সেবাই কি পরম ধর্ম ?
বৈষ্ণব গুরুরা, তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রচার করে যে- কলির ধর্ম সেবা বা সেবাই পরমধর্ম এবং এই সেবা বলতে তারা কোনো সামগ্রিক মানবসেবাকে বোঝায় না, বোঝায় কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তির পেটপূজাকে। এটা তারা এজন্য প্রচার করে যে, এটা প্রচার না করলে বা শিষ্যরা এটা বিশ্বাস না করলে, শিষ্যরা বা সাধারণ হিন্দুরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে এই সেবা উপলক্ষ্যে ঐসব গুরুদের পেট পূজা করবে কেনো ? কিন্তু বাস্তবে এটি একটি মিথ্যা প্রচার, ভাগবত বা গীতায় পাইকারী হারে জনসেবার কোনো কথা বলা নেই, ভাগবত বা গীতায় দানের কথাই বলা আছে। যেমন- গীতার ৯/২৭ নং শ্লোকে বলা আছে-
"হে কৌন্তেয়, তুমি যাহা কিছু কর, যাহা কিছু ভোজন কর, যাহা কিছু হোম কর, যাহা কিছু দান কর, যাহা কিছু তপস্যা কর, তত সমস্তই আমাকে অর্পন করিও।"
এখানে দানের বিষয় উল্লেখ আছে, কিন্তু সেবার বিষয় নেই।
এছাড়াও গীতার ১১/৪৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-
"ন বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈর্ণ দানৈর্ন চ ক্রিয়াভির্ণ তপোভিরুগ্রৈঃ
এবং রূপঃ শক্য অহং নৃলোকে দ্রষ্টুং ত্বদন্যেন কুরুপ্রবীর।।"
এর অর্থ - হে কুরুশ্রেষ্ঠ, বেদ অধ্যয়ন, যজ্ঞ, দান, পূণ্যকর্ম ও কঠোর তপস্যার দ্বারা এ জড় জগতে তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমার এই বিশ্বরূপ দর্শন করতে সমর্থ নয়।
এখানেও দানের বিষয় উল্লেখ আছে, কিন্তু সেবার বিষয় নয়।
তাছাড়াও দানের বিষয়ে গীতায় বলা হয়েছে-
"দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম।।" -(গীতা, ১৭/২০)
এর অর্থ - দান করা কর্তব্য বলে মনে করে, প্রত্যুপকারের আশা না করে, উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে এবং উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলে।
আবার ভাগবতের ১ম স্কন্ধের পঞ্চম অধ্যায়ের এক স্থানে বলা হয়েছে
"পুরুষের তপস্যাই বলো, বেদ অধ্যয়নই বলো, যাগযজ্ঞ বা মন্ত্রপাঠই বলো, আর জ্ঞান বা দানই বলো, শ্রীভগবানের গুনবর্ণনাকেই এই সমস্ত কার্যের নিত্যসিদ্ধ অক্ষয় ফল বলে সুধীগণ সিদ্ধান্ত করেছেন।"
এখানেও দানের কথাই উল্লিখিত হয়েছে, সেবার নয়।
তবে গীতায় সেবার কথা যে বলা নেই, তা কিন্তু নয়, কিন্তু সেটা বৈষ্ণব গুরুদের দ্বারা প্রচারিত পাইকারী হারে জনসেবা নয়, তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য, তত্ত্বজ্ঞান লাভের উপায় হিসেবে গুরুসেবার কথা গীতায় বলা হয়েছে, এভাবে-
"গুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণাম দ্বারা, নানা বিষয় প্রশ্ন দ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর। জ্ঞানী তত্ত্বদর্শী গুরুগণ তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন।"- (গীতা, ৪/৩৪)
গীতা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, জ্ঞানলাভের জন্য শুধু তত্ত্বদর্শী গুরুর সেবা করতে হবে। তাই হরিবাসর বা হরিসভা করে পাইকারীভাবে জনসেবা, শুধু অর্থক্ষয় মাত্র; কারণ, এসব ক্ষেত্রে পেটপূজা গ্রহণ করার পর কারো মধ্যে সেই ফিলিংসই জাগ্রত হয় না যে কেউ তাকে সেবা দিলো, তাই সেটা করার কথা গীতায় বলা হয় নি, কিন্তু বৈষ্ণবরা সেবা বলতে মূলত এটাকেই বুঝিয়ে থাকে।
তবে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বাড়িতে লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো বা দরিদ্রদেরকে সেবা দেওয়া মোটেই খারাপ কিছু নয়, এতে বাড়ি বা গৃহস্থের কল্যান হয় । কিন্তু এই সেবা হতে হবে একান্ত ব্যক্তিগত খরচে, হরিববাসর বা হরিসভার মতো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, যেখানে ১০ জনের টাকা ই ১০ জন খায় এবং তারপরও অর্থ উদ্বৃত্ত্ থাকে। যা হোক, তারপরও নিজ গৃহে নিজ খরচে লোকজনকে সেবা দেওয়া মোটেই পরম ধর্ম নয়, এটা একটা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান মাত্র।
পরিশেষে বলা যায়, সেবাই পরমধর্ম, এটা বৈষ্ণব গুরুদের দ্বারা প্রচারিত একটা মহামিথ্যা, যা শিষ্যদের কষ্টার্জিত অর্থকে অপচয় করার বা লুট করে খাওয়ার একটি বৈষ্ণবী মন্ত্র মাত্র।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment