Thursday 21 May 2020

মোক্ষলাভ এবং শ্রীকৃষ্ণের কথার সত্যতা


#মিন্টু_আমার_নাম,
মিন্টু,
মহাভারত পড়েছেন বা স্টার জলসার মহাভারত দেখে এইটুকু জেনেছেন যে- শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন; কিন্তু তিনি কী জন্য এটা করেছিলেন তার পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আপনি অর্জন করতে পারেন নি, তাই এই ধরণের প্রশ্ন আপনার মাথায় উদিত হয়েছে। যা হোক, না জানাটা অন্যায় নয়, জানার চেষ্টা না করাটা অন্যায়। আপনি জানার ইচ্ছা থেকে প্রশ্ন করেছেন, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার উদ্দেশ্যে লিখা আমার এই প্রবন্ধ পড়ে, আশা করছি আপনার এই সমস্ত ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে।

আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থগুলো লিখেছেন ঋষি ও মুনিগন, যাঁরা বেদমন্ত্র দর্শণ ও তা প্রকাশ এবং সেই মন্ত্রগুলোর উপর অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করে তা তাদের শিষ্যদেরকে শিখিয়েছেন এবং সেই বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দ্বারা সনাতনীদের জন্য নানা বিধি নিষেধ তৈরি করে দিয়েছেন। এই মুনি ঋষিদের যে জ্ঞান বা তাদের জ্ঞানের গভীরতা যে কতদূর বিস্তৃত, সে সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই বলেই মুনি ঋষিদের বলা মোক্ষ সম্পর্কে আপনি প্রশ্ন তুলতে পেরেছেন।

মুনি ঋষিদের জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে আপনাকে কিছু ধারণা দিই-

জ্যোতিষ শাস্ত্র, সনাতন ধর্মের একটি অংশ, এই জ্যোতিষ শাস্ত্র প্রবর্তন এবং তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমাদের মুনি ঋষিরা প্রায় ৮ হাজার বছর আগে বলে গেছেন যে- মঙ্গল গ্রহের রং লাল, বিজ্ঞানীরা এই সেদিন, আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন যে, হ্যাঁ, মঙ্গল গ্রহের রং লাল। তাহলে শুধুমাত্র খালি চোখে দেখে কয়েক কোটি কিমি দূরে ঘূর্ণায়মান একটি গ্রহ সম্পর্কে মুনি ঋষিরা কিভাবে এই সত্য জানতে পেরেছিলেন ? শুধু তাই নয়, পৃথিবী থেকে গ্রহগুলোর দূরত্ব সম্পর্কে মুনি ঋষিরা যে ধারণা দিয়েছেন, বিজ্ঞানীদের হিসাবও প্রায় তার কাছাকাছি, দু চার কি. মি এদিক ওদিক মাত্র। এ তো গেলো মঙ্গলের ভৌত বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা, এবার মঙ্গলের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের কার্যকারিতা সম্পর্কে সম্পর্কে কিছু বলি, এটা ভালো করে বোঝার জন্য জ্যোতিষ শাস্ত্রের কিছু জ্ঞান বা জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস থাকা আবশ্যক।

জ্যোতিষ মতে- পৃথিবীর চারিপার্শ্বস্থ মহাকাশ বারোটি রাশিতে বিভক্ত এবং মানুষ জন্মাবামাত্র এই ১২টি রাশির কোন একটির অন্তর্ভূক্ত হয়। মানুষের জন্মমূহুর্তে মহাকাশে গ্রহ নক্ষত্রের যে অবস্থান, সেটাই ঐ ব্যক্তির হরস্কোপ বা কুষ্ঠি। জন্ম সময় অনুযায়ী- গ্রহ এবং নক্ষত্রগুলো রাশিচক্রের ১২টি ঘরের যেকোনোটি অবস্থান করতে পারে। এই সূত্রে মঙ্গল যদি রাশিচক্রের প্রথমঘরে বা লগ্নে অবস্থান করে ঐ ব্যক্তির চরিত্র ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য একরকম হবে; মঙ্গল দ্বিতীয় ঘরে থাকলে তার চরিত্র ও ভাগ্য আরেকরকম হবে, তৃতীয় ঘরে থাকলে হবে অন্য আরেকরকম, এইভাবে ১২টি ঘরে মঙ্গল গ্রহের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে মানুষের চরিত্র শুধু মঙ্গলের কারণেই ১২ রকম হবে।

রাশিচক্রের সপ্তম ঘর, অনেক কিছুর সাথে সাথে কোনো ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর ঘর। কারো সপ্তম ঘরে যদি মঙ্গল থাকে, তাহলে তার চিকেন পক্স হতে বাধ্য, তার প্রেম ও বিয়ে দ্রুত বা হঠাৎই হতে বাধ্য এবং বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই তার স্বামী বা স্ত্রীর সাথে ঝগড়া, মারামারি হওয়া নিশ্চিত। এর ফলে তাদের মধ্যে ডিভোর্সও হয়ে যেতে পারে, ডিভোর্স না হলে কোনো একজনের মৃত্যুও হতে পারে। রাশিচক্রের প্রথম, চতুর্থ এবং সপ্তম ঘরে যদি মঙ্গলগ্রহ থাকে, তাহলে তাকে বলে মাঙ্গলিক। এই মাঙ্গলিক কোনো ব্যক্তির যদি অমাঙ্গলিক কারো সাথে বিয়ে হয়, তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবনের ঝড় নিশ্চিত, সেই দাম্পত্য ঝড়ে সবকিছু ছারখার হওয়াও নিশ্চিত। কিন্তু মাঙ্গলিক কারো যদি অন্য মাঙ্গলিকের সাথে বিয়ে হয়, তাহলে তাদের দাম্পত্য সমস্যা কিছুটা কম হয়। বিয়ের পূর্বে বর ও কনের যোটক বিচারে এই বিষয়টিই প্রধানত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।

রাশিচক্রের সপ্তম ঘরে মঙ্গলের অবস্থানে দাম্পত্য জীবনের উপর যে প্রভাব, এগুলো হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্য, আমি বহু কোষ্ঠী বিচার করে এগুলোর সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আমাদের মুনি ঋষিরা তাদের জ্ঞানের কোন শক্তির বলে বা ফলে মঙ্গলসহ গ্রহগুলোর এই আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে বা বলতে পেরেছিলেন, যেগুলোর ভিত্তিতে তারা রাশিচক্রের মতো একটি জটিল বিষয়ের কথা বলতে পেরেছিলেন, যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে দেখা বা বোঝা যায় না ? তার মানে মুনি ঋষিদের মধ্যে বিশেষ কোনো ক্ষমতা ছিলো, যার ফলে তারা অদেখা সত্যকেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বা পারতেন। এই মুনি ঋষিরাই বলে গেছেন মোক্ষের কথা, এখন এটাকে আপনি কিভাবে অস্বীকার করবেন ? কারণ, আমার জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যেমন আপনাকে আমার থেকে বেশী বা কমপক্ষে আমার মতো জ্ঞানী হতে হবে, তেমনি মুনি ঋষিদের কোনো কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হলে বা তাদের কোনো কথায় অবিশ্বাস প্রদর্শন করলে, নিজের জ্ঞানকে, মুনি ঋষিদের জ্ঞানের উপরে নিয়ে যেতে হবে; নিজের অবস্থান থেকে নিজেকে প্রশ্ন করুন, সেটা সম্ভব কি না, বা আদৌ তা সম্ভব কি না ?

মোক্ষের খবর কোন ধরণের ব্যক্তিরা আমাদেরকে দিয়েছে, আশা করছি সেটা আপনাকে বোঝাতে পেরেছি, সেই সাথে এটাও বোঝাতে পেরেছি যে তাদের ঐশ্বরিক জ্ঞান ছিলো কোন লেভেলের ? এবং এই মোক্ষের ব্যাপারটি শুধু একজন বা দুইজন ঋষি দ্বারা সার্টিফায়েড নয়, সমস্ত মুনি ঋষিদের দ্বরা সার্টিফায়েড। কারণ, কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন নি। সুতরাং, এভারেস্ট ডিঙ্গানোর ক্ষমতা যাদের নেই, তাদেরকে এভারেস্ট বিজয়ীদের কথাকে তো বিশ্বাস করতেই হবে এবং সেই একই কথা যদি শতাধিক এভারেস্ট বিজয়ী বলে, সেই কথায় কি সন্দেহ পোষণ করা উচিত, না সেটা বুদ্ধিমানের কাজ ?

এবার আসা যাক শ্রীকৃষ্ণের কথার সত্যতার ব্যাপারে

শ্রীকৃষ্ণ নিজে তার সম্পর্কে কোনো কিছু লিখে যান নি, শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক সমস্ত কিছু- ভাগবত, হরিবংশ এবং মহাভারতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন বেদব্যাস, যিনি মহামুনি হিসেবে সনাতন ধর্মে পরিচিত। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের যে কর্ম ও বাণী আমরা শাস্ত্রে পাই, তা বলার দায় বা কৃতিত্ব সম্পূর্ণরূপে বেদব্যাসের। এখন বেদব্যাস যদি শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের মাধ্যমে মিথ্যা বলান, তিনি বলাতে পারেন, তাতে আমাদের কিছু করার নেই, এক্ষেত্রে বেদব্যাস মিথ্যুক প্রমাণিত হবেন। কিন্তু কাউকে মিথ্যুক বলার পূর্বে, তার চরিত্র ও জীবনী আমাদেরকে আগে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সত্যিই তিনি মিথ্যা বলতে পারেন কি না ? কেননা, যে ব্যক্তি মদ ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখে নি, তাকে মদ্যপ বললে, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই শেষ পর্যন্ত অভিযোগকারী প্রমাণ করতে পারে না।

বেদব্যাসের জন্ম পরাশর মুনির ঔরসে, সত্যবতীর গর্ভে; কিন্তু সত্যবতী, পরাশর মুনির বিবাহিতা স্ত্রী ছিলো না, নিজের জীবনী লেখার সময় বেদব্যাস এই সত্যকে গোপন করেন নি।

বেদব্যাস, তার মাতা সত্যবতীর নির্দেশে, রাজা শান্তনুর ঔরসে জন্ম নেওয়া সত্যবতীর অন্য পুত্র বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর তার দুই স্ত্রীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম দিয়েছিলেন এবং এই বিষয়টি তিনি নিজেই মহাভারতে উল্লেখ করে গেছেন, যেহেতু মহভারতের রচয়িতা তিনি ই। অথচ তিনি ইচ্ছা করলেই এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পারতেন শুধু এই কথা লিখলে যে, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর মৃত্যুর পর বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হয়। তাহলে কেউ এই বিষয়টি জানতেই পারতো না বা কোনোভাবে এটা প্রমাণ করতে পারতো না যে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু আসলে বিচিত্রবীর্যের নয়, বেদব্যাসের সন্তান। কিন্তু মহান সত্যবাদী বেদব্যাস এগুলো লুকানোর চেষ্টা করেন নি; কারণ তিনি জানতেন, "যা মিথ্যা, তাতে সত্য নেই, আর যাতে সত্য নেই, তা ধর্ম নয়"; যে কথা বলে গেছেন আরেক মুনি, বাল্মীকি, তাঁর রামায়ণ গ্রন্থে।

উপরের এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই বেদব্যাস যে কোনো কথা মিথ্যা লিখবেন এবং মিথ্যার মাধ্যমে কৃষ্ণ চরিত্র, যে কৃষ্ণ, বেদব্যাসের চেয়েও বয়সে ছোট, সেই কৃষ্ণকে মহান করে তুলবেন, সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য ?

অনেকের মাথায় এই প্রশ্নও আসতে পারে যে- বেদব্যাস তো কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন না, তাহলে তিনি কিভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে বলা গীতার বিষয়টি জানতে পারলেন, যে গীতায় মোক্ষের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে, এখানেও তো মিথ্যার গন্ধ পাওয়া যায় ।

বেদব্যাস যে মিথ্যা বলেন না, সেটা তো উপরেই প্রমাণ করে দিয়েছি কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত না থেকেও বেদব্যাস কিভাবে গীতার বিষয়গুলো জানলেন এবং লিখলেন, এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধটি আমি অনলাইনে ছেড়েছি ২০১৬ সালে, অনেকেই সেটা পড়ে বিষয়টি জেনেছেন, যারা এখনও পড়তে পারেন নি, তাদের অবগতির জন্য সংক্ষেপে বলছি-

ধৃতরাষ্ট্রের দ্বারা অপমানিত হয়ে রাজমাতা সত্যবতী হস্তিনাপুরের প্রাসাদ ছেড়ে বেদব্যাসের আশ্রমে চলে যান এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে সেখানেই মারা যান। এরপর সত্যবতীর চিতাভস্ম নিয়ে বেদব্যাস হস্তিনাপুরের আসে এবং ধৃতরাষ্ট্রকে সেই চিতাভস্ম প্রদান করেন। এই সময় বেদব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন, তুমি যদি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দর্শন করতে চাও, তাহলে আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি প্রদান করতে পারি, যার দ্বারা তুমি এই প্রাসাদে অবস্থান করেও যুদ্ধ দর্শন করতে পারবে। ধৃতরাষ্ট্র রাজী না হলে এই দিব্যদৃষ্টি, বেদব্যাস, ধৃতরাষ্ট্রের অনুচর সঞ্জয়কে প্রদান করেন।

এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার, দিব্যদৃষ্টির দ্বারা যে ব্যক্তির নিজের কোনো কিছু দর্শন করার ক্ষমতা নেই, সে কিন্তু অপর কাউকে দিব্যদৃষ্টির দ্বারা কোনো কিছু দর্শন করাতে পারবে না। তার মানে হলো বেদব্যাসের নিজেরও দিব্যদৃষ্টি ছিলো, যার দ্বারা তিনি নিজে প্রথমে যুদ্ধ দেখেছেন এবং তারপর তা সঞ্জয়ের কাছে স্থানান্তর করেছেন। এই সূত্রেই বেদব্যাস যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত না থেকেও যুদ্ধ দর্শন করেছেন এবং জানতে পেরেছেন গীতার বাণীগুলো সম্পর্কে, যাতে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন অনেক কিছুর সাথে মোক্ষ বিষয়ক কথাবার্তাগুলো।

এখন দেখা যাক, শ্রীকৃষ্ণ কেনো, যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলতে পীড়াপীড়ি করেছিলেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে শকুনি একবার শ্রীকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন শকুনি, শ্রীকৃষ্ণকে একপ্রকার ভয় দেখান এবং সতর্ক করেন এই বলে যে, তাদের পক্ষে শুধু এগারো অক্ষৌহিনী সৈন্যই নেই, আছে ইচ্ছামৃত্যুর বর প্রাপ্ত ভীস্ম, অজেয় দ্রোণাচার্য, মহারথি কর্ণের মতো বীরযোদ্ধারা, ফলে তার বা কৌরবপক্ষের জয় সুনিশ্চিত। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ শকুনিকে বলেন, এদের সবাইকে হত্যা করা হবে এবং সেটাও ছলের দ্বারা; কেননা, এই যুদ্ধের কারণই হলো পাশা খেলার ছল। পাশা খেলায় ছল করে আপনি যদি যুধিষ্ঠিরকে না হারাতেন, আজকে এই যুদ্ধই হতো না।

শ্রীকৃষ্ণের এই কথা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে- ছলের ফল যেমন ছল হয়, তেমনি প্রতারণার ফল প্রতারণা। এজন্যই আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে- "শঠে শঠ্যাং সমাচরেৎ", অর্থাৎ শঠের সাথে শঠতা ই করতে হয়, এতে কোনো পাপ নেই এবং এটাই সনাতন ধর্ম।

আমি একটা কথা বার বার বলি যে সনাতন ধর্ম হলো বাস্তবতার ধর্ম। এখন বাস্তবতার নিরীখে একটা বিষয় ভাবুন যে, কেউ আপনার সাথে ছল বা প্রতারণা করছে, কিন্তু আপনি তা বুঝেও তার সাথে সততাপূর্ণ আচরণ করছেন, এক্ষত্রে আপনি ক্ষতির শিকার হবেন কি না ? অবশ্যই ক্ষতির শিকার হবেন। তাহলে আপনার কর্তব্য কী ? কর্তব্য হলো- যে যেমন, তার সাথে তেমনই আচরণ করা। এজন্যই শাস্ত্র বলে, ক্ষতি করতে এলে- গুরু, ব্রাহ্মণ এবং বালক, যারা প্রকৃতপক্ষে অবধ্য, তাদেরকেও হত্যা করা যায়, তাতে কোনো পাপ হয় না।

গুরু দ্রোণকে পরাজিত করা পাণ্ডবদের কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না, আবার দ্রোণ জীবিত থাকাকালীন পাণ্ডবদের জয় তথা ধর্ম প্রতিষ্ঠাও সম্ভব ছিলো না; এককথায় ভীস্মের পতনের পর গুরু দ্রোণই ছিলো অধর্মী দুর্যোধনের প্রধান শক্তি, একারণেই গুরু দ্রোণের মৃত্যু ছিলো অবশ্যম্ভাবী এবং যেহেতু গুরু দ্রোণ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টার সময় তার পুত্রের কারণে নিশ্চুপ ছিলেন, ফলে দ্রৌপদীর একটা অভিশাপ দ্রোণের উপর ছিলো এবং যেহেতু দ্রোণ ছলের কারণে ঘটা যুদ্ধে অধর্মীদের পক্ষের প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছিলো, তাই ছলের দ্বারাই তার মৃত্যু বা পতন অসম্ভাবী ছিলো, যেটা ঘটেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। এখানে পরমেশ্বর হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ মাঝখানে থেকে শুধু কার্য ও কারণকে মিলিয়ে দিয়েছেন মাত্র, যার নিয়তি সে ই ভোগ করেছে। অর্থাৎ কারো সাথে ছল বা প্রতারণা করে বা ছলকারী বা প্রতারণাকারীর সহযোগী হয়ে আপনি কিছুতেই অন্যরকম কিছু পেতে পারেন না, আপনার জন্য ছল বা প্রতারণাই অপেক্ষা করছে; এই ছল বা প্রতারণা করার সময় ঈশ্বর যেমন আপনাকে বাধা দেয় না বা দেবে না, তেমনি যখন তার ফল পাবার সময় উপস্থিত হবে, তখন ঈশ্বরই আপনাকে ছল বা প্রতারণার মাধ্যমে সেই ফল দেবে। আপনার আমার ক্ষেত্রে ঈশ্বর অলক্ষ্যে থেকে এই সব কাজ করেন, কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণরূপে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন, তাই তিনি মানবরূপেই দ্রোণাচার্যের পাপের ফল পাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, এতে ঈশ্বররূপী শ্রীকৃষ্ণের কোনো দোষ নেই, তিনি নিরপেক্ষ এবং সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখেন; আর তিনি- জন্মমাত্রই চিন্তাভাবনায় স্বাধীন মানবের কর্মের ফল দেন মাত্র; আর মানব, কর্মের ফল পান তাদের পূর্বজন্মের কর্মের ফল এবং এই জন্মের নিজস্ব চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে অর্জিত কর্মফলের, এখানে ঈশ্বরের ভূমিকা শুধু কার্য ও কারণকে মিলিয়ে দেওয়ার, যেটা তিনি করেছেন স্বশরীরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিত থেকে।

সুতরাং কারো সাথে যদি ছল হয়, সেটা তার নিজের কর্মের ফল। তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণাচার্যের সাথে যা ঘটেছে, সেটা দ্রোণাচার্যের নিজেরই অর্জিত।

আশা করছি- উপরের আলোচনা থেকে মিন্টুর মনে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়ে তার চিন্তার ভ্রান্তি দূর করতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment