Saturday, 23 May 2020

বেদে কি মোক্ষলাভের পথ ও পদ্ধতির আছে ? - ১


#Ajay_Dey,

আমারও খুব আফসোস লাগে, যখন দেখি আপনারা আর্য সমাজীরা বেদ সম্পর্কে এত কিছু জেনে তা নিজেদের গুহ্যদ্বারের মধ্যে ঢুকিয়ে বা লুকিয়ে রেখেছেন।

জ্ঞান অর্জন করে তা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখায় কোনো সার্থকতা নেই, জ্ঞানের সার্থকতা হলো অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়ায়। আপনারা আর্য সমাজীরা বেদ সম্পর্কে এত কিছু জানেন, তাহলে বেদ সম্পর্কে শত শত প্রবন্ধ লিখে অনলাইনে ছাড়েন না কেনো ? কেনো আমার পোস্টের কমেন্টে এসে ঘেউ ঘেউ করেন ? কেউ একজন বলেছিলো- মূর্খের পরিচয় ততক্ষণই গোপন থাকে, যতক্ষণ সে নিজের মুখ বন্ধ রাখে, বৈষ্ণবগুরুদের মতো আপনারাও কি এই কৌশল নিয়েছেন ?

আপনি বলেছেন- মনুস্মৃতিতে স্পষ্ট করে বলা আছে, যারা বেদ নিন্দা করে তারা নাস্তিক।

নিন্দা কাকে বলে সেটা জানেন ? যে যা, তাই বললে কাউকে গালি দেওয়া হয় না বা তার নিন্দা করা হয় না, যে যা নয় সেটা বললেই কাউকে গালি দেওয়া বা নিন্দা করা বোঝায়। নিন্দা মানে কুৎসা রটানো বা অপবাদ দেওয়া, আর এটা করা সম্ভব একমাত্র মিথ্যা প্রচার দ্বারা। আমি বেদ সম্পর্কে কোনো মিথ্যা তত্ত্ব প্রচার করেছি, এটার কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন ? পারবেন না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আমাকে আপনার বেদ নিন্দুক নাস্তিক মনে হলো ?

মূর্খ আমি না আপনি, সেটা আমি আপনার দেওয়া গীতার ১৫/১৫ রেফারেন্স দ্বারাই প্রমাণ করে দিচ্ছি-

এই শ্লোকে বলা হয়েছে-

"আমি সকল প্রাণীর হৃদয়ে অন্তর্যামীরূপে আছি, আমা হইতেই প্রাণীগণের স্মৃতি ও জ্ঞান হয় এবং আমা হইতেই প্রাণীগণের স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপ সাধিত হয়. আমিই বেদসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য, আমিই বেদান্তের অর্থ প্রকাশক এবং আমিই বেদবেত্তা।"

গীতার এই কথা কে বলেছেন ?

-স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।

তার মানে গীতার এই বাণীর মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে যে শ্রীকৃষ্ণই ঈশ্বর। তাহলে আপনারা আর্য সমাজীরা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মানেন না কেনো ? গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৩২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- যারা তার মতের দোষ ধরে এবং তার মত অনুসারে কাজ না করে তারা মূর্খ ও জ্ঞানভ্র্ষ্ট, এও বলেছেন যে- আমি সকল প্রাণীর ঈশ্বর (গীতা- ৯/১১, ১০/৩৩); অথচ আপনার শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মানেন না, তাহলে মূর্খে কে বা কারা ? আমি, না আপনারা আর্য সমাজীরা ? এই ক্ষেত্রে হয়তো আপনি বলবেন, গীতার এই "আমি তত্ত্বই" তো আপনি বোঝেন নি, তাই শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মনে করেন। এইজন্যই তো শুরুতেই বলেছি- জ্ঞানকে নিজেদের পাছার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন কেনো ? গীতার "আমি তত্ত্ব" সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে কেনো এতদিন তা অনলাইনে ব্যাপকভাবে প্রচার করেন নি, যাতে সব শ্রেণীর হিন্দু সেই জ্ঞান অর্জন করতে পারে ? নাকি রাধা ভক্তদের, রাধা-কৃষ্ণ থিয়োরির মতো নিজেরাই গীতার "আমি তত্ত্ব" ঠিক মতো বোঝেন না, তাই তা অন্যদেরও তা বোঝাতে পারেন না ? একটা বিষয় কিন্তু ক্লিয়ার যে, যে যা বোঝে, তা কিন্তু সে অন্যদেরকেও ঠিক মতো বোঝাতে পারে।

আমি আমার আগের একটি পোস্টে- গীতার ২/৪২,৪৩ নং শ্লোক, যে শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

"হে অর্জুন, কতগুলি অল্পবুদ্ধি লোক বেদের কর্মকাণ্ডের স্বর্গকলাদি প্রকাশক প্রীতিকর বাক্যে অনুরক্ত, তাহাদের মতে ইহা ছাড়া অন্য তত্ত্ব না্ই। জন্ম কর্ম ফলপ্রদ, বহুক্রিয়াযুক্ত ভোগৈশ্বর্যে তাহারা সর্বদা কামনাপরায়ণ ও স্বর্গকামী হয়।"

-এই শ্লোক অনুযায়ী আমি বলেছি যে বেদে মোক্ষ লাভের বিষয়ে কিছু বলা নেই, আমার এই কথাকে চ্যালেঞ্জ করে আপনি বেদ ও উপনিষদের দুটি রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন যে, বেদে মোক্ষলাভের বিষয়ে বলা আছে, এবার দেখা যাক আপনার দেওয়া রেফারেন্স প্রকৃত পক্ষে কী বলা আছে-

যদিও আমি মোক্ষের ব্যাপারে উপনিষদের কোনো প্রসঙ্গ আনি নি, তথাপি আপনি যেহেতু উপনিষদের রেফারেন্স দিয়েছেন, তাই বলছি, আপনি এখানে যে রেফারেন্স দিয়েছেন, তাতে "মৃত্যুপাশাংশ্ছিনত্তি" বলে যে শব্দ আাছে, তার অর্থ হলো "মৃত্যু পাশ বা মৃত্যুবন্ধন ছিন্ন করা", এই শব্দগুচ্ছ দ্বারা মোক্ষ লাভ বোঝায়, না অমরত্বকে বোঝায় ? এর দ্বারা অমরত্বকেই বোঝায়। সেজন্য হরফ প্রকাশনীর প্রকাশিত অখণ্ড উপনিষদ, যার অনুবাদক এবং সম্পাদক- অতুল চন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ ও মহেশচন্দ্র ঘোষ, সেখানে এই শ্লোকের অনুবাদে বলা হয়েছে-

"সেই পরমেশ্বরই জগতের স্থিতিকালে বিশ্বরক্ষক জগৎ প্রভু হইয়া সর্বভূতে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করেন। যে পরমেশ্বরে ব্রহ্মর্ষি ও দেবতাগন যুক্ত থাকেন, তাঁহাকে সম্যক জানিয়া সাধক অজ্ঞান মোহরূপ মৃত্যুবন্ধন ছিন্ন করিয়া অমরত্ব লাভ করিয়া থাকেন।"

এরপর যজুর্বেদের ৩১/১৮, যার ভিত্তিতে আপনি বলেছেন, বেদের মূল উদ্দেশ্যই হলো মোক্ষলাভ করানো, সেখানে বলা আছে-

"আমি এ মহান পুরুষকে জেনেছি, যিনি অবিদ্যার অতীত ও আদিত্যের মতো বর্ণ বিশিষ্ট। তাকে জেনেই মুত্যুকে অতিক্রম করা যায়, এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।"

এখানেও কি স্পষ্ট করে মোক্ষের কথা বলা আছে ?

মোক্ষলাভ করতে হলে কাউকে জন্ম ও মৃত্যুর চক্রকে অতিক্রম করতে হয়। শুধু মৃত্যুকে অতিক্রম করে মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে, যেটা পার্থিব বিষয়। যেমন- রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্রহ্মকে জানার চেষ্টা করে সাধনার মাধ্যমে পৃথিবীতে অমর হয়ে রয়েছেন। বেদে যদি মোক্ষের ব্যাপারে কোনো কিছু বলা থাকে তা স্পষ্ট করে দেখান বা মোক্ষ শব্দটিই বেদের কোনো মন্ত্রে দেখান। যদি বেদে মোক্ষের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা থাকে, তাহলে ভুল স্বীকার করে আমি আমার মত প্রত্যাহার করে নেবো। কারণ- সত্যকে স্বীকার করতে আমার যেমন কোনো লজ্জা নেই, তেমনি আবার কারো কাছ থেকে কিছু শিখতেও আমার কোনো দ্বিধা নেই, আর আমি তো মানুষ, আমারও ভুলত্রুটি হতে পারে বা আমারও কোনো বিষয় সম্পর্কে অজানা থাকতে পারে, কিন্তু কেউ সে বিষয় ধরিয়ে দিলে, সেটাকে মেনে নেওয়ার সৎসাহস আমার আছে।

যা হোক, বেদের আর্য সমাজ কথিত মোক্ষ তত্ত্বের বিপরীতে দেখুন- মাত্র ৭০০ শ্লোকের গীতায় মোক্ষ নামে আলাদা করে একটি অধ্যায় আছে এবং তাতে স্পষ্ট করে মোক্ষের বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করা আছে, যাতে এক জন সাধারণ মানুষও খুব সহজে বুঝতে পারে কোন পথ এবং কোন পদ্ধতিতে কোনো মানুষ মোক্ষ লাভ করতে পারে। যেমন-

মোক্ষলাভের জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া, কোন ব্যক্তি কর্মবন্ধন থেকে কিভাবে মুক্ত হন, সেটা বলা আছে গীতার ১৮/৪৯ নং শ্লোকে, এভাবে-

"যিনি সর্ব বিষয়ে আসক্তিশূন্য, যিনি জিতেন্দ্রীয়, যাহার কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই, তিনি কর্মফল ত্যাগের দ্বারা নিষ্কর্ম্যসিদ্ধি লাভ করে কর্মফল হইতে মুক্ত হন।"

এরপর শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "হে অর্জুন, এইরূপে সিদ্ধিলাভ করিয়া সাধক কিভাবে ব্রহ্মকে পান, তাহা সংক্ষেপে বলি শোন, উহাই জ্ঞানের চরম অবস্থা।"- (গীতা, ১৮/৫০)

আর শাস্ত্র থেকে এটা আমরা জানি যে ব্রহ্মকে লাভই হলো মোক্ষ লাভ, আর মোক্ষলাভ সেটাই যা অর্জন করতে পারলে আর পৃথিবীতে জন্ম হয় না। কিভাবে কোনো সাধক ব্রহ্মকে লাভ করতে পারে, সেটা বলা আছে গীতার ১৮/৫১-৫৫ নং শ্লোকে, দেখুন নিচে-

"বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক বুদ্ধিযুক্ত হইয়া, ধৈর্যসহ আত্মসংযম করিয়া, শব্দাদি বিষয়সমূহ ত্যাগ করিয়া, রাগ-দ্বেষ বর্জন করিয়া, নির্জন স্থানে অবস্থিত ও মিতভোজী হইয়া, বাক্য-শরীর-মনকে সংযত করিয়া, বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া, সর্বদা ধ্যানে নিরত থাকিয়া; অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ, এবং বাহ্যভোগসাধনার্থ প্রাপ্ত দ্রব্যাদি বর্জন করতঃ মমত্ববুদ্ধিহীন প্রশান্তচিত্ত সাধক ব্রহ্মভাব লা্ভে সমর্থ হন। ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে তিনি প্রসন্নচিত্তে শোক বা আকাঙ্ক্ষা কিছুই করেন না। তিনি সর্বভূতে সমদর্শী হন এবং আমাতে পরাভক্তি লাভ করেন। এইরূপ পরাভক্তি দ্বারা আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে পারেন, বুঝিতে পারেন- আমি কে, আমার কত বিভাব, আমার সমগ্র স্বরূপ কী এবং এইরূপে আমাকে স্বরূপতঃ জানিয়া তিনি আমাতেই প্রবেশ করেন।"

উপর্যুক্ত উপায়ে সাধক, ঈশ্বরকে লাভ করে মোক্ষ অর্জন করতে পারেন, আবার ঈশ্বরকে লাভে অন্য পথ সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"আমাকে আশ্রয় করিয়া সর্বদা কর্ম করিতে থাকিলেও আমার প্রসাদে শাশ্বত অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন।"- (গীতা, ১৮/৫৬)

উপর্যুক্ত উপদেশ দিয়া শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিয়েছেন-

"তুমি মনে মনে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া, মৎপরায়ণ হইয়া, সাম্যবুদ্ধির যোগ অবলম্বন করিয়া, সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখো এবং যথাধিকার কর্ম করিতে থাকো। আমাতে স্থির চিত্ত হইয়া থাকিলে আমার দয়ায় সকল সঙ্কট অর্থাত কর্মের শুভাশুভ সকল ফল অতিক্রম করিয়া মুক্ত হইতে পারিবে। আর তুমি যদি আমার কথা না শোনো, বিনাশপ্রাপ্ত হইবে।" -(গীতা, ১৮/৫৮)

এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন-

"তুমি একমাত্র আমাতেই মন দাও, আমাকে ভক্তি করো, আমাকে পূজা করো, আমাকে নমস্কার করো। আমি সত্য প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি, তুমি আমা্কেই পাইবে, যেহেতু তুমি আমার প্রিয়। তুমি সব কিছু ত্যাগ করে একমাত্র আমার শরণ লও।" - (গীতা, ১৮/৬৫,৬৬)

এভাবে গীতায় মোক্ষপ্রাপ্তির পথ ও পদ্ধতির সমস্তকিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যার কিছুই বেদে নেই। তাই আমি বলেছি- বেদে মোক্ষ বিষয়ে কিছু বলা হয় নি। কারণ, গীতার মতে- বেদের কর্মকাণ্ড স্বর্গপ্রাপ্তি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

শেষে আপনি বলেছেন- যদি মহামূর্খ না হতেন, তাহলে বেদে মন্ত্র থাকে, না শ্লোক থাকে, সেটা অন্তত জানতেন।

শিক্ষিত সমাজে 'স্লিপ অফ টাং' বা 'স্লিপ অফ পেন' বলে একটা কথা আছে, জানেন ? এর মানে হলো- কথায় বা লেখায় অনিচ্ছাকৃত ভুল, সহজ কথায় জানা বিষয় কোনো কারণে প্রকাশ করতে গিয়ে ভুল হয়ে গেছে।

অনলাইনে আজ পর্যন্ত (২৮.৩.২০২০) আমার প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৮৩০টি, আপনি আমার কয়টি প্রবন্ধ পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে- বেদের ঋকগুলোকে আমি শ্লোক বলেছি ? শ্লোক আর মন্ত্রের সাদৃশ্যতা হেতু হয়তো দু একটি প্রবন্ধে মন্ত্রের বদলে শ্লোক লিখে ফেলেছি, আবার বেদের ইংরেজি অনুবাদক তুলসীরাম শর্মাকে তুলসী রাম দাস হিসেবে উল্লেখ করেছি, কিন্তু এটা কি তথ্যগত খুব মারাত্মক ভুল যে, এজন্য আমার ফাঁসি হবে ? কারো কোনো অক্ষমতা সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে এটা মাথায় রাখা উচিত যে, যে লোক এভারেস্ট ডিঙ্গাতে পারে, তার শারীরিক ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা উচিত কি না
?

আশা করছি- এতক্ষণ কী বললাম সেই বিষয়টি আপনার মাথায় ঢুকেছে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment