গীতার ১৩/১৪(১৫) নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ কোন ঈশ্বরের কথা বলেছেন ?
#Arya_Nirmol,
এর আগে, আমি একটা লেখায় আপনাদের আর্য সমাজীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম- আপনারা গীতা পড়েন, গীতার মধ্যে ভুল খোঁজার উদ্দেশ্যে, গীতার জ্ঞান লাভ করার জন্য নয়, তাই গীতার বাণীর প্রকৃত মর্ম বা গীতার প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান আপনারা পান না, প্রাসঙ্গিক হওয়ায় সেই কথাটি আবারও বললাম।
যেহেতু আপনাদের উদ্দেশ্য গীতার তথাকথিত কাল্পনিক ভুল ত্রুটি খোঁজা, তাই আপনারা গীতার সামগ্রিক রূপটি দেখতে পান না, দেখেন খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন রূপ, যাতে আপাতদৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণের কথায় ব্যাকরণগত ত্রুটি আছে বলে মনে হয়, কিন্তু সামগ্রিক রূপটি অবশ্যই এমন নয়, তার প্রমাণ দিচ্ছি, নিচে-
আপনি ১৩/১৫ হিসেবে গীতার যে শ্লোকের উল্লেখ করেছেন, সেটি আসলে ১৩/১৪; কারণ, শুধু জগদীশচন্দ্র ঘোষ ই নয়, শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য এবং শ্রীধরস্বামীও ত্রয়োদশ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকটিকে প্রক্ষিপ্ত মনে ক'রে, এটাকে গণনা থেকে বাদ দিয়ে ২য় শ্লোক থেকে গণনা শুরু করেছেন। অনেক ছোটখাটো গীতাতেও এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। আপনি তো কোনো এ্যাপ থেকে এটাকে স্ন্যাপ করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি এই এ্যাপ বানিয়েছে, সে হয় তো বিষয়টি জানেই না, তাই ১৩ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকটি গণনায় নিয়ে শ্লোকের নং বসিয়েছে, তাই ১৩/১৪, ১৩/১৫ হয়ে গেছে। গীতা সম্পর্কে আপনাদের এমন জ্ঞান এবং এমন সব আনাড়ীর হাতের বানানো এ্যাপ ট্যাপ দিয়ে আপনারা শ্রীকৃষ্ণের কথার সমালোচনা করেন! আপনি ব্যক্তি হয়ে ঈশ্বরের কথার ভুল ধরেন, এজন্যই বোধ হয় আপনাদের কথাও ত্রুটিমুক্ত হয় না, যার জন্য আপনাদের সকল কটূক্তির জবাব আমি দিতে সক্ষম হই। কেননা, যেখানে ভুল আছে, সমালোচনা তো সেখানেই সম্ভব। ভুল হীন কথার সমালোচনা করে করার ক্ষমতা রাখে ?
যা হোক, ভুল রেফারেন্সে আপনি গীতার ১৩/১৪ নং শ্লোক, যে শ্লোকে বলা আছে-
"সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তথাপি তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তথাপি তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি জড়া প্রকৃতির গুণের অতীত, তথাপি তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।"
-সেই শ্লোকের উল্লেখ করে বলেছেন, এই শ্লোকটি কার মুখের বাণী ? যদি শ্রীকৃষ্ণের মুখের বাণী হয়, তিনি কোনো ঈশ্বরের বর্ণনা দিলেন ?
ঐ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ কার কথা বলেছেন, সেটা বোঝার জন্য পড়া শুরু করতে হবে ১৩/১২, আপনার হিসেবে ১৩/১১ নং শ্লোক থেকে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন বা বোঝাচ্ছেন,
"জ্ঞেয় কাহাকে বলে, তাহা বলিতেছি, ইহা জানিতে পারিলে মোক্ষ লাভ করা যায়, ইহা আদ্যন্তহীন আমার নির্বিশেষ স্বরূপ ব্রহ্ম, ইনি সৎ ও অসৎ কিছুই নহেন।"
খেয়াল করুন, শ্রীকৃষ্ণ এখানে বললেন, "ইহা আদ্যন্তহীন আমার নির্বিশেষ স্বরূপ ব্রহ্ম"
এবার সেই ব্রহ্ম বিষয়টি বোঝানোর জন্য অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
"সেই ব্রহ্ম সর্বত্রই হস্ত-পদ-মস্তক-মুখ-চক্ষু এবং কর্ণবিশিষ্ট, তিনি সমগ্র জগৎ জুড়িয়া আছেন।"- (১৩/১৩)
"সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তথাপি তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তথাপি তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি জড়া প্রকৃতির গুণের অতীত, তথাপি তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।"-(১৩/১৪)
"তিনি সর্বজীবের অন্তরে এবং বাহিরে আছেন। তিনি স্থাবর ও জঙ্গমরূপে আছেন; তিনি সূক্ষ, তাই তাঁহাকে জানা যায় না এবং তিনি দূরে থাকিয়াও নিকটে স্থিত।"-(১৩/১৫)
"তিনি অবিভক্ত হইয়াও সর্বভূতে ভিন্ন ভিন্ন হইয়া অবস্থিত। তাঁহাকে সর্বভূতের পালনকর্তা, সংহারকর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলিয়া জানিবে।"-(১৩/১৬)
"তিনি সকল জ্যোতিরও জ্যোতি; তিনি অজ্ঞানের অতীত, তিনি জ্ঞান, আবার তিনিই জ্ঞেয়; জ্ঞান যোগে তাহাকে পাওয়া যায়, তিনি সকল প্রাণীর হৃদয়ে অবস্থান করেন।"- (১৩/১৭)
আবারও খেয়াল করুন, শ্রীকৃষ্ণ ১৩/১৭ নং শ্লোকের শেষ বাক্যে বললেন, "তিনি সকল প্রাণীর হৃদয়ে অবস্থান করেন।"
যদিও এই "তিনি" কে, সেটা শ্রীকৃষ্ণ গীতার ১৩/১২ নং শ্লোকেই বলে দিয়েছেন এভাবে "ইহা আদ্যন্তহীন আমার নির্বিশেষ স্বরূপ ব্রহ্ম"; আবার শ্রীকৃষ্ণ ১৫/১৫ নং শ্লোকের শুরুতেই যে বলেছেন, "আমি সকল প্রাণীর হৃদয়ে অন্তর্যামীরূপে আছি।", এটা দ্বারাও প্রমাণ হয় যে- শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে বোঝানোর জন্য যে ব্রহ্মের কথা বলেছেন, সেটা আসলে তিনিই।
ফটো হিসেবে যে দুটি স্ন্যাপ পোস্ট করেছি, সাধারণ দৃষ্টিতে সেগুলো পড়ে বা দেখে, যে কারো মনে হবে, আরে তাই তো, শ্রীকৃ্ষ্ণ নিজে ঈশ্বর হলে এখানে তিনি কোন ঈশ্বরের কথা বলেছেন ? কিন্তু এসব ভাবার আগে মনে রাখতে হবে- গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছেন, তা অর্জুনকে বোঝানোর জন্য বলেছেন, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি জানি, কাউকে কিছু বোঝানোর জন্য অনেকভাবে অনেক কথা বলতে হয়, শ্রীকৃষ্ণ এখানে তাই করেছেন, অর্জুনকে তিনি "জ্ঞেয়" বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে প্রথমে বলেছেন, "ইনি আমার আদি অন্ত হীন নির্বিশেষ স্বরূপ ব্রহ্ম।" শেষে বলেছেন, "ইনি সবার হৃদয়ে অবস্থান করেন।" আবার যেহেতু গীতার ১৫/১৫ নং শ্লোক সাক্ষ্য দিচ্ছে যে- শ্রীকৃষ্ণই সবার হৃদয়ে অবস্থান করেন, সেহেতু এটা অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণিত যে শ্রীকৃষ্ণই পরমব্রহ্ম বা পরমাত্মা।
আমার এই জ্ঞানগর্ভ তাত্ত্বিক আলোচনা, আর্য সমাজীদের মাথায় না ঢুকলেও, আমার পাঠকবন্ধুরা যে বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন, সেই আশা আমি করছি।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment