Thursday 21 May 2020

ওঁ আসলে কী বা কে ?


ওঁ আসলে কী বা কে ?

আমরা সাধারণ হিন্দুরা সাধারণভাবে জানি যে- ওঁ এর মধ্যে অ, উ, ম এই তিনটি বর্ণ আছে এবং এগুলো যথাক্রমে- ব্রহ্মা (অজ), উপেন (বিষ্ণু) ও মহেশ্বর এর নামের প্রথম অক্ষরগুলোর একটি সংঘবদ্ধ রূপ। কিন্তু এই জানার মধ্যে ভুল আছে। প্রথমত "অজ" দ্বারা শুধু ব্রহ্মাকেই বোঝায় না, "অজ" দ্বারা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর, এই তিনজনকেই বোঝায়; কারণ, "অজ" মানে জন্মরহিত, অর্থাৎ যিনি কারো গর্ভে জন্মগ্রহন করেন নি, পৌরাণিক বা লৌকিক কোনোভাবেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিনজন কারো গর্ভে জন্মগ্রহন করেন নি, তাই এনাদের বলা হয় অজ ।

দ্বিতীয়ত- "উপেন" মানে যে বিষ্ণু বা বিষ্ণুর অপর নাম উপেন, এমন তথ্য কোথাও আমি পাই নি। তাই ওঁ এর মধ্যে তথাকথিত নিহিত 'অ' এবং 'ম' দ্বারা যথাক্রমে ব্রহ্মা ও মহেশ্বরকে বোঝালেও, 'উ' দ্বারা এই তিন সত্ত্বার কাউকে বোঝায় না। আমাদের অল্পশিক্ষিত ধর্মপ্রচারকগণ সম্ভবত ভক্তদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, ওঁ এর ব্যাখ্যা করার সময়, ওঁ এর মধ্যে যেহেতু তিনটি বর্ণ আছে এবং আমাদের আদিদেবও তিনজন; তাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের সাথে ওঁ-কে মেলাতে গিয়ে 'অ' তে 'অজ' মানে ব্রহ্মা, 'উ' তে 'উপেন' মানে বিষ্ণু এবং 'ম' তে মহেশ্বরকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে প্রচার হয়ে গেছে যে ওঁ আসলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তা নয়, আসল ব্যাপার অন্য কিছু। তবে অন্যরকমের একটি ব্যাখ্যায় 'উ' তে বিষ্ণুকে বোঝায়, সেটা বর্ণনা করছি নিচে-

ওঁ এর উচ্চারণ যদিও আমরা করি 'অউম', কিন্তু আসলে এর উচ্চারণ 'আউম', আউম এর 'আ' দিয়ে বোঝায় আদি, যা সৃষ্টিকে নির্দেশ করে; 'উ' দিয়ে বোঝায় উৎকর্ষ, যা পালনকে নির্দেশ করে; কারণ, পালন না করলে কোনো কিছুর উৎকর্ষ ঘটে না এবং 'ম' দিয়ে বোঝায় মিতি, মানে পরিমাপ বা সমাপ্তি। 'ম' দিয়ে সমাপ্তি বুঝতে যাদের কষ্ট হচ্ছে, তাদের জন্য বলছি- পরিমাপ মানে হলে কোনো কিছু নির্দিষ্ট সীমা, আর যখন কোনো কিছু সীমায় পৌঁছে যায়, তখনই সেটার সমাপ্তি ঘোষিত হয়; এই ভাবে 'ম' হলো সমাপ্তি বা ধ্বংসের সূচক। এই ভাবে 'আউম' দ্বারা- সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে বোঝায়। কিন্তু কোনোভাবেই 'উ' তে উপেন এবং উপেন দ্বারা যে বিষ্ণুকে বোঝায়, এমন কোনো থিয়োরি এখন পর্যন্ত আমি পাই নি, যদি কেউ পেয়ে থাকেন বা জেনে থাকেন, দয়া করে আমায় জানাবেন।

এবার দেখা যাক, গীতায় ওঁকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ?

গীতার ১৭/২৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন "ওঁ তৎ সৎ" এই তিন প্রকারে পরমব্রহ্মের নাম নির্দেশ করা হয়েছে। সুতরাং ওঁ দ্বারা যে পরমব্রহ্মকে বোঝায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আবার গীতার ১০ম অধ্যায়ের ২৫ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, বাক্যসমূহের মধ্যে আমি একাক্ষর, ওঁ-কার। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই যে ওঁ-কার বা শ্রীকৃষ্ণই যে পরমব্রহ্ম, সেটা এই শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত।

এছাড়াও ওঁ উচ্চারণ করলেই যে শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ করা হয়, সে কথা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, গীতার ৮/১২-১৩ নং শ্লোকে, এভাবে-

"… আত্মসমাধিরূপ যোগে অবস্থিত হইয়া, ওঁ- এই ব্রহ্মাত্মক একাক্ষর উচ্চারণপূর্বক আমাকে স্মরণ করিতে করিতে যে যোগী দেহত্যাগ করেন, তিনি পরমগতি লাভ করেন।"

গীতার এই তিনটি রেফারেন্স থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে ওঁ দ্বারা পরমব্রহ্ম বা ব্রহ্ম বা শ্রীকৃষ্ণকে বোঝায়।

এখন আসা যাক ওঁ সম্পর্কিত অন্যান্য কিছু তথ্যে-

ওঁ বা আউম হলো সৃষ্টির আদি ধ্বনি। পৌরাণিক ব্রহ্মার অণ্ডের বিস্ফোরণে যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়, যাকে বিজ্ঞান বলে বিগ ব্যাং থিয়োরি, সেই বিস্ফোরণে যে শব্দ ধ্বনিত হয়, সেটাই হলো ওঁ।

প্রকৃতির মূল রং যেমন- লাল, সবুজ এবং নীল; এবং এই তিনটি রংয়ের বিভিন্ন প্রকার মিশ্রনেই যেমন পৃথিবীর সকল রংয়ের সৃষ্টি; তেমনি আউম এর 'আ' 'উ' এবং 'ম' হলো পৃথিবীর সকল ধ্বনির মূল, অর্থাৎ এই তিনটি ধ্বনির সমন্বয়েই পৃথিবীর সকল ধ্বনির সৃষ্টি।

খ্রিষ্টানদের 'আমেন' এবং মুসলমানদের 'আমিন' প্রকৃতপক্ষে 'আউম' এর ই বির্বতিত রূপ।

সনাতনী হিন্দুরা ছাড়াও শিখ, জৈন, চীনা, তিব্বতীরাও পবিত্র প্রতীক হিসেবে ওঁ-কে মানে এবং ব্যবহার করে এবং ঔঁ কে ভেঙ্গেচুরে এর বিভিন্ন অংশ দিয়ে আরবিতে আল্লা লিখাও যায়।

এছাড়াও এই 'আ' 'উ' 'ম' বলত জিহ্বার কোনো প্রয়োজন হয় না, তাই জিহ্বা নেই এমন কোনো ব্যক্তিও শুধুমাত্র ওঁ উচ্চারণ করে যাতে পরমব্রহ্মকে স্মরণ করে মোক্ষলাভ করতে পারে, সেজন্যই পরমব্রহ্মের একটি নাম ওঁ।

#Khokan_Ball_ Khokan_Ball নামের একজনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই আসলে আমার এই প্রবন্ধটি লিখা, উনার ফটোপোস্টে দেখুন, উনি প্রশ্ন করেছেন- ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও মহেশ্বর, এই তিনজন মিলে একজন হয় কিভাবে ? যদিও উনি ব্রহ্ম লিখেছেন, কিন্তু এটি হবে ব্রহ্মা; কারণ, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা পৃথক ব্যাপার। যা হোক- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর আসলে- ব্রহ্ম, পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরেরই তিনটি কার্যকর রূপের নাম, তাই তাঁরা একই সত্ত্বা। ব্রহ্ম যখন সৃষ্টির কাজ করেন, তখন তাঁর নাম ব্রহ্মা; যখন তিন পালনের কাজ করেন তখন তিনি বিষ্ণু; যখন তিনি ধ্বংসের কাজ করেন তখন তিনি শিব বা মহেশ্বর বা রুদ্র। বাস্তবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর পৃথক কোনো সত্ত্বা নয়, একই সত্ত্বা, ব্রহ্ম।

আশা করছি- ওঁ যে আসলে কী বা কে, সে সম্পর্কে আমার বন্ধুদেরকে একটা ধারণা দিতে পেরেছি।
শেষে একটা বিষয় না বললেই নয়, আর্যমাজীরা ওঁ-কে বিকৃত করে "ও৩ম্" লিখে, এটা দ্বারা কী বোঝায়, আর্য সমাজীদের কাছে এটা জানতে চাই। যদি তারা এটা দ্বারা ওঁ ই বোঝায়, তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই ওঁ-কে বিকৃত করে "ও৩ম্" লিখার অধিকার তাদেরকে কে দিয়েছে বা সেই অধিকার তারা কোথা থেকে লাভ করেছে? নাকি আর্য সমাজীদের কাজই হচ্ছে সনাতন ধর্মের সকল কিছুকে বিকৃত করা ?

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
ওঁ।


No comments:

Post a Comment