Friday 16 October 2020

ঈশ্বর নিরাকার হলে দেব-দেবীদের আকার বা রূপ কিভাবে এলো ?

ঈশ্বর নিরাকার হলে দেব-দেবীদের আকার বা রূপ কিভাবে এলো ?

গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকে অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছেন-

"সতত ভগবানে সর্বকর্ম দিয়া যাঁহারা তোমার উপাসনা করেন, আর যাঁহারা নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন, এই উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে ?"

এর জবাবে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

"হে পার্থ, যাঁহারা আমাতে মন নিবিষ্ট করিয়া নিত্যযুক্ত হইয়া আমাকেই পরম শ্রদ্ধার সহিত উপাসনা করে, তাঁহারাই আমার মতে শ্রেষ্ঠ সাধক।"- (গীতা, ১২/২)

এই শ্লোকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে- ভক্তিমার্গে বা ভক্তিপথে ব্যক্ত উপাসনাই শ্রেষ্ঠ। তবে জ্ঞানমার্গে নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনাও নিষ্ফল নয়, এই পথেও স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকেই পাওয় যায়, যেকথা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন এর পরের শ্লোক, গীতার ১২/৩,৪ এ, এভাবে-

"কিন্তু যাঁহারা সর্বত্র সমবুদ্ধি সম্পন্ন, সর্বপ্রাণীর মঙ্গলপরায়ণ হইয়া, ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষয় হইতে সংযত করিযা, যাঁহারা- অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, ধ্রুব, অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁহারাও আমাকে প্রাপ্ত হন।"

সগুন-নির্গুণ বা সাকার-নিরাকার, উভয়ই ঈশ্বরের বিভাব, তবে এর মধ্যে সাকার উপাসনা শ্রেষ্ঠ; কারণ, সকলের পক্ষে নিরাকার উপাসনা করা সম্ভব নয়। যে কথা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতার ১২/৫ নং শ্লোকে, এভাবে-

"যাঁহারা নির্গুন ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁহাদের অধিক কষ্টভোগ হয়। কারণ, দেহধারীগণ অধিক কষ্টে নির্গুণ ব্রহ্ম বিষয়ক নিষ্ঠা লাভ করতে পারেন।"

এই শ্লোকের সরল অর্থ হলো- নির্গুণ ব্রহ্ম বিষয়ক জ্ঞান ও নিষ্ঠা লাভ করা সকলের পক্ষে সহজ ও সম্ভব নয়। কারণ, দেহাত্মবোধ বিদূরিত না হলে নির্গুন ব্রহ্মে স্থিতিলাভ করা যায় না। আর এই অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে পারেন শুধুমাত্র উচ্চস্তরের সাধকগণ, যা সাধারণ মানুষের শুধু নাগাল নয়, চিন্তারও বাইরে। এই সমস্যার সমাধানেই ব্যক্ত উপাসনা পদ্ধতির প্রয়োজন, যে উপাসনা পদ্ধতির পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"যাঁহারা মৎপরায়ন হইয়া, আমাতে সর্বকর্ম সমর্পণ করিয়া, একমাত্র আমাকে ধ্যান করিতে করিতে উপসনা করেন, হে পার্থ, আমি তাঁহাদেরকে মৃত্যুময় সংসার সাগর হইতে উদ্ধার করিয়া থাকি।"-(গীতা, ১২/৬,৭)

তাই শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ হলো- "আমাতেই মন স্থির করো, বুদ্ধি আমাতেই নিবিষ্ট করো, তাহা হইলে দেহান্তে তুমি আমাকেই পাইবে।"- (গীতা, ১২/৮)

আর শ্রীকৃষ্ণকে পেলেই যে মোক্ষলাভ হয়, সেটা তো গীতার ছত্রে ছত্রে প্রমাণিত।

যা হোক, প্রতীক উপাসনা বা মূর্তি পূজার কেনো প্রয়োজন, সে সম্পর্কে গীতাশাস্ত্রী শ্রীজগদীশ চন্দ্র ঘোষ, তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "শ্রীগীতা"র ভূমিকায় বলেছেন-

"যাহা নির্গুণ, নির্বিশেষ, নিষ্ক্রিয়… মনুষ্য তাহা ধারণ করিতে পারে না এবং তাহার সহিত ভাব-ভক্তির কোনো সম্বন্ধও স্থাপন করিতে পারে না। তাহা অচিন্ত্যরূপ, নিজ বোধরূপ…। অথচ কোন তত্বে চিত্ত স্থির না করিলে আত্মবোধও জন্মে না। এই হেতু নির্গুণ ব্রহ্ম উপাসনায় মন স্থির করিবার জন্য প্রতীক উপাসনা অর্থাৎ যাহা ব্রহ্ম নয়, তাহাকে ব্রহ্মরূপে ভাবনা করার ব্যবস্থা।"

জগদীশচন্দ্রের এই মত থেকে স্পষ্ট যে- নির্গুণ ব্রহ্মে চিত্ত স্থির করার জন্য প্রথমে প্রতীক উপাসনার প্রয়োজন। শুরুতে প্রতীক উপাসনার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে নত হয়ে, তার সাথে ভাব-ভক্তির সম্বন্ধ স্থাপন করে, আস্তে আস্তে আত্মবোধ জাগ্রত হলে সাধক নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনার উপযুক্ত হয়।

-একারণে শুরুতেই কাউকে নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করতে বলা আসলে তাকে অথৈ মহাসমুদ্রে ফেলে দেওয়া, যেখানে সে শুধু হাবুডুবুই খাবে এবং হাবুডুবু খেতে খেতেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হবে। কিন্তু সে এই সংসাররূপ সাগরে বেঁচে যাবে, যদি সে কোনো খড়কুটা রূপ কাষ্ঠ পায়, এই কাষ্ঠই আসলে একটি প্রতীক, যাকে অবলম্বন করে সে বেঁচে যাবে এবং আস্তে আস্তে নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনার উপযুক্ত হবে।

সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকারে মন নিবিষ্ট করা সম্ভব নয় বলেই, বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক "শহীদ মিনার" স্থাপন করা হয়েছে'; স্থাপন করা হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদের প্রতীক ঢাকার সাভারের "জাতীয় স্মৃতিসৌধ"। একই কারণে স্থাপন করা হয়েছে ঢাকার মীরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতীক "বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ"। এই ব্যবস্থা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, পৃথিবীর সকল দেশে রয়েছে। এই সব প্রতীকের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে সেই বিষয়টি আগে ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান প্রদান করা হয়, এরপর নিজ ক্ষমতা ও আগ্রহ অনুসারে কোনো ব্যক্তি সেই প্রতীককে অবলম্বন করেই সেই বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করে এবং সে সম্পর্কে আরও উচ্চতর জ্ঞান লাভ করে; একারণেই শুরুটা হওয়া চাই প্রতীককে অবলম্বন করে, এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনার মাধ্যম হিসেবে প্রথম ধাপ হলো সাকার উপাসনা, যাকে সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে মূর্তিপূজা।

মূর্তির মাধ্যমে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করতেই করতেই মানুষ এক সময় ঈশ্বর সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে পারে, তখন তারা বুঝতে পারে- যেকোনো দেব-দেবীর পূজার মাধ্যমে আসলে ঈশ্বরেরই পূজা করা হয় এবং সকল দেব-দেবী প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের বিভিন্ন কার্যকারী রূপ, তখন তারা সব ছেড়ে এক ঈশ্বরের প্রতীক শ্রীকৃষ্ণে মন নিবিষ্ট করে এবং এইভাবে উপাসনা করতে করতে এক সময় তারা নিরাকার ব্রহ্মের উপলব্ধি করতে পারে এবং সেই নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করতে করতে এক সময় তার সাথে একাত্ম হয়ে মোক্ষ লাভ করে। সুতরাং সাকার উপাসনা আসলে নিরাকার উপাসনারই প্রথম ধাপ এবং সাকার উপাসনা দুই ধাপে বিভক্ত, প্রথম ধাপে বহু দেব-দেবীর পূজা-প্রার্থনা এবং দ্বিতীয় ধাপে এক ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের পূজা-প্রার্থনা।

সনাতন ধর্ম হলো বাস্তবতার ধর্ম, এই সব বাস্তবতাকে না বুঝে যারা সরাসরি নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলে, তারা আসলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। যেমন কোনো নিরাকার ব্রহ্মের সাধক, কখনোই তারা ছোট বাচ্চাকে বোঝাতে পারবে না যে নিরাকার ব্রহ্ম আসলে কী ? ফলে সেই বাচ্চাকে দিয়ে সে কখনো নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করাতে পারবে না। এমনটি হলে সেই ছোট বাচ্চা ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত হবে, এর থেকে বাঁচতে প্রথমে সেই ছোট বাচ্চাকে কোনো প্রতীককে নমস্কার করা শিখাতে হবে, প্রতীকের সামনে নত হওয়া শিখাতে হবে, যার মাধ্যমে সে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার একেবারে প্রাথমিক ধাপে প্রবেশ করবে।

যেসব হিন্দু সরাসরি নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলে, তারা আসলে সামাজিক বাস্তবতাকে না বুঝে অবাস্তব থিয়োরি ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তা বলে। কারণ, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় মুসলমানরা এক নিরাকার আল্লার উপাসনা করে; কিন্তু কোরান হাদিসে আল্লার আকারের বর্ণনা দেওয়া আছে, সেই বর্ণনা মোতাবেক মূর্তি তৈরি করলে সেটা হিন্দুদের মতো হয়ে যায় বলে তারা সেটা করে না। এছাড়াও কোরান, হাদিসের বইকে তারা শ্রদ্ধা করে, যেটা প্রতীক উপাসনার পর্যায়ে পড়ে; তারা পশ্চিম দিককে শ্রদ্ধা ক'রে সেদিকে পায়খানা প্রস্রাব করে না বা পশ্চিমদিকে পা দিয়ে ঘুমায় না, এটাও একধরণের প্রতীকী উপাসনা। যেকোনো মসজিদকে তো তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে এবং তার জন্য দো্য়াও পড়ে। মসজিদ দেখে শ্রদ্ধা ভক্তি করা এবং তার জন্য দোয়া দরূদ পড়া কি প্রতীক উপাসনা নয় ? একই কথা প্রযোজ্য মক্কার কাবা শরীফ এবং তার ছবির ক্ষেত্রেও। হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর ছবি ঘরে রাখার মতো মুসলমানরাও বিভিন্ন দর্শনীয় মসজিদ, বিশেষ করে মক্কার কাবা শরীফের ছবি ঘরে রাখে এবং তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে, যা একধরণের প্রতীক উপাসনা ই। বর্তমানে আরবি হরফে লেখা "আল্লাহু" এবং "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" লেখা ছবিও মুসলমানদের কাছে শ্রদ্ধার প্রতীকে পরিণত হয়েছে, তাই এগুলো তারা ঘরের মধ্যে, বাড়ির গেটে সেট করে রাখে। এগুলোও কি প্রতীক উপাসনা নয় ?

সনাতন ধর্মে উপাসনাযোগ্য প্রতীকের তো শেষ নেই, ইসলামে কী কী প্রতীকের উপাসনা করা হয়, তার বর্ণনা সংক্ষেপে উপরে দিয়েছি; খ্রিষ্টান মতবাদে- যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরার ছবি, সদ্যজাত যীশু এবং তার মা মেরীর ছবি এবং শুধু মেরীর ছবিও খুবই শ্রদ্ধার প্রতীক এবং এগুলোর মাধ্যমের খ্রিষ্টানরা তাদের নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে। বৌদ্ধ মতবাদেও গৌতম বুদ্ধের ছবি এবং তার মূর্তি বৌদ্ধদের উপাসনার মাধ্যম। ধর্ম এবং ধর্মীয় মতবাদে প্রতীক উপাসনা তো মাস্ট, রয়েছে যেকোনো দেশের প্রতীক, পতাকা; এমনকি যেকোনো জনসংঘ, দল বা বাণিজ্যিক কোম্পানিরও প্রতীক বা লোগো থাকে, যেগুলো সেই জনসংঘ, দল বা কোম্পানির লোকের কাছে বেশ শ্রদ্ধার বিষয়। এমন কি যে আর্য সমাজীরা নিরাকার উপাসনার পক্ষে এত গলা ফাটায়, তারাও ওঁ এর একটি বিকৃতি রূপ "ও৩ম" ব্যবহার করে, এটা কি সাকার উপাসনা নয় ? যেকোনো প্রতীক তো সাকার ই। এভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে পৃথিবীর সর্বত্র প্রতীক উপাসনা রয়েছে এবং এটাই সনাতন ধর্মের প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা। তাই জেনে বা না জেনে, জ্ঞানে বা সজ্ঞানে- পৃথিবীর সকল মানুষ সনাতনী বিধি বিধান পালন বা চর্চা করে আসছে।

এসব বিষয় উপলব্ধি না করে, মুসলমানদের সস্তা প্রচার- আমরা এক নিরাকার আল্লার উপাসনা করি- তে প্রভাবিত হয়ে, সকল সনাতনীর জন্য নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা চালুর চিন্তা ও তার প্রচার করা মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, সকল মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি কখনো এক হয় নি, কখনো এক হবেও না, তাই সকলের জন্য এক নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা কখনো বাস্তব সম্মত নয়।

প্রতীক উপাসনার বাস্তবতা কোথায়, এ সম্পর্কে একটি উদাহরণ নিচে দিচ্ছি-

ধরে নিন, বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ কোনো এক বিদেশী বাংলাদেশ ঘুরতে এসে কোনো এক জেলা শহরে তিন রাস্তার মোড়ে উঁচু বেদীর উপর নির্মিত কোনো এাকটি মূর্তি দেখতে পেলো। এটা সম্পর্কে কৌতূহলী হলে প্রথমেই সে তার গাইডকে জিজ্ঞেস করবে- এটা কী, আর এটা এখানে কেনো ? এর জবাবে গাইড তাকে জানাবে, এটা মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রতীক। তারপর সেই বিদেশী জিজ্ঞেস করত পারে মুক্তিযুদ্ধ কী, এটা কত সালে হয়েছিলো এবং সে সময় কী কী ঘটেছিলো ? এর জবাবে গাইড তাকে যা ই জানাক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সে আগ্রহী হলে সে নেট ঘেঁটে আরও তথ্য জানার চেষ্টা করবে, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে যাবে, ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাবে, মীরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে যাবে, বাংলাদেশের পতাকার বিবর্তনের ইতিহাস পড়বে, দেশের সকল জেলায় ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ভাস্কর্যগুলো দেখতে যাবে, এভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর সে এমন উচ্চতর জ্ঞান লাভ করবে, যখন তার কাছে প্রথম দেখা সেই জেলা শহরের ভাস্কর্যটির হয়তো অতটা গুরুত্বই থাকবে না, যদিও তার জানার শুরুটা হয়েছিলো এখান থেকেই।

সনাতন ধর্মে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার স্তরে পৌঁছতে কোনো বিগিনারকে প্রতীক উপাসনা বা মূর্তিপূজা ঠিক 

এইভাবে নিবিষ্ট করে এবং পর্যায়ক্রমে তাকে উচ্চস্তরে পৌঁছে দেয়।

তাই প্রতীক উপাসনা বা মূর্তিপূজা নিরর্থক নয়; এটা উচ্চ স্তরের সাধকদের জন্য নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করে ব্রহ্ম লাভের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। নিরর্থক তারা, যারা মূল বিষয় না বুঝে শুরুতেই সবার জন্য নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলে। যদিও গীতার বহুশ্লোক অনুযায়ী মোক্ষ লাভের জন্য কষ্টসাধ্য নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার কোনো প্রয়োজনই নেই, একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান এবং তাতে মন নিবিষ্ট করাই যথেষ্ট। তারপরও যারা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করে মোক্ষ লাভ করতে চান, করতে পারেন, কিন্তু আপনাদের জন্যও স্টার্টিং পয়েন্ট হলো কোনো প্রতীক উপাসনা বা মূর্তির পূজা। আমার এই কথা যে কতখানি সত্য ও বাস্তব, সেটা নিজেদের জীবনের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ পাবেন, আজ যারা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা বলে গলা ফাটাচ্ছেন, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই কি আপনারা সেই জ্ঞান পেয়ে গিয়েছিলেন ? ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম যাকে পেয়েছিলেন, তিনিও একজন আকার, তিনি মা। তারপর জ্ঞান বুদ্ধির বিকাশের সাথে সাথে দেব-দেবীর মূর্তি বা ছবির সামনে আপনাকে নত হওয়া শিখিয়ে আপনার বাবা মা আপনাকে শিখিয়েছিলো কিভাবে ভগবানের পূজা করতে হয় এবং তার কাছে প্রার্থনা করতে হয়। শিশুকাল থেকে সেই আকার বা প্রতীককে ধরেই ধর্মীয় জগতে আপনার পথচলা, যে পথ চলতে চলতে আপনি আজ নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তায় পৌঁছে গেছেন। তাই নিরাকার ব্রহ্মের বিষয়টা শুরুতে কেউ বোঝে না, বোঝা সম্ভব নয়; আকার দিয়েই প্রথমে কাউকে কোনো বিষয় বোঝাতে হয়, তারপর সে আস্তে আস্তে নিরাকারের দিকে এগিয়ে যায়, যার পারিভাষিক টার্ম হচ্ছে- মূর্ত থেকে বিমূর্ত।

তাই নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা সাকার দিয়েই শুরু হয় বা শুরু করতে হয়, এখন প্রশ্ন হলো- ঈশ্বর তো নিরাকার, তাহলে দেব-দেবীরা কোথা থেকে এলো আর তাদের আকারই বা কিভাবে কল্পিত হলো ?

আমরা জানি- শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেছিলেন, তাতে তিনি নিজের মধ্যেই সকল দেব-দেবীকে প্রদর্শন করিয়েছিলেন। সেই থেকেই দেব-দেবীদের রূপ কল্পিত হয়েছে এবং সেই কল্পনা অনুসারে দেব-দেবীদের মূর্তি নির্মান করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হয়, তাহলে এই দেব-দেবীদের তার কী প্রয়োজন আর আমরাই বা কেনো ঐ সকল দেব-দেবীর পূজা করে থাকি ?

-সনাতন ধর্ম বাস্তবতার ধর্ম এবং এটা সব সময় আমাদেরকে বাস্তবতার শিক্ষা দেয়। যেকোনো দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সেখানে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি থাকে। তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার সুবিধার্থে তার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী নিয়োগ করে থাকেন, এদেরকে সহায়তা করার জন্য থাকে বিভিন্ন পদমর্যাদার সরকারী কর্মচারীবৃন্দ। সবাই মিলে রাষ্ট্রটাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ বা ভারতের ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হলেন রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তিনি একা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন না, রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য তিনি নির্ভর করেন তার সরকারী কর্মচারীসহ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের উপর, যদিও এদের সকলের যে ক্ষমতা, তা প্রধানমন্ত্রীরই দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী চাইলে তাদের সেই ক্ষমতাকে কেড়ে নিতেও পারেন।

সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার এই বাস্তবতার শিক্ষাকেই লালন করা হয় বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার মাধ্যমে। কারণ- বাস্তব জীবনে মানুষ শুধু কোনো একজনকে সন্তুষ্ট করে চলতে পারে না, তাকে প্রতিদিনের জীবনে, প্রতিটা ক্ষেত্রে নানাজনকে সন্তুষ্ট করে পথ চলতে হয়। শুরু করছি একেবারে বাড়ি থেকে- আপনার বাড়িতে যতজন সদস্য, ততজনকেই সন্তুষ্ট করে আপনাকে চলতে হবে, মন রক্ষা করে চলতে হবে পাড়া প্রতিবেশীদেরকেও। আপনি যদি ব্যবসায়ী হন, সকল কাস্টমারের মন আপনাকে রক্ষা করতে হবে। আপনি যদি চাকুরীজীবী হন, অফিসের সকলের মন যুগিয়ে আপনাকে চলতে হবে। মন রক্ষা করে চলতে হবে আপনার এলাকার মেম্বার, কমিশনার, চেয়ারম্যানসহ ছোট বড় সকল রাজনৈতিক নেতাদের; কারণ, কখন যে কাকে আপনার প্রয়োজন হবে, সেটা আপনি নিজেও জানেন না, তাই সকলের মন রক্ষা করে না চললে আপনি সামাজিকভাবে বিপদে পড়বেন। এই যাদের মন রক্ষা করে বা তাদেরকে সন্তুষ্ট করে আপনার চলতে হচ্ছে, এরা সকলেই একেক প্রকারের, একেক ক্ষমতার অধিকারী দেব-দেবী, যাদের সকলের মাথার উপরে রয়েছে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী।

আবার রাষ্ট্রের একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাত করা প্রায় অসম্ভব বা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার এমন ব্যক্তিও রয়েছে, যারা চাইলেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা সাক্ষাত করতে পারে; হয় এরা জন্মসূত্রে প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়, নয়তো কর্ম ও গুণে এরা নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকটে নিয়ে যেতে পেরেছে। তো যে সাধারণ নাগরিকের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করা সম্ভব নয়, সেই সাধারণ নাগরিকও যদি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চায়, প্রথমত তাকে প্রধানমন্ত্রীর ভক্ত হতে হবে, তারপর তার দেখা করার পক্ষে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে, তারপর তাকে গিয়ে ধরতে হবে গ্রামের পাতিনেতাকে, পাতিনেতা গিয়ে ধরবে শহরের নেতাকে, সেই নেতা গিয়ে ধরবে এমপিকে, এমপি যদি মন্ত্রী না হয়, সে গিয়ে ধরবে কোনো মন্ত্রীকে, সেই মন্ত্রী যদি সিনিয়র মন্ত্রী না হয়, সে গিয়ে ধরবে কোনো সিনিয়র মন্ত্রীকে, যে প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ, সেই মন্ত্রী যদি চায় তো, সে সেই সাধারণ ব্যক্তির সাথে প্রধানমন্ত্রীর দেখা করিয়ে দিলেও দিতে পারে। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রীরূপ ঈশ্বরকে পাওয়ার এই প্রসেস আসলে সনাতন ধর্মের দেবতত্ত্বের মধ্যে নিহিত। যেকোনো দেব-দেবীর পূজায় যে ভক্তি সে নিজের মধ্যে সৃষ্টি করে, সেই ভক্তি তাকে আস্তে আস্তে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে নিয়ে যায় বা যেতে পারে।

কোনো মানুষ শুধু একজনকে সন্তুষ্ট করে চলতে পারে না, যেটা আগেও বলেছি; জীবন যাপনের তাগিদেই তাকে নানাজনকে নানাভাবে সন্তুষ্ট করে চলতে হয়, সমাজ জীবনের এই শিক্ষাই দেওয়া হয় বহু উদ্দেশ্যে বহু দেব-দেবীর পূজার মাধ্যমে। যে কারণে সনাতন ধর্মে বহ দেব-দেবীর পূজার ব্যবস্থা রয়েছে, আর বহু দেব-দেবী যে সনাতন ধর্মে স্বীকৃত সেটা তো শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের মধ্যেই রয়েছে। এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন- সকল দেবতার পূজার মাধ্যমে আসলে তারই পূজা করা হয় (৯/২৩) এবং দেব-দেবীদের পূজা করে ভক্তরা যে ফল লাভ করে, সেটা শ্রীকৃষ্ণই দেয় (৭/২২) তাই বহু দেব-দেবীর পূজা যে সনাতন ধর্ম স্বীকৃত তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং ঈশ্বর নিরাকার হলেও তাকে বোঝা এবং পাওয়ার সুবিধার্থে প্রথমে তার আকাররূপ কোনো দেব-দেবীর আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়, সেই দেব-দেবীর পূজা করে নিজের মধ্যে ভক্তি সৃষ্টি করতে হয়। মানুষ যেহেতু কোনো আকার বা প্রতীক ব্যতীত নিজের ভক্তি শ্রদ্ধাকে প্রদর্শন করতে পারে না, যেকারণে শহীদ মিনার বা জাতীয় স্মৃতিসৌধের সৃষ্টি, সেহেতু নিরাকার ঈশ্বরের প্রতি নত হতে বা তার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে দেব-দেবীদের উৎপত্তি, যা সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতার প্রতিরূপ।

আলোচনার শেষে সারসংক্ষেপ হিসেবে বলা যায়- দেবদেবীরা হলেন ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তি বা ক্ষমতার প্রকাশ, যেমন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার প্রকাশ হলো তার মন্ত্রী আমলাসহ সকল সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী বৃন্দ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেমন সকলে পৌঁছতে পারে না, তাকে বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীর হাত ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছতে হয়, তেমনি বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে নিজের মধ্যে ভক্তির সৃষ্টি করে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে যাওয়া যায়। ঈশ্বর নিরাকার হলেও নিরাকারের সামনে যেহেতু কেউ নত হতে পারে না বা কোনো নিরাকারে ভক্তি শ্রদ্ধা অর্পন বা প্রদর্শন করা যায় না, সেহেতু ভক্তদের সুবিধার্থেই ঈশ্বরের বিভিন্ন সাকার শক্তির প্রকাশ দেবদেবীদের মূর্তি বানিয়ে তার সামনে নত হয়ে তার মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করে ঈশ্বরের প্রতি যে আমাদের ভক্তি আছে, তার প্রমাণ আমাদেরকে দিতে হয়, এজন্যই নিরাকার ঈশ্বরের সাকার শক্তিরূপ দেব-দেবীদেরকে পূজা আমাদের করতে হয়, যেহেতু আমরা স্বল্পজ্ঞানী সাধারণ মানুষ; কিন্তু যখন আমাদের জ্ঞানের উন্নয়ন ঘটবে, যখন আমরা বুঝতে পারবো যে এক শ্রীকৃষ্ণই সব, তখন সবধরণের মূর্তি পূজা ছেড়ে শুধু শ্রীকৃষ্ণে মন নিবিষ্ট করলেই হবে, যদিও এটা সাকার উপাসনা ই এবং ঈশ্বর প্রাপ্তির তুলনামূলক সহজ পথ এটা। কিন্তু যদি কেউ এর চেয়েও কঠিন পথে নিরাকার ঈশ্বরের সাধনা করতে চায়, সেটাও সে করতে পারে, কিন্তু তার ফল হবে একই, যেকারণে- গীতার ১২/৩,৪ এ বলা হয়েছে,

"কিন্তু যাঁহারা সর্বত্র সমবুদ্ধি সম্পন্ন, সর্বপ্রাণীর মঙ্গলপরায়ণ হইয়া, ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষয় হইতে সংযত করিযা, যাঁহারা- অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, ধ্রুব, অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁহারাও আমাকে প্রাপ্ত হন।"

নিরাকার ব্রহ্মের কঠিন সাধনা করে যদি শেষ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণকেই প্রাপ্ত হয়, তাহলে নিরাকার ব্রহ্মের এই কঠিন সাধনার দরকার কী, গীতার মতে- শ্রীকৃষ্ণের সাকার সাধনাতেই আমি তো তাকে লাভ করতে পারছি ?

নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ দেব-দেবীর কল্পনা কেনো করা হয়েছে এবং তাদের পূজা আমাদেরকে কেনো করতে হয়, আশা করছি- উপরের আলোচনার মাধ্যমে আমার পাঠক বন্ধুদেরকে তা বোঝাতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment