Thursday 3 June 2021

শিব ও বিষ্ণুর মনে হয় ভূগোল জ্ঞান ছিল না ?

 


শিব ও বিষ্ণুর মনে হয় ভূগোল জ্ঞান ছিল না ?

“পুরাণের ভাষ্য মতে সতী দেহ ত্যাগ করলে শিব,নিজ স্ত্রীর দেহকে স্কন্দে করে, পাগলের মত নেচেছিলেন। আর এই সময়ে বিষ্ণু এসে সেই দেহকে, একান্ন খন্ড করে কেটে ছড়িয়ে দিল, শুধু ভারতবর্ষে। শিব ও বিষ্ণুর মনে হয় ভূগোল জ্ঞান ছিল না।”

এটা সহ আরও কিছু মন্তব্য করেছে কোনো এক মূর্খ, যার টোটাল কমেন্টটি আমি ফটো হিসেবে এই পোস্টের সাথে যুক্ত করে দিয়েছি, সেটা নিশ্চয় দেখে নিয়েছেন, এগুলোরই জবাব দিবো এই প্রবন্ধে, তাই কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক-

সতীর একান্ন পিঠের অবস্থান যেহেতু শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে, সেহেতু এই মুসলমান এই প্রশ্ন তুলেছে যে- শিব ও বিষ্ণুর মনে হয় ভূগোল জ্ঞান ছিলো না।

এই প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞেস করছি, ১৯৭১ সালের আগের ইতিহাসে কি বাংলাদেশ শব্দটি এবং বাংলাদেশের অস্তিত্ব দেখাতে পারবেন ? পারবেন কি ১৯৪৭ সালের আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ? পারবেন না। একইভাবে প্রমাণ করতে পারবেন না ৫ হাজার বছর আগের ইতিহাসের দ্বারা বর্তমানের প্রায় ২০০ এর বেশি দেশের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে।

পৃথিবীর সবেচেয়ে পুরোনো সভ্যতা হলো সিন্ধু সভ্যতা, যার সূচনা হয়েছিলো বর্তমান থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর পূর্বে এবং এটা টিকে ছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর। সিন্ধু সভ্যতার পরে এর পাশেই গড়ে উঠেছিলো আর্য সভ্যতা। এই সিন্ধু এবং আর্য সভ্যতাতেই পৌরাণিক কাহিনীগুলোর জন্ম এবং এই কাহিনীগুলোর যখন জন্ম, তখন পৃথিবীতে সভ্যতা ছিলো মাত্র একটি এবং পৃথক পৃথক দেশ বলতে কিছু ছিলো না, সেই সময় বর্তমানের ইউরোপ, আফ্রিকা, রাশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ভূখণ্ডে কিছু লোকজন ছিলো বটে, কিন্তু তাদের সভ্যতার কোনো জ্ঞান ছিলো না, বলা যেতে পারে তারা ছিলো জঙ্গল বা গুহা নিবাসী; পৌরাণিক কাহিনীর কোনো জ্ঞান তাদের ছিলো না, তারা সতীর একান্ন পিঠের কী বুঝবে ? তাই সতীর দেহের একান্ন খণ্ডকে এমন সব জায়গায় ফেলা হয়, যে সব স্থান ছিলো সিন্ধু বা আর্য সভ্যতার অন্তর্ভূক্ত, এই পরিকল্পনায় যে, এসব স্থানের সংস্পর্শে এসে অনার্য বা অসভ্য লোকজন সভত্যার জ্ঞান লাভ করবে।

কোনো একটা দেশের সরকার, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা ঘাট নেই, নেই স্কুল কলেজ, সেখানে কি বিশ্ববিদ্যালয় গড়বে ? গড়বে না। একইভাবে দেশের কোনো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল পেতে পারে না কোনো বিমানবন্দর। কোনো একটি দেশের সরকার, দেশের সেই স্থানেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিমানবন্দর স্থাপন করবে, যে এলাকার লোকজন জ্ঞান বুদ্ধি ও ধন সম্পদে সেটা পাবার যোগ্য; যেমন- বাংলাদেশে, ঢাকার পর একমাত্র সিলেট জেলায় আছে ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনের শাখা অফিস, এর একমাত্র কারণ লন্ডনের সাথে সিলেট এলাকার লোকজনের ডাল ভাতের সম্পর্ক, সিলেট এলাকার অসংখ্য লোকজন লন্ডনে বসবাস করে এবং বলতে গেলে তারা প্রতিদিন লন্ডনে যাতয়াত করে, তাই তাদের সুবিধার্থে ব্রিটেন সরকার সিলেটে দূতাবাসের অফিস বসিয়েছে, শুধু তাই নয় সিলেট থেকে সরাসরি লন্ডন যাওয়ার বৈমানিক সুবিধাও তারা পেয়েছে, এই সুবিধা কিন্তু সারা বাংলাদেশের অন্য কোনো এলাকার লোকজন পায় নি, তার মানে যে এলাকার লোকজন যেটা পাওয়ার যোগ্য, তারা ঠিক সেটাই পায়। এই বিবেচনায় সিন্ধু বা আর্য সভ্যতার যুগে সতীর একান্ন পীঠ পাবার যোগ্য যেসব এলাকার লোকজনের ছিলো, তারাই সেই সব পীঠাস্থানের সুযোগ সুবিধা পেয়েছে।

কোনো পীঠস্থান শুধু একটি মন্দির বা পূজা কেন্দ্র নয়, সেটা একটা জ্ঞানকেন্দ্রও। কোনো একটি দেশের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সারা পৃথিবীর লোকজন যেমন জ্ঞান লাভ করে আসে, তেমনি পীঠস্থান দর্শন করেও লোকজন সেই সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করে আসে। এখন যেসব এলাকায় পীঠস্থান রয়েছে, সেসব এলাকার লোকজন তো ঐতিহাসিকভাবেই ভাগ্যবান, যেমন কারো বাড়ির পাশে যদি কোনো মেডিক্যাল কলেজ থাকে, তার মতো লাকি আর কে আছে ? সে সকালে বাড়ির পান্তা খেয়ে কলেজে গিয়ে ক্লাস করে এসে আবার দুপুরে বাড়ির খাবার খেতে পারে, একইভাবে পীঠস্থান এলাকার লোকজন বিনা পরিশ্রম ও বিনা অর্থ ব্যয়ে পীঠস্থানের সুখ সুবিধা এবং পীঠস্থানে যাওয়ার পূণ্য অর্জন করতে পারে, কিন্তু যাদের সেই সৌভাগ্য নেই, তাদের এখন উচিত বা কর্তব্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জ্ঞান অর্জনের মতো পীঠস্থানে গিয়ে জ্ঞান ও পূণ্য অর্জন করা।

আশা করছি- সতীর একান্ন পিঠ কেনো ভারতীয় উপমহাদেশে তার জবাব আমার বন্ধুদের মুখে তুলে দিতে পেরেছি। এবার যাওয়া যাক এই মন্তব্যের পরের অংশে, যেখানে মন্তব্যকারী বলেছে-

“যদি শিব ও বিষ্ণু বিশ্বরে পরিচালক ও স্রষ্টা হন, এবং সতী যদি মহামায়া হন, তবে দেহের খন্ডিত অংশ,
পৃথিবীর অন্য দুর দেশে ও তো যাওয়া কর্তব্য ছিল, তা যায় নাই কেন ? একটি কথা স্মরণে নেওয়া দরকার, যখন পৌরাণিক যুগে, মূর্খ ও অর্বা চীনদের দ্বারা পুরাণ লিখিত হয়, এই লেখকদের ভূগোল সম্পর্কে ভাল জ্ঞান ছিল না। এক দেশের সাথে অন্য দেশের, যোগাযোগ ও যাতায়াত ছিল সীমাবদ্ধ। তাই মূর্খতা বশে, শিব ও বিষ্ণ ঈশ্বরের গুণবাচক নাম জুড়ে দিয়ে,,কাল্পিক কালীমূর্ত্তি তৈরি করে,ভূয়া পীঠস্থান গড়ে তুলে ভন্ড সাধু ও পান্ডাদের চলছে, সহজ সরল জন সমাজেকে ধর্মের নামে শোষন, ও অবাধে লুষ্ঠন। শিব ঈশ্বরের গুণবাচক নাম।”
-এসব বিষয়ের আলোচনা উপরেই হয়ে গিয়েছে, তাই এগুলো আর পয়েন্ট টু পয়েন্ট আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। শুধু এই মন্তব্যকারীকে বলবো- আপনার বাপের বাপের বাপের বাপের বাপের বাপের বাপের উচিত ছিলো আপনার নাম কী হবে তা নির্ধারণ করে একটি দলিল লিখে রেখে যাওয়া। আমার এই কথার উত্তরে এখন আপনিই বলবেন, তার কী প্রয়োজন ? আমার যে জন্ম হবে সেটাই তো ছিলো অনিশ্চিত, তাহলে সাত পুরুষ আগে নাম ঠিক করার কী প্রয়োজন ? এই একইভাবে প্রয়োজন ছিলো না পৌরাণিক কাহিনী রচয়িতা মুনি ঋষিদের সারা পৃথিবীর ভূগোল জ্ঞানের; কারণ, তখন সভ্যতা বলতে ছিলো শুধু আর্য ও সিন্ধু সভ্যতার অধিভূক্ত এলাকা তথা ভারতীয় উপমহাদেশ, আর বাকি পৃথিবী ছিলো জঙ্গলাকীর্ণ, সেই জঙ্গল এলাকা নিয়ে ভেবে তারা নিজেদের সময় নষ্ট করতে চায় নি, একইভাবে তারা চায় নি কোনো জঙ্গলের মধ্যে কোনো পীঠস্থান প্রতিষ্ঠা করে তার মাহাত্ম্যকে হারাতে।

এরপর মন্তব্যকারী বলেছে,

“বামন পুরাণে দারুবনের কাহিনী নিম্নরূপঃ 
বস্ত্র ত্যাগ করে, সুদর্শন শিব ঘুরে বেড়াতেন। একদিন এভাবে মনিদের তপোবনে এলেন। মুনিগন তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন। এমন সময় মুনিপত্নীগণ, শিবের সুঠাম দেহ দেখে, কামে বিমোহিত হয়ে, সভ্যতার সীমা লঙ্ঘন করে, যৌনতায় লিপ্ত হোলেন। ! মুনিগণ ধ্যানে ঐ অপকর্মের কথা জানতে পেরে, শিবকে ধরে পাথরে ঠুকে, শিবের লিঙ্গচ্ছেদ, করলেন। সেই খন্ডিত লিঙ্গ স্বর্গ, মর্ত, পাতালে সব ধ্বংস করতে লাগল। মুনিগণ ভয় পেয়ে গেলেন, এবং শিবের স্তব করতে লাগলেন। তখন দৈব আওয়াজ হলো, পাবর্তী যোনিরূপ ধারণ করলে, ঐই লিঙ্গ যোনিতে প্রবেশ করবে, এবং সব কিছু শান্ত হবে।। মুনিদের পার্থনায় ফলে পার্বতী স্ত্রী, যোনীর আকৃতি ধারণ করলেন,?? এবং শিবের খসে পড়া লিঙ্গ ঐই যোনীর মধ্যে প্রবেশ করলো???। সেখানে হতেই শুরু হলো লিঙ্গ পূজা।

এ ছারা কুর্মপুরাণে ও স্কন্দপুরাণে, এমন কদর্থ পূর্ণ লেখা শিবের নাম লেখা হয়েছে, যা উল্লেখ না করাই ভাল।”

(মন্তব্যটি পড়ার সুবিধার্থে এটিকে এডিট করেছি, এর আসল রূপ পাবেন ফটোপোস্টে)

-এর আগে আমি বহুবার বলেছি পুরাণগুলো নানাভাবে বিকৃত হয়েছে এবং তাতে নানা উদ্ভট ও অশ্লীল উপাখ্যান যুক্ত হয়েছে। বামন পুরাণের রেফারেন্সে এখানে শিবের যে কাহিনী এই মুমিন বলেছে,. সেটা যে মোটেই সত্য নয়, তার প্রমাণ আমি শিব সম্পর্কিত প্রচলিত কাহিনী থেকেই দিচ্ছি-

প্রথমেই সে বলেছে- “বস্ত্র ত্যাগ করে, সুদর্শন শিব ঘুরে বেড়াতেন।”

এমন কোনো ঘটনা শিবের কাহিনীতে থাকতেই পারে না। কারণ, শিব প্রয়োজন ছাড়া কোথাও যায় না, প্রয়োজন না হলে কারো সাথে কথাও বলে না। সব সময় ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা শিবের স্বভাব, তাই বস্ত্র ত্যাগ করে শিবের ঘুরে বেড়ানোর কোনো প্রশ্নই উঠে না। ফলে এর পরবর্তী কাহিনী- মুনিদের স্ত্রীর সাথে শিবের যৌনমিলন এবং শিবকে ধরে মুনিদের পাথরে ঠোকা এবং শিবের লিঙ্গচ্ছেদ একটি আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। যে বা যারা এই কাহিনী বলে বা বিশ্বাস করে, সে বা তারা শিব সম্পর্কে কিছুই জানে না; শিব সর্বশক্তিমান দেবতা, সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তি তার মধ্যে আছে বলেই তার নাম দেবাদিদেব মহাদেব। পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়, মুনি ঋষিরা তার দর্শন লাভের জন্য শত শত বছর ধরে ধ্যান করতো, তাই কোনো ভাবে তার দর্শন পেয়ে মুনি ঋষিরা তার সাথে এমন আচরণের কথা ভাবতেই পারবে না, আর লিঙ্গচ্ছেদ তো আরো পরের ব্যাপার। তারপরও যদি ধরে নিই যে মুনিরা ধরে শিবের লিঙ্গচ্ছেদ করেছিলো, তারপর সেই কাটা লিঙ্গ নিয়ে যে কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে, সেটা কতটুকু বাস্তব, সেটা এবার দেখা যাক-

বলা হয়েছে সেই খণ্ডিত লিঙ্গ স্বর্গ, মর্ত্য পাতালের সব ধ্বংস করতে লাগলো, শিবের এই কাটা লিঙ্গের যদি এত ক্ষমতা থাকে, তাহলে শিবের কত শক্তি চিন্তা করুন, এত শক্তিমান শিবকে ধরে কি পাথরে ঠোকা বা তার লিঙ্গ কাটা সম্ভব ?

এরপর বলা হয়েছে, শিবের ঐ কাটা লিঙ্গকে শান্ত করার জন্য পার্বতী যোনী রূপ ধারণ করে এবং শিবের কাটা লিঙ্গ ঐ যোনীর মধ্যে প্রবেশ করে শান্ত হয়। এখন পাথরের শিবলিঙ্গের নিচের অংশ যদি যোনী হয় এবং যোনীর মধ্যে যদি শিবের লিঙ্গ প্রবিষ্ট বলে কল্পনা করা হয়, তাহলে যোনীর উপরের দিকে লিঙ্গের মাথা থাকে কিভাবে ? যৌনকর্মের সময় যোনীর ভেতরে লিঙ্গের মাথাকে প্রবেশ করানো হয় এবং যোনীর বাইরে থাকে লিঙ্গের গোড়ার দিকের অংশ, আর গোড়ায় থাকে লিঙ্গের অণ্ডকোষ, এই যদি হয় প্রকৃত ঘটনা, তাহলে শিবলিঙ্গে শিবের লিঙ্গ বলে যাকে মুসলমানরা বলে থাকে সেটার মাথা বা লিঙ্গমনি যোনীর বাইরে বা উপরে থাকে কিভাবে ? শিবের পাষাণ প্রতীক যদি পার্বতীর যোনী ও শিবের পুংলিঙ্গ হয় এবং লিঙ্গটি যদি যোনীতে প্রবিষ্ট অবস্থায় থাকে, তাহলে লিঙ্গমনি যোনীর ভেতরে থাকার কথা, তা বাইরে কেনো ?

শিবলিঙ্গ নিয়ে যাদের মাত্রাতিরিক্ত চুলকানী, তারা যেন আমার এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে যায়।

আশা করছি- সনাতন ধর্ম সম্পর্কে ফটোপোস্টে উল্লিখিত কটূক্তির জবাব আমার বন্ধুরা পেয়ে গেছে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment