Thursday 21 May 2020

বেদ পাঠ বা শ্রবণে কি নারীর অধিকার নেই ?


বেদ পাঠ বা শ্রবণে কি নারীর অধিকার নেই ?

হিন্দু সমাজে একটা বিধান আড়ালে আবডালে প্রচলিত যে বেদ এ নারীর অধিকার নেই। পক্ষান্তরে সমাজে বেশ উচ্চকণ্ঠে প্রচারিত হয় যে- মুসলমানদের কোরানে নারী পুরুষ সকলেরই সমান অধিকার। এই বিষয়টি অনেক হিন্দু নারীকে যেমন ইসলাম গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করেছে, তেমনি অনেক হিন্দু পুরুষকেও সনাতন ধর্ম নিয়ে হীন্মন্যতায় ভুগিয়েছে বা সনাতন ধর্ম ত্যাগ করতে উৎসাহ জুগিয়েছে।

বেদ এ নারীর অধিকার নেই, এই বিশ্বাসটি হিন্দু সমাজে প্রোথিত হয়েছে ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের চতুর্থ অধ্যায়ের একটি বাণী থেকে, যেখানে বলা হয়েছে,

"স্ত্রী, শুদ্রজাতি এবং নিন্দিত দ্বিজ জাতির বেদ শ্রবণে অধিকার নেই।"

আমি একটা কথা প্রায়ই বলি যে- গীতার সাতশত শ্লোক ছাড়া সনাতন ধর্মের সমস্ত গ্রন্থ, যেগুলো বর্তমানে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, সেগুলো কোনো না কোনোভাবে বিকৃত। এই বিকৃতিগুলো যেমন ঘটেছে ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ার আগে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের লিপিকারদের হাতে, যারা হাতে লিখে বই কপি করতো; তেমনি কিছু বিকৃতি ঘটেছে ভারতবর্ষে ছাপাখানা আসার পর সনাতন ধর্মবিরোধীদের হাতে সনাতন ধর্মীয় গ্রন্থগুলি ছাপা হওয়ার সময়। তাই কোনো একটি গ্রন্থে কী লেখা আছে, তার উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ভুল হবে, একই বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থে কী কী বলা হয়েছে বা পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে উপলব্ধি করতে হবে যে প্রকৃত সত্যটা আসলে কী ? কেউ যদি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলেই সে কেবল সনাতন ধর্মের প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে, অন্যথায় ভুলের চক্রে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে।

ভাগবতের যে বাণীটি উল্লেখ করেছি, সেটি যে প্রক্ষিপ্ত, তার প্রমাণ বেদের মধ্যেই আছে, তার প্রমাণ আপনারা পাবেন শেষে, তার আগে এটি কিভাবে প্রক্ষিপ্ত, সেটি বুঝে নিন-

ভাগবতের এই বাণীতে বলা হয়েছে- "নিন্দিত দ্বিজ জাতির বেদ শ্রবণে অধিকার নেই।"

দ্বিজ তারাই, যারা উপনয়নের মাধ্যমে ব্রাহ্মণত্বে উন্নীত হয়, এই অধিকার লাভ করে শাস্ত্রানুযায়ী কর্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের সন্তানরা। উপনয়নের মাধ্যমে ব্রাহ্মণত্বে উন্নীত হওয়ার পর এরা যদি কোনো নিন্দিত কাজ করে, যা তাদের করা উচিত নয়, তাহলে শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে যাগযজ্ঞের মতো মাঙ্গলিক কাজ, যে কাজে বেদমন্ত্র পাঠ করতে হতো, তেমন কাজ থেকে এদেরকে বহিষ্কার করা হতো, ফলে এরা বেদ পাঠ থেকে বঞ্চিত হতো, যেটা ছিলো সমাজের জন্য একটি ভালো বিষয়। খেয়াল করুন, এরা বেদ পাঠ করতো, কিন্তু নিন্দিত কাজের ফলে তা হতে অধিকার হারাতো, এরা তো অন্যের পাঠ করা বেদ শ্রবণ করতো না, তাহলে এদের উপর শ্রবণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণ কী ?

সনাতন ধর্মে শুদ্র হিসেবে তারাই পরিচিত, পূর্বজন্মের সুকর্মের অভাবে যারা এই জন্মে দরিদ্র, জ্ঞানহীন হয়ে জন্মগ্রহন করেছে এবং দাসের মতো হীন কাজ করে যারা জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অক্ষর জ্ঞানহীন এবং মূর্খ বলেই এরা শূদ্র, একারণেই এদেরকে পরের হুকুম মানতে হয় এবং হুকুমদাতার দেয়া অন্নে এদেরকে প্রতিপালিত হতে হয়।

তো যারা অক্ষর জ্ঞানহীন, তারা তো নিজে কিছু পড়তে পারে না, তাদেরকে অন্যের পাঠ শুনতেই হয়। তো শুদ্রজাতির সেই শ্রবণেও অধিকার থাকবে না কেনো ? এরা যদি ভগবত কথা না শুনে, তাহলে এদের আত্মার উন্নতি হবে কিভাবে ?

শুদ্রদের বেদ পাঠে অধিকার নেই বলে হিন্দু সমাজে প্রচলিত, এই বিষয়টি নিয়ে তারাই মাইন্ড করে, যারা শুদ্রের প্রকৃত সংজ্ঞাই জানে না। গীতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শুদ্র নয়। মানুষ- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শুদ্র হয় কর্মসূত্রে। আর আগেই বলেছি, অক্ষর জ্ঞানহীন এবং মূর্খরাই হলো শুদ্র। তো যারা অক্ষর জ্ঞানহীন, তারা বেদ পড়বে কিভাবে ? আর যারা বেদ পড়তেই পারে না, তারা বেদ পাঠের অধিকার লাভ করবে কিভাবে ? এই বিবেচনা হতেই প্রাচীনকাল থেকে শুদ্ররা যে বেদ পাঠের জন্য অযোগ্য, পাঠান্তরে কালক্রমে যেটা হয়ে উঠেছে নিষিদ্ধ; আর এটা ধর্মীয় কারণে নয়, এটা যে অক্ষরজ্ঞানহীন এবং মূর্খদের সামাজিক অযোগ্যতার কারণে, সেটা তো একটু আগেই বললাম। তাহলে সামাজিক কারণে শুদ্ররা যেখানে বেদ পাঠেরই অযোগ্য, সেখানে ভাগবতে কিভাবে বলা হয়েছে যে- শুদ্রজাতির বেদ শ্রবণের অধিকার নেই ? বলতে পারতো শুদ্রজাতির বেদ পাঠের অধিকার নেই, যেহেতু তাদের বেদ পাঠের যোগত্যা নেই। আর, অযোগ্যদের হাতে কোনো কিছু পড়লে, সেটা যে আর আস্ত থাকে না, সেটা তো সর্বজনবিদিত। তাই অযোগ্যদের হাত থেকে বেদের বিকৃতিকে রক্ষা করার জন্য শ্রেণী বিশেষে যে বেদ পাঠ নিষিদ্ধ ছিলো, সেটা ছিলো বাস্তব এবং সনাতন ধর্মের রক্ষার জন্য উপযোগী সিদ্ধান্ত।

এবার আসা যাক স্ত্রীজাতির বেদ পাঠের কথায়-

প্রাচীনকাল থেকেই মেয়েরা সামাজিক কারণে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সুযোগ না পাওয়ায়, তাদের বুদ্ধির বিকাশ কম হয়েছে এবং সেই অল্পবুদ্ধির উত্তরাধিকারিণী হওয়ায় বর্তমান যুগেও, যেখানে মেয়েদের ব্যাপক পড়াশোনার সুযোগ আছে এবং আছে ঘরে বসেই ইন্টারনেট টিভির মাধ্যমে সারা পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ, এই সময়েও কোনো কোনো শিক্ষিত মেয়ে যেসব কাণ্ড ঘটায়, যেমন কলেজ পড়ুয়া হিন্দু মেয়ের মুসলমান ট্রাক ড্রাইভারের হাত ধরে পলায়ন বা শিক্ষিত, ধনী ও সম্ভান্ত হিন্দু ঘরের মেয়েরও চাষা ভূষা মুসলমানের প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়ে পলায়ন- এই ঘটনাগুলো আমাদেরকে, জেনেটিক্যালি মেয়েদের অল্পবুদ্ধির প্রমাণই দেয়। বর্তমান কালেই যখন এই অবস্থা, তখন প্রাচীনকালে মেয়েদের বুদ্ধি কোন স্তরে ছিলো সেটা একটু কল্পনা করুন। সেই সময় অক্ষরজ্ঞানহীন ও মূর্খ শুদ্রদের সাথে সামগ্রিক নারী জাতির তেমন কোনো পার্থক্য ছিলো না বলেই হয়তো শুদ্র ও নারীদেরকে এক কাতারে ফেলে ভাবা হতো - স্ত্রীজাতির বেদ পাঠে কোনো অধিকার নেই। কিন্তু বেদ শ্রবণের কোনো অধিকার থাকবে না কেনো, বেদ শ্রবণে তো আর কোনো যোগ্যতার দরকার হয় না, বসে বসে শুনলেই হয়, বুঝুক বা না বুঝুক, সেটা তো পরের ব্যাপার।

এই সব বিচারে আমার সিদ্ধান্ত, ভাগবতের ঐ বাক্যটি সম্পূর্ণ প্রক্ষিপ্ত, বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পরে কেউ এই বাক্যটি ভাগবতের মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে, যেমন বসিয়ে দিয়েছে, এই তথ্য যে- সনাতন ধর্মকে বিলুপ্ত করার চেষ্টাকারী বুদ্ধ ছিলেন বিষ্ণুর অবতার!

বেদ পাঠে যে নারীর অধিকার আছে, এবার সে ব্যাপারে একটি তথ্য আপনাদেরকে দিই-

ঋগ্বেদের ১/১৭৯ সূক্তের রচয়িতা ঋষি অগস্ত্যের স্ত্রী লোপামুদ্রা, ৫/২৮ সূক্তের রচয়িতা ঋষি অত্রির কন্যা বিশ্ববারা, ৮/৯৬ সূক্তের রচয়িতা ঋষি অত্রির কন্যা অপালা, ১০/৩৯ ও ৪০ সূক্তের রচয়িতা ঋষি কক্ষিবৎ এর কন্যা ঘোষা, ১০/৮৫ সূক্তের রচয়িতা সাবিত্রী সূর্যা, ১০/১২৫ সূক্তের রচয়িতা ঋষি অম্ভৃণের কন্যা বাক এবং ১০/১৪৫ সূক্তের রচয়িতা ইন্দ্রাণী।

এখানে দেখা যাচ্ছে ঋগ্বেদের ৮টি সূক্তের রচয়িতা ৭ জন নারী ঋষি বা ঋষিকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা রচনা করতে পারেন, তারা তা পড়তে বা পাঠ করতে পারবেন না কেনো, বা শ্রবণই বা করতে পারবেন না কেনো ?

সুতরাং বেদ পাঠে যে নারীদের কোনো বাধা নেই বা বাধা নেই বেদ পাঠে সক্ষম কারোরই, আশা করছি- উপরের আলোচনা থেকে তা আমার বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার করতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment