Sunday 16 August 2020

"গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং" (১৯৪৬)- এর ভেতর বাহির” : (পর্ব-২)


"গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং" (১৯৪৬)- এর ভেতর বাহির” : (পর্ব-২)

জ্যোতিবসু, পরে তার লেখা এক বইয়ে কলকাতার এই ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর কথা লিখতে গিয়ে লিখেছে, "প্রথম তিন দিনে প্রায় ২০ হাজার লোক নিহত হয়।" এছাড়াও অন্যান্য সূত্রে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায়, তা হলো, শহরের সমস্ত ড্রেন হিন্দুদের লাশে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো। আর গঙ্গায় এত লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে, দুর্গন্ধে মাঝিদের নৌকা চালানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিলো। বাঁশের লগি দিয়ে লাশ সরিয়ে সরিয়ে রাস্তা তৈরি করে মাঝিদেরকে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিলো। এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করুন আর ভাবুন, ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় মুসলমানরা হিন্দুদের কত রক্ত ঝরিয়েছিলো ?

পরিস্থিতি কিছুটা শাস্ত হলে একই রকমের ছোরা বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া গিয়েছিলো, বেলগাছিয়া খিদিরপুর এলাকা থেকে বিপুল পরিমান অব্যবহৃত তরোয়াল, লাঠি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়েছিলো। এগুলো পুরোপুরি ব্যবহার হলে আরও কত হিন্দুর রক্ত ঝরতো সেই বিষয়টিও একবার কল্পনা করুন। আর একই জায়গা থেকে এরকম বিপুল পরিমান অব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করে যে, হিন্দু হত্যার এই পরিকল্পনা ছিলো সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এবং অস্ত্রগুলোও মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিলো। আরও একটা উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, হত্যাকাণ্ডে কসাইখানার কসাইদের সক্রিয় ভূমিকায় লাগানো হয়েছিলো, যাতে কসাইদের জবাই করার দক্ষতাকে হিন্দুদের গলা কাটার জন্য ব্যবহার করা যায় এবং যত বেশি সম্ভব হিন্দুদেরকে যেন হত্যা করা যায়।

ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল শ্রী গোলক বিহারী মজুমদার আই.পি.এস, "ছেচল্লিশের আতঙ্কের দিনগুলো ভুলি নি"- শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, "রাত ১১ / ১২টা নাগাদ ( ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬) পাড়ায় ওরা আবার আক্রমন করলো। দেখলাম একদল লোক - তাদের হাতে ছোরা, তরোয়াল ইত্যাদি নানা অস্ত্রশস্ত্র। তারা চিৎকার করে বলছে, 'আজ তো এক এক হিন্দুকো কোরবানী করেগা।' মা, বাবা, দিদি, আমি, ভাগ্নে সবাই সন্ত্রস্ত। যেকোনো মূহুর্তে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। সবচেয়ে বেশি ভয় দিদিকে নিয়ে। দিদি দেখতে খুব সুন্দরী। ভাবলাম দিদিই হবে ওদের প্রথম টার্গেট। হিন্দু মেয়েদের ওপর ওদের বরবারই লোভ। চার পাঁচদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও আতঙ্ক কাটে নি। ইউনিভার্সিটি খোলা ছিলো। রাজা বাজারের উপর দিয়ে আমাকে যেতে হতো। একদিন দেখলাম, গরু কেটে যেমন হুকের সাথে ঝুলিয়ে রাখে, তেমনিভাবে দেখলাম, হাত পা কাটা হিন্দু মেয়েদের চুল বেঁধে সব ঝুলিয়ে রেখেছে। বিভৎস আর নৃশংস সেই দৃশ্য।"

দেবকুমার বসু, "১৯৪৬ এর দাঙ্গার কয়েকটা দিন" নামে একটি লেখা লিখেছেন ২০০৬ সালে; সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, "রাজা বাজারের সামনের ভিক্টোরিয়া কলেজ ও স্কুল। মেয়েদের কলেজ ও হোস্টেল একদম ফাঁকা, সব পালিয়েছে। কেবলমাত্র রাস্তার দোতলার জানালায় চারটি মেয়েকে খুন করে রাস্তার দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে, কে বা কারা । এই নৃশংসতা ও বিভৎসতা যারাই দেখেছেন, তারাই অনুভব করতে পারেন যে, আমাদের মতো, যুবকেরা কেনো উত্তেজিত হয়ে ক্ষিপ্ত হবে। কেউ এই হোস্টেলের দিকে তাকালে রাস্তার দিকের জানালাগুলি ইট গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া আছে, দেখবেন। আজ ষাট বছর পরেও বন্ধ আছে। কাদের ভয়ে ? "

তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল তার ডায়েরিতে ৩.১১.১৯৪৬ তারিখে লিখেন, "পলাশীর যুদ্ধে যত লোক নিহত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি লোক নিহত হয়েছে, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এ।"

গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং সম্পর্কে লিওনার্ড মোসলে তার বই "দ্য লাস্ট ডেজ অব ব্রিটিশ রাজ" এ লিখেছেন, "ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওড়া পোল পার হয়ে হাওড়া থেকে দলে দলে আসতে শুরু করলো মারাত্মক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত অবাঙ্গালি মুসলমান গুণ্ডারা এবং তারা মিশে গেলো চৌরঙ্গী, চিৎপুরে অপেক্ষমান মুসলমানদের সঙ্গে, শুরু হলো প্রলয়কাণ্ড- কোলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের হিন্দু এলাকাগুলিতে। ইসলামের বিশ্বপ্রেম গ্রাস করে নিলো অরক্ষিত মুসলমান পরিবেষ্টিত হিন্দু পরিবারগুলোকে। আর্ত আহতদের আর্তনাদ, লাঞ্ছিত নারীর ভয়ার্ত ক্রন্দন চাপা পড়লো- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান এবং আল্লাহো আকবার- এর উন্মত্ত কোলাহলে। আগুনে জ্বলতে থাকলো হিন্দুদের স্থাবর অস্থাবর সব কিছু, আকাশে উঠলো কুণ্ডলায়িত কালো ধোঁয়া।"

মুসলমানদের এই আক্রমন সম্পর্কে বীন্দ্রনাথ দত্ত তার "দ্বিখণ্ডিতা মাতা ধর্ষিতা ভগিনী" পুস্তিকায় লিখেছেন, "১৬ আগস্টের ২/৩ দিন আগে থেকেই কলিকাতার নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে নৌকাযোগে হায়নার দল গঙ্গার ঘাটে ক্রমে বাসা বেঁধেছিলো। শ্রাবণের জমাট বাঁধা কালো মেঘের আড়াল ভেঙ্গে সেদিন সূর্য উঠেছিলো কলিকাতার আকাশে; আর রাতের আঁধারেই তৈরি হয়েছিলো শত শত ইসলামের বিশ্বস্ত সৈনিক সম্পূর্ণ অপ্রস্তত নিরীহ হিন্দুদের প্রাণ সংহার করতে।"

১৯৪৬ সালে কলকাতার হিন্দুদেরকে রক্ষা করেন শ্রী গোপাল মুখার্জি :

সূরাবর্দীর সরকারের পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা যখন একের পর এক মার খাচ্ছিলো, মরছিলো আর ধর্ষিতা হচ্ছিলো এবং এটা যখন লাগাতার তিন দিন ধরে চললো, তখন কিছু হিন্দু বুঝতে পারলো যে, হিন্দুদের বাঁচাতে সরকার পুলিশ কিছু করবে না। অতএব যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে। এই ভাবনা নিয়ে একজন কসাই, নাম গোপাল, পাঁঠার মাংস বিক্রি করতো বলে যার নাম হয়েছিলো গোপাল পাঁঠা, সেই গোপাল পাঁঠা দিনের মধ্যে ৮০০ হিন্দু ও শিখ যুবককে সাথে নিয়ে গড়ে তোলে এক বাহিনী এবং পাল্টা মুসলমানদের হত্যা করতে শুরু করে। এর পরই, খুব দ্রুত, পরিস্থিতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেতে থাকে এবং সূরাবর্দী তার বিপদ বুঝতে পারে। তাই মুসলমানরা মার খেতে শুরু করলে সূরাবর্দী দ্রুত পুলিশ-প্রশাসনকে সক্রিয় করে এবং দাঙ্গা থামাতে বাধ্য হয়। এভাবে গোপাল পাঁঠা নামক এক বীরের নেতৃত্বে ১৯৪৬ এ রক্ষা পায় কোলকাতার হিন্দুরা ।

হিন্দুরা নিজের জাতির লোকের প্রতি কেমন অকৃতজ্ঞ আর বেঈমান, গোপাল পাঁঠার প্রতি হিন্দুদের এই দৃষ্টিঙ্গীতে তার কিছু প্রমান পাওয়া যায়। যার কারণে কোলকাতার হিন্দুরা রক্ষা পেলো, সেই তাকেও পরবর্তীতে কোনো হিন্দু তার মূল্যায়ন করা দূরে থাক, তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে নি। গোপাল পাঁঠার জীবদ্দশায় সম্ভবত একজন সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলো। অথচ প্রতিবছরই ১৬ আগস্ট আসে, যায়; কিন্তু তাকে নিয়ে আধ মরা নামের বুড়োগুলোর কারো কোনো মাথাব্যথা নেই! হিন্দুদের এই অকৃতজ্ঞতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো বাংলাদেশ মাইনোরিটি ওয়াচের শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্র ঘোষও, তিনি আমাকে বলেছিলেন, অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে যখন কোনো মেয়েকে মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারে পৌঁছে দিই, তখন অনেকেই ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয় না। এই ক্ষোভ এবং লজ্জা আমারও, কিন্ত কাকে দোষ দেবো ? আমি নিজেই তো হিন্দু সমাজের একজন সদস্য। হিন্দুদের জন্য কাজ করতে হলে এদেরকে নিয়েই কাজ করতে হবে আর অল্প অল্প করে সিস্টেমটাকে পাল্টাতে হবে। আজ আমি বুঝেছি, কাল আপনি বুঝবেন, পরশু আরেকজন বুঝবে এভাবেই হিন্দু সমাজের দুর্বলতাগুলো কেটে যাবে এবং সমাজ আস্তে আস্তে পরিবর্তনের পথে চলবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই, পরিবর্তন এক দিনে হয় না, আর এক দিনে বড় কিছু অর্জনও করা যায় না। হিন্দু সমাজের যে ক্ষত ও দুর্বলতা, সেই লজ্জা আমাদের পূর্ব পুরুষদের; কিন্তু এখন আমরা যদি সেই দুর্বলতাগুলোকে কাটানোর চেষ্টা না করি, তাহলে আমরা যেমন এখন পূর্বসূরীদের দায়ী করছি, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আমাদেরকে দায়ী করবে আর গালি দেবে। এ ভুল আমি করতে চাই না, আর আমি বিশ্বাস করি, আপনিও নিশ্চয় চান না।

মুসলমান হওয়ার প্রস্তাব:

সেই সময়ের একটি ঘটনায় জানা গেছে, মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হিন্দু পরিবারের একটি অবিবাহিত যুবতী মেয়ে, তার প্রতিবেশি মুসলমানের বাড়িতে গিয়ে সাহায্য ও আশ্রয় চাইলে, ওই বাড়ির মুসলমান মালিক মেয়েটিকে প্রকাশ্যে এই প্রস্তাব দেয় যে, মুসলমান হলে তাকে সাহায্য ও রক্ষা করবে। মেয়েটি এই প্রস্তাবে রাজী না হলে, ওই বাড়ির মালিক ই, মেয়েটিকে দাঙ্গাকারী মুসলমানদের হাতে তুলে দেয় এবং মেয়েটিকে একটি বাড়িতে আটকে রেখে মুসলমানরা দুদিন ধরে ধর্ষণ করে। পরে গোপাল পাঁঠার নেতৃত্বে মুসলিম নিধন শুরু হলে মেয়েটি উদ্ধার পায়।এই মেয়েটি জীবিত ছিলো বলে তার নিকট থেকে এই ঘটনাটি জানা গেছে। কিন্ত এরকম ঘটনার শিকার কত শত মেয়ে যে মারা গেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

পুলিশের অস্ত্র :

আরেকটি ঘটনায় জানা গেছে, এ্যাকশন শুরু হওয়ার পর, দাঙ্গাকারী মুসলমানদেরকে, পুলিশের মুসলমান সদস্যরা তাদের অস্ত্র দিয়ে দিয়েছিলো; পরে গোপাল পাঁঠার নেতৃত্বে হিন্দু ও শিখরা ঘুরে দাঁড়ালে পুলিশের হিন্দু সদস্যরাও তাদের অস্ত্র গোপালের বাহিনীকে দিয়ে সাহায্য করে; যার কারণেই মুসলমানরা আক্রমন বন্ধ করতে বাধ্য হয়।

ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর সময় ঢাকায় হিন্দু গনহত্যা:

এ সম্পর্কে শুধু একজনের মাধ্যমেই কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তাঁর, "দ্বিখণ্ডিতা মাতা, ধর্ষিতা ভগিনী" নামক ছোট্ট পুস্তিকায় তুলে ধরেছেন। এখানে উল্লেখ করছি তার মুখেই, "১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট আমি ঢাকা শহরের বাসিন্দা ছিলাম। ঐ সময় অসংখ্য হিন্দুদেরকে হত্যা ক'রে, সমস্ত মৃতদেহগুলি উলঙ্গ করে (যাতে বিভৎসতা দেখে হিন্দুরা ভয় পায়) ট্রাক বোঝাই ক'রে হিন্দুপাড়া ওয়ারিতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, দাহ করানোর জন্য। ঐ মৃতদেহগুলির মধ্যে উলঙ্গ মহিলাদের দেহ এবং এবং শিশুদের মস্তকবিহীন দেহও ছিলো। উলঙ্গ মহিলাদের স্তন এবং তলপেটের মাংস নরপশুরা কামড়ে তুলে নিয়েছিলো। একদিন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঐ প্রকার এক মহিলার মৃতদেহ দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। শিশুদের মাথাগুলি লাইটপোস্ট বা অন্য কিছুর সাথে বাড়ি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ট্রাকের পাটাতনের নিচে ত্রিপল পেতে দেওয়া হতো, যাতে রাস্তায় রক্ত না পড়ে। ট্রাক থেকে মৃতদেহগুলো হাত, পা ধরে নামানোর সময় আমাদের পায়ের পাতা রক্তে ডুবে যেতো। অবস্থা একটু শান্ত হলে যখন স্কুল কলেজ খুললো, তখন আমাদের সহপাঠী মুসলিম লীগের কট্টর সমর্থক ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, হিন্দুদের মৃতদেহগুলি শ্যামপুর ঘাটে না পাঠিয়ে উয়ারির হিন্দু পাড়ায় পাঠানো হলো কেনো ? তারা বললো, লীগ নেতারা তোদের ভয় দেখানোর জন্য ওখানে পাঠিয়েছে; কারণ, পাকিস্তানের দাবী না মানলে তোদেরও ঐ একই অবস্থা হবে।"

ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর সময় "হরেন ঘোষ" এর  কারণে রক্ষা পায় কোলকাতার বড় বড় স্থাপনা :

১৯৪৬ সালে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী সূরাবর্দীর মেয়েকে গান শেখাতেন হরেন ঘোষ নামের এক বৃদ্ধ। ১৬ আগস্টের হিন্দু হত্যার ছক সূরাবর্দীর বাড়িতেই তৈরি হয়। পরে দেখা যায়, এই পরিকল্পনার কিছু কিছু বিষয় আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো। সূরাবর্দীর সন্দেহ হয় হরেন ঘোষকে, কিন্তু প্ল্যান মোটামুটি সাকসেস হওয়ায়; সূরাবর্দীর, সন্দেহের বিষয়টি চেপে যায়। এরপর, হিন্দু হত্যা ছাড়াও সূরাবর্দীর আরও একটা প্ল্যান ছিলো- টালার জলের ট্যাংক, হাওড়া ব্রিজ, হাওড়া রেল স্টেশন এবং শিয়ালদহ স্টেশনসহ কোলকাতার বড় বড় স্থাপনাগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। ঘটনাক্রমে এই প্ল্যান একদিন হাতে পড়ে যায় হরেন ঘোষের। তার পর ই, তিনি দ্রুত অন্তর্ঘাতের এই পরিকল্পনাটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন, ফলে বিরাট এক ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পায় কোলকাতা। পরিকল্পনা ফাঁসের জন্য, স্বাভাবিক ভাবেই সূরাবর্দীর সন্দেহ আবারও গিয়ে পড়ে হরেন ঘোষের উপর। সূরাবর্দীর গুন্ডারা গিয়ে ধরে আনে হরেন ঘোষকে এবং তারপর, তার হাত পা এক এক করে টুকরো টুকরো কাটে এবং একটি বাক্সে ভরে রাস্তায় ফেলে দেয়।

ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর সময় গান্ধী-নেহেরুর ভূমিকা :

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট থেকে কোলকাতায় মুসলমানরা যখন পাইকারি দরে হিন্দুদেরকে হত্যা ও ধর্ষন করতে থাকে এবং হিন্দুদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুঠপাট করতে থাকে, তখন ভারতবর্ষের জাতীয় বাবা, গান্ধী বাবা, মৌনী বাবা হয়ে চুপ করে বসেছিলো, মুসলমানদের গণহিংসার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলে নি এই অহিংসাবাদী। অন্যদিকে পরকীয়ায় পণ্ডিত নেহেরু, লেডি মাউন্টব্যাটেনের সাথে পরকীয়ার ফাঁকে ফাঁকে ভাইসরয়ের সাথে তার অন্তবর্তী সরকারের রূপরেখা কেমন হবে, সেই আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। গান্ধী-নেহেরুর ভুল নীতির কারণে যখন হাজার হাজার হিন্দুর জীবনে দুর্দশা নেমে এসেছিলো, তখন এই দুই লম্পট ছিলো এ ব্যাপারে একেবারে উদাসীন; যেন হিন্দু হত্যা-ধর্ষণ, তাদের সম্পত্তি লুঠ ছিলো একেবারে সাধারণ ব্যাপার। নোয়াখালির হিন্দু নিধন যজ্ঞেও এই দুই কুলাঙ্গারের ভূমিকা ছিলো এই একই রকম। কিন্তু কোলকাতা ও নোয়াখালির প্রতিক্রিয়ায় বিহারে যখন মুসলিম নিধন শুরু হয়েছিলো, তখন এই হারামজাদারা ঠিকই বিহারে ছুটে গিয়েছিলো এবং প্রায় ২০০ হিন্দুকে পুলিশ- সেনাবাহিনী দিয়ে মেরে বিহারের দাঙ্গা অতিদ্রুত থামিয়েছিলো। শুধু মুসলমান মরলেই এই বাস্টার্ডদের প্রাণ কাঁদতো, হিন্দু মরলে না।

গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ও আমাদের সাহিত্যিকগণ :

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, কাকের চেয়ে কবি অর্থাৎ সাহিত্যিকের সংখ্যা বেশি। এই সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই আবার কোকিল অর্থাৎ পাবলিক তাদের খায় ভালো। কাক বা কোকিল যে ই হোক, প্রেমের কাল্পনিক গল্পের নামে আবর্জনা লিখে টার্গেট যাদের বাজার ধরা, তারা ১৯৩৯ থেকে ১৯৭১, এই সময়ের মধ্যে মুসলমানদের দ্বারা বাংলায় যে হিন্দু নির্যাতন হয়েছে, সে সম্পর্কে কেউ কিছু লিখে নি। যদিও এই কাক কোকিলেরা নামে হিন্দু এবং তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা সেই পূর্ববাংলা থেকেই মুসলমানদের তাড়া খেয়ে পশ্চিমবাংলায় হিজরত করেছিলো। এই হিন্দু নিধন, ধর্ষণ এবং বিতাড়ন সম্পর্কে আমরা যাদের লেখা পেয়েছি, তারা কেউই প্রচলিত অর্থে সাহিত্যিক নন, বাজারে তাদের নাম-ডাক নেই, তাই কোনো প্রকাশক তাদের বই ছাপে না। তারা হিন্দু সমাজ, ধর্ম ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার স্বার্থে নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে বই ছাপে। এই মহান ব্যক্তিদের প্রতি জানাচ্ছি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। 

এর বিপরীতে এক বিখ্যাত কোকিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত আবর্জনার বর্ণনা দিই। ইনি ১৮৪০ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যের ঘটনা নিয়ে "সেই সময়""প্রথম আলো" নামে দুটি এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়কে ধারণ করে "পূর্ব পশ্চিম" নামে আরেকটি ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস লিখছেন। এই পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে, টাঙ্গাইলে মুসলমানদের দ্বারা জোরপূর্বক কিছু হিন্দুর মুসলমান হওয়া ছাড়া অন্য কোনো হিন্দু নির্যাতনের বর্ণনা নেই। অথচ এই পুরোটা সময় ছিলো পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের জন্য এক বিভীষিকাময় সময়। তিনি হয়তো ঐসব মুসলিম নির্যাতনের কাহিনী লিখে মুসলিম পাঠক হারাতে চান নি, যদিও এই উপন্যাসে তিনি দুই দুইটা হিন্দু মেয়েকে মুসলমান ছেলের সাথে প্রেমের বিয়ে দিয়ে মুসলমান পাঠককে খুশি করেছেন ঠিকই, আর সবক্ষেত্রে হিন্দুদের দিয়েছেন আচাঁছা বাঁশ। 

তসলিমা নাসরিন যে বলেছে, সব লেখকই ধান্ধাবাজ, সুনীলের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি করে সত্য। তসলিমা তার দ্বিখণ্ডিতা বা উপন্যাসে নিজের সব ঘটনা উজার করে লিখেছে, সেখানে প্রেম, যৌনতার মতো গোপন ঘটনাগুলোকেও তিনি গোপন করেন নি। এ সম্পর্কে তসলিমার বক্তব্য ছিলো, "আমি তো আমার জীবনী লিখছি, সেখানে কাউকে খুশি রাখার জন্য সেন্সর করবো কেনো ? আমি তো আর সুনীল নয়, যে কাট ছাট করে অর্ধেক জীবন লিখবো।" এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, সুনীলের জীবনী ভিত্তিক একটি উপন্যাস রয়েছে, যার নাম "অর্ধেক জীবন", তসলিমা সেই উপন্যাস নিয়েই উপরের এই মন্তব্য করেছে। অর্ধেক জীবনে সুনীল খুব কমই নিজেকে প্রকাশ করেছে। এটা পড়লে মনে হবে, সেক্স এর মতো কোনো ঘটনা তার জীবনে ঘটে নি। 

এমনই ধান্ধাবাজ লেখক সুনীল এবং সুনীলের মতো অন্যান্য বাজারী লেখকরা। এদের কাছ থেকে হিন্দু সমাজ ও ধর্ম আর কী আশা করতে পারে। অথচ, তসলিমার মতো মুসলমান পরিবারে জন্ম নেওয়া একটা মেয়ে, ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ঘটনায় বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে "লজ্জা" উপন্যাস লিখে আজ দেশ ছাড়া। তার না আছে সংসারের সুখ, না আছে জীবনের নিরাপত্তা। মৌলবাদীদের তলোয়ার যার ঘাড়ের উপর ঝুলছে সব সময়। এইসব বিবেচনা করলে সুনীলের মতো লেখকদের মুখের উপর যেমন বমি করে দিতে ইচ্ছা হয়, তেমনি তসলিমার মতো মানুষদেরকে পূজা করতে ইচ্ছা হয়। অথচ সুনীলের লেখার ক্ষমতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা তসলিমার চেয়ে অনেক বেশি। ও যদি হিন্দু সমাজ নিয়ে কিছু ভাবতো আর কিছু কাজ করতো, তাহলে হিন্দুদের আজকের যে দুর্দশা, তার অনেকটাই লাঘব হতো।

গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এবং আমাদের পূর্ব প্রজন্ম :

মুসলমানদের দ্বারা এই হিন্দু নিধনের প্রত্যক্ষ ফল আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে ভোগ করতে হয় নি, ভোগ করতে হয়েছে আমাদের পূর্ব প্রজন্মকে। তারা চোখের সামনে দেখেছে, কিভাবে মুসলমানরা তাদের মা বাবা, ভাই বোন আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করেছে, বাড়ির মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, মৃতদের লাশগুলো রাস্তায় পড়ে থেকে কিভাবে পচেছে আর কাক শকুন কুকুরেরা কিভাবে সেগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। কিন্তু এই নৃশংসতার ইতিহাস তারা শুধু নিজেরাই ভুলে যেতে চায় নি, পরবর্তী প্রজন্মকেও তারা তা জানতে দিতে চায় নি। তাদের মনোভাব, "কী হবে ঐ পুরোনো ঘাকে খুঁচিয়ে, তার চেয়ে ভুলে যাওয়াই ভালো।" তাই তারা তাদের কোনো বক্তৃতা, বিবৃতি ও লেখায় এই নৃশংসতাকে স্মরণ করে নি, যাতে নতুন প্রজন্ম মুসলমানদের ঐ নৃশংসতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং ভবিষ্যতে সাবধান হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলো সাংঘাতিক রকমের ভীতু, অপদার্থ ও নপুংসক। তারা মনে করেছিলো, আমরা তো পারি নি, তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এর বদলা নিতে পারবে না। তাই এগুলো নিজেরা ভুলে যাওয়া এবং অন্যদের ভুলিয়ে দেওয়াই ভালো। এই নির্বোধদের প্রতি কিভাবে শ্রদ্ধা রাখা সম্ভব ?

প্রতিশোধ নেওয়াটা বড় ব্যাপার না হলেও, ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেই সাথে মুসলমানদের মন-মানসিকতা সম্পর্কে সচেতন হওয়াও তো দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরণের ঘটনার হাত থেকে হিন্দুরা রক্ষা পায়। আবারও যদি এই ধরণের ঘটনা ঘটানোর সুযোগ মুসলমানরা পায়, তাহলে তো তাদেরই ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীরা তার শিকার হবে, এই বুদ্ধিটুকুও তাদের মাথায় ছিলো না ? যারা নিজেদের মা বোনের ধর্ষণ ও পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে না এবং এজন্য পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহিত করা বা কমপক্ষে জানানোরও বোধ করে না, তারা কি মানুষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য ? তারা তো নপুংসকের চেয়েও অধম। এদের উদ্দেশ্যেই বোধ হয়, কবি গুরু বলেছিলেন, "ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।" 

একটা কথা প্রচলিত আছে যে, হিন্দুরা পড়তে জানে কিন্তু লড়তে জানে না। তো যে পড়া দিয়ে হিন্দুদের আত্মরক্ষার চেতনার কোনো বিকাশ হয় না, সেই পড়া প'ড়েই বা কী লাভ ? মহাভারতের ঘটনা প্রায় সবাই জানে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে গুরু দ্রোণকে বঞ্চিত করার শোধ, দ্রোণ নিজে না নিলেও, দ্রোণই তৈরি করেছিলো পঞ্চপাণ্ডবকে। তারাই গুরু দক্ষিণা হিসেবে দ্রোণের হয়ে যুদ্ধ করে রাজা ধ্রুপদকে পরাজিত ও বন্দী করে ধ্রুপদের অহংকারী মাথাকে দ্রোণের সামনে নিচু করে দিয়েছিলো। আর এই ভাবেই গুরু দ্রোণ তার প্রতিশোধ নিয়েছিলো। রামকৃষ্ণ দেবও হিন্দু সমাজের জন্য নিজে কিছু করতে না পারলেও তৈরি করে গিয়েছিলো স্বামী বিবেকানন্দ সহ বেশ কয়েকজন শিষ্যকে, যারা হিন্দু সমাজকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছে। এসব কাহিনী কি আমাদের দুর্বুদ্ধিজীবী হিন্দুরা জানে না ? এরা সবই জানে সবই বোঝে, কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বা আত্মরক্ষার করার জন্য যে ক্ষমতার প্রয়োজন; নিরামিষ ভোজন- তাদের সেই ক্ষমতাকে শুষে নিয়েছে, তারা এসব ভাববে কিভাবে ? এদের উদ্দেশ্যেই শ্রদ্ধেয় শিবপ্রসাদ রায় তার দিব্যজ্ঞান নয়, কাণ্ডজ্ঞান চাই পুস্তিকায় বলেছেন, "ভিখারীর বৈরাগ্য, নপুংসকের ব্রহ্মচর্য আর শক্তিহীনের ভক্তি এরকমই হয়"| অর্থাৎ এদের না আছে আত্মরক্ষার ক্ষমতা, না আছে প্রতিশোধ নেবার শক্তি। যাদের নিজেকে রক্ষা করার কোনো ক্ষমতা নেই, তারা সমাজ-সংসার নিয়ে ভাববে কিভাবে ?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, গীতায় জ্ঞানযোগ কর্মযোগের কথা বলেছেন। কিন্ত তিনি প্রথমে কর্মযোগ ও পরে জ্ঞানযোগের কথা বলেছেন। এর তাৎপর্য এই যে, কর্ম করলেই জ্ঞানলাভ হবে। যেমন- এই লেখাটি পড়তে প্রথমে আপনাকে কর্ম করতে হচ্ছে এবং তারপরই এ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারছেন অর্থাৎ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারছেন। ঠিক একইভাবে, "গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং" নিয়ে প্রথমে আমি গবেষণা করে কর্ম করেছি, তারপর এই বিষয়ে আমার জ্ঞান লাভ হয়েছে। তারও আগে, আমি যে বইগুলো ঘেঁটে গবেষণা করেছি, সেই বইগুলো, যে প্রত্যক্ষদর্শীরা লিখেছে, তারা কর্ম করেছে; কিন্তু এই কর্মটা ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিলো না ব'লে, ঘটনার এতদিন পরেও এই নৃশংসতা সম্পর্কে, হিন্দুরা খুব কমই জানে বা জানতে পেরেছে বা কেউ জানতেই পারে নি। আগে জানা না থাকলেও আজ আপনি সেটা জানলেন এবং তা মোটামুটি বিস্তারিত। 

গীতায় জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের কথা বলা হয়েছে পাশাপাশি অধ্যায়ে। এর তাৎপর্য হলো, কর্ম করলে যেমন জ্ঞান লাভ হবে, তেমনি জ্ঞানলাভ অর্থাৎ জানার পরেও আপনাকে কিছু কর্ম করতে হবে। আমি কর্ম করে আপনাকে, আপনার স্ব-জাতীয় পূর্বপুরুষদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার কথা জানালাম; এরপর আপনার কর্তব্য, কিছু কর্ম করা। সেই কর্ম কী হবে, সেটা ঠিক করবেন আপনি এবং নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন- আপনার পরিবার, হিন্দু সমাজ, হিন্দু জাতি ও হিন্দু ধর্মের - ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করবার জন্য আপনার কী কী করা বা কোন কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ?

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment