; এটা সামাজিক অসহযোগিতা ছাড়া আর কী ? এই ধরণের সামাজিক অসহযোগিতা, সামাজিক বন্ধন শিথিল হওয়ার কারণ, যার কোনো প্রয়োজন ও উপযোগিতা নেই।

অশৌচ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- অশৌচ কিছু নিয়ম, যা কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে শোক পালনের জন্য করা হয়; অশৌচ কোনো পাপ বা অপরাধ নয় যে, অশৌচের কারণে সমাজের লোকজনের তাদেরকে পরিত্যাগ করবে।

যা হোক, লাশের সৎকার করার পরেই মৃত ব্যক্তির পুত্রদেরকে যে বিধি পালন শুরু করতে হয়, তা হলো- এক খণ্ড সাদা বস্ত্র পরতে হয়, সেই সাদা বস্ত্র পরেই শ্রাদ্ধ বা ভোগের আগের দিন পর্যন্ত থাকতে হয়, চুল-দাড়ি-নখ কাটা হয় না, খাট বা চৌকিতে ঘুমানো হয় না, চেয়ারে বসা হয় না, দিনে একবার দুপুরে আতপ চালের ভাত খেতে হয়, সকালে ও রাতে সামান্য চিড়া বা ফল মূল খেয়ে থাকতে হয় এবং এইরকম আরো কিছু বিধি বিধান পালন করতে হয়। বাড়ি বা ঘরের ভেতরে যেসব বিধি পালন করতে হয়, সেগুলো তো কেউ দেখে না, কিন্তু যা মানুষ দেখে, তা হলো- মৃতের পুত্ররা একখণ্ড সাদা বস্ত্র প’রে আছে, চুল দাড়ি কাটছে না, হাতের মুঠোয় একটি কুশাসন বহন করছে; কিন্তু এর কারণ কী ? এসব দেখে অনেক মুসলমানই প্রশ্ন করে, এসবের কী কোনো দরকার আছে ?

আমি উপরেই বলেছি, হিন্দু সমাজের পালনীয় কোনো বিধি বিধানই অযথা বা অহেতুক নয়; ধানের মধ্যে যেমন দু চারটা চিটা থাকে, তেমনি এই সব যৌক্তিক বিধি বিধানের মধ্যেও দুচারটা অবিধি ঢুকে গেছে, যেগুলোর কোনো বাস্তব বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, এগুলোকেই বলা হচ্ছে কুসংস্কার, যা যুক্তি-বিজ্ঞান-তর্কের ভিত্তিতে পরিত্যাজ্য, কিন্তু সকল বিধি বিধান নয়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার গবেষণা ও ভাবনায় যে বিধি বিধানগুলোর কোনো প্রয়োজন দেখি না, সেগুলো আমার কাছে কুসংস্কার হিসেবে বিবেচিত এবং এই কুসংস্কারগুলোকে আমি সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

(বাকি অংশ পাবেন পরের পর্বে।)

জয় হিন্দ।

No comments:

Post a Comment