Tuesday 4 August 2020

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি : যোগেন মণ্ডল থেকে মনীষা এবং যোগেন মণ্ডলের চিঠি :


ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি : যোগেন মণ্ডল থেকে মনীষা এবং যোগেন মণ্ডলের চিঠি :

মনীষার মতই বরিশালে আরেকজন নেতা হঠাৎ করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ভারত ভাগের ঠিক পূর্বমূহুর্তে, তবে তিনি ছিলেন দলিত সমাজের মানুষ। নাম ছিল তার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, ওরফে যোগেন মন্ডল। একেবারে হতদরিদ্র, অচ্যুত ঘরে জন্ম নিয়েও তিনি জীবনের বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে শেষমেশ একজন আইনজীবী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এটা আরও একশ বছর আগের কথা, তখন বৃটিশদের শাসন চলছে। আইনজীবী হয়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে একের পর এক চমক দেখাতে শুরু করলেন। বরিশালের কিংবদন্তী অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলে সরল কুমার দত্তকে হারিয়ে এই অঞ্চলের প্রথম দলিত ব্যক্তি হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হোন। এরপর ধাপে ধাপে তিনি বাংলার প্রাদেশিক সরকারে সমবায় মন্ত্রী ও বিচার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপরে যখন দেশ ভাগাভাগি শুরু হয় তখন তিনি ভারতের পক্ষে না গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা শুরু করেন। ব্রাহ্মণ শাসিত হিন্দু সমাজ দ্বারা যুগ যুগ ধরে লাঞ্চিত হওয়ার কারণে তিনি হিন্দুদের দেশে থাকতে চাইলেন না। তিনি চাইলেন আরেক নিপীড়িত জনগোষ্ঠী মুসলমানদের সাথে জোট বেঁধে থাকতে। তার হিসাব ছিল সহজ, হিন্দু অভিজাতদের কাছে অস্পৃশ্য হিন্দুরা যেমন নিপীড়িত, গরীব মুসলমানরাও তেমনি নিপীড়িত। অতএব, দুই নিপীড়িত জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, পরষ্পরের সহযোগী হতে হবে। গরীবের দুঃখ গরীব ছাড়া আর কে বুঝবে?

এই চিন্তা থেকে তিনি পূর্ব বাংলার সকল দলিত মানুষদের পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার আহবান জানালেন। ভারত পাকিস্তান প্রশ্নে সিলেট বিভাগে যখন গণভোট আয়োজন হয়েছিলো তখন যোগেন মন্ডল সর্বশক্তি দিয়ে সিলেটকে পাকিস্তানে রাখার কাজে নেমেছিলেন। এই অঞ্চলের দলিত নেতাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি সিলেটকে পাকিস্তানে রাখার পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তার এই পরিশ্রম বৃথা যায় নি। সিলেটের জনগণ ৫৬%-৪৩% ভোটে সিলেটকে পাকিস্তানে রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, যেখানে দলিত ভোটের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্ব বাংলার অন্যান্য অঞ্চলেও নিম্নবর্গের হিন্দুরা পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

তার এহেন তৎপরতায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ খুব খুশি হোন। তিনি যোগেন মন্ডলকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন এবং পাকিস্তান আইনসভার প্রথম স্পীকারের পদে অধিষ্ঠিত করেন। যোগেন মন্ডলের জীবনের সেরা সময় ছিল সম্ভবত ঐ দিনগুলো। কিন্তু সুখের সময় বেশিদিন থাকলো না। পাকিস্তান গঠিত হওয়ার তিন বছরের মাথায় যখন পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপর ভয়ংকর হামলা শুরু হয়, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, দলিত নির্বিশেষে যখন লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাট করা হয়, জ্বালিয়ে দেয়া হয়, ধর্মান্তরিত করা হয় তখন তিনি বুঝতে পারেন, তিনি কি ভুল করেছেন। কিন্তু তখন আর সেই ভুল শোধরাবার কোন সুযোগ ছিল না। তাই তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধাণমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে পদত্যাগপত্র পত্র পাঠিয়ে পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমান।

তার ভারতের জীবনও খুব সুখকর ছিল না। ভারতে গিয়ে তিনি দলিত সমাজের উন্নতির জন্য আবার রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেখানে আর কেউ তাকে পাত্তা দেয় নি। না নিজের সমাজ, না অভিজাত সমাজ কেউই তাকে আর আপন করে নেয় নি। সেখানকার মানুষের কাছে তিনি বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই প্রতিপন্ন হয়েছেন এবং মাত্র ৬৪ বছর বয়সে একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

আজ যখন মনীষার গরুর মাংস বিতরণের ছবি দেখি তখন আমার যোগেন মন্ডলের কথা বার বার মনে হয়। যে গোহত্যা সনাতন সমাজে পাপ বলে বিবেচনা করা হয়, যে গোহত্যায় তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন অত্যন্ত দুঃখিত হোন, যে গোহত্যার মাধ্যমে দুষ্ট লোকেরা হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘর অপবিত্র করে দেয়, বাড়ির ভেতর গরুর হাড়গোড়, নাড়িভুঁড়ি ফেলে আসে সেই গোহত্যায় অংশ নিয়ে এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে মনীষা দেশের হিন্দু / মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কি বার্তা দিতে চাইলেন ? এর মাধ্যমে কি তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে নিজের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন? সম্প্রতি বরিশাল কলেজের নাম অশ্বিনীকুমার দত্তের নামে নামকরণের আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এক শ্রেণীর মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুত্ববাদী হিসেবে চিহ্নিত  হয়েছেন। এই ঘটনার মাধ্যমে তিনি তাদের মন জয় করার চেষ্টা করলেন ? নাকি তিনি দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীকে এর মাধ্যমে সেক্যুলারিজমের পাঠ দিলেন?

যা হোক, সময়ই বলে দেবে মনীষার এমন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে কার কি লাভ হয়েছে, তবে আমি চাই তাকে যেন যোগেন বাবুর ভাগ্য বরণ করতে না হয়। আমি চাই তিনি এই মাটিতেই যেন সসম্ভ্রমে বাঁচতে পারেন এবং স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন। তার ক্ষেত্রে ইতিহাস যেন ভুল প্রমাণিত হয় কিংবা তিনি যেন নতুন ইতিহাস নির্মাণ করতে পারেন। কিন্তু আমি চাইলেই কি তার পাপ তাকে ছাড় দেবে, তার কুকর্মের ফল তো তাকে ভোগ করতেই হবে।

উপরের এই অংশটি কল্লোল দাশ এর থেকে কপি পেস্ট করা হলেও সামান্য এডিট করা হয়েছে।

সরকারী হিসেবে ১৯৫০ সালে পরিকল্পিতভাবে ৫০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়; বেসরকারী হিসেবে সংখ্যাটা কত হতে পারে তা একটু চিন্তা করুন; সেই সাথে কল্পনা করুন-ধর্ষণ-লুঠপাট ও অগ্নি সংযোগ কী পরিমাণ হয়েছে। এর সবই করা হয় বাকি হিন্দুদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্য, যাতে হিন্দুদের জমি-জমা, বাড়ি-ঘর এমনিই দখল করা যায় বা নিদেনপক্ষে নাম মাত্র মূল্যে পাওয়া যায়। আর এই বিতাড়নে সাধারণ মুসলমান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরও ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। কেননা, পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বিষয়ে, মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে গেলে, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলো, আপনি এসব বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন। কিন্তু ঘটনার সত্যতার বিষয়ে যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল জোর করলে, তাকে গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হয়। যোগেন্দ্র নাথ বুঝতে পারেন, পাকিস্তান নামক জঙ্গলে সভ্য লোকেদের কোনো স্থান নাই। এরপর তিনি কোলকাতায় চলে যান এবং কোলকাতা থেকেই ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে তার পদত্যাগ পত্র করাচীতে পাঠিয়ে দেন।

যা হোক নিচে দেখে নিন মনীষার মতো মূর্খ এবং নির্বোধ যোগেন মণ্ডলের সেই বিখ্যাত চিঠির কিছু অংশ, যা সে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে মনীষার মতো বিশ্বাস যে ভুল ছিলো, যে ভুলে বাংলাদেশের হিন্দুদের বহু ক্ষতি হয়েছিলো, নিজের সেই ভুলকে স্বীকার করে গেছেন-

"ঢাকায় ৯ দিন অবস্থানকালে আমি ঢাকা ও তার পার্শ্ববতী এলাকার প্রায় সব দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করি। ঢাকা-নারায়নগঞ্জ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে শত শত নিরপরাধ হিন্দুর হত্যালীলার সংবাদ আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে।"

, "ইং ২০ ফেব্রুয়ারি, (১৯৫০) আমি বরিশাল পৌঁছলাম এবং সেখানকার দাঙ্গার ঘটনাবলী শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই জেলার শহরে প্রচুর হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক হিন্দুকে খুন করা হয়েছে। এই জেলার প্রত্যেকটা দাঙ্গা-বিধস্ত এলাকা আমি পরিদর্শন করি। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, কী করে জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল পরিধির মধ্যে মোটর রাস্তা দ্বারা কাশীপুর মাধব পাশা এবং লাখুটিয়ার মতো স্থানেও মুসলিম দাঙ্গাবাজরা বিভৎস তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারে। মাধব পাশার জমিদার বাড়িতে প্রায় ২০০ জনকে হত্যা ও ৪০ জনকে আহত করা হয়। মুলাদী নামক একটি স্থানে নরকের বিভীষিকা নামিয়ে আনা হয়। একমাত্র মুলাদীতেই ৩০০ জনের বেশি লোককে খুন করা হয়েছে। মুলাদী গ্রাম পরিদর্শন কালে আমি স্থানে স্থানে মৃত ব্যাক্তিদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। দেখলাম নদীর ধারে কুকুর-শকুনেরা মৃতদেহগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমি জানতে পারলাম, সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে পাইকারি হারে খুন করার পর- সব যুবতী নারীকে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। রাজাপুর থানার অন্তর্গত কৈবর্তখালি গ্রামে ৬৩ জনকে একদিনে হত্যা করা হয়। ঐ থানা অফিসের কাছেই অবস্থিত হিন্দু বাড়িগুলি লুট করে জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে কেটে ফেলা হয়। বাবুগঞ্জ বাজারের সমস্ত হিন্দুর দোকান প্রথমে লুঠ করে পরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিস্তারিত বিবরণ যা এসেছে, তা থেকে খুব কম করে ধরলেও একমাত্র বরিশাল জেলাতেই খুন করা হয়েছে ১০ হাজার হিন্দুকে। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের দাঙ্গার বলির সংখ্যা মোট ৫০ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। গভীর দুঃখে আমি কাতর হয়ে পড়লাম। প্রিয়-পরিজন হারানো, স্বজন হারানো নারী-পুরুষ ও শিশুদের সব হারানো কান্না-বেদনা-বিলাপে আমার ভগ্ন হৃদয় হাহাকার করে উঠলো। আমি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, "ইসলামের নামে কী আসছে পাকিস্তানে ?"

"পাকিস্তানে হিন্দুদেরকে সবদিক থেকেই বিড়ম্বিত করে দেশের মধ্যেই রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে।...মুসলিম লীগ নেতারা বারবার বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন যে, পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে জন্মগ্রহন করেছে এবং মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেই বেড়ে উঠবে।...মহান শরিয়ত নির্দেশিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা শুধু মুসলমানদের হাতেই থাকবে। হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যাঘুরা সেখানে হবে জিম্মি। এই সব জিম্মিরা রাষ্ট্রের কাছে থেকে তাদের নিরাপত্তা ও বাঁচার অধিকার পেতে কিছু মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে।"

"গভীর উৎকণ্ঠা এবং দীর্ঘদিন ধরে চিন্তাভাবনা করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, পাকিস্তান হিন্দুদের বসবাসের জায়গা নয়। সেখানে তাদের ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন; তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ধর্মান্তরিতকরণ অথবা নিশ্চিত অবলুপ্তির করাল গ্রাস। বিরাট সংখ্যক হিন্দু পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেছেন। যেসব হিন্দু এই অভিশপ্ত প্রদেশে থেকে যাবেন, ভাবতে কষ্ট হয়, তারা সবাই ক্রমে ক্রমে পরিকল্পিত পদ্ধতির যাঁতাকলে পড়ে হয় ধর্মান্তরিত হয়ে যাবেন, নয় তো খুন হয়ে যাবেন।"

"আমি যখন নিশ্চিত যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার মন্ত্রী পদে থাকা সত্ত্বেও সেখানকার হিন্দুদের কোনো কাজেই লাগতে পারবো না, তাদের জন্য কোনো সুযোগ সুবিধা ই আদায় করতে পারবো না; তখন সব জেনে শুনে পাকিস্তানের হিন্দুদের এবং বিদেশের মানুষের মনে এই ধারণা কেনো দিতে যাবো যে পাকিস্তানে হিন্দুরা পূর্ণ মান-মর্যাদা-নিরাপত্তা এবং সম্পত্তি ও নিজের ধর্মাচরণের অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারছে বা পারবে ? এরকম ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করার মতো ভণ্ডামি করা আমার উচিত নয় বলে মনে করছি এবং মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগ করছি।"

কর্মের ফল মানুষ অবশ্যই পায়, মনীষাও পাবে, যেমন যোগেন মণ্ডল পেয়েছিলো।

জয় হিন্দ।

No comments:

Post a Comment