Tuesday, 21 July 2020

যিনি কৃষ্ণ তিনিই কি চৈতন্য ?


যিনি কৃষ্ণ তিনিই কি চৈতন্য ?

বৈষ্ণব সমাজের একটি বহুল প্রচারিত তত্ত্ব হলো- যিনি কৃষ্ণ তিনিই চৈতন্য। হরিবাসর বা হরিসভায় যেসব লোক লীলাকীর্তন করে, তারা মঞ্চে উঠে এই কথাটি একবার হলেও বলবেই বলবে। এর ফলে সাধারণ হিন্দুরা চৈতন্যকে, শ্রীকৃষ্ণের সমান মনে করে এবং এর ফলে তারা নিজের অজান্তেই এক অমার্জনীয় অপরাধ করে, যেটা তাদেরকে মোক্ষ বা মুক্তি থেকে বহু দূরে সরিয়ে দেয়।

গীতায় বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারবে, সেই ব্যক্তির মুক্তি বা মোক্ষের কোনো সম্ভাবনা নেই (গীতা, ১০/৩)। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি, শ্রীকৃষ্ণকে চৈতন্যর সমান বিবেচনা করে, তখন সে মহাসমুদ্রকে এক পুকুরের সমান বিবেচনা করে, এর ফলে শ্রীকৃষ্ণের প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না, সে ভুল পথে তার জীবনকে অতিবাহিত করে।

বস্তুত এই জগতে কেউ শ্রীকৃষ্ণের সমান নয়, কেউ শ্রীকৃষ্ণের তুল্য নয়, এমনকি ব্রহ্মা এবং শিবও শ্রীকৃষ্ণের সমান বা তুল্য নয়, যদিও আমরা সাধারণ বিবেচনায়- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ব'লে, এই তিন দেবসত্ত্বাকে একই মনে করি, কিন্তু তত্ত্বগতভাবে সেটা সত্য নয়। এ প্রসঙ্গে ভাগবতের দুটি গল্পের উল্লেখ করা যায়-

শ্রীবিষ্ণুর, পৃথিবীতে শ্রীকৃষ্ণ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর, শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে যখন তার অদ্ভুত সব লীলা প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন, সেই সময় অঘাসুর বধের পর ব্রহ্মার এক অুনচর, ব্রহ্মাকে জানায় যে বৃন্দাবনে এক অদ্ভুত বালকের জন্ম হয়েছে, আমার মনে হচ্ছে সেই বালক স্বয়ং বিষ্ণু, বিষ্ণুই সেই বালক রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে। ব্রহ্মার সেই কথা বিশ্বাস হয় না, ব্রহ্মা বলে- আমি বিষ্ণুকে ভালোরকম জানি, বিষ্ণু পৃথিবীতে কেনো অবতীর্ণ হতে যাবেন আর তিনি যদি সেটা করেন, সেটা কি আমি জানবো না ? এরপরেও ব্রহ্মার সেই অনুচর তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে যে, বৃন্দাবনের সেই বালকই অবশ্যই বিষ্ণুর অবতার। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা বৃন্দাবনে এসে সেই বালককে স্বচক্ষে দেখার এবং সেই বালক বিষ্ণুর অবতার কিনা তা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, এরপর অনুচরসহ ব্রহ্মা বৃন্দাবনে আসে এবং দেখে গরু চরানোর পাশাপাশি শ্রীকৃষ্ণ, তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে খেলাধুলা করছে। এরপর একটি গরু খোঁজার কারণে, শ্রীকৃষ্ণ দল থেকে আলাদা হয়ে গেলে, ব্রহ্মার বিমোহনে সকল বালক এমনকি গরুর বাছুর এবং তাদের সাথে থাকা একটি বানরও ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে এবং শ্রীকৃষ্ণের অলক্ষ্যে তাদের সবাইকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মালোকে লুকিয়ে রাখে।

গরু খোঁজা থেকে ফিরে আসার পর শ্রীকৃষ্ণ দেখে তাদের খেলার স্থলে কেউ নেই, শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারে, ব্রহ্মা তাদের সবাইকে চুরি করে নিয়ে গেছে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায়, ছেলেরা এখনও বাড়ি ফিরছে না দেখে তাদের মায়েরা উদ্বিগ্ন হয় এবং হারিকেন জ্বালিয়ে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এতে শ্রীকৃষ্ণ ভাবে, তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে গ্রামে না ফিরলে তাদের পিতা মাতারা পেরেশনে পড়ে যাবে এবং নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে; এই সমস্যার সমাধানে শ্রীকৃষ্ণ, প্রথমে তার সঙ্গে যতজন সঙ্গী ছিলো, নিজেই তাদের রূপ ধারণ করে এবং সকলকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। এর ফলে গ্রামবাসীরক কেউ বুঝতেই পারে না যে আসলে ঘটনা কী ঘটেছে। এভাবে শ্রীকৃষ্ণ একাই- কয়েকটি বাছুর, একটি বানর এবং তার কয়েকজন বন্ধুর রূপে প্রক্সি দিতে থাকে এবং এর ফলে বৃন্দাবনের সবাই এক অদ্ভুত শান্তি ও সৌন্দর্য অনুভব করতে থাকে এবং এভাবেই কেটে যায় এক বছর।

এক বছর পর ব্রহ্মার হঠাৎ মনে হয়, আরে এক বছর পূর্বে সে তো শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গী সাথীদেরকে চুরি করে নিয়ে এসেছিলো, এই এক বছর শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে বৃন্দাবনে সময় কাটাচ্ছে, সেটা একটু দেখে আসা দরকার; সাথে সাথে সে বৃন্দাবনে এসে উপস্থিত এবং দেখে, শ্রীকৃষ্ণ আগের মতোই তার বন্ধু বান্ধবদেরকে নিয়ে খেলাধুল করছে, এই দৃশ্য দেখে ব্র্হ্মা তো অবাক, নিজেই নিজেকে বলে- এটা কিভাবে সম্ভব ? আমি তো সবাইকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মালোকে লুকিয়ে রেখেছি, তাহলে এরা এলো কোথা থেকে। ব্রহ্মার উপস্থিতি বুঝতে পেরে শ্রীকৃষ্ণ, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের ব্রহ্মাকে আহ্বান করে, ফলে হাজার হাজার ব্রহ্মা ঐখানে উপস্থিত হতে থাকে। এটা দেখে ব্রহ্মা আশ্চর্য হয়ে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে- আমি তো ব্রহ্মা, তাহলে এত সব ব্রহ্মা কোথা থেকে আসছে ?

ইতোমধ্যে বালকরূপী শ্রীকৃষ্ণের সকল সঙ্গী সাথী বিষ্ণুর রূপ ধারণ করে এবং তারা বালকরূপী শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে একে একে লীন হয়ে যায়; তারপর শ্রীকৃষ্ণ, ব্রহ্মাকে বলে- চতুর্মুখী ব্রহ্মা, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে হাজার হাজার ব্রহ্মাণ্ড আছে, তুমি শুধু একটির রচয়িতা, কিন্তু আমি এই হাজার হাজার ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক এবং তার হাজার হাজার ব্রহ্মার স্রষ্টা, আমার আসল রূপ তোমাকে দেখানোর জন্যই আমি এই লীলার আয়োজন করেছি।

এরপর ব্রহ্মা তার নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং শ্রীকৃষ্ণের কাছে তার মূর্খতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এরপর শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে সকল ব্রহ্মা সেখান থেকে চলে যায় এবং তারপর ব্রহ্মা, ব্রহ্মালোক থেকে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গী সাথীদেরকে নিয়ে এসে ঘুমন্ত অবস্থায় ফেরত দেয় এবং নত মস্তকে শ্রীকৃ্ষ্ণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। এরপর ঘুম থেকে উঠে কেউ বলে খুব ভালো ঘুমিয়েছি, কেউ বলে মনে হচ্ছে একবছর পর ঘুম থেকে উঠছি। যা হোক, সন্ধ্যা হলে যথারীতি কৃষ্ণ সকলকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে, কেউ বুঝতেও পারে না যে বালকরূপী কৃষ্ণ, গত এক বছরে কি কঠিন পরীক্ষা দিয়েছে, ব্রহ্মার কাছে এবং বৃন্দাবনবাসীর কাছে। এই ঘটনাটির বর্ণনা আছে বেণীমাধব শীলের ভাগবতের দশম স্কন্ধে "পিতামহের মোহ" এবং "কমল যোনী কর্তৃক কৃষ্ণের স্তব" পর্বে; সুবোধচন্দ্রের ভাগবতের দশম স্কন্ধের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে "ব্রহ্মার মোহনাশ" এবং চতুর্দশ অধ্যায়ে "ব্রহ্মা কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তব" অধ্যায়ে; এছাড়াও এই ঘটনাটি পাওয়া যাবে যেকোনো গদ্য ভাগবতের দশম স্কন্ধের ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়ে। বিভিন্ন ভাগবতে এই ঘটনাটির বর্ণনা হয়তো বিভিন্নরকম হবে, কিন্তু মূল ঘটনা এক, যা আমি উপরে বর্ণনা করলাম।

ভাগবতের আরেকটি বর্ণনায়, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ, বকাসুর নামে এক অসুরকে বধ করে, সেই বর্ণনায় দেখা যায়, বকাসুর, শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমন করে গিলে ফেললে, দেবতারা সন্ত্রস্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে উদ্ধার করতে আসে এবং ইন্দ্র, ব্রহ্মা, শিব ও অগ্নিদেব বকাসুরকে প্রহার করে বালক কৃষ্ণকে উদ্ধার করতে না পেরে, তারা শুধু কৃষ্ণের জন্য প্রার্থনা করতেই পারে বলে ফিরে যায়, এরপর বকাসুরের ঠোঁটের মধ্যে থাকা কৃষ্ণ, বকাসুরের ঠোঁটকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে এবং বকাসুরকে হত্যা করে।

উপরের এই দুই ঘটনাতে প্রমাণ হয়, শিব বা ব্রহ্মা, কেউ শ্রীকৃষ্ণের সমান নয়।তাহলে ব্রহ্মা বা মহেশ্বর যেখানে শ্রীকৃষ্ণের সমান নয়, সেখানে চৈতন্যদেব কিভাবে শ্রীকৃষ্ণের সমান হয় ?

অনেক বৈষ্ণব, চৈতন্যদেবকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার মনে করে, এই সূত্রেও তারা মনে করে যে যিনি কৃষ্ণ তিনিই চৈতন্য। কিন্তু পৃথিবীতে শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলে কিছু নেই। অবতার যা আছে তা বিষ্ণুর, এমনকি শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার এবং রামচন্দ্র, বিষ্ণুর আংশিক অবতার; এই সূত্রে রামও শ্রীকৃষ্ণের সমান নয়, তাহলে যে চৈতন্য বাস্তবে কোনো অবতার নয়, বা ভগবান নয়, সেই চৈতন্য কিভাবে শ্রীকৃষ্ণের সমান হয় ?

শ্রীকৃষ্ণের তুল্য এই জগতে যে কেউ হতে পারে না, তার প্রমাণ আছে গীতায়। শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় তাঁর বিশ্বরূপ দর্শনের পর অর্জুন গীতার একাদশ অধ্যায়ের ৪৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে বলেছেন-

"তোমার মহিমার তুলনা নাই, তুমি বিশ্বপিতা, তুমি জগতের পূজ্য, তুমি সকলের গুরু, তুমি গুরু হইতে গুরুতর। এই ত্রিলোকে তোমার তুল্য কেহ নাই, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ থাকিবে কি প্রকারে ?"

আবার গীতার ১০ম অধ্যায়ের ২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

"দেবতারা বা মহর্ষিরা কেহই আমার উৎপত্তির বিষয়ে জ্ঞাত নহেন। কারণ, আমি সকল প্রকারে তাহাদের আদিতে বিরাজমান।"

গীতার এই শ্লোকগুলোও প্রমাণ করে যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেহই শ্রীকৃষ্ণের তুল্য বা শ্রীকৃষ্ণের সমান হতে পারে না, সেখানে চৈতন্যদেব কিভাবে শ্রীকৃষ্ণের সমান হবে ?

আমি আমার গবেষনায় দেখেছি- ইসলামের মতো চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব মতবাদও একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব মতবাদ, এর কোনো কিছুই ঠিক নেই এবং বৈষ্ণবরা ধর্মের নামে সমাজে যা প্রচার করে তার প্রায় পুরোটাই ভুল, এই ভুল শিক্ষা নিয়ে হিন্দু ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে উঠল হিন্দুধর্মের ধ্বংস নিশ্চিত। তাই হিন্দু সমাজে বৈষ্ণব মতবাদের প্রচার যত দ্রুত বন্ধ করা যায়, ততই হিন্দু সমাজের মঙ্গল।

চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব মতবাদ, কিভাবে হিন্দু সমাজকে আস্তে আস্তে দুর্বল এবং ধ্বংস করছে, তার প্রমান পাবেন এই পোস্টের সাথে যুক্ত Written photo পোস্টটি পড়লে।

সুতরাং বৈষ্ণব মতবাদের প্রচারকে প্রতিরোধ করে হিন্দু সমাজের মঙ্গল করা আপনার আমার সকলের একান্ত ধর্মীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব।

কী বলছি, আমার পাঠক বন্ধুরা আশা করি তা বুঝেছেন।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment