Friday, 22 May 2020

অনুগীতা, আর্য সমাজ এবং শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব


অনুগীতা, আর্য সমাজ এবং শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব :

বর্তমানে প্রচলিত মহাভারতের অনুগীতা পর্বের একটি ঘটনা- যেখানে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে পুনরায় গীতার জ্ঞান দেন নি; সেটাকে সামনে এনে আর্যরা লাফালাফি করে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে- শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয়; সে যোগযুক্ত হয়ে ঈশ্বরের সাথে কানেক্ট হয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করেছে মাত্র।

কিন্তু মহাভারত সম্পর্কে যদি আর্যদের টোটাল জ্ঞান থাকতো, তারা এই ধরণের মূর্খামি করতো না। অনুগীতা পর্বটি মহাভারতে কিভাবে যুক্ত হলো, সেটা জানা ও বোঝার জন্য মহাভারত রচিত হওয়ার ইতিহাস জানতে হবে, আজ এখানে তার কিছুটা তুলে ধরছি-

বর্তমানে প্রাপ্ত বা প্রচলিত মহাভারতের আদি পর্বেই বলা আছে- বেদব্যাস মাত্র ২৪ হাজার শ্লোকে এই সংহিতা রচনা করেছেন, সেই সময় বেদব্যাস হয়তো  দু চারটি উপাখ্যান তাতে রেখেছিলেন। এই উপাখ্যানের সুযোগ নিয়ে মূল ২৪ হাজার শ্লোকের মহাভারত কিভাবে ১ লক্ষ শ্লোকে উন্নীত হলো, সে সম্পর্কে রাজ শেখর বসু, তার অনুবাদিত মহাভারত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন,

"মহাভারত সংহিতা গ্রন্থ, এতে বহু রচয়িতার হাত আছে এবং একই ঘটনার বিভিন্ন কিংবদন্তী গ্রথিত হয়েছে। মূল আখ্যান সম্ভবত একজনেরই রচনা, কিন্তু পরে বহু লেখক তাতে যোগ করেছেন। এমন আশা করা যায় না যে তারা প্রত্যেকে সতর্ক হয়ে একটি পূর্ব নির্ধারিত বিরাট পরিকল্পনার বিভিন্ন অংশ গড়বেন, মূল প্ল্যান থেকে কোথাও বিচ্যুত হবেন না।"

রাজশেখর বসু আরো বলেছেন, "বর্তমান মহাভারতের সমস্তটা এক কালে রচিত না হলেও এবং তাতে বহু লোকের হাত থাকলেও সমগ্র রচনাই এখন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের নামেই চলে।"

এতে বোঝা যাচ্ছে মহাভারতের বিভিন্ন উপাখ্যান, বিভিন্ন লোক, বিভিন্ন সময় লিখে মহাভারতের সাথে জুড়ে দিয়েছে, সুতরাং অনুগীতা সম্পর্কিত উপাখ্যানটি যে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তাই এই উপাখ্যানগুলির উপর ভিত্তি করে কৃষ্ণের কাজ ও কথা সম্পর্কে সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না বা উচিতও নয়।

এই তথ্যগুলি যদি আর্যরা জানতো, তাহলে তারা মহাভারতের অনুগীতা উপাখ্যানের উপর ভিত্তি করে- কৃষ্ণ ঈশ্বর নয়- এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্যই করতো না।

শ্রীকৃষ্ণ, গীতার কয়েকটি শ্লোক, যেমন- "হে অর্জুন, ঈশ্বর সর্ব জীবের হৃদয়ে অবস্থান করিয়া মায়া দ্বারা যন্ত্র চালিত পুতুলের ন্যায় ভ্রমণ করাইতেছেন। তুমি সর্বতোভাবে তাহার শরণ লও, তবেই তাঁহার দয়ায় তুমি পরম শান্তি ও শাশ্বত পদ পাইবে।" (গীতা, ১৮/৬১,৬২)- দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে না বুঝিয়ে পরোক্ষভাবে নিজেকে বুঝিয়েছেন, এগুলোর দ্বারাও কিছু মূর্খ এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, গীতার শ্রীকৃষ্ণ যোগী পুরুষ, তিনি ঈশ্বর নন, তিনি যোগের দ্বারা যুক্ত হয়ে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করেছিলেন, যেই যোগের দ্বারা যুক্ত হতে না পারায় অনুগীতা মোতাবেক তিনি পরে আর অর্জুনকে গীতার জ্ঞান পুনরায় দিতে পারেন নি!

গীতায় এরকম শ্লোক আছে মাত্র দুটি, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ পরোক্ষভাবে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এর বিপরীতে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সরাসরি ঈশ্বর হিসেবে প্রকাশ করেছেন, সেরকম শ্লোক আছে কয়েকশত; এই কয়েকশত শ্লোকের বিপরীতে মাত্র দুটো শ্লোক নিয়ে কথা বলা আসলে তিমি মাছকে ছেড়ে পুঁটি মাছ নিয়ে কথা বলা এবং তাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো।

যা হোক, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ, পরোক্ষভাবে কয়েকটি শ্লোকে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে প্রকাশ করলেও প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে প্রকাশ করেছেন অসংখ্য শ্লোকে, যেগুলো কৃষ্ণ বিরোধীদের চোখে পড়ে না, নিচে সেরকম কিছু শ্লোকের বাংলা অনুবাদ কৃষ্ণ ভক্তদের জন্য উল্লেখ করছি-

গীতার ৭ম অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"হে অর্জুন, তুমি আমাতে নিবিষ্ট চিত্ত ও একমাত্র আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত হইলে যেভাবে আমার সমগ্রস্বরূপ জানিতে পারিবে, তাহা বলিতেছি শোনো।"

'একমাত্র আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত'  হওয়ার কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ কি এটা বোঝান নি যে তিনিই ঈশ্বর ?

৬ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "আমিই জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ।"

৭ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমাতেই এই সমস্ত জগৎ গাঁথা রহিয়াছে।"

১০ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমাকে সর্বভূতের সনাতন বীজ বলিয়া জানিবে।"

আর্যদের মতো মূর্খদের জন্য এই ৭ম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ আরো কিছু বলেছেন, সেগুলো আলোচনা করবো এই প্রবন্ধের শেষে, এখন ৯ম অধ্যায়ে যাই-

৯ম অধ্যায়ের ১৭ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"আমিই এই জগতের পিতা মাতা বিধাতা ও পিতামহ, আমিই বেদের পবিত্র ওঙ্কার, আমিই ঋক, সাম, যজুঃ প্রভৃতি সকল বেদ।"

এরপর ২৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"যাহারা অন্য দেবতার পূজা করে, তাহারাও না জানিয়া আমাকেই পূজা করে।"

২৪ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমিই সর্বযজ্ঞের ভোক্তা ও ফলদাতা।"

২৭ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি যাহা যাহা কার্য করো- ভোজন, হোম, দান, তপস্যা সেসব আমাতেই অর্পণ করো।"

৩৪ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি সর্বদা আমাতে মন দাও, আমাকে ভক্তি করো, আমার উদ্দেশ্যেই যজ্ঞ করো, আমাকেই নমস্কার করো।"

১০ম অধ্যায়ের ২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"দেবতারা বা মহর্ষিরা কেহই আমার প্রভাব বা উতপত্তির বিষয়ে জ্ঞাত নহেন। কারণ, আমি সকল প্রকারে তাঁহাদের আদিতে বিরাজমান।"

৩ নং শ্লোকে বলেছেন, "যিনি আমাকে জন্মরহিত, অনাদি ও সর্বলোকের মহেশ্বর বলিয়া জানেন, তিনি মোহশূন্য হইয়া এই জগতের সর্বপাপ হইতে মুক্ত হন।"

৮ নং শ্লোকে বলেছেন, "আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ, আমা হতেই সমস্ত জগত প্রবর্তিত হয়।"

২০ নং শ্লোকে বলেছেন, "সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আত্মা আমিই, আমিই সর্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহারস্বরূপ।"

৩৯ নং শ্লোকে বলেছেন, "সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি। এই বিশ্বচরাচরে কোনো কিছুই আমা ছাড়া হইতে পারে না।"

শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করার পর অর্জুন ১১/৪০ নং শ্লোকে বলেছেন,

"তুমি সমস্ত জগত ব্যাপিয়া রহিয়াছ, সুতরাং তুমিই সমস্ত।"

 চতুর্দশ অধ্যায়ের ২৭ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"আমি অব্যয় অমৃতস্ববরূপ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা; শাশ্বত ধর্ম, ঐকান্তিক সুখ- এই সকলেরই একমাত্র আশ্রয় বা প্রতিষ্ঠা আমিই।"

এরপর পঞ্চদশ অধ্যায়ের ১৩ নং শ্লোকে বলেছেন,

"আমি আপন শক্তিকে পৃথিবীতে প্রবেশ করাইয়া সর্বভূতকে ধারণ করিয়া থাকি।"

১৫ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"আমি সকল প্রাণীর হৃদয়ে অন্তর্যামীরূপে আছি, আমা হতেই প্রাণীগণের স্মৃতি ও জ্ঞান হয় এবং আমা হতেই প্রাণীগণের স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপ সাধিত হয়"

এরপর অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৫৭ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "তুমি মনে মনে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া, মৎপরায়ণ হইয়া, সাম্য বুদ্ধির যোগ অবলম্বন করিয়া, সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখো এবং যথাধিকার কর্ম করিতে থাকো।"

৬৫ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি একমাত্র আমাতেই মন দাও, আমাকে ভক্তি করো, আমাকে পূজা করো, আমাকে নমস্কার করো।"

৬৬ নং শ্লোকে বলেছেন, "তুমি একমাত্র আমার শরণ লও।"

শ্রীকৃষ্ণের এই সব ডাইরেক্ট স্পিচে কি প্রমাণ হয় না যে শ্রীকৃষ্ণই ঈশ্বর ? এরকম অসংখ্য ডাইরেক্ট স্পিচ বাদ দিয়ে দু' একটি ইনডাইরেক্ট স্পিচ নিয়ে বালার্যদের এত লাফালাফি কেনো ?

আর্য, যাদের বলদামির কারণে লোকজন এখন তাদেরকে বালার্য বলে সম্বোধন করে, তারা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানে না, এই আর্যদের স্বরূপ কী, সে সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গীতাতে বলে দিয়েছেন, দেখুন নিচের কয়েকটি শ্লোক-

"ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়া প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ।
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।"- (গীতা, ৭/১৫)

এর অর্থ- পাপিষ্ঠ ও বিবেকহীন নরাধমেরা মায়া দ্বারা হতজ্ঞান হইয়া অসুর স্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে ভজনা করে না।

আর্যদের মতো কেনো কিছু ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মনে করে না, সে কথা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলে গেছেন, দেখুন নিচের এই শ্লোক-

"অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম।"।- (গীতা, ৭/২৪)

এর অর্থ- অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ আমার পরমভাব না জানিয়া অব্যক্তরূপ আমি ব্যক্তিরূপে জন্ম লইয়া থাকি, এরূপ বিবেচনা করে।

অর্থাত- আমার জন্ম ও মৃত্যু নেই বা আমি জন্মরহিত, এই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ যে বুঝিয়েছেন যে তিনি সাধারণ জীবের মতো জন্ম ও মৃত্যুর অধীন নয়, বরং তিনিই জন্ম ও মৃত্যুর নিয়ন্তা, সেটা উপলব্ধি না করে যারা শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ জীবের মতো জন্ম-মৃত্যুর অধীন একটি জীব মনে করে এবং মনে করে যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয়, একজন যোগী পুরুষ মাত্র!

যারা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মানে না তাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই, এই সূত্রে আর্যদের কোনো পারলৌকিক মুক্তি নেই; তবে আর্যদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই; কেননা, গীতার ১০ম অধ্যায়ের ১০ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ তাদের পথ দেখিয়ে বলেছেন-

"যে সব ভক্ত সর্বদা আমাতে মন রাখিয়া আমার ভজনা করেন, আমি সেই সব ব্যক্তিকে সেইরূপ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যাহা দ্বারা তাহারা আমাকে লাভ করিয়া থাকেন।"

শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আর্যদের মন নেই, তাই তারা মূর্খ; সুতরাং আর্যরা যদি পরমপ্রভু শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবে তারা নিশ্চয় শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারবে এবং বুঝতে পারবে যে যারা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মনে
করে তারাই আসলে প্রকৃত জ্ঞানী, তারা আর্যদের মতো কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে অবিশ্বাসী ইতর শ্রেণীর পশু নয়।

আশা করছি- এই প্রবন্ধ পড়ার পর দুর্যোধনের উত্তরসূরী আর্যরা শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান এবং শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করে কথা বলায় উচিত শিক্ষা পেয়েছে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment