Friday 28 August 2020

রাধার পোস্টমর্টেম :



রাধার পোস্টমর্টেম :

ফটোপোস্টে রাধা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, এখানে শুধু সে সম্পর্কেই কথা বলবো।

দেখুন, শুরুতেই বলা হয়েছে, "শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছে অপ্রাকৃত পুরুষ এবং রাধারানী হচ্ছে অপ্রাকৃত প্রকৃতি।"

এই কথাটা পুরোটাই ভুল।

প্রকৃতি শব্দটা এসেছে প্রকৃত থেকে, যার একটি অর্থ বাস্তব; প্রকৃতি শব্দের বিবর্তিত রূপ হলো প্রাকৃত এবং প্রকৃত বা প্রাকৃত এর বিপরীত শব্দ হলো অপ্রকৃত বা অপ্রাকৃত, এর মানে হলো অবাস্তব। শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন, তাই তিনি বাস্তব বা প্রকৃত, তিনি কোনোভাবেই অপ্রাকৃত নন। একইভাবে রাধাও পৃথিবীতে এসেছিলো, তাই সেও প্রকৃত, রাধা অপ্রাকৃত নয়।

ইংরেজিতে ন্যাচার বলতে যা বুঝি, বাংলায় প্রকৃতি বলতে আসলে তাই বোঝায়। এই প্রকৃতি অর্থাৎ পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ পৃথিবীর উপরস্থ সকল প্রাণীর জন্ম দিয়ে থাকে, জন্ম দেওয়া যেহেতু নারীর স্বভাব, তাই নারী বলতে প্রকৃতি বা প্রকৃতি বলতে নারীকে বোঝানো হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ গীতার ১৪/৩,৪ নং শ্লোকে বলেছেন-

"মম যোনির্মহদ ব্রহ্ম তস্মিন গর্ভং দধাম্যহম্।

সম্ভবঃ সর্বভূতানাং ততো ভবতি ভারত।।"

এর অর্থ - হে ভারত, প্রকৃতি সংজ্ঞক ব্রহ্ম আমার যোনি স্বরূপ এবং সেই ব্রহ্মে আমি গর্ভাধান করি, যার ফলে সমস্ত জীবের জন্ম হয়।

এবং

"সর্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ।

তাসাং ব্রহ্ম মহদযোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা।।"

এর অর্থ - হে কৌন্তেয়, সকল যোনিতে যে সমস্ত মূর্তি প্রকাশিত হয়, ব্রহ্মরূপী যোনিই তাদের জননী স্বরূপা এবং আমি তাদের বীজ প্রদানকারী পিতা।

এর সরল অর্থ হলো- প্রকৃতি স্বরূপ যোনীতে শ্রীকৃষ্ণ বীজ প্রদান করেন, তাই শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ এবং জগতের পিতা; ফলে শ্রীকৃষ্ণ অপ্রাকৃত পুরুষ নয়, প্রকৃত পুরুষ; এবং রাধা, শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রকৃতি নয়, প্রকৃতি হলো এই জগত।

এরপর বলা হয়েছে, 

"শ্রীমতি রাধারানীর অন্তরের ভাব হচ্ছে মাধুর্য প্রেমের পূর্ণতা এবং এই মাধুর্য প্রেম হচ্ছে পাঁচটি অপ্রাকৃত (শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মাধুর্য) রসের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং কৃষ্ণপ্রেমের সর্বোত্তম প্রকাশ।"

এখানে- শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মাধুর্যকে পাঁচটি অপ্রাকৃত রস বলা হয়েছে। কিন্তু এগুলো আসলে অপ্রাকৃত নয়, প্রকৃত রস।

পিতা মাতার সাথে সন্তানের যে ভাব বা সম্পর্ক, তাকে বলে শান্ত।

ভৃত্য বা চাকরের প্রতি মালিকের যে ভাব বা সম্পর্ক তাকে বলে দাস্য।

বন্ধুর সাথে কোনো ব্যক্তির যে ভাব বা সম্পর্ক তাকে বলে সখ্য।

সন্তানের প্রতি পিতা মাতার যে ভালোবাসা তাকে বলে বাৎসল্য।

আর স্ত্রী বা প্রেমিকার সাথে কোনো পুরুষের যে সম্পর্ক তাকে বলে মাধুর্য্য, মধুর থেকে মাধুর্য্য শব্দটি এসেছে।

এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখি- প্রেম এবং ভালোবাসা একই অর্থ প্রকাশ করে না। কোনো পুরুষের সাথে তার স্ত্রী বা প্রেমিকার যে সম্পর্ক তাকেই বলে প্রেম; আর বাকি সমস্ত মানুষের সাথে তার যে সম্পর্ক তাকে বলে ভালোবাসা, এই ভালোবাসারই বিভিন্ন রূপ হলো- শান্ত, দাস্য, সখ্য এবং বাৎসল্য রস।

এই সব তত্ত্ব থেকে এটা পরিষ্কার যে- কোনো পুরুষের সাথে মধুর বা মাধুর্য্য রসের সম্পর্ক হতে পারে একমাত্র তার প্রেমিকা বা স্ত্রীর, যার সাথে তার যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। ফটোপোস্টে যে বলা হয়েছে- "শ্রীমতি রাধারানীর অন্তরের ভাব হচ্ছে মাধুর্য প্রেমের পূর্ণতা … এবং কৃষ্ণপ্রেমের সর্বোত্তম প্রকাশ।" এটা বলে আসলে এটা বোঝানো হচ্ছে যে রাধার সাথে কৃষ্ণের যৌন সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধার যৌনসম্পর্ক থাকবে কেনো, রাধা কি শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী ? মোটেই নয়। পুরাণ মতে রাধা আয়ান ঘোষের স্ত্রী, তাহলে অন্যের স্ত্রীর সাথে কোনো পুরুষের যে প্রেম তাকে কী বলে ? পরকীয়া প্রেম। এর মানে-"শ্রীমতি রাধারানীর অন্তরের ভাব হচ্ছে মাধুর্য প্রেমের পূর্ণতা … এবং কৃষ্ণপ্রেমের সর্বোত্তম প্রকাশ।" এটা বলে আসলে এটাই বোঝানো হচ্চে যে- রাধা একজন চরিত্রহীনা নারী; যে নিজের স্বামী ছাড়াও অপর পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখে।

এরপর ফটোপোস্টে বলা হয়েছে, "প্রকৃতপক্ষে রাধারাণী হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি"

-এটা একটা ডাহা মিথ্যা প্রচার; রাধা, শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি নয়, শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি হলেন যোগমায়া, যে কথা শ্রীকৃষ্ণ নিজে বলেছেন গীতার ৭/২৫ নং শ্লোকে, দেখুন নিচে-

"নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ।

মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম।।"

এর অর্থ - আমি মূঢ় ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের কাছে কখনও প্রকাশিত হই না। তাদের কাছে আমি আমার অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকি। তাই তারা আমার অজ ও অব্যয় স্বরূপকে জানতে পারে না।

শ্রীকৃষ্ণ এখানে স্পষ্ট করে বললেন যে, তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির নাম যোগমায়া; অথচ কিছু মূর্খ, যারা কোনো দিন গীতা ভালো করে পড়ে না, পড়লেও বুঝে না, তারা শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তিকে রাধা বলে প্রচার করে হিন্দু ধর্মের সর্বনাশ করে যাচ্ছে।

ফটোপোস্টের শেষের দিকে বলা হয়েছে- রাধা নিত্যকাল ধরে শ্রীকৃ্ষ্ণের আনন্দ বর্ধন করেন।

এই কথাতে এটিই প্রমাণ হচ্ছে যে- পুরুষের আনন্দ বর্ধনের জন্য একজন করে পরকীয়া প্রেমিকা থাকা দরকার, কিন্তু সমাজ সংসার কি এটা মেনে নেবে ? নেবে না। তাহলে সমাজ সংসার যা মানবে না, এমন অবাস্তব বিষয় কি সনাতন ধর্মে থাকতে পারে ? পারে না। কারণ, বাস্তবতা ই হলো সনাতন ধর্ম।

ফটো পোস্টের একেবারে শেষে বলা হয়েছে- শ্রীকৃষ্ণকে পরম আনন্দে মগ্ন রেখেছেন বলে তাঁর নাম রাধা।

এরা একবার বলে- রাসমণ্ডলে আবির্ভূত হয়ে কৃষ্ণের দিকে ধাবিত হয়েছিলেন বলে তার নাম রাধা; এখানে আবার বলছে, শ্রীকৃষ্ণকে আনন্দে মগ্ন রেখেছেন বলে তার নাম রাধা ! আসলে প্রকৃত সত্যিটা কী ? দুই রকম তথ্য তো সত্য হতে পারে না। সত্য এক। রাধা সম্পর্কে নানারকম মত এটাই প্রমাণ করে যে, যুবক কৃষ্ণের সাথে যুবতী রাধা সম্পর্কিত যেসব কথাবার্তা তা সবই গালগল্প, বাস্তবে যার কোনো ভিত্তি নেই। রাধা সম্পর্কে প্রকৃত সত্য হলো এটাই যে- বৃন্দাবনে, কৃষ্ণের বাল্যকালে, কৃষ্ণের খেলার সাথীদের মধ্যে রাধা বলে একজন ছিলো; কৃষ্ণ, ১০ বছর দুই মাস বয়সে কংসকে হত্যার জন্য বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে গেলে যার সাথে কৃষ্ণের দেখা সাক্ষাত শেষ হয়ে যায়।

আশা করছি- রাধার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রকে খারাপ দেখানোর এই অপচেষ্টার জবাব, আমার পাঠক বন্ধুদের মুখে তুলে দিতে পেরেছি।

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment