Monday 25 May 2020

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির গীতা সম্পর্কে অপপ্রচারের জবাব


ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির গীতা সম্পর্কে অপপ্রচারের জবাব :

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর ঘোষ এবং এই ব্যক্তি একজন ভালো লেখক। বাজারে ইনার অনেক বই আছে এবং তার প্রায় সব বই আমার পড়া। প্রবীর ঘোষ বা তার সংগঠন, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, যেটা আমার ভালো লাগে; কিন্তু এরা এদের কাজের আড়ালে ভারতীয় তথা সনাতনী হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে বাজে কথা ব'লে, পক্ষান্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষেই কাজ করে। যেমন- প্রবীর ঘোষ, সুলতান মাহমুদ কর্তৃক সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের প্রশংসা করে বলেছে, এর ফলে হাজার বছরের মিথ্যা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের ভিত্তিমূল আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলো।

কিন্তু সুলতান মাহমুদের বর্বর আক্রমনে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ হিন্দু নারীকে যৌনদাসী হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া এবং কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি লুটের ব্যাপারে এই মানবতাবাদী কোনো কথা উচ্চারণ করে নি। কারণ, হিন্দুদেরকে এই মানবতাবাদীর সম্ভবত মানুষ বলে মনে হয় না, যেহেতু ভারতে- মানবতাবাদের পক্ষে কথা বলা মানে শুধুই মুসলমানদের পক্ষে কথা বলা। তাই পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতাজ বেগমও বলে- আমি মুসলিম তোষণ করি না, মানবতার পক্ষে কাজ করি। এই কথা শোনার পর আমার শুধু একটা প্রশ্নই মনে জেগেছিলো - হিন্দুদেরকে আপনার কি মানুষ মনে হয় না ?

যা হোক, প্রবীর ঘোষের এই ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, "সত্যের সন্ধান" ফেসবুক আইডি থেকে একটি প্রবন্ধ অনলাইনে ছেড়েছে, যেখানে তারা গীতার উৎপত্তির বিষয়ে কিছু গালগল্প নয় বালগল্প ঝেড়ে, গীতার শ্লোকের বিকৃত ব্যাখ্যা ক'রে, গীতার সমালোচনা করেছে; এই প্রবন্ধে দেবো তার ই জবাব-

ফটো পোস্টে দেখুন, সেখানে গীতার দুইটি শ্লোক, দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫৫ ও ৫৬ উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার বিকৃত অনুবাদ ক'রে, সেই বিকৃত অনুবাদের ভিত্তিতে সেগুলোর সমালোচনা করা হয়েছে; পুরো প্রবন্ধের অংশ বিশেষ আমি ফটো হিসেবে পোস্ট করেছি, বাকি অংশসহ পুরো প্রবন্ধই আপনারা পাবেন আমার এই প্রবন্ধের শেষে, যেখান থেকে আপনারা এই ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কুযুক্তিগুলো জানতে পারবেন।
ফটোপোস্টে দেখুন গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫৫ ও ৫৬ নং শ্লোকের অনুবাদে তারা লিখেছে-
“হে অর্জুন! যখন মানুষ নিজের মনে স্থিত সমস্ত কামনাসমূহ সম্পূর্নরুপে ত্যাগ করেন (এবং) আত্মাতে ই আত্মদ্বারা অর্থাৎ নিজেতেই নিজে সন্তুষ্ট থাকেন, তখন সেই মানুষকে ‘স্থিরপ্রজ্ঞ’ বলা হয়। দুঃখ পেলে যার মন উদ্বিগ্ন হয় না, সুখ পেলে যিনি স্পৃহাশুন্য থাকেন; যিনি আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ বর্জিত হয়েছেন, সেই মুনি স্থিরবুদ্ধি বলে কথিত হন।"
খেয়াল করুন, অনুবাদের শুরুতেই তারা বলেছে, "“হে অর্জুন! যখন মানুষ নিজের মনে স্থিত", এই কথা বলে তারা পুরো বিষয়টিতে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছে, কিন্তু এই কথাগুলো কোনো সাধারণ মানুষ সম্পর্কে বলা হয় নি, বলা হয়েছে যোগীদের সম্পর্কে; এর প্রমাণ আপনারা পাবেন, এর আগের শ্লোক ৫৪ তে, যেখানে অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছেন-

"স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্।।"
এর অর্খ- হে কেশব, যিনি সমাধিস্থ হইয়া স্থিতপ্রজ্ঞ হইয়াছেন তাহার লক্ষ্মণ কী ? স্থিতধী ব্যক্তি কীরূপ কথা বলেন ? কীরূপে অবস্থান করেন ? কীরূপে চলেন ?

এর জবাবে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
“প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনগতান্।
আত্মন্যেবাত্মনা তুস্তঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।।”
এর অর্থ হলো- হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা বর্জন করিয়া আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলিয়া কথিত হন।

সমাধিস্থ হতে পারেন একমাত্র যোগী সন্ন্যাসীরাই, তাই অর্জুন-শ্রীকৃষ্ণের এই কথোপকথন যে যোগী সন্ন্যাসীদেরকে নিয়ে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অথচ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এখানে তাদের মনগড়া অনুবাদে যোগী সন্ন্যাসীদেরকে না বুঝিয়ে সরাসরি মানুষ শব্দ বসিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছে এবং তার প্রেক্ষিতে গীতার বাণী যে সমাজ সংসারের জন্য বাস্তব নয়(!), সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে।

সনাতন ধর্মে স্পষ্ট করে বলা আছে, কোন বয়সে মানুষ সন্ন্যাস নিতে পারবে বা্ যোগধর্ম চর্চা করতে পারবে। কাউকে সন্ন্যাস নিতে হলে তাকে ব্রহ্মচর্য (২৫ বছর পর্যন্ত), গার্হস্থ্য (২৫-৫০ বছর পর্যন্ত) ও বাণপ্রস্থ(৫০- ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত) আশ্রমের সকল দায়িত্ব পালন করে সন্ন্যাসে যেতে হবে। সন্ন্যাস মানে পূর্ণ অবসর সংসার ও সমাজের দায়িত্ব থেকে। গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করে, বাণপ্রস্থে কোনো ধর্মীয় সংগঠনের অধীনে থেকে সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করে ৭৫ বছর বয়সের পর কোনো ব্যক্তি সন্ন্যাস নিতে পারে এবং ঈশ্বরকে পাবার আশায় কঠোর তপস্যা বা যোগধর্মের চর্চা করতে পারে। সুতরাং গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫৫, ৫৬ নং শ্লোক কখনোই সাধারণ মানুষের জন্য বলা হয় নি, এটা বলা হয়েছে সন্ন্যাসী বা যোগীদের জন্য। অথচ এই শ্লোক দুটি সাধারণ মানুষের জন্য কথিত ব'লে এই নাস্তিকরা সাধারণ হিন্দুদেরকে গীতা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে। হিন্দুদের সম্পর্কে এদের উদ্দেশ্যে বরাবরই অসৎ, এই অপচেষ্টা, সেই অপচেষ্টারই একটা অংশ, তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আবর্জনা সাফ না করলে তো তা সমাজকে কলুষিত করবে, সেজন্যই আমার এই কষ্ট স্বীকার।

যা হোক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি কিভাবে গীতার বাণীর বিকৃত অনুবাদ করে তার দ্বারা সনাতনী বিশ্বাসকে দুর্বল করতে চেষ্টা করছে, আশা করছি, সেই বিষয়টা আমার বন্ধুদেরকে বোঝাতে পেরেছি।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
------------------------

নিচে দেখে নিন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পুরো প্রবন্ধটি-

সত্যের সন্ধান

“গীতার শ্লোক ও তার খণ্ডন”

ভাগবত গীতা রচিত হয়েছিল মৌর্য যুগের শেষ ও গুপ্ত যুগের প্রথমে।তৎকালীন সময়ে বৌদ্ধধর্ম, জৈন ধর্মের প্রসারতা, সাধারন মানুষের কাছে ধর্ম গুলির ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যাপকতায় হিন্দুসমাজ তথা ব্রাহ্মন্যশ্রেনি প্রমাদ গোনে। তাঁরা হিন্দু ধর্ম রক্ষা করতে , শুদ্রদের পদানত করতে ও নিজেদের সম্পূর্ন আয়ত্বে আনতে এমন কিছুর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কারও মনে সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। প্রশ্নাতীত আনুগত্যে সব কিছু মানুষ মেনে নেবে। যারই ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হল ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’, যা শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিসৃত বানি বলে প্রচার করে দেওয়া হল।

গীতার অনেক শ্লোক কঠ্ উপনিষদ থেকে নেওয়া। আসুন আমরা যুক্তির আলোয় ‘গীতা’ র শ্লোক নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখি মানুষকে কি উপদেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা ধাপে ধাপে অন্যন্য ধর্ম গ্রন্থ গুলিকে নিয়েও পর্যালোচনায় নামব।

গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় শ্লোক ।।৫৫।।

“প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনগতান্।
আত্মন্যেবাত্মনা তুস্তঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে”

অর্থাৎ “হে অর্জুন! যখন মানুষ নিজের মনে স্থিত সমস্ত কামনাসমূহ সম্পূর্নরুপে ত্যাগ করেন (এবং) আত্মাতে ই আত্মদ্বারা অর্থাৎ নিজেতেই নিজে সন্তুষ্ট থাকেন, তখন সেই মানুষকে ‘স্থিরপ্রজ্ঞ’ বলা হয়”।

এবং

“দুঃখেস্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে”।। ৫৬।।

অর্থাৎ “দুঃখ পেলে যার মন উদ্বিগ্ন হয় না, সুখ পেলে যিনি স্পৃহাশুন্য থাকেন; যিনি আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ বর্জিত
হয়েছেন, সেই মুনি স্থিরবুদ্ধি বলে কথিত হন”।

‘ভগবানের মুখনিসৃত বানী’ যখন তখন সর্বকালের সমগ্র মানবজাতির কথা ভেবেই নিশ্চই বলা হয়েছে।সমগ্র মানবজাতিকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে কামনা, বাসনা সম্পূর্ন ত্যাগ করে ‘আত্মদ্বারা’ অর্থাৎ নিজেই নিজেতে স্থির থাকবে। দুঃখ, সুখ, ক্রোধ, ভয়, আসক্তি ইত্যাদি সবেতেই চরম উদাসীন থাকবে ও অচঞ্চল থাকবে, সোজা কথায় মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে, ন্যায় নীতি বর্জিত রোবটের মতো হয়ে যাও।যদি হউ তবে তুমি ‘আর্দশ পুরুষ’।

লক্ষ্যনীয় বিষয় এই ‘আর্দশ পুরুষ’ এর ডেফিনেশানের সঙ্গে কিন্তু রামকৃষ্ণ থেকে বিবেকানন্দ অনুকূল ঠাকুর বা সাইবাবা কেউই পরছেন না। বা রামমোহন বা বিদ্যাসাগর কেউই ‘আর্দশ পুরুষ’ নন কিন্তু।রাগ, দুঃখ, কষ্ট, ভালবাসা- এগুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।এসব বাদ দিলে কি অবস্থা হবে ভাবতে পারছেন? ভয়ঙ্কর এই ভাবধারা গ্রহণ করলে রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে ডারউইন বা আইনস্টাইন কেউই কিছু করতে সচেষ্ট হতেন না। এঁরা যদি ঘরে বসে হরিনাম করে কাটিয়ে দেতেন আজকের সমাজ কেমন হত ভাবতে পারা যায় না। এমন আর্দশ পুরুষের দরকার নেই যেখানে ন্যায় নীতি, বিবেক বিসর্জন দিয়ে কল্পিত ভগবান কে ভালবাসতে হবে। যাই হোক এই সব ‘স্থির’ মানুষদের জীবনের উদ্দেশ্য কি হবে? না, ‘তাঁর’ অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাধন ভজন করা। তার জন্য পাশে যে মরছে মরুক ওসবে দৃষ্টিপাত না করে ‘আমাকে’ ভালোবেসে যাও আর হড় হড় করে চোখের জল ফেল।

একবার ভাবুন, গীতায় বলা হচ্ছে ‘দুঃখেস্বনুদ্বিগ্নমনাঃ’ থাকতে। আপনার বাচ্ছা ছেলেটা বা মেয়েটা বা আপনার বাবা বা মা অসহ্য যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু আপনাকে দুঃখ বা বিচলিত হলে হবে না। কারন আপনি ‘স্থির পুরুষ’। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন পাশের মেয়েটাকে কয়েকজন যৌন হেনস্থা করছে, দেখেও না দেখার ভান করে চলে যান, কারন আপনি ‘প্রজ্ঞ’। সুতরাং এসবে মনকে বিচলিত করলে হবে না। আপনি যদি আজ স্থির ‘প্রজ্ঞ’ হয়ে আপনার বিষয় সম্পত্তি দেখভাল না করেন, রক্ষা না করেন তাহলে আপনার স্ত্রী, পুত্র বা কন্যার কথাটাও ভেবে দেখবেন। দায়িত্ব জ্ঞানহিন স্বামী বা বাবা হওয়াটা কাজের কথা নয়।

মনে রাখতে হবে সমাজে দুই প্রকার মানুষ খুবই বিপদজনক- এক যারা অপরাধ বা অন্যায় করে। আর আরও মারাত্মক অপরাধী তারা যারা এসব দেখেও প্রতিবাদ না করে উদাসীন থাকে, মুখ বুজে থাকে। এরা সমাজের জঞ্জাল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তারে ঘৃনা যেন তৃনসম দহে। চলবে…
#তথ্য:ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তি বাদী সমিতি।

No comments:

Post a Comment