Thursday 21 May 2020

অশৌচ কী ও কেনো ? ( পর্ব- ২)


অশৌচ কী ও কেনো ? ( পর্ব- ২)

“মৃতের পুত্ররা একখণ্ড সাদা বস্ত্র প’রে আছে, চুল দাড়ি কাটছে না, হাতের মুঠোয় একটি কুশাসন বহন করছে; এর কারণ কী বা এসবের কী কোনো দরকার আছে ?”

এই ধরণের প্রশ্ন অনেকে করে থাকে বা অনেক হিন্দুর মাথাতেও এটা আসতে পারে, কিন্তু এর কারণ অনেকেরই অজানা, যা হোক, সেটা দেখে নিন নিচে-

আমার বাবা মারা গেলে আমরা ভাইয়েরা এই সব বিধি বিধান পালন করছিলাম। আমাদের গ্রামের অন্য পাড়ার এক মুসলমান, যে আমার বাবা মারা যাওয়ার সময় গ্রামে ছিলো না, তাই সে আমার বাবার মারা যাওয়ার খবর জানতো না, হঠাৎ সে গ্রামে ফিরে আসে এবং বাজারের মধ্যে আমার বড় ভাইকে ঐ বেশে দেখেই বুঝতে পারে যে, আমাদের পরিবারে কিছু একটা হয়েছে, তখন সে আমার বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী ? তখন আমার বড় ভাই তাকে বলে যে কয়েকদিন আগে আমার বাবা মারা গেছেন।

একই ঘটনা ঘটেছে আমার ক্ষেত্রেও, আমি আমার কর্মস্থলে বসে আছি, এক মুসলমান এসে আমাকে দেখেই বুঝতে পারে যে, আমার পরিবারের কেউ মারা গেছে, তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করতেই তাকে জানাই যে, আমার বাবা মারা গেছেন। অথচ সেই মুসলমানই আবার আমাকে বলে যে, দাদা, একটা জিনিস জানার জন্য জিজ্ঞেস করছি, অন্যভাবে নেবেন না, বাপ মা মারা গেলে এই যে, আপনারা এমনভাবে কয়েকদিন থাকেন, এর কি কোনো দরকার আছে ?

এর কী দরকার আছে, তা উপরের দুটি ঘটনার মধ্যেই বলে দিয়েছি, তারপরও আর একটু ব্যাখ্যা করছি:

এই যে, আমার বড় ভাইকে দেখে আমাদের গ্রামের ঐ লোক বুঝতে পারলো যে, আমার বাবা বা মা মারা গেছে, তারপর সে বিষয়টা জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হলো এবং আমাদের পরিবারের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করলো; একইভাবে আমাকে দেখেও সেই মুসলমানটি মূল ঘটনা বুঝতে পারলো এবং আমার সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করলো, বাবা বা মা মারা গেলে, সাদা এক বস্ত্রে কয়েকদিন থাকা বা চুল দাড়ি না কাটা বা হাতে কুশাসন বহন করার কারণ হলো এটাই; এটা একটা বিজ্ঞাপন বা মেসেজ প্রদান যে আমার বাবা বা মা মারা গেছে, সুতরাং আপনারা আমাদের প্রতি বা আমাদের পরিবারের সাথে সহমর্মী হোন এবং তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করুন। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এই ধরণের কোনো ব্যবস্থা নেই, ফলে কোনো মুসলমানের বাপ মা মারা গেলে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তার বাড়িতে শোকের কোনো ঘটনা ঘটেছে।

এবার আসি বাড়ির ভেতরে পালনীয় বিধি বিধানসম্পর্কে এবং দেখি এরই বা কী প্রয়োজন রয়েছে ?

বাড়ির কেউ মারা গেলে বাধ্যতামূলক যে বিষয়টি থেকে বিরত থাকতে হয়, তা হলো মাছ মাংস খাওয়া; অর্থাৎ শ্রাদ্ধ বা ভোগের পূর্ব পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির গোষ্ঠীর সবাইকে নিরামিষ খেতে হয়। মাছ মাংস খাওয়া, অর্থাৎ খাবারে বিলাসিতা পরিবারের স্বাভাবিক অবস্থাকে প্রকাশ করে। তাই কেউ মারা গেলে খাবারের বিলাসিতাকে বর্জন ক’রে অর্থাৎ নিরামিষ খেয়ে কয়েকদিন শোক প্রকাশ করা হয় এবং এই একই কারণে খাবারে সংযম আনার জন্য শুধু দুপুরে এক প্রকার সিদ্ধ জাতীয় খাবার দিয়ে আতপ চালের ভাত খাওয়া হয় এবং সকাল ও রাতে সামান্য কিছু খাওয়া হয়, এটা মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে এক ধরণের শ্রদ্ধা প্রদর্শন, যার কোনো ব্যবস্থা মুসলিম সমাজে নেই।

কোনো ব্যক্তি মারা গেলে সনাতন রীতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধশান্তি করতে হয় এবং বৈষ্ণব রীতি অনুযায়ী মহাপ্রভুর ভোগ দিতে হয়। শ্রাদ্ধ হোক বা মহাপ্রভুর ভোগ হোক, মূল উদ্দেশ্যে পাড়া প্রতিবেশি, গ্রামের লোক এবং আত্মীয়-স্বজনকে অন্ন ও জল দান, যে অন্ন ও জল, মৃত ব্যক্তির আত্মা পিতৃলোকে থাকার সময় পাবে বলে বিশ্বাস করা হয়। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প আছে- মহাভারতের কর্ণ সারা জীবন মানুষকে প্রচুর সোনা রূপা ও টাকা পয়সা দান করেছে, এই কারণে সে দাতাকর্ণ নামে পরিচিত, কিন্তু কাউকে কোনো দিন অন্ন ও জল দান করে নি, এমনকি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর দেশের অবস্থা ভালো ছিলো না বলে তার আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে তার শিশু পুত্র বা পিতার পক্ষে কোনো শ্রাদ্ধ শান্তির আয়োজন করাও সম্ভব হয় নি, এছাড়াও কর্ণ ছিলো অধর্মী দুর্যোধনের পক্ষে এবং তারা পরাজিত হয়েছিলো, তাই অধর্মীদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে কেউ শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজনও অনুভব করে নি, এর ফলে কর্ণ মৃত্যুর পর পিতৃলোকে গেলে তাকে শুধু সোনা রূপা খেতে দেওয়া হয়, কর্ণ জিজ্ঞেস করে এমন কেনো, সে সোনা রূপা দিয়ে কী করবে ? তখন যমরাজ তাকে বুঝিয়ে বলে যে কোথায় তার ভুল ছিলো, সে তো নিজে কখনো অন্ন ও জল কাউকে দান করেই নি, এমনকি সে কখনো তার পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যেও অন্ন-জল দান করে নি। এতে কর্ণ বলে, আমি মৃত্যুর কিছুদিন আগে জানতে পারি আমার প্রকৃত পিতা মাতার পরিচয়, তাই পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে কিছু করতে পারি নি, এখন আমার কী কর্তব্য ? এরপর যমরাজ কর্ণকে একটা সুযোগ দেয়, সূক্ষ্মদেহে ১৫ দিন পৃথিবীতে অবস্থান করে তার পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল দান করার। কর্ণ যে ১৫ দিন এই কাজ করেছিলো, তাই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত, যা দুর্গা পূজা শুরুর আগে, মহালয়ার দিনসহ আগের ১৫ দিন। এই জন্য এই ১৫ দিনের নাম পিতৃপক্ষ এবং মহালয়ার পরের ১৫ দিন দেবীপক্ষ নামে পরিচিতি

বাংলাদেশের হিন্দুরা, পিতৃপক্ষ ও মহালয়া সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝে না বা জানে না, আর যারা জানে বা বোঝে তারাও কিছু পালন করে না, এরা মহালয়া মানে বোঝে শুধু ভোরের বেলায় ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোতে চণ্ডীপাঠ আর দুর্গার অসুর দমনের কাহিনী দেখা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু হিন্দু এই পিতৃপক্ষ যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করে, তারা এই ১৫ দিনের কোনো একদিন বা মহালয়ার দিন ভোরে গঙ্গায় স্নান করে পিতৃপুরুষদেরকে স্মরণ করে তাদের উদ্দেশ্যে জল দান করে, যাকে বলে পিতৃতর্পণ; কর্ণ তার পিতৃ পুরুষদের মৃত্যু তিথি জানতো না বলে যদিও সে এই বিধি ১৫ দিন ধরেই পালন করা করেছিলো, কিন্তু যারা তাদের পিতৃপুরুষদের মৃত্যু তিথি জানে, তাদেরকে শুধু এই ১৫ দিনের মধ্যে সেই তিথিতে তর্পন করলেই চলবে।

উপরে “পিতৃলোক” ব’লে একটা শব্দের উল্লেখ করেছি, এ ব্যাপারে কিছু বলা প্রয়োজন।

সনাতন ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের মৃত্যুর পর যমরাজ তার আত্মাকে পিতৃলোকে নিয়ে যায় এবং সেখানে কোনো আত্মা তিন পুরুষ পর্যন্ত বাস করে, এরপর সে স্বর্গ বা নরকে যায়; এজন্য যেকোনো মানুষকে তার পূর্ব তিন পুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ বা তর্পন করতে হয়। পৃথিবীতে তৃতীয় প্রজন্মের জন্ম হলে পিতৃলোক থেকে তিনটি আত্মার সবচেয়ে সিনিয়র আত্মাটি মুক্ত হয় এবং তার কর্মফল এবং তার পরবর্তী তিন প্রজন্মের, তার উদ্দেশ্যে পালনীয় প্রেতকার্যের ফলাফলের উপর সেই আত্মা হয় স্বর্গে গমন করে বা নরকে গমন করে। এরপর স্বর্গ বা নরকের কাল ভোগ শেষ হলে সেই আত্মা পুনরায় তার কর্মফল অনুযায়ী পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করে। কিন্তু কোনো মানুষ যদি বিবাহযোগ্য হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ সন্তানাদি জন্ম না দিয়েই মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার আত্মাকে তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে অবস্থান করতে হয় না, যমরাজ তাকে সরাসরি স্বর্গ বা নরকে প্রেরণ করে এবং সেই ফল ভোগ শেষ হলে তাকে পুনরায় পৃথিবীতে জন্ম নিতে হয়। এজন্য প্রাপ্ত বয়স্ক যেকোনো ব্যক্তিকে বিবাহ করতেই হবে এবং সন্তানের জন্ম দিতেই হবে, না হলে শুধু তার নয়, তার পূর্ব তিন পুরুষের আত্মার কোনো মুক্তি নেই, আর যে আত্মা মুক্তি পায় না, তার নরক বাস নিশ্চিত এবং পরবর্তী জন্মে তার পক্ষে মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়া অসম্ভব। এজন্য শুধু নিজে পূর্ব পুরুষদের আত্মার মুক্তির জন্য শ্রাদ্ধ শান্তি বা মহাপ্রভুর ভোগ দিলেই হবে না, নিজের আত্মার মুক্তির জন্য পরবর্তী প্রজন্ম যাতে গর্বের সাথে সনাতন ধর্ম যথাযথভাবে পালন করে, সেই শিক্ষাও তাদেরকে খুব ভালোভাবে দিয়ে যেতে হবে। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি, যার ছেলে মেয়ে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম পালন করবে, তার এবং তার পূর্ব তিন পুরুষের আত্মা কখনোই মুক্তি পাবে না, এরা নরক বাস শেষে ইতর প্রাণী রূপে পৃথিবীত জন্ম নেবে। তাই ছেলে মেয়েকে খুব যত্নের সাথে সনাতন ধর্ম শিক্ষা দিন এবং নিজের আত্মার মুক্তিকে নিশ্চিত রাখুন।

ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে; কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর কতদিন পর তার আত্মার মুক্তির জন্য শ্রাদ্ধ শান্তি করতে হবে, এটা নিয়ে সমাজে বেশ দ্বিধাবিভক্ত মত আছে। এই নানা মতের কারণ, মনু সংহিতার একটি শ্লোক, যে শ্লোকে বলা আছে,

“শুধ্যেদ্বিপ্রো দশাহেন দ্বাদশাহেন ভূমিপ।
বৈশ্যপঞ্চদশাহেন শূদ্রো মাসেন শুধ্যতি।।“ (মনু সংহিতা- ৫/৮৩)

অর্থাৎ জন্ম বা মরণে ব্রাহ্মণের দশদিন, ক্ষত্রিয়ের দ্বাদশ দিন, বৈশ্যের পঞ্চদশ দিন এবং শূদ্রের একমাস অর্থাৎ ত্রিশ দিন অশৌচ থাকে; ইহার পর শুদ্ধ হয়”।

মনুর রেফারেন্স দিয়ে পুরোহিত দর্পনেও একথা বলা আছে।

আমি আগেই প্রমান করে দিয়েছি যে, মনু সংহিতা হিন্দু ধর্মের কোনো প্রামান্য গ্রন্থ নয়; এ সম্পর্কে আমার

“স্বায়ম্ভূব মনু কে আর কেনোই বা লিখা হয়েছিলো মনু সংহিতা”

নামের একটি প্রবন্ধ আছে, যারা সেটা পড়েছেন, তারা বিষয়টি জানেন; আর যারা এখনও সেটা পড়েন নি, সেটা পড়লে জানতে ও বুঝতে পারবেন।

যা হোক, মনু সংহিতার এই শ্লোকে বলা হয়েছে,  ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের  ১২ দিন; বৈশ্যের ১৫ দিন এবং শুদ্রের ৩০ দিন অশৌচ থাকে। কিন্তু মনু সংহিতারই অপর একটি শ্লোকে বলা আছে,

“সপিণ্ডের মৃত্যু হলে দশ দিন অশৌচ হবে”- ৫/৫৯

যে গ্রন্থে একই বিষয়ে দুই ধরণের কথা থাকে, সেই গ্রন্থে যে ভেজাল আছে, তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু মনুসংহিতার এই একই কথা (৫/৫৯) বলা আছে গরুর পুরাণে, সেখানে বলা আছে,

“সপিণ্ডদিগের মরণাশৌচ দশাহ”- ৬/১০

অর্থাৎ অশৌচ পালন করতে হবে ১০ দিন।

এখানে সপিণ্ড মানে যারা পিণ্ডদানের অধিকারী।

মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কয়টি পিণ্ড দিতে হবে, তার থেকেও কতদিন অশৌচ পালন করতে হবে, তার একটি নির্দেশনা আছে।

এটা প্রচলিত মত এবং সবাই জানে যে, মৃতের উদ্দেশ্যে ১০ দিনে ১০টি পিণ্ড দিতে হয়। এই ১০ দিনে ১০টি পিণ্ড দিয়ে একাদশতম দিনে শ্রাদ্ধ করাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু ১০টি পিণ্ড দিয়ে ১৫ বা ৩০ তম দিনে শ্রাদ্ধ করলে আত্মা এই বাকি দিনগুলোতে ক্ষুধায় কষ্ট পায়, মৃতের আত্মার শান্তির জন্যই তো এত কিছু, তাহলে ১০ দিনে ১০ টি পিণ্ড দিয়ে একাদশতম দিনে শ্রাদ্ধ না করে ১৫ বা ৩০ তম দিনে শ্রাদ্ধ করার কি কোনো যুক্তি আছে ?

একাদশতম দিনেই যে শ্রাদ্ধ শান্তি করতে হবে, এর একটি জোরালো প্রমান আছে বরাহ পুরাণের একটি মন্ত্রে, সেখানে বলা আছে,

“একাদশ দিনে যথাবিধি একোদ্দিষ্ট বিধিক পিণ্ডদান করিবে, অনন্তর স্নানান্তর শুচি হবে। মনুষ্যগণের মধ্যে বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র, এই চারি বর্ণের একোদ্দিষ্ট একইরূপ।” – (১৮৮/৬,৭)

এছাড়াও কোনো ব্যক্তি মারা যাওয়ার ৪র্থ ও ১০ম দিনে বিশেষ পিণ্ড দিতে হয়, একে বলে পূরক পিণ্ড। এ থেকেও প্রমাণিত যে ১০ম দিনে পূরক পিণ্ড দিয়ে এগারোতম দিনেই শ্রাদ্ধশান্তি করতে হবে।

এ থেকে স্পষ্ট এবং প্রমাণিত যে সকলের জন্য মরণাশৌচ ১০ দিন এবং এগারোতম দিনেই শ্রাদ্ধ বা মহাপ্রভুর ভোগ দিয়ে লোকজনকে অন্ন ও জল দান করতে হবে।

অশৌচ সম্পর্কে শেষ কথা হলো, অনেকেই মনে করে অশৌচ চলাকালীন গৃহে প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর দেবতাকে স্পর্শ করা যাবে
না বা তাদের উদ্দেশ্যে ফুল জল চিনি বাতাশা নিবেদন করা যাবে না। যারা এমন মনে করে, তাদেরকে শুধু একটি প্রশ্ন করছি, এমন করে আপনি আপনার আরাধ্য ঠাকুর দেবতাকে কি ত্যাগ করলেন না ? যদি কোনোভাবে আপনার ঠাকুর দেবতাকে ত্যাগ করেন, তাহলে সেটা কিন্তু আপনার জন্য অমার্জনীয় অপরাধ। কারণ, কখনো কোনো অবস্থাতেই ঈশ্বর আপনাকে ত্যাগ করে না, সকল সময়ে ঈশ্বর আপনার হৃদয়ে বাস করে, এ কথা ই বলা আছে গীতার ১৮/৬১ নং শ্লোকে,

“ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।”

এর অর্থ পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন।

তো যে ঈশ্বর সূক্ষ্মভাবে আপনার ভেতরে সর্বদা বাস করছেন, তাকে কি আপনি স্থূল অর্থে ত্যাগ করতে পারেন ?

পারেন না।

তাহলে অশৌচের অজুহাতে আপনি তাকে আপনার সেবা থেকে বঞ্চিত করছেন কেনো ? আগেই বলেছি, অশৌচ- শোক পালনের কিছু নিয়ম, কোনো অপরাধ বা পাপ নয় যে আপনি কাউকে পরিত্যাগ করবেন বা আপনাকে কেউ পরিত্যাগ করবে।

কোনো ব্যক্তির জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্রই কেবল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে পারে বলে সমাজে একটা বিষয় প্রচলিত আছে, কিন্তু এটা সঠিক নয়। জ্যেষ্ঠ পুত্রের অবর্তমানে পিতা মাতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা পালন করবে জ্যেষ্ঠের ইমিডিয়েট ছোট জন, সে উপস্থিত না থাকলে তার ছোট জন, এভাবে পুত্রের সিরিয়াল শেষ হলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অধিকারী হবে মৃতের পুত্রের পুত্র অর্থাৎ নাতীরা এবং পুত্রের পুত্রদের সিরিয়াল শেষ হলে অধিকারী হবে বড় মেয়ের পুত্র; কিন্তু মৃত ব্যক্তির পুত্র যদি না থাকে এবং কন্যারও যদি পুত্র না থাকে, তাহলে সরাসরি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অধিকারী হবে বড় মেয়ে এবং বড় মেয়ের অনুপস্থিতিতে অধিকারী হবে ক্রমান্বয়ে তার ছোটরা।
                                                                                               
এছাড়াও অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, অশৌচের মধ্যে একাদশী পালন করা যাবে কিনা ?

অশৌচের মধ্যে একাদশী পালন করা যাবে না ব’লে যারা বিশ্বাস করে, তারা এটা বিশ্বাস করে যে অশৌচ পড়লে কোনো ধর্ম কার্যই করা যাবে না; কিন্তু এটা যে সঠিক নয়, তা উপরের এই আলোচনা থেকেই সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে বলে আশা করছি। তারপরও আর একটি উদাহরণ দিচ্ছি, কেউ মারা গেলে তার আত্মার শান্তি ও মুক্তির জন্য শ্রাদ্ধ বা ভোগ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন বাড়িতে গীতা পাঠ এবং হরিনাম সংকীর্তনের আয়োজন করার নিয়ম। গীতা হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এবং একমাত্র গীতাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে এবং এই গীতা পাঠ করলেই শ্রীকৃষ্ণের পূজা করা হয়(গীতা, ১৮/৭০) এবং গীতা পাঠ করলেই শ্রীকৃষ্ণ সবচেয়ে খুশি হন (গীতা মাহাত্ম্য, ২২) এবং এই গীতা স্পর্শ করলেই সকল প্রকার অনাচার জাতীয় পাপ দূর হয় (গীতা মাহাত্ম্য-৩৪,৩৫); তাহলে অশৌচের মধ্যে যদি গীতা স্পর্শ ও পাঠ করতে কোনো বাধা না থাকে, অন্য কোনো দেব-দেবীকে স্পর্শ ও তাদের সেবা প্রদানে বাধা থাকবে কেনো ?

যারা মনে করেন, অশৌচের মধ্যে কোনো ধর্মকার্য করা যাবে না বা কোনো দেব-দেবীকে স্পর্শ ও তাদেরকে জল মিষ্টি দেওয়া যাবে না, তাদেরকে আরেকটি প্রশ্ন করছি, আপনি নিজেকে পবিত্র মনে করেন, না দেব-দেবীকে ? যদি দেব-দেবীকে পবিত্র মনে করেন, তাহলে গীতার মতো দেব-দেবীকে স্পর্শ করে এবং তাদের সেবা দিলেই আপনি পবিত্র হবেন, এছাড়া অন্য যে কোনো কারণে যদি আপনি দেব-দেবীদের থেকে দূরে থাকেন, সেটা হবে তাদেরক প্রতি অবজ্ঞা বা অবহেলার প্রদর্শন।

অশৌচের মধ্যে একাদশী প্রসঙ্গে বলতে চাই, অশৌচ চলাকালীন যে ধরণের খাবার দাবার খাওয়া হয়, তাতে আর নতুন করে একাদশী পালন করে খাবারে সংযম আনার কোনো প্রয়োজন নেই; কারণ, একাদশী পালন করাই হয় খাবারে সংযম এনে দেহকে কন্ট্রোল করার জন্য, অশৌচের মধ্যে যেহেতু এই কাজ প্রতিদিনই করা হয়, তাই আর নতুন করে একাদশী পালন করে দেহকে কন্ট্রোল করার দরকার নেই। কিন্তু এটাকে আবার অশৌচের মধ্যে ধর্ম কার্য নিষেধ বলে কেউ মনে করবেন না, অশৌচ হোক আর যা ই হোক, ধর্ম কার্য পালনে বাধা কখনো নেই; আমি অশৌচের মধ্যে একাদশী পালন করাকে নিষেধ করলাম, একাদশী পালনের বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে।

উপরের এই টোটাল আলোচনা ছিলো মরণাশৌচ নিয়ে, আলোচনা যখন অশৌচ নিয়ে তখন জননাশৌচের আলোচনাও এখানে সেরে নিই।

কারো জন্ম হলে যে অশৌচ পালন করা হয়, তাকে বলে জননাশৌচ। মরণাশৌচ শোকের হলেও জননাশৌচ আনন্দের। তাই এতে সদ্য জাত শিশুর পিতা মাতা এবং শিশুর দেখা শোনার কাজে নিয়োজিত কেউ ছাড়া অন্য কারো কোনো অশৌচ হয় না এবং জননাশৌচে বিয়ে, পূজা-প্রার্থনাসহ কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানেই কোনো বাধা নেই। এই অশৌচে পিতা মাতাকে যা পালন করতে হবে, তা হলো- যেহেতু তারা সদ্যজাত শিশুর জন্মে আনন্দে আত্মহারা হয়ে থাকে এবং মা তো সব সময় শিশুর কাছে থাকেই এবং বাবাও যখন তখন শিশুকে কোলে নেয় বা আদর করে এবং এই সময় যেহেতু শিশুকে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মধ্যে রাখা যায় না বা স্বাভাবিকভাবেই সেটা সম্ভব নয়, তাই শুধু পিতা মাতাকেই নয়, যারাই শিশুটিকে দেখা শোনার জন্য সর্বদা নিয়োজিত থাকবে, তাদেরকেই পরিবারের বা অন্য লোকজনের সাথে মেলামেশায় একটু সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে, যাতে তাদের মাধ্যমে কোনো রোগ জীবানু অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে না পড়ে।

হিন্দু সমাজে আঁতুড় ঘর নামে একটা ব্যাপার আছে, যাতে, কোনো মহিলার বাচ্চা হলে তাকে ৬ দিন (এলাকা ভেদে ২/১ দিন পার্থক্য হতে পারে) ঐ ঘরে আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয় এবং আঁতুড় ঘরে কাটানো সময় শেষের পরের দিনের দিন কামানের মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তাকে বাড়ির অন্যদের সাথে মিশতে দেওয়া হয়; এটা এইজন্যই করা হয়, যাতে মা ও শিশুর দ্বারা রোগ জীবানু অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং আঁতুড় ঘর থেকে বের হওয়ার পর ঐ ঘরে থাকা সব কাপড় চোপড় পুড়িয়ে ফেলা হয়, এটাও করা হয় রোগ জীবানু নাশের জন্য। বর্তমানে বেশিরভাগ ছেলে মেয়ের জন্ম হচ্ছে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে এবং সেখানেই মা ও শিশুর চিকিৎসার সুবিধার্থে বেশ কয়েকদিন রাখা হচ্ছে; যদি ৫/৬ দিন সেখানে রাখতে বাধ্য হতে হয়, তাহলে বাড়িতে আর আলাদা করে আঁতুড় ঘর বানানোর প্রয়োজন নেই, কামানের দিন হসপিটাল বা ক্লিনিক থেকে বাড়িতে এনে কামান দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাড়িতে তুললেই হবে।

জননাশৌচের মূল কথা হলো- সদ্যজাত শিশু এবং তার মায়ের দ্বারা কোনো রোগ জীবানু যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তার ব্যবস্থা করা, এখানে আর অন্য কোনো ব্যাপার নেই এবং জননাশৌচ হবে শুধু পিতা মাতার, এই কথাটিই বলা আছে মনুসংসহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের ৬২ নং শ্লোকে এই ভাবে-

"সর্বেষাং শাবমাশৌচং মাতাপিত্রোস্তু সূতকম্।
সূতকং মাতুরেব স্যাদুপস্পৃশ্য পিতা শুচিঃ।।

এর অর্থ- মৃত্যুজনিত অশৌচে অঙ্গাস্পৃশ্যত্বরূপ অশৌচ  সকলেরই সমান। কিন্তু জন্ম সম্পর্কিত অশৌচে মাতা ও পিতার মাত্র সূতক অর্থাৎ অঙ্গাস্পৃশ্যত্ব হয়; ঐ অস্পৃশ্যত্যরূপ অশৌচ  মাতার দশরাত্রি হয়ে থাকে, কিন্তু পিতা স্নান করলেই সেই  অস্পৃশ্যতা দূর হবে।

যদিও আমি মনে করি না যে মনুসংহিতা হিন্দু ধর্মের কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ, তারপরও যেহেতু হিন্দু সমাজের বহু নিয়ম কানুন মনুসংহিতার থেকে উদ্ভূত, তাই মনুসংহিতাকে কিছুটা পাত্তা দিতেই হয়। এছাড়াও যে বিষয়গুলো ভালো এবং যুক্তিসম্মত, সেটা আমরা যেকোনো গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করতেই পারি।

কোনো বাড়িতে লোকজন মারা গেলে সেই বাড়িতে মৃত্যু পরবর্তী ১ বছর কোনো বিবাহের অনুষ্ঠান করা যায় না বলে একটা ব্যাপার সমাজে প্রচলিত আছে। এটাও মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের একটি সংস্কার; কারণ, বিবাহ একটি আনন্দ অনুষ্ঠান এবং যেকোনো আনন্দ অনুষ্ঠান, মৃত্যুজনিত যে শোক সেটাকে চাপা দিতে পারে, যা মৃত ব্যক্তির প্রতি এক ধরণের অবহেলা বা অবজ্ঞা। মৃতের প্রতি যাতে তার ছেলে মেয়েরা এই ধরণের কোনো অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে না পারে, সেজন্য এই বিধি প্রচলিত হয়েছে; কিন্তু এমন যদি ঘটনা হয় যে এক বছরের মধ্যে বিয়ে না দিলে কোনো সামাজিক বা পারিবারিক সমস্যার সৃষ্টি হবে বা একমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই কোনো পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে, সেক্ষেত্রে এই বিধি ভাঙ্গা যাবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই বিয়ের অনুষ্ঠান করা যাবে; কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা শুধু এমার্জেন্সির ক্ষেত্রে, স্বাভাবিক অবস্থায়, শুধু যৌনতা বা আনন্দের জন্য মৃতের পুত্র-কন্যা বা নাতী-নাতনীর ক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ের অনুষ্ঠান করা অনুচিত। শুধু বিয়েই নয় নবান্নসহ যেকোনো আনন্দ অনুষ্ঠানই এই এক বছরের মধ্যে করা অনুচিত। আমি একটি মেয়ের বিয়ে ঘটিয়েছিলা্ম তার পিতার মৃত্যুর দিনেই; কারণ, সেই দিনই ঘটনা না ঘটালে মেয়েটিকে বাঁচানো যেতো না, সেই সময় মেয়েটিকে বাঁচানো আমার জন্য ছিলো গুরুত্বপূর্ণ, তাই সেই ঘটনা আমি ঘটিয়েছিলাম, যদিও এটা নিয়ে আমাকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো, কিন্তু সেসব আমার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জীবিত মানুষ, যে মরে গেছে সে তো বেঁচেই গেছে, যারা বেঁচে আছে, তারা যাতে ভালো থাকে এবং সামাজিক সংস্কারগুলোর কারণে তাদের জীবন যেন বিষাদময় বা বিপন্ন না হয়, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করাই হলো আমার লক্ষ্য।

অশৌচ সম্পর্কে আমার কাছে যত প্রশ্ন ছিলো, সে সবের আলোকে এই প্রবন্ধটি লিখলাম, এর বাইরেও কারো যদি কিছু জানার থাকে এবং শুধু বিশ্বাস নয়, যুক্তি-বিজ্ঞান ও শাস্ত্রের ভিত্তিতে যদি তার উত্তর জানার যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে ইনবক্সে আমাকে প্রশ্ন করবেন, পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ আমাকে সেই উত্তর দিতে সহায়তা করবেন বলে আশা রাখি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment