Thursday 21 May 2020

হিন্দুধর্ম ও সমাজে বেদ ও গীতার স্থান


হিন্দুধর্ম ও সমাজে বেদ ও গীতার স্থান :

বেদ হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ নয়, প্রথম বা আদি ধর্মগ্রন্থ; প্রধান ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে গীতা। যদিও এই গীতা মহাভারতের একটি অংশ এবং মহাভারত থেকে একে আলাদা করেছেন আদি শঙ্কারাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রিষ্টাব্দ) নামের এক সন্ন্যাসী। তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়ে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের কথোপকথনের উপর ভাষ্য লিখতে গিয়ে, এই অংশটিকে মহাভারত থেকে আলাদা করেন, যা বর্তমানে গীতা বা শ্রীমদ্ভগবদগীতা নামে পরিচিত। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেই শঙ্কারাচার্য মহাশয় কিন্তু মহাভারতের এই অংশটির উপর ভাষ্য রচনা করে তাকে আলাদা গ্রন্থ হিসেবে রূপ দিয়েছেন। আর এই গীতা, গীতা পূর্ববর্তী সকল ধর্মীয় গ্রন্থের শুধু সার ই নয়, সরাসরি পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের বাণী। কিন্তু বেদ সরাসরি ঈশ্বরের বাণী নয়, বেদ- ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকশত মুনি-ঋষির উপলব্ধিজাত বাণী।

বেদ, সকাম কর্মের কথা বলে, যে সকাম কর্মের উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীতে ও স্বর্গে ভোগ বিলাস করা। কিন্তু সনাতন ধর্মের চরম উদ্দেশ্য এই ভোগ বিলাস নয়, এর চরম লক্ষ্য হলো মানুষকে মোক্ষ প্রদান করা, যার মাধ্যমে মানুষ জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। এজন্য গীতার ২য় অধ্যায়ের ৪২ ও ৪৩ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতি বাদিনঃ।।
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।।

এর অর্থ হলো- বিবেক বর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ, উচ্চকূলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদি সকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয় সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার উর্ধ্বে আর কিছুই নেই।

এছাড়াও পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ, গীতার ১০ম অধ্যায়ের ২২ন নং শ্লোকে বলেছেন,

“বেদনাং সামবেদোহস্মি”

এর অর্থ- সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ।

চারটি বেদের মধ্যে সামবেদ হলো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনামূলক গান এবং অন্য বেদগুলোর বিষয়বস্ত হলো জাগতিক সুখ সবিধার জন্য ক্রিয়া কর্ম।

সনাতনীদের চরম উদ্দেশ্য যেহেতু পার্থিব ভোগ বিলাসের উর্ধ্বে উঠে মোক্ষ লাভের জন্য কাজ করা, সেহেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অন্য তিনটি বেদকে বাদ দিয়ে সামবেদকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

এই কথার মাধ্যমেও এটা স্পষ্ট যে, বেদ হিন্দুদের জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ গীতা।
একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, বেদ যদি হয়  সনাতন নামক অশ্বত্থবৃক্ষের মূল, তাহলে গীতা হচ্ছে সেই বৃক্ষের ডালপালার শীর্ষে অবস্থিত- পতা, ফুল ও ফল। এই উদাহরণ দিতে গিয়ে আমি সনাতন ধর্মকে অশ্বত্থ বৃক্ষের সাথে তুলনা করলাম এজন্য যে, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, বৃক্ষদের মধ্যে আমি অশ্বত্থ (১০/২৬)।

পরিশেষ আরেকটা বিষয় বিবেচ্য যে- সনাতনী ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে গীতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেই প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে একটি করে গীতা থাকে এবং শুধু তাই ই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হওয়ার দিক থেকেও সনাতনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে গীতা সবার উর্ধ্বে। এই তথ্যগুলোও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে গীতা ই হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ, কিন্তু বেদ সনাতন ধর্মের মূল গ্রন্থ।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment