Wednesday 27 May 2020

জামাই ষষ্ঠী কী ও কেনো ? এবং দেবী ষষ্ঠীর বাহন কেনো বিড়াল ?


জামাই ষষ্ঠী কী ও কেনো ? এবং দেবী ষষ্ঠীর বাহন কেনো বিড়াল ?

জামাই ষষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত- মাতৃত্ব, সন্তানধারণ ও বংশবৃদ্ধির গল্প ৷ মা ষষ্ঠীকে খুশি করে এইসব আশীর্বাদ পাওয়ার অনুষ্ঠানই হলো জামাই ষষ্ঠী ৷

কথিত আছে, একসময় নিয়ম ছিলো, কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয়, ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে যেতে পারবেন না ৷ এই ব্যবস্থায় যে সমস্যা দেখা দেয়, তা হলো- সন্তানধারণে বিলম্ব বা সদ্যজাত সন্তানের মৃত্যুর ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতো কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য ৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখ অদর্শনে পিতামাতার কষ্টের কথা ভেবে সমাজের বিধানদাতারা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নেয় জামাই ষষ্ঠী হিসাবে, যেদিন মেয়ে ও জামাইকে নেমন্তন্ন করে সমাদর করা হবে, এতে কন্যার মুখ দর্শনও করা যাবে আর সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করাও হবে, যাতে কন্যা শীঘ্র পুত্রমুখ দর্শন করতে পারে ৷

জামাই ষষ্ঠী প্রচলনের পর, সন্তান না হওয়া পর্যন্ত কন্যার বাড়িতে পিতা মাতার না যাওয়ার বিধি বর্তমানে পরিবর্তিত হয়ে- এক বৎসর কন্যার বাড়িতে না যাওয়ার বিধি প্রবর্তিত হয়েছে।

কিন্তু, ১০৮টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে, নতুন পাখার উপর আমের পল্লব এবং আম ও তৎসহযোগে কমপক্ষে পাঁচ ধরনের ফল সাজিয়ে জামাই-এর মঙ্গল কামনায় শাশুড়ির দল ‘জামাই ষষ্ঠী'-র দিনে যে ব্রত রক্ষায় ব্রতী হন তার সারমর্মটা কী?


সনাতন ধর্মে দেবী ষষ্ঠী, মাতৃত্বের প্রতীক বা জননী। তিনি সন্তান কোলে ধারণ করে থাকেন। মায়ের পূজা শেষে তার কাছে জামাইয়ের দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করা হয় এবং মেয়ে যাতে সন্তানবতী হয়- তার কামনা করা হয়।

দেবী ষষ্ঠীর সাথে দুটি সন্তান থাকলেও সাধারণভাবে ষষ্ঠী দেবীর নির্দিষ্ট কোনো অবয়ব বা মূর্তি নির্মান করে পূজা করা হয় না। মঙ্গল ঘটে আঁকা মূর্তি, শিলে পিটুলি দিয়ে তৈরি মূর্তি, ঘটে পোঁতা বটগাছের ডাল ইত্যাদিতে ষষ্ঠীদেবীর প্রতিমা কল্পনা করে পূজা করা হয়। ষষ্ঠীদেবীর পূজা সাধারণত বটগাছতলায়, বাড়ির আঙিনায়, নদী বা পুকুরের ধারে হয়ে থাকে। অনেক গ্রামে বট-অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে 'ষষ্ঠীতলা' বলে নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন ষষ্ঠীদেবী নির্দিষ্ট তিথিতে পূজিতা হন। মূলত গৃহস্থ নারীরা তেল-হলুদ-দই, ঘট, বটের ডাল ইত্যাদি উপকরণের মাধ্যমে পূজা নির্বাহ করে থাকেন, পূজাশেষে 'ব্রতকথা' শ্রবণ করে স্নান সেরে বাড়ি ফিরে ফলাহার করেন।

এছাড়াও সনাতন ধর্মে দেবী ষষ্ঠীকে যেহেতু মাতৃত্বের প্রতীক বা সন্তানদাত্রী হিসেবে বিশ্বাস করা হয়, সেহেতু শিশুর জন্মের দু'দিন পর 'সূতিকাষষ্ঠী', ষষ্ঠ দিনে 'ঘাটষষ্ঠী', একুশদিনে 'একুশে' এবং শিশুর বারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি জন্মতিথিতে 'জলষষ্ঠী' দেবীর পূজা করার নিয়ম রয়েছে। জৈষ্ঠ মাসে জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ছাড়াও শ্রাবণ মাসে লোটনষষ্ঠী, ভাদ্র মাসে চাপড়া বা মন্থনষষ্ঠী, আশ্বিন মাসে দুর্গাষষ্ঠী বা বোধনষষ্ঠী, অগ্রহায়ণ মাসে মূলাষষ্ঠী, পৌষ মাসে পাটাইষষ্ঠী, মাঘ মাসে শীতলষষ্ঠী, চৈত্র মাসে অশোকষষ্ঠী বা নীলষষ্ঠী পূজার প্রচলন আছে। বৈশাখ, আষাঢ়, কার্তিক ও ফাল্গুন মাসে ষষ্ঠী পূজার কোনো প্রচলন নেই।

বলা হয় ষষ্ঠী দেবীর বাহন বিড়াল। এবার দেখা যাক ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে কেনো বিড়ালকে কল্পনা করা হয়েছে ?

আমার বিভিন্ন লেখায় আমি বলেছি যে, দেব-দেবীদের বাহন বলে কিছু হয় না, কারণ, দেব-দেবীরা এমনিতেই সুপার পাওয়ারের অধিকারী, তাদের কোথাও যাওয়ার জন্য কোনো বাহনের প্রয়োজন হয় না, তারা এমনিতেই যেখানে খুশি যখন তখন যেতে পারেন। দেব-দেবীদের সাথে যেসব পশু পাখি থাকে, তারা আসলে বহন করে বিশেষ কিছু তথ্য, যা জানলে মানুষের উপকার নিশ্চিত; এই সূত্রে দেখা যাক, ষষ্ঠী দেবীর বাহন বিড়াল আসলে মানুষের জন্য কোন বিশেষ তথ্যকে বহন করে চলেছে ?

চিকিৎসা শাস্ত্র বলছে, ‘বাধক’ রোগ, যা মাতৃত্বের পথে এক ধরণের বাধা, তা দূর করতে নারীদের পক্ষে বিড়ালের স্পর্শ খুবই উপকারী। বিড়ালের দুধ যে বিভিন্ন মেয়েলী রোগের মহৌষধ , তা Dictionary of Homeopathic Materia Medica গ্রন্থে বলা আছে। যে সকল কারণে মানুষের বাচ্চা হয় না , সেই সকল কারণ দূর করার শক্তিও বিড়ালের দেহে বর্তমান চিকিৎসা শাস্ত্র জানাচ্ছে।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি যে, দেবী ষষ্ঠী হলেন মাতৃত্বের প্রতীক আর মাতৃত্বের পথে বিভিন্ন রকম বাধা দূর করতে বিড়াল সাহায্য করে বলেই বিড়াল থাকে দেবী ষষ্ঠীর সাথে, যাতে আমরা অযথা বিড়ালকে বাড়ি থেকে না তাড়িয়ে বিড়ালের যত্ন ও পালন করে তার থেকে আমরা উপকার নিতে পারি।

বিড়ালকে যে খারাপ চোখে দেখা যাবে না এবং তার সম্পর্কে অযথা খারাপ কিছু বলা যাবে না, তার নির্দেশ দেওয়া আছে ষষ্ঠী দেবীর পাঁচালির গল্পে, সেই গল্পটি এরকম :

এক বাড়িতে দুই বউ ছিলো, এর মধ্যে ছোট বউ বিভিন্ন জিনিস চুরি করে খেতো আর বিড়ালের নাম দিতো, শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জিনিস চুরি করে খেয়েছে বলে বিড়ালকে সে অযথা মারতোও। বিড়ালের এই কষ্টের কথা দেবী ষষ্ঠী অবগত হয়ে সেই বউকে দেবী ষষ্ঠী নানারকম শাস্তি দিতে শুরু করে, একে একে তার সাতটি ছেলে এবং একটি কন্যা মারা যায়। এরপর অলক্ষুণে বলে স্বামী ও শাশুড়ি মিলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অন্যদিকে বড় বউ স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে থাকে।

ছোট বউ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে বনে গিয়ে কাঁদতে থাকে, সেই সময় মা ষষ্ঠী, এক বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে। ছোট বউ তার সন্তান মারা যাওয়ার কাহিনী বলে; বৃদ্ধা, ছোট বউকে বিড়ালের প্রতি তার খারাপ আচরণের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়, এতে ছোট বউ লজ্জা পায় এবং তার অমন আচরণের জন্য ক্ষমা চায়। বৃদ্ধা তখন ছোট বউকে বলে, বিড়াল, মা ষষ্ঠীর বাহন, বাড়ি ফিরে গিয়ে তুমি ভক্তি ভরে মা ষষ্ঠীর পূজা করো আর বিড়ালের প্রতি ভালো ব্যবহার করো, তাহলে তোমার কোনো সন্তান আর মারা যাবে না, আস্তে আস্তে স্বামী সংসার সব ফিরে পাবে।

এর পর ছোট বউ বাড়ি ফিরে মা ষষ্ঠীর পূজা করে এবং তার সুখ ফিরে পায়, এভাবে পৃথিবীতে মা ষষ্ঠীর পূজা চালু হয়ে যায়।

এই গল্পের আধ্যাত্মিক দিক বাদ দিলেও বা ষষ্ঠী দেবীর পূজা করলে সন্তান লাভ হয়, এমন গল্পকে বিশ্বাস না করলেও, জামাই ষষ্ঠীর কার্যকারিতা যে- জামাইকে বাড়িতে এনে তাকে খাইয়ে দাইয়ে কাপড় চোপড় উপহার দিয়ে জামাইকে খুশি রেখে নিজ কন্যার সুখকে নিশ্চিত করা বা রাখা তাতে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই; বর্তমানে সবকিছুকে বাদ দিলেও জামাই ষষ্ঠীর এটাই হলো বাস্তব বা কার্যকর কারণ। ষষ্ঠীর পর কন্যার বাড়ি থেকে ডালি ভ’রে কন্যার শ্বশুর বাড়িতে যে ফল-মূল দেওয়া হয়, এটাও কিন্তু জামাইয়ের বাড়ির লোকজনকে খুশি রেখে কন্যার সুখ শান্তিকে নিশ্চিত করার একটি কৌশল।

জামাই ষষ্ঠী প্রতি বছর হলেও এবং প্রতি বছর জামাইকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে এমন খাতির যত্ন করার নিয়ম থাকলেও, মূলত বিয়ের পর যে ষষ্ঠী আসে, তাতে জামাইকে অবশ্যই শ্বশুর বাড়ি বাধ্যতামূলক যেতেই হয়; এতে অন্য যে সুবিধাটি নিহিত আছে, তা হলো- বিয়ের সময় অনেক সময়ই নানা বিষয় নিয়ে বর ও কনে পক্ষের মধ্যে মনোমালিন্য হয়, যদি সেরকম কোনো ঘটনা ঘটে, সেই বিষয়গুলো যাতে জামাই মনে না রাখে এবং শ্বশুর বাড়ি যেতে বাধ্য হয়ে সব ভুলে সম্পর্ক ঠিকঠাক করতে বাধ্য হয়, জামাই ষষ্ঠীতে জামাইয়ের, শ্বশুরবাড়িতে বাধ্যতামূলক যাওয়ার এটাও একটা কারণ, যা শাস্ত্রকারদের মাথায় ছিলো এবং এসব ছোট ছোট কারণকে প্রাধান্য দিয়ে বিধি নিষেধ তৈরি করার জন্যই কিন্তু হিন্দুধর্ম ও কালচার গ্রেট।

এই হলো জামাই ষষ্ঠীর কারণ ও কাহিনী; আশা করছি, আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে বিষয়টি ক্লিয়ার হয়েছে।

জয় হিন্দ।

No comments:

Post a Comment