নমস্কার- ব্যক্তিকে নয়, ঈশ্বরকে:
২০১৬ সালে আমি একটি প্রবন্ধে বলেছিলাম- নমস্কার নয়, বলুন জয় শ্রীরাম বা জয় শ্রীকৃষ্ণ। সেই প্রবন্ধে আমি এই মত প্রকাশ করেছিলাম যে, কাউকে নমস্কার বললে কাজের কাজ আসলে কিছুই হয় না, কিন্তু এর কিছু ক্ষতিকর দিক আছে, যা জাতি হিসেবে আমাদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, তাই এই সম্বোধনের পরিবর্তে আমরা যদি একে অপরকে জয় শ্রীরাম বা জয় শ্রীকৃষ্ণ বলি এবং জবাবে দ্বিতীয় ব্যক্তিও যদি জয় শ্রীরাম বা জয় শ্রীকৃষ্ণ বলে, তাহলে আমরা যেমন দিনে অন্তত কয়েকবার ভগবানের নাম অভ্যাসবশতই নিতে পারবো, তেমনি এই দুই জনের জয় হলে আমরা সনাতনীরা সকল প্রকার সমস্যা থেকে মুক্ত হবে।
সম্প্রতি সেই প্রবন্ধের বিরুদ্ধে এবং হিন্দু সমাজে প্রচলিত আরো কিছু সম্বোধনকে বাতিল করে দিয়ে আর্য সমাজীরা সকল ক্ষেত্রে সম্বোধন হিসেবে নমস্কারকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টার উদ্দেশ্যে নেটে এ সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ এবং ইউটিউবে একটি ভিডিও ছেড়েছে। সেই প্রবন্ধ এবং ভিডিওতে মূলত একই তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে এবং একই রকম কথা বলা হয়েছে, তাদের সেই ভুল ব্যাখ্যায় কেউ যেন বিভ্রান্ত না হয়, সেই উদ্দেশ্যেই আমার এই প্রবন্ধটি লেখা, তাদের দেওয়া রেফারেন্স দিয়ে এখানে আমি প্রমাণ করে দেবো যে- নমস্কার শুধু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই করা যাবে, কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্যে নয়।
যা হোক, নমস্কার যে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে তা প্রমাণ করার জন্য, আর্য সমাজীরা বেদের মন্ত্রের অর্থকে বিকৃত করে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের ইচ্ছেমতো বেদের মন্ত্রের অর্থ করেছে, আর্য সমাজীদের পোস্টের স্ন্যাপশট আমার এই প্রবন্ধের সাথে যুক্ত করে দিয়েছি, সেখানে দেখুন, যজুর্বেদের ১৬/৩২ নং মন্ত্রের অর্থ হিসেবে তারা লিখেছে- নমস্তে জ্যেষ্ঠদেরকে, নমস্তে কণিষ্ঠদেরকে, নমস্তে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ধনী গরীব, জ্ঞানী স্বল্পজ্ঞানী সকলকে।
কিন্তু এই মন্ত্রটির প্রকৃত অর্থ- জ্যেষ্ঠ ও কণিষ্ঠরূপী রুদ্রকে নমস্কার, পূ্র্ব ও পশ্চাৎ জাত-রূপী রুদ্রকে নমস্কার, তির্যক আদি রূপে ও অবুৎপন্ন ইন্দ্রিয়ে জাত রূপী রুদ্রকে নমস্কার, গাভী প্রভৃতির পশ্চাদ্ভাগে ও বৃক্ষাদিমূলে জাতরূপী রুদ্রকে নমস্কার।
মন্ত্রের কোনো শব্দে রুদ্র শব্দটি না থাকলেও, এর অর্থে রুদ্র ব্যবহার করা হয়েছে এজন্য যে- আর্য সমাজীদের বেদ অনুবাদক ড. তুলসীরাম, তার অনুবাদেই বলেছেন, এই মন্ত্রটি- কুৎসা ঋষি, রুদ্র দেবতার উদ্দেশ্যে রচনা করেছেন। শুধু এই মন্ত্রটিই নয়, যজুর্বেদের ১৬ অধ্যায়ের সবগুলো মন্ত্রই রুদ্রদেবের উদ্দেশ্যে রচিত, তাহলে এই মন্ত্রের নমস্কার রুদ্রদেবের উদ্দেশ্যে হবে না কেনো ? আর জ্যেষ্ঠ কণিষ্ঠ ইত্যাদি রুদ্র এজন্যই বলা হয়েছে যে, আমার জানি গীতার ভাষ্যমতে রুদ্রগণ হলেন এগারোজন, আর সংখ্যায় একাধিক হলে বর্ণনার খাতিরে কাউকে ছোট বা কাউকে বড় বলে তো ধরে নিতেই হয়। এই মন্ত্রটি যে রুদ্রদেবের উদ্দেশ্যে রচিত, সেটা বিশ্বাস না হলে আপনারা যেকোনো বাংলা বেদ খুল দেখে নিতে পারেন। অর্থাৎ এখানে যে মন্ত্রে রুদ্রদেবকে নমস্কার করতে বলা হয়েছে, সেখানে আর্য সমাজীরা বলছে- এই নমস্কার নাকি- জ্যেষ্ঠ, কণিষ্ঠ, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ধনী, গরীব, জ্ঞানী এবং স্বল্পজ্ঞানী সকলকে করতে বলা হয়েছে ! আর্য সমাজীদের গুরু দয়ানন্দই তো বিভিন্ন শ্লোকের অর্থ পাল্টে দিয়ে তা নিজের মতে আনার অপচেষ্টা করেছে, তাহলে তার শিষ্যরা তা করবে না কেনো ?
এখানে আর একটা কথা না বললেই নয়, আর্য সমাজীরা তো বলে- বেদের সকল মন্ত্র সরাসরি ঈশ্বের বাণী, তাহলে এই মন্ত্র অনুযায়ী রুদ্রদেবকে কি ঈশ্বর নমস্কার করেছে ? ঈশ্বরের কি কাউকে নমস্কার করার প্রয়োজন রয়েছে ? এছাড়াও আর্য সমাজীদের মতে- ঐ মন্ত্রে যদি জ্যেষ্ঠ কণিষ্ঠ নির্বিশেষে সবাইকে নমস্কার করার কথা বলা হয়, আর বেদ যদি সরাসরি ঈশ্বরের বাণী হয়, তাহলে কি ঈশ্বরই মানুষকে নমস্কার করেছে ? ঈশ্বরের কি মানুষকে নমস্কার করার কোনো দরকার আছে ? প্রচলিত এবং আর্যসমাজীদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে যে আমি বলেছি- বেদ সরাসরি ঈশ্বরের বাণী নয়, এটা ঋষিদের উপলব্ধিজাত বাণী, ঋষিগণ বেদের মন্ত্রের মাধ্যমে দেব-দেবী ও ঈশ্বরের নিকট স্তবস্তুতি করেছেন, এখন এই বিষয়টি শুধু এই মন্ত্রের মাধ্যমেই নয়, বেদের সকল মন্ত্রের মাধ্যমে মিলিয়ে দেখুন।
যা হোক, এরপর আর্য সমাজীরা চুতর্বেদ শতকম থেকে যে রেফারেন্স দিয়েছে, ফটোপোস্টে খেয়াল করে দেখুন, সেখানেও বলা হয়েছে- হে পরমেশ্বর, তোমাকে নমস্কার। তার মানে এখানে ঈশ্বরকেই নমস্কার করা হয়েছে।
এছাড়াও আর্য সমাজীদের মতেই, অথর্ববেদের ১০ম কাণ্ডের ৮ম সূক্তের ১ম মন্ত্রে যদি বলা হয়- যিনি ভূতকাল, ভবিষ্যৎকালের এবং নিখিল জগতের অধিষ্ঠাতা, সুখ যাঁহার স্বরূপ সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মকে নমস্তে।- তাহলে এখানে কি পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে নমস্কার করার কথা বলা হচ্ছে না ?
এরপর অথর্ববেদের ১০ম কাণ্ডের ৭ম সূক্তের ৩২ নং মন্ত্রে যদি বলা হয়- " ভূমি যাঁহার পদমূল সদৃশ, অন্তরিক্ষ যাঁহার উদর সদৃশ এবং দ্যুলোককে যিনি মস্তক সদৃশ সৃষ্টি করিয়াছেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মকে নমস্তে।"- তাহলে এখানে কার উদ্দেশ্যে নমস্কার করার কথা বলা হলো, মানুষকে, না ঈশ্বরকে ?
এরপর অথর্ববেদের ১০ম কাণ্ডের ৭ম সূক্তের ৩৩ নং মন্ত্রে যদি বলা হয়- "যিনি বার বার নব নব সূর্য ও চন্দ্রকে নেত্র সদৃশ এবং অগ্নিকে মুখ সদৃশ সৃষ্টি করিয়াছেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মকে নমস্তে।"- তাহলে কি এর দ্বারা ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে নমস্কার করা বোঝায় না ?
এছাড়াও অথর্ববেদের ১০ম কাণ্ডের ৭ম সূক্তের ৩৪ নং মন্ত্রে যদি বলা হয়- "বায়ু যাঁহার প্রাণ আপান সদৃশ, রশ্মিসমূহ যাঁহার দৃষ্টি স্বরূপ এবংসমূহ যাঁজার প্রজ্ঞাসদৃশ সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মকে নমস্তে।"- তাহলে এখানে যে ঈশ্বরকেই নমস্কার করা বোঝাচ্ছে, সেটা তো একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝবে।
এছাড়াও যজুর্বেদের ১৬/৪১ নং মন্ত্রে যদি বলা হয়- "কল্যান ও সুখের কারণকে নমস্তে। কল্যানদাতা ও সুখ দাতাকে নমস্তে। কল্যানময় ও সুখময়কে নমস্তে।"- তাহলে এখানেও কি ঈশ্বরকেই নমস্কার করার কথা বলা হচ্ছে না, যেহেতু ঈশ্বরই হলো- কল্যান ও সুখের কারণ, কল্যানদাতা ও সুখ দাতা এবং কল্যানময় ও সুখময় ?
এরপর আর্য সমাজীরা, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ২য় অধ্যায়ের ১৭ নং শ্লোকের রেফারেন্স দিয়েছে, সেখানেও বলা হয়েছে- যোগ যেমন পরমাত্মা দর্শনের সাধন বা উপায়, নমস্কারাদিও অনুরূপ বলিয়া তাঁহাকে নমস্কার জানাই।
- এখানে বলা হলো যোগ এবং নমস্কার একই রকম ব্যাপার এবং এই দুটো দিয়েই পরমাত্মা দর্শন করা যায়, তাই তাঁহাকে নমস্কার জানাই, তাহলে এই তাঁহাকে বা তিনিটা কে ? এই তিনিই পরমাত্মা বা ঈশ্বর, সুতরাং এখানেও নমস্কার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত।
এরপর আর্যসমাজীদের দেওয়া রেফারেন্স অনুযায়ী ই, গীতার ১১/৩৭ নং শ্লোকে অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণকে বলেছেন, "তুমি ব্রহ্মারও গুরু এবং আদি কর্তা, তাই তোমাকে সমস্ত জগত নমস্কার করিবে না কেনো ?" এখানেও শ্রীকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকেও নমস্কার করার কথাই বলা হয়েছে। এছাড়াও গীতার ১১/৩৯, ৪০ নং শ্লোকে, অর্জুন যে শ্রীকৃষ্ণকে বলেছেন, "তোমাকে সহস্রবার নমস্কার করি, আবার পুনঃ পুনঃ তোমাকে নমস্কার করি। তোমাকে সম্মুখে পশ্চাতে সর্বদিকে নমস্কার করি।" এর দ্বারা কি কোনো মানুষকে নমস্কার করার কথা বলা হয়েছে ? এখানেও তো ঈশ্বরকেই নমস্কার করার কথা বোঝাচ্ছে।
যা হোক, নমস্কার কাকে বা কার উদ্দেশ্যে সে সম্পর্কে এত এত রেফারেন্স জানার পরও আর্য সমাজীরা বলেছে- "তাহলে আমরা জানলাম নমস্কার শব্দটি 'কাওকে' সম্বোধন করার সময় ব্যবহৃত হয়।" এই 'কাওকে' বলতে তারা আবার বোঝে সর্বশ্রেণীর মানুষকে! একেই বুঝি বলে সাতকাণ্ড রামায়ণ পরার পর বুঝলাম সীতা হলো রামের মাসী। আর্য সমাজীদের জ্ঞান এই রকমই, হাঁটুর নিচে। এরা শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ে, কিন্তু সেগুলোর তেমন কিছুই বোঝে না। ঐ এক দয়ানন্দ যা বলে গেছে, এদের সকল চিন্তা-ভাবনা ঐদিকেই ধাবিত হয়, কিন্তু দয়ানন্দ যে মহর্ষি অর্থাৎ মহাজ্ঞানী নয়, সে নিজেই ভুল আর বিকৃতির মহাসাগর, সেটাকে তারা বিবেচনায় নেয় না। আসলে যার যেমন চিন্তার পরিধি, সে তো তেমনই চিন্তা করবে।
যা হোক, আর্য সমাজীরা অন্তত আমার একটি কথাকে স্বীকার করেছে যে- নমস্কার মানে নত হওয়া, সম্মান করা; তার মানে নমস্কার বলতে বোঝায় নত হয়ে সম্মান করা, আর এখানেই আমার আপত্তি, কাউকে সম্মান জানাবো ঠিকই, কিন্তু সেটা নত হয়ে নয়, মাথা উঁচু করেই সম্মান জানাবো। আর কাউকে সম্মান জানানোর পদ্ধতিই হলো- কারো সাথে দেখা হলেই মুখ ফুটে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা, এটা যেকোনো বাক্য বা যেকোনো শব্দ হলেও হয়। এই থিম থেকেই ইংরেজরা ব্যবহার করে 'হাই' বা 'হ্যালো'; মুসলমানরা ব্যবহার করে আসসালামু ওয়ালাইকুম; সনাতনীরা সাধারণভাবে ব্যবহার করে নমস্কার; সানতনীদের বিভিন্ন ভাগ আবার ব্যবহার করে যথাক্রমে- হরে কৃষ্ণ, জয়গুরু, জয় নিতাই, রাধে রাধে, শিব শিব, ভারতের হিন্দি বলয়ে ব্যবহার হয় জয় শ্রীরাম, কোথাও কোথাও জয় শ্রীকৃষ্ণ। এই সবগুলোই সম্বোধন, উদ্দেশ্য একই, তাহলো একে অপরের সাথে কানেক্টিভিটি তৈরি করা। আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, বিপরীত দিক থেকে কেউ যদি আসে, তাকে যদি আপনি কিছু বলেন, তাহলে তার সাথে আপনার একটি যোগাযোগ তৈরি হবে; আর যদি কিছু না বলেন, আপনার সাথে তার তো কোনো কানেকটিভিটি তৈরি হবে না, আপনার বয়সে বড় হলে সে আপনাকে বেয়াদব বা উদ্ধত মনে করবে। এজন্যই বড়দেরকে সম্মান জানিয়ে তাদের সাথে কানেক্টিভিটি তৈরি করার জন্যই কোনো না কোনো সম্ভাষণের প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই বিভিন্ন জন তাদের পছন্দমতো বিভিন্ন সম্ভাষণ ব্যবহার করে।
এখানেই আমার বক্তব্য হচ্ছে- আমি এমন কিছু বলে সম্বোধন করবো, যাতে আমার সেই কানেক্টিভিটি রক্ষা হয় এবং একই সাথে ভগবানের নামও করা হয়। তাহলে একদিক থেকে যেমন আমার সমাজ রক্ষা হচ্ছে, তেমনি ধর্মও রক্ষা হচ্ছে। নমস্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- কারো ভেতরে অবস্থিত ঈশ্বরকে সম্মান জানানো, আর ঈশ্বর যেহেতু সর্বশক্তিমান, সেহেতু তার কাছে নত হতেই হয়, আর অহম ত্যাগ করার জন্য হাতজোড় করতেই হয়, এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই আভিধানিক অর্থ কয়জন বুঝে নমস্কার দেয় ? যদি কেউ আভিধানিক অর্থ বুঝে কাউকে নমস্কার দেয়, তাহলে ঠিক আছে; কিন্তু সে যদি আভিধানিক অর্থ না বুঝে এমনি এমনি কাউকে নমস্কার দেয়, তাহলে যে নমস্কার দেবে এবং যে নেবে, উভয়েরই তো পাপ হবে। কারণ, শাস্ত্র বলছে- নমস্কার শুধু ঈশ্বরকেই করা যায়, এখন আভিধানিক অর্থ না বুঝে আমি যদি কাউকে নমস্কার দিই, তাহলে তাকে তো ঈশ্বর বানিয়ে ফেললাম; নিজের বাপকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বাবা বলে ডাকলে যেমন নিজের বাপ খুশি হবে না, তেমনি ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কাউকে ঈশ্বরের সম্মান দিলে ঈশ্বরও আপনার উপর খুশি হবে না, তাহলে সেটা- পাপ কি না বলেন ?
গীতায় বলা হয়েছে- সকল দেব-দেবীর পূজা ঈশ্বরের কাছেই যায়। এর মানে হলো, আপনি যে দেব-দেবীরই পূজা করেন না কেনো, শেষ পর্যন্ত সেটা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছাবে এবং সেই দেব-দেবীর মাধ্যমে ঈশ্বর তার ফল আপনাকে দেবে। কিন্তু এই ফল পাওয়ার জন্য আপনাকে এই মনোভাব নিয়ে পূজাটি করতে হবে যে- আমি, সরস্বতী বা লক্ষ্মী বা কার্তিক বা গণেশ বা কালী বা দুর্গার মাধ্যমে আসলে ঈশ্বরেরই পূজা করছি, তাহলে আপনার পূজা সার্থক এবং তার ফল আপনি নিশ্চিতভাবে পাবেন। কিন্তু এটা না জেনে কেউ যদি বিদ্যার সবর্ময় দেবী হিসেবে সরস্বতী বা ধনের সর্বময় দেবী হিসেবে লক্ষ্মীকে পূজা করে, তাহলে তার কি কোনো মূল্য আছে ? পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি বা ইচ্ছা ব্যতীত কোনো দেব-দেবীর কি ক্ষমতা আছে কারো জন্য কিছু করার ? নাই। দেব-দেবীর পূজার ফল পেতে হলে যেমন এটা জেনে পূজা করতে হবে যে এই দেব বা দেবীর মাধ্যমে আমি আসলে ঈশ্বরের পূজা করছি, তেমনি নমস্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ- আপনার হৃদয়ে অবস্থিত ঈশ্বরকে আমি সম্মান জানাচ্ছি আপনার মাধ্যমে- এটা জেনে বা বুঝে যদি কেউ কাউকে নমস্কার করে এবং যাকে নমস্কার করা হচ্ছে সেও যদি সেটা বোঝে, তাহলেই কেবল পাপমুক্ত হবে নমস্কার সম্বোধন; কারণ, তাতে দাতা ও গ্রহিতা উভয়েই বুঝতে পারবে যে- আসলে তাকে নয়, তার ভেতরের ঈশ্বরকে সম্মান দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু এটা যদি দাতা বুঝে, কিন্তু গ্রহিতা না বুঝে, তাহলে গ্রহিতা তো ঈশ্বরের স্থানে বসে যাবে, আর সাধারণ মানুষকে ঈশ্বরের স্থানে বসানোর পাপ হবে নমস্কার দাতার, আর না বুঝে নিজেকে ঈশ্বরের স্থানে মেনে নেওয়ায়, পাপ হবে নমস্কার গ্রহিতারও। আবার দাতা ও গ্রহিতা কেউই যদি নমস্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ না বুঝে একে অপরকে নমস্কার দেয়, তাহলে উভয়েই নিজেদেরকে ঈশ্বরের স্থানে মেনে নেওয়ায় পাপ হবে দুজনেরই। তাহলে এখন আপনারাই বলেন না বুঝে নমস্কার দেওয়া নিরাপদ কি না বা বুদ্ধিমানের কাজ কি না ? যদি কাউকে নমস্কার দেওয়া হয় তাহলে তাকে আগে বোঝাতে হবে নমস্কার দেওয়ার আভিধানিক অর্থ, তারপর তাকে তা দিতে হবে এবং তখন সেটা সঠিক হবে। নমস্কারের আভিধানিক অর্থ না বুঝে একে অপরকে নমস্কার দেওয়া মানে নিজের পাপকে বাড়ানো। আর বর্তমান হিন্দু সমাজের ০.৫% মানুষও নমস্কারের আভিধানিক অর্থ জানে না, তাহলে প্রায় সব হিন্দুকে নমস্কার বলার পরামর্শ দেওয়া কি তাদেরকে পাপের পথে ঠেলে দেওয়া নয় ?
বেদের গায়ত্রী মন্ত্র অবশ্যই মহামন্ত্র, কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের জন্য নয়, উচ্চস্তরের সাধকদের জন্য, তাই গায়ত্রী মন্ত্রের ফল একমাত্র তারাই পেতে পারে; একারণেই সাধারণের জন্য মহামন্ত্র হলো হরে কৃষ্ণ হরে রাম, যার ফল পাওয়ার জন্য কোনো উচ্চস্তরের জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই উচ্চস্তরের সাধক হওয়ারও। একইভাবে সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে সম্মান জানানোর জন্য নমস্কার শব্দের দূরুহ আভিধানিক অর্থকেও জানার বা ধারণ করার প্রয়োজন নেই, কারো জয় চাইলেই তাকে সম্মান জানানো হয়, একই সাথে তার জয়ও কামনা করা হয়, এসব বিবেচনা করেই হিন্দুদের মধ্যে সম্বোধন হিসেবে আমার আবিষ্কার- জয় শ্রীরাম বা জয় শ্রীকৃষ্ণ; কারণ, বর্তমানে হিন্দু জাতি রয়েছে সবচেয়ে সমস্যা সঙ্কুল অবস্থায়, এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হতে পারে শুধু রাম বা শ্রীকৃষ্ণের যোদ্ধা আদর্শকে নিজের মধ্য ধারণ করলেই। আর এর সহজ উপায় হলো- জয় শ্রীরাম বা জয় শ্রীকৃ্ষ্ণ বলে উনাদেরকে স্মরণ করা, ফলে তাদের আদর্শ এমনিতেই আপনার মধ্যে সঞ্চারিত হবে, আর এর ফলে আপনি যেমন বিপদ আপদে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন, তেমনি পারবেন সমাজ এবং ধর্মকেও রক্ষা করতে। আর এটাও প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার যে জয় শ্রীরাম বা জয় শ্রীকৃষ্ণ বলার মাধ্যমে মানুষের মনে ও দেহে একটা জোশ আসে, যে জোশ নমস্কার বলার মাধ্যমে আসে না। আর এই জোশ ই হলো জগতে মাথা উঁচু করে টিকে থাকার একমাত্র উপায়, যদি আপনি সেটাকে উপলব্ধি করে থাকেন।
আশা করছি- সনাতনীদের মধ্যে পারস্পারিক সম্বোধনের ক্ষেত্রে, কেনো নমস্কারের পরিবর্তে জয় শ্রীরাম বা জয় শ্রীকৃ্ষ্ণ বলতে হবে, সেটা আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার করতে পেরেছি।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:
Post a Comment