Wednesday 20 May 2020

হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত ৪৯ প্রকার পাপ বা বিধি-নিষেধ সম্পর্কিত আলোচনা - ( পর্ব- ১ )


হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত ৪৯ প্রকার পাপ বা বিধি-নিষেধ সম্পর্কিত আলোচনা - ( পর্ব- ১ )

সভ্যতার সূচনালগ্নে, অর্থাৎ যখন মানুষ জ্ঞান বুদ্ধিতে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ এবং সেই সভ্যতার অধিবাসী, যারা আর্য নামে পরিচিত এবং যাদের বর্তমান নাম হিন্দু, তারা তাদের ধর্মগ্রন্থে মানুষের আচরণের সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন, যাকে বলা যেতে পারে মানব সমাজের সংবিধান বা দলিল; সেই সংবিধান অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, মানুষের কী কী করণীয় আর কী কী বর্জনীয় ? যেটা আমার আজকের আলোচ্য বিষয় এবং সেই আলোচনা থেকে আপনারা জানতে পারবেন, কেনো হিন্দুরা জন্মগতভাবেই আদর্শবাদী বা আদর্শ মানুষ। এছাড়াও এই সিরিজ পোস্ট থেকে জানতে পারবেন, মুসলমানদের আরও কয়েকটি মিথ্যা দাবীর বিষয় সম্পর্কে, যেগুলো সম্পর্কে মুসলমানদের দাবী, তারাই সেগুলোই প্রবর্তক, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।

সমাজে মানুষের দ্বারা করণীয়, ভালো বা উপকারী কাজগুলোকে পূণ্য এবং খারাপ কাজগুলোকে পাপ বলে অভিহিত করা হয়। পাপ মানে হচ্ছে সীমা। তাই যে সীমা লংঘন করে তাকেই বলা হয় পাপী। হিন্দু শাস্ত্রে দুই ধরণের পাপ আছে- ১. মহাপাপ, ২. উপপাপ। যারা মহাপাপ করে, বাংলায় এদেরকে মহাপাপী বললেও সংস্কৃত ভাষায় এদেরকে বলে মহাপাতক; এই সূত্রে যারা উপপাপ করার অপরাধে অপরাধী, তাদেরকে সংস্কৃতে বলে উপপাতক

উপপাপ হোক বা মহাপাপ, সাধারণ অর্থে সবগুলোকেই বলা হয় পাপ এবং হিন্দু শাস্ত্রে উনপঞ্চাশ রকমের পাপের কথা বলে মানুষের আচরণের সীমাকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই পোস্টে আলোচনা করবো সেই বিষয়গুলো নিয়ে, যেগুলো সভ্যতার সূচনালগ্নেই, হিন্দু শাস্ত্র, মানুষের জন্য প্রবর্তন করেছিলো এবং এই আলোচনা থেকে আপনাদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, হিন্দু শাস্ত্র, মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের ব্যবস্থা সেই ৮/১০ হাজার বছর আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছে।

একটু আগেই বলেছি, হিন্দু শাস্ত্র মতে পাপ দুই প্রকার- উপপাপ ও মহাপাপ। মহাপাপ ৪ প্রকার, সেগুলোর আলোচনা পাবেন এই সিরিজের শেষ পর্বে।তার আগে ৪৫ প্রকার উপপাপগুলো সম্পর্কে আলোচনা সেরে নিই।

প্রথমেই ১ নং উপপাপে বলা হয়েছে গো-হত্যার কথা। তার মানে উপপাপগুলোর মধ্যে গো-হত্যা প্রথম। এ থেকে স্পষ্ট যে, কোনো অবস্থাতেই কোনো হিন্দুর পক্ষে গো-হত্যার কারণ হওয়া যাবে না।

যে ব্যক্তি বাজার থেকে মুরগীর মাংস কিনে, সেই ব্যক্তিই সেই মুরগী হত্যার জন্য দায়ী; বাজারে দোকান বসিয়ে যে মুরগী বিক্রি করছে, সে দায়ী নয়; কারণ, আমি মুরগীর মাংস খাবো ব’লে বাজারে গিয়েছি বলেই দোকানীকে সেই মুরগীকে হত্যা করতে হয়েছে, আমি না চাইলে সেই মুরগীকে দোকানদার হত্যা করতো না। তার মানে যে ব্যক্তি, যে পশু-পাখির মাংস খায়, সেই ব্যক্তিই সেই পশু বা সেই পাখি হত্যার কারণ। একইভাবে, যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ গরুর মাংস খায়, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণই গরু হত্যার কারণ। হিন্দুদের জন্য গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ এই কারণেই যে, তারা যেন গরু হত্যার কারণ না হয়। এই কারণে হিন্দু শাস্ত্রের পাপের তালিকায় প্রথমেই রাখা হয়েছে গো-হত্যাকে।

যে সব মুসলমান এবং “যেসব মুসলমান চাটা অতি আধুনিক হিন্দু”, যাদেরকে সানিউর রহমান, তার এক ভিডিওতে বলেছে থার্ড ক্লাস হিন্দু, সানিউরের মতে, যাদের জন্ম মুসলমানদের বীর্যে, সেই সব নামধারী হিন্দু এবং মুসলমান, যারা হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলোতে, গরুর মাংস খাওয়ার বিধান খুঁজে পায় এবং তা প্রচার করে হিন্দুদেরকে গরুর মাংস খেতে উৎসাহিত করে, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- বই পুস্তকে হিন্দুদের গরুর মাংস খাওয়া সম্পর্কে কী বলা আছে, সেসব ঘাঁটতে গিয়ে এত গলদঘর্ম হওয়ার কোনো কারণ নেই, হিন্দু শাস্ত্রে উল্লিখিত ৪৯ প্রকার পাপের মধ্যে গো-হত্যা জনিত পাপকে প্রথম দিকে রাখা হয়েছে, এ থেকেই এটা স্পষ্ট যে, কোনো হিন্দুর গরুর মাংস খাওয়া চলবে না, যেহেতু গরুর মাংস খাওয়া ই হচ্ছে গো-হত্যার একমাত্র কারণ।

২ নং উপপাপের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে “অযাজ্যযাজন”, এর মানে হচ্ছে অযোগ্য অর্থাৎ পাপী ব্যক্তির হয়ে পূজা বা যজ্ঞক্রিয়া সাধন।

এটা ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের জন্য প্রযোজ্য। খারাপ বা পাপী ব্যক্তির জন্য পূজা বা ধর্মকার্য করাকে পুরোহিত ব্রাহ্মণদের জন্য পাপ বলা হয়েছে এই জন্য যে, তাহলে সাধারণ লোক পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে বা খারাপ কাজ করতে ভয় পাবে। সমাজকে শুদ্ধ রাখার জন্য হিন্দু শাস্ত্র প্রণয়িতাদের যে এটা কতবড় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত তা ভেবে আমি অবাক হয়েছি, একটু সময় নিয়ে আপনিও ভাবুন, অবাক হতে বাধ্য হবেন। ধর্মের ভয় মানুষের সবচেয়ে বড় ভয়। কোনো মানুষ যখন এটা দেখবে যে, পাপকাজ করলে তার বাড়িতে পূজা যজ্ঞ করার জন্য কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত আসবে না, তখন সে কি কোনো খারাপ কাজ করতে উৎসাহ পাবে ? পাবে না।

এর বিপরীতে ইসলামের বিধান হলো, যত পাপ কাজই করো না কেনো, নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরোলেই সব পাপ মাফ। ইসলামে এই পাপ মাফের ব্যবস্থা দিনে পাঁচবার। কেউ যদি প্রতিদিন নামায না পড়ে, তাহলে সপ্তাহে একবার, শুক্রবার, জুম্মাবার। কেউ যদি এই জুম্মাবারেও নামায না পড়ে, তার জন্য রয়েছে বছর শেষে ঈদের নামায। এছাড়াও আছে, শব ই কদরের পাপমুক্তির রাত। তাই মুসলমানদের পাপ, মাফ না হয়ে যেতে পারেই না। আর এই কারণেই প্রায় সব মুসলমান বছর জুড়ে মিথ্যা বলে, ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে, চুরি ডাকাতি করে, খুন ধর্ষণ করে; কারণ, তারা জানে একবার নামায পড়লে তাদের সব পাপ মাফ হবেই এবং এইভাবে তারা আল্লার পতিতালয়ে বেহেশতে গিয়ে মিনিমাম ৭২ হুরকে নিয়ে শুতে পারবেই। ছোভানাল্লা।

কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রে এই রকম পাপ মাফ পেয়ে সমাজকে কলুষিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদিও বলা হয়, উপবাস করলে পাপ মাফ হয় বা কৃষ্ণ নাম করলে পাপ মাফ হয়, এটা আসলে অনিচ্ছাকৃত পাপের জন্য এবং ভবিষ্যতে যাতে আর ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত পাপ না হয়, সেসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে মনকে প্রস্তুত রাখার জন্য।

৩ নং উপপাপে বলা হয়েছে “পরস্ত্রীগমন” এর কথা।
এটা নিয়ে বেশি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেবার প্রয়োজন আছে বলে করি না। কারণ, আমরা সবাই জানি, পরের স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি দিলে সেই সংসার এবং নিজের সংসারের মাধ্যমে সমাজে কিছু না কিছু উপদ্রব ঘটবেই অর্থাৎ সমাজের শান্তি নষ্ট হবেই। আর যা কিছু সমাজের শান্তি নষ্ট করে তাই পাপ। এজন্যই পরস্ত্রীগমনকে পাপ বলা হয়েছে, অর্থাৎ এর মাধ্যমে ব্যভিচারকে নিষেধ করা হয়েছে। অথচ মুসলমানরা বলে, ইসলামে নাকি চৌদ্দশত বছর আগেই বলা হয়েছে,

“তোমাদের যৌনাঙ্গকে সংযত করো !

যদিও গনিমতের মালের নামে ধরে আনা অমুসলিম নারীদের বেলায় যৌনাঙ্গকে সংযত করলে মুসলমানরা কিভাবে তাদের ভোগ করবে, সে ব্যাপারে কোনো মুসলমান মুখ খুলে না এবং যে ইসলামে অমুসলিম নারীদেরকে ধর্ষণ করার কথা বলা হয়েছে, সেই ইসলামে নাকি একথা বলা আছে যে, তোমরা তোমাদের যৌনাঙ্গকে সংযত করো!যা হোক, ইসলামের কোনো ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গকে সংযত করার কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও, যেহেতু তারা জোর গলায় প্রচার করে যে, রোগ ব্যাধির কথা চিন্তা করে ইসলাম সেই চৌদ্দশত বছর আগেই বলেছে, তোমাদের যৌনাঙ্গকে সংযত করো, তাদের সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, তাহলে ব্যাভিচারকে পাপ বলে হিন্দু শাস্ত্রে যে ৮/১০ হাজার বছর আগেই তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটা ইসলামের আগে বলা হয়েছে, না পরে বলা হয়েছে ? শুনে রাখ, ইসলাম যদি পুত্র হয়, হিন্দু ধর্ম হলো, সেই পুত্রের বাপ নয়, বাপের বাপের বাপের বাপের বাপ।

হিন্দু শাস্ত্রে ৪ নং উপপাপে বলা হয়েছে “আত্মবিক্রয়’ এর কথা।

এর মানে হলো কোনো কিছুর বিনিময়ে নিজের সত্ত্বাকে কারো কাছে বিক্রি করা যাবে না। কারণ, এই আত্মবিক্রয়ের ফলেই সমাজে মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অধর্মের সূচনা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ যখন টাকা খেয়ে আদালতে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, তখন নির্যাতিতরা ন্যায় বিচার পায় না, অপরাধীরা উৎসাহ পায় এবং সমাজে আরো অপরাধ ঘটে। একারণেই হিন্দু শাস্ত্রে আত্মবিক্রয়কে পাপ বলা হয়েছে। এটাকে প্রাথমিকভাবে খুব ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এর ফলাফল সমাজে সাংঘাতিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এটা বিবেচনা করেই আত্মিক্রয়কে পাপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে জিজ্ঞেস করছি, তথাকথিত আধুনিক ধর্ম ইসলামে কি এরকম কোনো বিধান আছে ?

৫ নং উপপাপে বলা হয়েছে “গুরুত্যাগ” বা গুরুর প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন না করা।

এটাকে আসলে বুঝতে হবে সৎগুরুত্যাগ হিসেবে বা তার প্রতি কর্তব্য পালনের ব্যাপার হিসেবে। কারণ, বর্তমান সমাজে বাণিজ্যিক অর্থাৎ অসৎ গুরুর অভাব নেই। এখন এই অসৎ গুরুকে আপনি যদি প্রকৃত গুরু বিবেচনা ক’রে, গুরুত্যাগ পাপ মনে ক’রে তাকে যদি ছুঁড়ে না ফেলে আঁকড়ে ধরে থাকেন, তাহলে আপনার ইষ্টের চেয়ে অনিষ্টই বেশি হবে। গুরু বা সৎগুরু তিনিই, যিনি সর্বাবস্থায় আপনার সর্বাঙ্গীন কল্যান চান। আমার লেখা ‘গুরুতত্ত্ব’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে, সেটা যদি পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় এটা বুঝেছেন যে, প্রকৃত গুরু কাকে বলে, আর কোন কোন অবস্থায় গুরুকে ত্যাগ করা যাবে ? তাই এ নিয়ে এখানে বিস্তারিত বলে এই পোস্টের পরিধি আর বাড়ালাম না।

৬ ও ৭ নং উপপাপে বলা হয়েছে, মাতৃত্যাগ ও পিতৃত্যাগ অর্থাৎ মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য পালন না করা।

এই প্রসঙ্গে কাউকে জ্ঞান দিতে গেলে সেটা আমার নিজেরই মূর্খামি হবে, তাই এ প্রসঙ্গে আর কিছু বললাম না। শুধু ইসকন ভক্ত এবং সাধু-সন্ন্যাসী-মহারাজদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা যে সংসার ত্যাগের নামে পিতা-মাতাকে ত্যাগ করেন, এটা কি পূণ্যের কাজ, না পাপের কাজ ? অথবা অন্যভাবে প্রশ্নটা করতে পারি, আপনারা ধর্মের নামে যে সংসার ত্যাগের পথ বেছে নিয়েছেন, সেটা কি সঠিক, না ভুল পথ ?

তৈত্তিরীয় উপনিষদ, যা কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শাখার অন্তর্গত, তার ১/১১/১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

“আচার্য, সমাবতর্নের দিন, তার শিষ্যদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘সত্য কথা বলবে, ধর্ম আচরণ করবে, বেদপাঠ হতে বিরত থাকবে না, আচার্যকে প্রিয় উপহার দেবে এবং বংশ ধারাকে অব্যাহত রাখবে।”

‘বেদ’ এ যে চারটি আশ্রমের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও দ্বিতীয় আশ্রমের নাম গার্হস্থ্য আশ্রম, যেখানে কর্তব্য হলো সংসার ধর্ম পালন করা এবং সন্তানের জন্ম দেওয়া। আপনারা হিন্দু শাস্ত্রের কোন বিধানের বলে সংসার ত্যাগ ক’রে বিয়ে শাদী না ক’রে সাধু-সন্ন্যাসী-মহারাজ হয়েছেন ?ক্ষমতা থাকলে জবাবটা দিয়ে যাবেন, আর না পারলে নিজেরা সংসারে ফিরে এসে পিতা-মাতার প্রতি যে কর্তব্য তা পালন করবেন, বিয়ে ক’রে সন্তানের জন্ম দিয়ে স্বর্গ পাওয়ার পথ প্রশস্ত করবেন। কারণ, মহাভারতে বলা আছে, যে ব্যক্তি সন্তানের জন্ম না দিয়ে মারা যাবে, সে স্বর্গে যেতে পারবে না। সন্তানের জন্ম না দিলে আপনারা তো স্বর্গেই যেতে পারবেন না, সেক্ষেত্রে মোক্ষলাভের আশা করেন কিভাবে ? আর অবশ্যই নিজেদের ভুল পথে যেতে অন্য কাউকে তো উৎসাহিত করবেনই না, বরং নিষেধ করবেন।

৮ নং উপপাপে বলা হয়েছে, “স্বাধ্যায়ত্যাগ” অর্থাৎ বেদপাঠ পরিত্যাগ করা।

যে কাজ করি বা করতে হয়, সেটা আর না করাকে বলা হয় ত্যাগ করা। তাহলে আমরা ৯৯.৯৯% হিন্দুরা বেদ তো কোনো দিন পাঠ করিই নি, আর পাঠ করবো কিভাবে বেদ যে কেমন গ্রন্থ সেটাও তো দেখি নি, তাহলে সেটাকে ত্যাগ করবো কিভাবে ? তার মানে ‘বেদ’ এর সংস্পর্শে না এসে জন্ম থেকেই আমরা পাপ করে চলেছি। এই পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য অবশ্যই আমাদেরকে প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একদিন বেদ পাঠ করতে হবে, তার আগে দরকার বেদ গ্রন্থকে বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখা। যারা এখনও বেদ দেখেন নি বা যাদের বাড়িতে বেদ নেই, তারা আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, বেদ কোথায় পাওয়া যায়, তা বলে দেবো; দাম খুব বেশি নয়, ৪ খণ্ডের এক সেট বেদ বাংলাদেশি টাকায় ৮০০ এর মতো, পশ্চিমবঙ্গেও এরকমই। তাই বাড়িতে বেদ রাখুন, আর তা পাঠ করে “স্বাধ্যায়ত্যাগ” নামক পাপ থেকে দূরে থাকুন।

৯ নং উপপাপে বলা হয়েছে, “অগ্নিত্যাগ” অর্থাত যাগযজ্ঞ না করা।

বেদের যুগে সনাতন ধর্মের একমাত্র ধর্মীয় কার্য ছিলো যজ্ঞ করা। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে সনাতন ধর্মের মধ্যে নানা রকম মূর্তি পূজা যুক্ত হয়েছে, যাবর্তমানে উৎসব ব্যতীত আর কিছুই নয়; শুধু মাত্র কৃষ্ণকে ভজনাকরলেই, যেগুলোর আর কোনো কিছু করার প্রয়োজনই নেই। কারণ, কৃষ্ণই হচ্ছে সকল দেব-দেবীর আশ্রয় বা মূল, যার প্রমান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শন। এমন কি গীতাতে এ কথাও বলা হয়েছে যে, কৃষ্ণের অনুমতি ছাড়া কোনো দেব-দেবীও কারো জন্য কিছু করতেও পারে না।

সমাজের জন্য উৎসবের প্রয়োজন, তাই বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজাকে আমরা যদি উৎসব হিসেবে দেখি বা রেখে দিই, তাতে কোনো ক্ষতি নেই; কিন্তু প্রকৃত ধর্মচর্চা করতে হলে আমাদেরকে বেদের নির্দেশ মেনে যজ্ঞই করতে হবে। আশা করছি বিষয়টি নিয়ে সকলে ভাববেন।

১০ নং উপপাপে বলা হয়েছে, “সুতত্যাগ” অর্থাৎ ছেলে মেয়ের প্রতি কর্তব্য না করা।

এই কাজটা সাধারণত কেউই করে না, সবাই চেষ্টা করে তার ছেলে মেয়েদেরকে যথাসাধ্য ভালো ক’রে মানুষ করার। তাই এই পাপটি, কোটিতে ২/১ জন ছাড়া সম্ভবত কাউকে স্পর্শ করে না, আর কোটিতে ২/১ টি ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, তাই এ নিয়ে আর কোনো কথা বললাম না।

১১ নং উপপাপে বলা হয়েছে, “পরিবিত্তিতা”, এর মানে হলো বড় ভাই/বোনের আগে ছোট ভাই/বোনের বিয়ে দেওয়া।

এতে সমাজে বড়দের মর্যাদা নষ্ট হতে পারে, তাদের সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন উঠতে পারে এবং এর ফলে সামাজিক শৃঙ্খলার ক্ষতি হতে পারে ব’লে হিন্দু শাস্ত্রে একে পাপ বলে গণ্য করা হয়েছে।

১২ নং উপপাপও এই বিয়ে সংশ্লিষ্ট, এর নাম “পরিবেদন”, এর মানে হচ্ছে বড় ভাই/বোনের আগে ছোটদের বিয়ে করে ফেলা। এক্ষেত্রেও ১১ নং পাপের মতো সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে, এ্ই দুই ধরণের বিয়ের সাথে যুক্ত সকলে এই পাপের অংশীদার হবে। এমন সূক্ষ্ম সমাজ চিন্তা কি পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির ভেতর আছে, না এমন ভাবনা কেউ ভাবতে পেরেছে ?

১৩ নং উপপাপে বলা হয়েছে, “কন্যাদূষণ” অর্থাৎ কোনো নারীকে ধর্ষণ করা।

এটা যে কত বড় পাপ, সে সম্পর্কে সবাই কম বেশি জ্ঞান রাখেন; তাই আমি আর বেশি কিছু বললামনা। শুধু এটা খেয়াল রাখবেন, এটাকে রাখা হয়েছে ১৩ নং এ, যে ১৩ সম্পর্কে প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে আনলাকি থার্টিন ব’লে, তার মানে অশুভ সংখ্যা ১৩। তার মানে এই কাজটি কেউ করলে বা করার চেষ্টা করলে তার জীবনে যে দুর্ভাগ্য কিভাবে নেমে আসবে, যে ব্যক্তি সেটা করবে, সে তা হাড়ে হাড়ে টের পায় বা পাবে। ধর্ষণকে আমি আনলাকি থার্টিন বললেও, আগে বলা অন্য পাপগুলোকে যে লাকি বলছি, এমন মনে করার কিন্তু কোনো কারণ নেই। কারণ, পাপ মানেই অশুভ বা খারাপ কাজ, আর খারাপ কোনো কিছু কারো জীবনে কখনো ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না।

হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত মহাপাপ এবং উপপাপের মোট সংখ্যা ৪৯টি। এই পর্বে প্রথম ১৩ টি সম্পর্কে আলোচনা করলাম, বাকিগুলো নিয়ে আলোচনা শীঘ্রই পাবেন।

মানব জীবনাচরণে এই ৪৯ প্রকার বিধিনিষেধ, সভ্যতার সূচনালগ্নেই, হিন্দু শাস্ত্র মানুষকে প্রদান ক’রে, একটি মানব শিশুকে আদর্শ মানু্ষ হিসেবে গড়ে উঠার ও নিজের জীবনকে পরিচালিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে; যার কারণে হিন্দুরা জন্মগতভাবেই আদর্শ মানুষ এবং যারা বিভিন্ন ব্যক্তিমতের ধর্মে বিশ্বাস করেও মানুষের মতো জীবনযাপন করে, তারাও প্রকারন্তরে হিন্দুধর্মই পালন করে এবং হিন্দুদের মতো আদর্শ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment