#Arya_Nirmal,
দেশে আইন কানুনের শত শত বই আছে, কিন্তু মূল আইন দেশের সংবিধান, সেটা কিন্তু খুব বড় বই নয়, তথাপি সংবিধানই দেশের সবচেয়ে বড় আইনের বই।
বেদের মোট মন্ত্র সংখ্যা ২০৪৩৪, আর গীতার শ্লোক সংখ্যা মাত্র ৭০০। আপনি কিভাবে আশা করলেন যে ৭০০ শ্লোকের গীতায় সবকিছু থাকবে বা সবকিছুর বিস্তারিত থাকবে ? গীতায় সনাতন ধর্মের আবশ্যকীয় মূল ব্যাপারগুলো থাকবে এবং তাই আছে। আবার এমন কিছু ব্যাপার আছে, যেগুলো গীতায় আছে, কিন্তু বেদে নেই; যেমন- মোক্ষ বিষয়ক কথাবার্তা। আপনি বলেছেন গীতায় ১৬ সংস্কার নেই, আমি বলছি বেদে মোক্ষের ব্যাপারে বলা নেই, এখন আপনি বেদ থেকে মোক্ষের ব্যাপারটি দেখান দেখি। তাছাড়া ১৬ সংস্কার খুবই সাধারণই একটি বিষয়, এমন বিষয় গীতার মতো উচ্চমার্গীয় গ্রন্থেই বেমানান।
আপনি বলেছেন, বেদে প্রলয় ও সৃষ্টি তত্ত্ব আছে, কিন্তু গীতায় নেই। আগেই বলেছি- ৭০০ শ্লোকের গীতায় সবকিছু থাকবে এমনটা আশা করা মূর্খামি। কিন্তু গীতা যেহেতু সকল সনাতনী গ্রন্থের সারসংক্ষেপ, সেহেতু সৃষ্টি ও প্রলয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের ইঙ্গিত গীতায় থাকা স্বাভাবিক, এখন গীতায় ঢুকে দেখা যাক এ ব্যাপারে কোনো কোনো কিছু বলা আছে কি না ?
গীতার জ্ঞান বিজ্ঞান নাম সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে-
"ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার এই রূপে আমার প্রকৃতি আট ভাগে ভাগ করা হইয়াছে।" -(গীতা, ৭/৪)
"এই আট প্রকার প্রকৃতির নাম অপরা (জড়) প্রকৃতি। ইহা ছাড়া জীবরূপা চেতনাত্মিকা আমার আর একটি প্রকৃতি আছে, তাহার নাম পরা প্রকৃতি। সেই পরা প্রকৃতি এই জগতকে ধারণ করিয়া আছে।" - (গীতা, ৭/৫)
"এই অপরা ও পরা প্রকৃতি হইতেই সর্ব প্রাণীর সৃষ্টি হইয়াছে। সুতরাং আমিই জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ।" - (গীতা, ৭/৬)
"হে অর্জুন, আমা অপেক্ষা শ্রেয় আর কিছু নেই; সুতা্য় যেমন মনিগুলি গাঁথা থাকে, তেমনি আমাতেই এই সমস্ত জগত গাঁথা রহিয়াছে।"- (গীতা, ৭/৭)
এরপর গীতার এই সপ্তম অধ্যায়েরই ৮ থেকে ১১ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
"আমি জল মধ্যে রস, আমি চন্দ্র সূর্যের প্রভা, সকল বেদে আমি ওঙ্কার, আমিই আকাশে শব্দ এবং আমিই মানবমধ্যে পৌরুষরূপে বিদ্যমান।
পৃথিবীর পবিত্র গন্ধ এবং অগ্নির তেজ আমিই, সর্বভূতে জীবন এবং তপস্যীগণের তপস্যা আমিই। হে অর্জুন, আমাকে সর্বভূতের সনাতন বীজ বলিয়া জানিবে। বুদ্ধিমানের বুদ্ধি তেজস্বীদের তেজ আমিই।
হে অর্জুন, বলবানদের কাম রাগ বিবর্জিত বল আমিই। আমিই প্রাণীগনের ধর্মের অবিরোধী কাম।"
সৃষ্টি ও প্রলয় সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ গীতার অষ্টম অধ্যায়ের ১৭ ও ১৮ নং শ্লোকে আরও বলেছেন,
"সহস্র চতুর্যুগে ব্রহ্মার একদিন বা এক রাত্রি। ইহা যিনি জানেন, তাঁহারই দিন ও রাত্রির প্রকৃত জ্ঞান আছে। ব্রহ্মার দিন হইলে অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে সকল ব্যক্ত পদার্থ সৃষ্টি হয়। আবার রাত্রি হইলে সেই অব্যক্ত কারণেই লয় প্রাপ্ত হয়।"
আবার সৃষ্টি ও প্রলয় সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৯ম অধ্যায়ের ৪, ৭ এবং ৮ নং শ্লোকে বলেছেন,
"আমি অব্যক্তস্বরূপ এই সমগ্র জগত ব্যাপিয়া আছি। আমাতে সর্বভূত অবস্থিত, কিন্তু আমি সেই সকলে অবস্থিত নহি। হে অর্জুন, প্রলয়ের সময়ে সর্বভূত আমার প্রকৃতিতে বিলীন হয়। পুনরায় সৃষ্টিকালে আমি তাহাদের পুনরায় সৃষ্টি করি। আমি নিজের প্রকৃতিকে আত্মবলে রাখিয়া মায়ার বশে অবশ এই ভূতগণকে পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি করি।"
এরপর ১০ম অধ্যায়ের ৬,৮ ও ২০ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
"ভৃগু প্রভৃতি সপ্তমহর্ষি, তাঁহাদের পূর্ববর্তী চারিজন মহর্ষি এবং চৌদ্দজন মনু, ইঁহারা সকলেই আমার প্রভাবযুক্ত এবং আমার মানসজাত, এই জীবজগৎ তাঁহাদেরই সন্তান। আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ, আমা হইতেই সমস্ত জগত প্রবর্তিত হয়। সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আত্মা আমিই, আমিই সর্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহারস্বরূপ।"
এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণ, গীতার দশম অধ্যায়ের ৩২ ও ৩৯ নং শ্লোকে বলেছেন,
"হে অর্জুন, আমি সৃষ্ট পদার্থসমূহের মধ্যে আদি, মধ্য ও অন্ত। সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি। এই বিশ্বচরাচরে কোনো কিছুই আমা ছাড়া হইতে পারে না।"
আর্য সমাজীদের কাছে আমার প্রশ্ন- গীতার এই শ্লোকগুলি কি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও প্রলয় তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করে না বা এগুলি কি সৃষ্টি ও প্রলয় তত্ত্বের ইঙ্গিত নয় ?
সৃষ্টি ও প্রলয় তত্ত্ব সম্পর্কে যা বলার ছিলো, তা বললাম। এবার দেখা যাক, আর্য সমাজীদের যে জ্ঞান বুদ্ধি, সে সম্পর্কে গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কী বলেছেন-
গীতার ৭ম অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
"পাপিষ্ঠ ও বিবেকহীন নরাধমেরা মায়াদ্বারা মোহিত হইয়া অসুর স্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে ভজনা করে না।"
অথচ, ঘোষ রূপা ওরফে রূপা ঘোষ ওরফে বিক্রম বর্মন আমাকে অসুর বলে ! কিন্তু গীতার সূত্র অনুযায়ী অসুর তারাই, যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভজনা করে না। তাই বাস্তবে অসুর হলো শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব বিরোধী আর্য সমাজীরাই।
আবার আর্য সমাজীরা নিজেদেরকে জ্ঞানের মহাসুমদ্র মনে করে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৭/১৭ নং শ্লোকে বলেছেন,
"জ্ঞানী সতত আমাতেই যুক্তবিত্ত এবং একমাত্র আমাতেই ভক্তিমান"
এই সূত্রে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিরোধী আর্য সমাজীরা কি জ্ঞানী ? এরা জ্ঞানের মহাসমুদ্র নয়, এরা অজ্ঞানের পঙ্কিল নর্দমা, যে নর্দমার কাদা ছড়িয়ে এরা হিন্দু সমাজকে কলুষিত করছে।
আর্য সমাজীরা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মনে করে না, তারা তাঁকে একজন যোগী পুরুষ মনে করে, যারা শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে এইরকম ভাবে, তাদের সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৯ম অধ্যায়ের ১১ ও ১২ নং শ্লোকে বলেছেন,
"অবিবেকী ব্যক্তিরা সকল প্রাণীর ঈশ্বররূপ আমার পরমভাব না জানিয়া নর দেহধারী বলিয়া আমাকে অবজ্ঞা করে। এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তিদের- আসা ব্যর্থ, কর্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত।"
আর্য নির্মলের কমেন্টের প্রসঙ্গে এতক্ষণ আর্য সমাজীদের সম্পর্কে বললাম, এবার নজর দিই জিতেন্দ্র জিতুর প্রশ্নের দিকে-
জিতু প্রশ্ন করেছে- আমি আমার একটি প্রবন্ধে বলেছি, বর্তমানে গীতাই সনাতন ধর্মের প্রধান গ্রন্থ, কিন্তু বেদ আদি বা ভিত্তি গ্রন্থ। এই ব্যাপারে জিতু আমায় প্রশ্ন করেছে, তাহলে শঙ্করাচার্য মহাভারত থেকে গীতাকে আলাদা করার আগে হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কী ছিলো ?
জিতু,
বর্তমানে নিশ্চয় আপনি কোনো এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করেন। ফোনের জগতে এন্ড্রয়েড হলো লেটেস্ট প্রযুক্তি, কিন্তু এন্ড্রয়েড আসার আগে বাটন ফোনই ছিলো প্রধান।
সনাতন ধর্ম পরিবর্তনশীল এবং সংস্কারমুখী। বেদের জ্ঞান এসেছিলো সভ্যতার একেবারে প্রাথমিক যুগে, যখন মানুষ তার চেয়ে উচ্চতর জ্ঞান ধারণের উপযোগী ছিলো না এবং তখন বেদের চেয়ে উচ্চতর জ্ঞানের হয়তো প্রয়োজনও ছিলো না। তখন বেদই ছিলো প্রধান। কিন্তু বেদ, মানুষকে, জীবনের সকল শিক্ষা দিতে পারে না ব'লে মহাভারতের কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হয়, যাতে জীবনের সকল শিক্ষা নিহিত। এই মহাভারতের একটি অংশ মানুষের মুক্তি ও ভক্তির কথা বলে ব'লে তা মহাভারত থেকে আলাদা হয়ে গীতা নামে স্বতন্ত্র গ্রন্থের মর্যাদা পায়।
আপনি যখন বয়সে ছোট ছিলেন তখন আপনি জ্ঞান বুদ্ধিতে আপনার পিতার থেকে বেশি বা আলাদা কিছু ছিলেন না; কিন্তু আপনি যখন বয়সে বড় হওয়ার সাথে সাথে জ্ঞান বুদ্ধিতেও বড় হয়েছেন বা হবেন, তখন আপনি আপনার পিতার থেকে শুধু আলাদাই হবেন না, পিতাকে ছাড়িয়েও যেতে পারেন বা পারবেন; তখন আপনার পরিচয় শুধু আপনার পিতার দ্বারা হবে না, আপনার পরিচয় আপনি নিজেই হবেন। জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্মে আপনি যদি খুবই বড় হন, তখন এটা অসম্ভব নয় যে আপনার দ্বারাই আপনার পিতাও পরিচিত হবেন। তাই মহাভারত থেকে প্রসূত হওয়ায় গীতা যে বড় বা প্রধান হতে পারে না, এমনটা নয়; আবার এমনটাও নয় যে, মহাভারতের আগে আসা বেদ থেকে, মহাভারত প্রসূত গীতা বড় হতে পারে না।
একজন ব্যক্তির থেকে অপর ব্যক্তি বড় হয় বয়স ছাড়াও জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্মে; কিন্তু একটি গ্রন্থ, অপর গ্রন্থ থেকে বড় হয় তার উচ্চ মার্গীয় দর্শনে, এই দিক থেকে বর্তমানে গীতাই বড় বা প্রধান, আর গীতা আসার আগে প্রধান ছিলো বেদ। কিন্তু গীতা যে সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় গ্রন্থ, এটা বোঝার জন্য হাইস্কুল লেভেলের জ্ঞান থাকলে চলবে না, তাকে কমপক্ষে স্নাতকোত্তর লেভেলের জ্ঞানী হতে হবে। যেমন- আমি নিজেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় একবার পুরোটা গীতা পড়ে আমার বাবাকে বলেছিলাম, আমি পুরোটা গীতা পড়ে দেখেছি, গীতার মধ্যে কিছু নাই! তখন ছিলো আমার বালকবুদ্ধি, কিন্তু এখন প্রথাগত শিক্ষায় এম.এ পাস এবং আরো শত শত গ্রন্থ পড়ার পর, গীতা পড়ে বুঝতে পারি যে, গীতার মধ্যে আসলেই কী কী আছে। তাই গীতার বিষয় বোঝার জন্য পরিণত বয়স ও বুদ্ধির প্রয়োজন, যেটা আর্য সমাজীদের আছে বলে আমি মনে করি না।
আশা করছি- উপরের আলোচনা থেকে নির্মল আর্য এবং জিতেন্দ্র জিতু, তাদের কমেন্টের জবাব পেয়েছে।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment