অবতারবাদ নিয়ে বিক্রম বর্মনের চুলকানির জবাব :
বিক্রম তার একটি পোস্টের শুরুতেই বলেছে,
"হিন্দু সমাজে অবতার বাদ নিয়ে হাজারো ভন্ড প্রাণীরা বোকা দের ঠকিয়ে ভণ্ডামি চালিয়ে যাচ্ছে হাজার দুহাজার বছর ধরে ।লোকনাথ ,চৈতন্য, অনুকূল,প্রণবানন্দ, রামকৃষ্ণ ,সাইবাবা এদের মধ্যে কিছু কিছু ভন্ড রা সাক্ষাৎ নিজেকে অবতার ভাবতো আর আমাদের নাদান হিন্দুরা অন্ধের মতো তা মেনে চলছে ।"
বিক্রমের এই কথার সাথে আমার কোনো দ্বিমত নেই; কারণ, বিক্রম সত্য বলেছে, আর যে সত্য বলবে তার সাথে আমার কোনো দ্বিমত থাকে না। পৃথিবীতে বিষ্ণুর অবতার ১০ টি নির্দিষ্ট, এনারা হলেন- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, কৃষ্ণ এবং কল্কি; এদের মধ্যে ৯ জনের আগমন অলরেডি ঘটে গেছে, বাকি আছে শুধু একজন, তিনি কল্কি। শাস্ত্রমতে তিনি আসবেন কলিযুগের শেষে এবং এসে অধর্মীদের বিনাশ করে সত্য যুগের শুরু করবেন।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, অনেকে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করে, কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, বিষ্ণুর অবতারগণ সনাতন ধর্মকে রক্ষা করার জন্য অবতীর্ণ হন, সনাতন ধর্মকে বিলুপ্ত করার জন্য নয়। বুদ্ধের মতবাদের কারণে সনাতন ধর্ম বিলুপ্ত হতে বসেছিলো, ৭ম শতাব্দীতে- শঙ্করাচার্য, রামানুজ, মাধব, কুমারিল ভট্টের মতো কিছু মাহাত্মার চেষ্টায় ভারতবর্ষে সনাতন ধর্ম আবার পুনর্জীবিত হয়, সুতরাং যার দ্বারা সনাতন ধর্মের ক্ষতি হয়, তিনি কিছুতেই বিষ্ণুর অবতার হতে পারেন না।
১০ অবতারের সংখ্যা মেলাতে অনেকে কৃষ্ণকেই বাদ দিয়ে সেখানে বুদ্ধকে আনেন, কিন্তু তারা ভুলে যান যে, একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হলেন বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার, অন্যান্যরা হলেন বিষ্ণুর আংশিক অবতার। আবার অনেকে বলরামকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করে না, তারা বলরামকে অনন্তনাগের অবতার বলে মনে করে, কিন্তু তারা হয়তো জানে না যে, শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গীতার ১০/২১ নং শ্লোকে বলেছেন, "আদিত্যগণের মধ্যে আমি বিষ্ণু" তার মানে যিনি শ্রীকৃষ্ণ, তিনিই বিষ্ণু; আবার শ্রীকৃষ্ণ ১০/২৯ নং শ্লোকে বলেছেন, "নাগগণের মধ্যে আমি অনন্ত", তার মানে যিনি শ্রীকৃষ্ণ, তিনিই অনন্ত; আর যেহেতু শ্রীকৃষ্ণই বিষ্ণু, তার মানে বিষ্ণুই অনন্ত, এই অনন্ত নাগের অবতার যদি বলরাম হয়, তাহলে বলরাম, বিষ্ণুর অবতার হয় কি না বলেন ? পুরাণ মতে- অনন্তনাগ হলো বিষ্ণুর সেবক, বিষ্ণু যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ রূপে পৃথিবীতে এসেছেন, তাই শ্রীকৃষ্ণের সেবা তথা তাকে বিভিন্ন কাজে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই রূপে বলরাম পৃথিবীতে আসেন।
যা হোক, এরপর বিক্রম বলেছে,
"এমন অন্ধবিশ্বাসী পাখন্ডি হিন্দু সমাজে ততদিন থাকবে যতদিন হিন্দুরা " বেদ" কে জানতে এবং বুঝতে না শিখবে ।"
- বেদকে বুঝলেই যে সবাই মহান জ্ঞানী হয়ে যায় না, সেটা তো বিক্রমের মতো আর্য সমাজীদের উল্টা পাল্টা কথা শুনলেই বোঝা যায়।
এর সাথে বিক্রম আরো বলেছে,
"বেদ বিরুদ্ধ যা গ্রন্থ আছে তা সব ত্রুটি পূর্ন ,এবং তাকে ত্যাগ করা অনিবার্য ,"
-সনাতন ধর্মে বেদ বিরুদ্ধ ব’লে কোনো গ্রন্থ নেই, রয়েছে বেদের চেয়ে আপডেট গ্রন্থ, যেহেতু বেদ হলো সনাতন ধর্মের মূল বা ভিত্তি গ্রন্থ। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলোতে নানারকম বিকৃতি প্রবেশ করেছে, যেগুলোকে আমরা বলতে পারি মিথ্যা, তাই সেই মিথ্যাকে ত্যাগ করা অনিবার্য এবং যেহেতু বেদ বিরুদ্ধ গ্রন্থ বলে কিছু নেই, সেগুলোকে ত্যাগ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না।
এই একই প্যারায় বিক্রম আরো বলেছে,
বেদের মাত্র একটা মন্ত্র এর মাধ্যমে এই অবতার বাদ কে মিথ্যা এবং যুক্তিহীন প্রমান করা যাবে তা হলো যজুর্বেদ এর 40 অধ্যায় 8 নং মন্ত্রে বলেছে - ঈশ্বর জন্ম গ্রহন করেনা, তিনি শরীর ধারণ করতে পারেনা, তিনি সর্ব ব্যাপক ।"
-আর্য সমাজের অগ্নিবীর কর্তৃক প্রকাশিত বেদ থেকে এই মন্ত্রের একটি স্ন্যাপশট এই প্রবন্ধের সাথে যুক্ত করে দিয়েছি, সেখানে দেখুন ইংরেজিতে এই মন্ত্রের অনুবাদ লেখা হয়েছে-
"The Supreme Soul is omnipresent, omnipotent, without body, without any flaw, without sinews, pure, sinless, visionary poetic creator and omniscient, existent
in the heart and mind of all, transcendent, self-existent, who for the infinite ages of eternity creates, organises, reveals and sustains all the forms of existence as they
are and ought to be."
এর বাংলা হলো- সর্বপ্রধান আত্মা সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, দেহরহিত, ত্রুটিহীন, স্নায়ুবিহীন, খাঁটি, পাপমুক্ত, কল্পনাপ্রবণ কাব্যিক স্রষ্টা, সর্বজ্ঞ, সবার হৃদয় এবং মনে যার অস্তিত্ব বিদ্যমান, সর্বোৎকৃষ্ট, নিজেই নিজের অস্তিত্বরক্ষাকারী, যিনি অসীম যুগের সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন, সংগঠিত করেছেন, প্রকাশিত করেছেন, সর্বপ্রকার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছেন, যাদেরকে টিকিয়ে রাখা উচিত। (অনুবাদ ১০০% শুদ্ধ নাও হতে পারে।)
এখানে যে বলা হয়েছে, সর্বপ্রধান আত্মা অর্থাৎ পরমাত্মা দেহরহিত, এটা নিয়েই বিক্রমের- যত মাস্তানি যে, ঈশ্বর কখনো দেহধারণ করেন না, তাই দেহধারী শ্রীকৃষ্ণ কখনো ঈশ্বর নয়।
এর আগে আমি বলেছি যে বেদের রচয়িতা জ্ঞাত ৩৫৫ জন এবং অজ্ঞাত আরো কয়েকজন এবং বেদ রচয়িতা সকল ঋষির জ্ঞান বুদ্ধি সমান ছিলো না; সুতরাং কোনো একজন ঋষির একটি মন্ত্রকে ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কিন্তু বিক্রম আমার কথাকে স্বীকার করে না, সে বলে- চারজন ঋষির কাছে বেদ প্রকাশিত হয়েছে এবং তারা অন্য ঋষিদের আত্মায় তা স্থানান্তর করেছে; এসব ভাবের কথা এবং কোনো ভাবের কথায় আমার কোনো আস্থা নেই, আমি প্র্যাকটিক্যাল লোক এবং সবকিছু বাস্তবতার দৃষ্টিতে বিবেচনা করি। মানবরূপে জন্মগ্রহণকারী ঋষিরা বেদ রচনা করেছে, তাদের নাম পরিচয়ও আমরা পাই, সুতরাং এর উপরে কোনো কথা নেই। এই সকল ঋষিরা যে শুধু ঈশ্বরের কথা চিন্তা করেই বেদের মন্ত্রগুলো রচনা করেছে, এমন নয়, তারা এমন সব মন্ত্র রচনা করেছে যেগুলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো কিছুকে ব্যাখ্যা তো করেই না, এমনকি সেগুলো সাধারণ মানুষের জন্যও কোনো কাজে লাগে না বা লাগবে না। এরকম অযথা বিষয় নিয়ে রচিত অনেক মন্ত্র যেমন বেদে আছে, তেমনি ঋষি বিশ্বামিত্র এবং ঋষি বশিষ্ঠের ঝগড়াঝাটির বিষয়ও বেদের মন্ত্রের বিষয়বস্তু, এই মন্ত্রগুলো বিশ্বসৃষ্টির কোন বিষয়কে ব্যাখ্যা করে ? বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠের এই ঝগড়াঝাটির বিষয় পাওয়া যাবে ঋগ্বেদের ৩/৫৩/২৩, ২৪ এবং ৭/১০৪/১৩-১৬ মন্ত্রে। শুধু তাই নয়, বিক্রম যজুর্বেদের যে মন্ত্রটি নিয়ে মাস্তানি করে এবং শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয় বলে লাফায় এবং এটাও বলে যে বেদ মানবরূপী ঋষিদের দ্বারা রচিত নয়, সেই মন্ত্রটিও ফটোপোস্ট হিসেবে দিয়ে দিয়েছি, দেখুন, সেই মন্ত্রের রচয়িতা হিসেবেও ড. তুলসী রাম, দীর্ঘতমা ঋষির নাম দিয়ে দিয়েছে, শুধু এটাই নয়, যজুর্বেদের প্রতিটি মন্ত্রেরই রচয়িতা হিসেবে একজন করে ঋষির নাম দেওয়া আছে আর্য সমাজের অগ্নিবীর কর্তৃক প্রকাশিত বেদে।
সুতরাং বেদের মন্ত্র মানেই যে চুড়ান্ত কিছু নয় এবং এটাতেই যে অবতারবাদের শেষ নয়, সেটা এসব বিষয় থেকে প্রমাণিত।
যা হোক, এরপর বিক্রম- গীতার ৪/৭ নং শ্লোক নিয়ে বলেছে-
" যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিঃ ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদা আত্মনম্ সৃজামি অহম্ ।।৭
অর্থ- হে ভরত যখনই ধর্মের অধঃপতন হয়এবং অধর্মের অভূত্থান হয় তখনই আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতির্ন হই।
অর্থাৎ ঈশ্বর শ্রী কৃষ্ণ অধর্মের সময় জন্ম নিয়ে সেই অধর্ম কে পতন করে ।
আমি :- প্রথমেই বলে রাখি কৃষ্ণ একজন যোগী ,এই শ্লোকে 'আমি' বলতে ঈশ্বর কে বোঝানো হয়েছে কৃষ্ণ কে নয় । গীতায় তাকে অনেকবার যোগীরাজ এবং যোগেশ্বর অর্থাৎ যে যোগের মাধ্যমে ঈশ্বর কে লাভ করে । হিন্দুরা গীতার অর্থ না বুঝে উল্টো পাল্টা বকে !"
-গীতার অর্থ না বুঝে হিন্দুরা নয়, আর্যরাই উল্টোল্টাল্টা বকে। যোগ মানে অঘটন্ ঘটানোর ক্ষমতা, আর যোগেশ্বর মানে সেই ক্ষমতা যার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় আছে। শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর বলা হয়েছে এই কারণে যে তাঁর মধ্যে ঈশ্বরের ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় আছে, তাই তিনি যেকোনো ঘটনা ঘটাতে পারেন, তাহলে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর হলো না কীভাবে ?
বিক্রম বলেছে- "এই শ্লোকে 'আমি' বলতে ঈশ্বর কে বোঝানো হয়েছে কৃষ্ণ কে নয় ।"
-এই আমিটা বলেছে কে ?
-শ্রীকৃষ্ণ।
-তাহলে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর হয় না কীভাবে ?
শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলছেন, জগতে ধর্মের অধঃপতন হলে আমি অবতীর্ণ হই। আর বলদা বিক্রম বলছে, এই আমি শ্রীকৃষ্ণ নয়, এই আমি বলতে অন্য ঈশ্বরকে বোঝানো হয়েছে। মানসিক হসপিটাল কি এর বাড়ি থেকে খুব দূরে ? কেউ একে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করায় না কেনো ?
এরপর বিক্রম বলেছে অবতারবাদীরা নাকি বলে যে-
" আর্যসমাজি ভন্ড তারা নাস্তিক কৃষ্ণ কে ঈশ্বর ভাবেনা । এখানে ঈশ্বর জন্ম নেয় এইটাই বলা আছে । তোমরা গীতা পারোনা !
বিক্রমকে আগেও বলেছি, আবারও বলছি- আমার সাথে পাঙ্গা দিতে হলে আগে বাংলা লেখাটা ভালো করে শিখ। ঠিক জায়গায় বিরামচিহ্ন ব্যবহার না হলে যে বাক্যের অর্থই পাল্টে যা্য়, এটা তো সবাই জানে। " আর্যসমাজি ভন্ড তারা নাস্তিক কৃষ্ণ কে ঈশ্বর ভাবেনা ।' এই বাক্যটিকে আমি প্রথমে পড়েছিলাম এইভাবে- "আর্যসমাজিরা ভন্ড, তারা নাস্তিক কৃষ্ণকে ঈশ্বর ভাবেনা ।" এই বাক্য অনুসারে কৃষ্ণই নাস্তিকে পরিণত হয়েছে। পরে বাক্যটি আরো কয়েকবার পড়ে বুঝলাম, এই বাক্যে আসলে বিক্রম বলতে চেয়েছে,
"আর্যসমাজিরা ভন্ড, তারা নাস্তিক, কৃষ্ণকে ঈশ্বর ভাবেনা ।" তারপর আবার ঐ প্যারাতেই লিখেছে- "তোমরা গীতা পারোনা !" কিন্তু বাক্যটি হবে "তোমরা গীতা পড়ো না।"
-তিনটি বাক্য লিখতে যার এতগুলো ভুল, নিজের বক্তব্য যে অন্যকে ঠিকমতো বোঝাতেই পারে না, সে যদি আসে সনাতন ধর্মের মতো গভীর জ্ঞান কাউকে বোঝাতে, তাকে কী বলবেন ?
আমি অবশ্য এদেরকে বলি মাতব্বর শ্রেণীর মূর্খ।
তোমরা গীতা পড়ো না। এর জবাবে বিক্রম লিখেছে,
"আচ্ছা আমরা গীতা পরিনা ? তো শোনো ! গীতা ১০/২৩ " বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি " এখানে বলেছে আমি বসু অর্থাৎ ৮ বসুর মধ্যে কৃষ্ণ আগুন । তাহলে কি বলবেন আগুন হয় কৃষ্ণ ? আগুন জড় বস্তু নাকি চেতন ?
- অগ্নি মানে সাধারণ অর্থে আগুন, এটা সবাই জানে, যে আগুন সবকিছুকে জ্বলে পুড়ে ছাই করে দেয়। কিন্তু কৃষ্ণ যে বলেছে বসুদের মধ্যে অগ্নি, এই অগ্নি বলতে কি কৃষ্ণ আগুনকে বুঝিয়েছেন ? দেখা যাক-
পৌরাণিক কাহিনী মতে- ধর্মের ঔরসে এবং দক্ষকণ্যা বসুর গর্ভে- ধর, ধ্রুব, সোম, অনল, অনিল, সাবিত্র, প্রত্যুষ ও প্রভাষ- এই আট বসুর জন্ম হয়। এই অষ্টবসুর মধ্যে একজনের নাম অনল, আর অনল মানে অগ্নি। এদেরকে উদ্দেশ্য করেই শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি; তাহলে এখানে শ্রীকৃষ্ণ অগ্নি বলতে কি সাধারণ আগুনকে বুঝিয়েছেন ?
তারপর বিক্রম বলেছে,
"গীতা ১০/২১ জ্যোতিস্কদের মধ্যে কিরনশালী সুর্য, মরুতদেও মধ্যে মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে চন্দ্র। এর মানে কি কৃষ্ণ ই সূর্য ,মরিচি, চন্দ্র ? এইবার ভাবুন তো নিজেরাই নিজেকে প্রশ্ন করুন ।"
-গীতার ১০/৩৯ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- এই বিশ্বচরাচরে কোনো কিছুই আমা ছাড়া হইতে পারে না। ১০/৪১ এ তিনি বলেছেন- এই পৃথিবীতে যাহা কিছু ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রী সম্পন্ন অথবা শক্তিসম্পন্ন দেখ, তাহাই আমার শক্তির অংশ হইতে উদ্ভূত বলিয়া জানিবে। ১০/৪০ এ বলেছেন- আমি যাহা কিছু বিভূতির কথা তোমাকে বললাম, তাহা আমার বিভূতি সমূহের সংক্ষেপ মাত্র।
এসবের প্রেক্ষিতে আমি বিক্রমকেই জিজ্ঞেস করছি- শ্রীকৃষ্ণ যদি বলেন যে আমিই সূর্য, মরিচী ও চন্দ্র, তাতে সমস্যা কী ?
তারপর বিক্রম বলেছে-
"গীতা ১০/৩৭ বাসুদেব পান্ডবদের মধ্যে ধনঞ্জয়,আমি মুনিদের মধ্যে ব্যাস । এখানে কৃষ্ণ বলছে আমি অর্জুন , আর আমি ব্যাসদেব ব্যাসদেব,কৃষ্ণ,অর্জুন এরা 3 জনে একই সময়ে বেঁচে ছিল , শাস্ত্র অজ্ঞ হিন্দুরা অর্জুন তাহলে কৃষ্ণের অবতার ? ব্যাসদেব ছিল কৃষ্ণর অবতার ? এইবার ভাবুন আপনাদের অবতার বাদ এর কি কোনো সত্য যুক্তি আছে কাল্পনিক মিথ্যা ধারণা ছাড়া ?"
-গীতার ১৮/৬১ নং শ্লোক অনুযায়ী পরমাত্মা সকল প্রাণীর মধ্যে জীবাত্মারূপে অবস্থিত; তার মানে পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ, পরমাত্মারূপে অবস্থিত; তাহলে শ্রীকৃষ্ণ কেনো বলতে পারবেন না যে তিনিই অর্জুন বা ব্যাসদেব ? আবির্ভাবের দিক থেকে ব্যাসদেব, শ্রীকৃষ্ণের সিনিয়র, আর অর্জুন জুনিয়র। শ্রীকৃষ্ণ যদি পরমাত্মারূপে সকলের মধ্যেই থাকেন, তাহলে ব্যাসদেবকে মরে কি শ্রীকৃষ্ণরূপে বা শ্রীকৃষ্ণকে মরে কি অর্জুন রূপে জন্ম নিতে হবে ? শ্রীকৃষ্ণের ব্রহ্মা বিমোহনা লীলা বলে একটা লীলা আছে। সেই লীলায় শ্রীকৃষ্ণের সকল সঙ্গী সাথীকে ব্রহ্মা একবার চুরি করে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে, শ্রীকৃষ্ণ ব্যাপারটি বুঝতে পেরে সন্ধ্যার বেলা বাড়ি ফেরার সময় শ্রীকৃষ্ণের যতজন সঙ্গী ছিলো, নিজেকে ততটিতে পরিণত করেন এবং তারপর প্রত্যেককে তার সঙ্গী সাথীদের রূপে রূপান্তরিত করে নিয়ে বাড়ি ফিরেন, ফলে কারো পিতা মাতাই আসলে বুঝতে পারে নি যে ছেলে হিসেবে যাদেরকে তারা মনে করছে, তারা আসলে তাদের ছেলে নয়, শ্রীকৃষ্ণই তাদের সন্তান রূপে তাদেরকে বাৎসল্য সুখ দিচ্ছি, এভাবে এক বছর ধরে প্রত্যেক পিতা মাতাকে শ্রীকৃষ্ণ নিজে তাদের সন্তানরূপে বাৎসল্য অর্থাৎ সন্তান সুখ দিয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের যদি একই সময়ে বহু হবার ক্ষমতা থাকে, তাহলে তার একই সাথে অর্জুন আর ব্যাসদেব হতে সমস্যা কোথায় ?
এরপর- ঈশ্বর সর্বব্যাপক, না একদেশীয় ? এই প্রশ্নের জবাব ঝাড়তে গিয়ে বিক্রম বলেছে-
" ভাবুন যে ঈশ্বর জায়গায় আছে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ঈশ্বর নেই । তাহলে ভাবুন ঈশ্বর কেন জন্ম নেবে অধার্মিক দের দমন করার জন্য ? সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ঈশ্বর নিজে একা করেন, যে ব্যাক্তি অধার্মিক ছিল যেমন রাবন, দুর্যধন ইত্যাদি এদের শরীরের মধ্যে কি ঈশ্বর ব্যাপাক ছিলোনা ? নিশ্চয়ই ছিল তাদের দেহ তে ,ঈশ্বর সর্ব শক্তিমান যে চাইলেই তাদের সেকেন্ডের মধ্যে বিন্যাস করতে পারবে । রাবন,কংস ইত্যাদিরা ঈশ্বর এর কাছে এক একটা কীট এর থেকেও কম , এই সমস্ত কীট কে বিনাশ করতে ঈশ্বর কে জন্ম নিতে হবে ? এইটা একটা বিনোদন ছাড়া কি ?
- পৃথিবীর সর্বত্রই বাতাস আছে এবং সেই বাতাসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছেড়ে দেওয়া রেডিও সিগন্যাল আছে, কিন্তু আমরা তখনই কোনো জায়গার বাতাসে কী পরিমান রেডিও সিগন্যাল আছে, তা শুনতে পাই, যখন সেই জায়গায় রেডিও বা বেতার যন্ত্র টা অন করে চ্যানেলগুলো ঘুরাতে থাকি। তার মানে কোন জায়গার বাতাসে অবস্থিত সিগন্যালগুলো তখনই এ্যাকটিভ হয় যখন রেডিও নামক একটি মহাশক্তিশালী যন্ত্র- যে যন্ত্র অদৃশ্য সিগন্যালগুলোকে শব্দে পরিণত করে- সেই যন্ত্রটা আমাদের কাছে থাকে, এর মানে হলো- পৃথিবীর সর্বত্র রেডিও সিগন্যাল থাকলেও, রেডিও নামক মহাশক্তিশালী যন্ত্রটার কারণেই সেগুলো আমাদের কাছে ধরা পড়ে বা এ্যাকটিভ হয়। এভাবেই পৃথিবীর সর্বত্র ঈশ্বর থাকলেও আমরা তখনই ঈশ্বরের গুন বা কার্যকারিতা বুঝতে পারি যখন মিনিমাম ছয়টি গুন সমৃদ্ধ কোনো অবতার বা ভগবানের জন্ম হয় বা সকল গুন নিয়ে যখন শ্রীকৃষ্ণ নামক ঈশ্বরের জন্ম হয়।
সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় ঈশ্বর অবশ্যই একা করেন, কিন্তু তিনি সেটা করেন একটি সিস্টেমের মাধ্যমে। ভারত বা বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই দেশের সব কিছু করেন, এটা হলো একটা থিয়োরি, এর মানে হলে দেশের ভালো বা মন্দ, সবকিছুর জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু দেশ পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী কি সকল কাজ একাই করেন ? অবশ্যই নয়। মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে দেশের সমগ্র প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত সিস্টেমে কাজ করে। একইভাবে ঈশ্বরও এই বিশ্বজগত পরিচালনা করে একটা সিস্টেমের মাধ্যমে, বিভিন্ন কাজ পরিচালনার জন্য যেমন প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন মন্ত্রী থাকে, তেমনি বিভিন্ন কাজ পরিচালনার জন্যও আছে বিভিন্ন দেব-দেবী। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজ যেমন শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী করে থাকেন, তেমনি জ্ঞানার্জনের জন্য আপনাকে সরস্বতী দেবীর আদর্শ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে, যে আদর্শ ঈশ্বর অনুমোদিত একটা সিস্টেমের আদর্শ।
কোনো সিনেমা বা গল্পে দেখবেন, কোনো অশুভ শক্তির চরিত্রকে যত শক্তিশালী করে তৈরি করা হয়, তাকে দমন করার জন্য শুভ শক্তির চরিত্রকে তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী করে তৈরি করা হয়। এটা একটা সিস্টেম, যে সিস্টেম বলে যে অশুভ শক্তি কখনো শুভ শক্তির উপর চিরস্থায়ী বিজয় অর্জন করতে পারে না।
কোনো সাধারণ দৃষ্কুতকারীকে দমন করার জন্য সাধারণ মানুষই যথেষ্ট, কিন্তু যখন দৃষ্কৃতকারী হয়ে উঠে প্রচণ্ড শক্তিশালী, যাকে সাধারণ মানুষ দমন করতে পারে না, তখনই প্রয়োজন হয় তার চেয়েও প্রচণ্ড শক্তিশালী কোনো সত্ত্বার, হিন্দু শাস্ত্রে যাকে বলা হয়েছে অবতার।
একজন ইসলামি জঙ্গীকে দমন করার জন্য একজন বা কয়েকজন পুলিশই যথেষ্ট, কিন্তু কয়েকশত বা কয়েক হাজার ইসলামি জঙ্গী যখন একত্রিত হয়ে আইএস এর মতো জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলে, তখন তাদেরকে দমন করার জন্য একটি বৃহৎ শক্তির প্রয়োজন, এই বৃহৎ শক্তির পৌরাণিক রূপই হলো অবতার, যিনি একাই ঘটাতে পারেন বৃহৎ কোনো অঘটন, যেমন- পরশুরাম কর্তৃক ২১ বার অত্যাচারী ক্ষত্রিয়দেরকে দমন বা তার প্রতি অনুগত হয়ে সংগঠিত হতে পারে একটি বৃহৎ শক্তি, যেমন- রামের অনুগত বিশাল বাহিনী দমন করে রাবনের শক্তিকে; অবতারের শিক্ষা আসলে এভাবেই লুকিয়ে আছে সামাজিক বাস্তবতায়।
দুর্যোধনকে, শ্রীকৃষ্ণ যখন তখন হত্যা করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে একটি সিস্টেমের মাধ্যমে তাকে বিনাশ করেছেন, যার কারণে মহাভারতের মতো একটি শিক্ষা লোকসমাজে প্রচারিত হয়েছে এবং টিকে আছে, যা মানুষকে যুগ যুগ ধরে পথ দেখাচ্ছে এবং দেখাবে।
অবতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিক্রম বলেছে- "অবতার এর অর্থ হলো অবতারন করা মানে ওপর থেকে নামা যে ঈশ্বর সর্ব ব্যাপক তার নামা বা ওঠা আসে কোথা হইতে ? "
-অবতরণ শব্দের সাথে অবতার শব্দের উচ্চারণগত মিল থাকলেও অবতার শব্দের অর্থ অবতরণ নয়, অবতার শব্দের অর্থ আবির্ভূত হওয়া, সুধীর চন্দ্র সরকারের পৌরাণিক অভিধান খুললে আপনারা আমার কথার সত্যতার প্রমাণ পাবেন। এর মানে হলো অবতার শব্দের অর্থ এবং তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিক্রম যা বলেছে, তা হচ্ছে বলদার গু।
বিক্রম আরো বলেছে-
"ঈশ্বর নিজ কর্ম অনুযায়ী চলেন এবং প্রকৃতি এবং জীব কেও নিয়ম অনুযায়ী চালান । ঈশ্বর এর কর্ম হলো সৃষ্টি, স্থিতি,প্রলয় এবং সমস্ত জীবের পাপ পূর্ণের ফল ফল দেওয়া ।"
-বিক্রমের মতে ঈশ্বর তো দেহ ধারণ করেন না, তাহলে ঈশ্বরকে কর্ম করতে হবে কেনো ? আমরা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মানি, তাই আমাদের ঈশ্বর লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করেন, যে কথা তিনি গীতার ৩/২৩,২৪ নং এ বলেছেন। সুতরাং বিক্রমের ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা যে স্পষ্ট নয়, তা এখানে প্রমাণিত।
বিক্রম যে বলেছে- ঈশ্বরের কর্ম হলো সমস্ত জীবের পাপ পূণ্যের ফল দেওয়া। এই পাপ পুণ্যের ফল- মানুষ, কি মানুষকে দেয় না ? কেউ অন্যায় করলে লোকজন ধরে কি তাকে শাস্তি দেয় না ? বা কেউ কোনো ভালো কাজ করলে লোকজন তাকে পুরস্কৃত করে না ? অবশ্যই দেয় বা করে। তাহলে এসব ক্ষেত্রে মানুষ কি ঈশ্বরের কাজ করছে না ? অবশ্যই করছে, তাহলে মানুষই তো ঈশ্বর, কিন্তু মানুষ পূর্ণ শক্তিমান ঈশ্বর নয়। ঈশ্বরের শক্তির যতটুকু অংশ কোনো মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, সেই মানুষ সেই পরিমাণ শক্তিমান। ঈশ্বরের এই শক্তি যখন কোনো মানুষের মধ্যে অধিক মাত্রায় থাকে, যা মিনিমাম ছয়টি গুনকে প্রকাশ করতে পারে, তখন সেই মানুষকে বলা হয় অবতার বা ভগবান। কিন্তু যখন কোনো মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের শক্তি পূর্ণমাত্রায় থাকে এবং তিনি নিজের ইচ্ছামতো যা খুশি ঘটাতে পারেন, তখন তিনি হন ঈশ্বর, যেমন - শ্রীকৃষ্ণ।
বিক্রম তার পোস্টের এক স্থানে বলেছে- মূর্তি পূজা শাস্ত্র বিরোধী।
শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৭/২১,২২ নং শ্লোকে কেনো বলেছেন,
"যে যে ভক্ত ভক্তিযুক্ত হইয়া যে যে দেব মূর্তি অর্চনা করিতে ইচ্ছা করে, আমি সেই সকল ভক্তের সেই সেই দেবমূর্তিতে ভক্তি অচলা করিয়া দিই। সেই ভক্তি নিয়া সে সেই দেবমূর্তির অর্চনা করিয়া থাকে এবং সেই দেবতার নিকট হইতে নিজ কাম্যবস্তু লাভ করিয়া থাকে। প্রকৃতপক্ষে আমিই সেই কামনা পূর্ণ করিয়া থাকি, কেননা সকল দেবতা আমারই অঙ্গস্বরূপ।"
-মূর্তি পূজা যদি শাস্ত্র বিরোধী হয় তাহলে শ্রীকৃষ্ণ গীতায় এই কথাগুলো কেনো বলেছেন ?
তারপর বিক্রম গীতার ৪/৭,৮ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য বলেছে-
"তোমরা যদি তবুও এই গীতা ৪/৭ শ্লোক কে অবতার ভাবো তাহলে তোমাদের যুক্তিতেই এই শ্লোক কে ডাহা মিথ্যা প্রমান করে দেবো এবং কৃষ্ণ মিথ্যা বাদী ছিল ।। দেখুন ! সাধারণ কিছু উদাহরণ যেমন :- হিন্দুরা প্রায় 1200 বছর ধরে বিদেশি মুসলিম এবং ইংরেজ দের দাস হয়ে ছিল । এসেছিল ঈশ্বর এর কোনো অবতার ? তৈমুর লং প্রায় 1 লক্ষ এর মতো হিন্দু হত্যা করেছিল ! এসেছিল কোনো অবতার অধর্ম কে বিনাশ করতে ? সব থেকে হিন্দু হত্যা করেছে মুঘল সম্রাট রা এসেছিল কোনো অবতার ? দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বাংলায় ৫০শে মনন্বতর লক্ষ লক্ষ হিন্দু কে মারা হয়েছিল না খাইয়ে এসেছিল কোনো অবতার ? অথবা ঈশ্বর জন্ম নিয়েছিল ভাই রা একটু বলুন অযোধ্যা রাম মন্দির, কাশিবিশ্বনাথ মন্দির ভাঙা হয়েছিল এসেছিল কোনো অবতার ? তাহলে কি প্রমান হলো তোমাদের অবতার যুক্তিতে ?
-এখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যখনই প্রয়োজন হয়, তখনই তিনি অবতীর্ণ হন, এই অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হলো মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান, যে শিক্ষাগুলো তিনি অলরেডি- পরশুরাম, রাম এবং শ্রীকৃষ্ণ হিসেবে দিয়ে গেছেন। মধ্যযুগে হিন্দুরা নানাভাবে বিদেশী শক্তির কাছে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এই কারণে যে- তারা অবতারগণের শিক্ষাকে ভুলে গেছে। অবতারগণের শিক্ষাকে ভুলে না গিয়ে যদি হিন্দুরা শক্তি অর্জন ও রাজ্য সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দিতো এবং একতাবদ্ধ থাকতো, তাহলে হিন্দুদের ক্ষতি কেউ করতে পারতো এবং এখনও হিন্দুরা যে মুসলমানদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার, তার কারণ অবতারগণের শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ না করা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডবদেরকে নানাভাবে সহায়তা করলেও, শেষে ভীম ও দুর্যোধনের লড়াইয়ে ভীমকে কোনো সাহায্য করেন নি, এর কারণ হলো মানুষকে নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে এবং সেই লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য শক্তি অর্জন করতে হবে।
সুতরাং যে শিক্ষা, অবতারগণ একবার দিয়ে গেছেন, সেই শিক্ষা আবার দেওয়ার জন্য কোনো অবতারের জন্ম হবে, এটা ভাবা মূর্খতা। শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে অবতারের পূর্ণতা লাভ করেছে, সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ প্রদেয় শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে, কল্কি নামে একজন অবতার আসবেন বলে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কিন্তু তার কার্যকলাপে আমাদের কোনো লাভ হবে না; কারণ, তিনি কলিযুগের শেষ অধর্মকে বিনাশ করে সত্যযুগের শুরু করবেন, কিন্তু কলিযুগ শেষ হতে এখনও অনেক বাকি, সুতরাং কল্কি বা কোনো অবতারের আবির্ভাবের আশায় বসে না থেকে শ্রীকৃষ্ণ প্রদর্শিত পথে যদি আমরা এগিয়ে যাই, আমরা সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। সুতরাং গীতার ৪/৭ নং শ্লোকের জন্য বিক্রম, শ্রীকৃষ্ণকে যে মিথ্যাবাদী বলেছে, এটা তার বোঝার ভুল মাত্র।
প্রথমে বিক্রম গীতার ৪/৭ শ্লোক অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণকে মিথব্যাদী বললেও পরে শ্রীকৃষ্ণ যে মিথ্যাবাদী নয়, সেটা বোঝাতে গিয়ে বলেছে,
"শুনুন এই শ্লোকে কোনো কিছুই ভুল নেই তোমাদের বোঝার ভুল , তোমরা শাস্ত্র চর্চা ( বেদ উপনিষদ মনুস্মৃতি দর্শন ) না করে ভন্ড দের কথার চালায় হিন্দুদের আজ এই অবস্থা !
গীতার সেই শ্লোক গুলোতে কি বোঝাতে চেয়েছে দেখুন
গীতা ৪ অধ্যায়
পরিত্রানায় সাধুনাম বিনাশায়ঃ চ দুস্কৃতম্ ।ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে ।।৮
সাধুদের পরিত্রান (পরিত্রানায় সাধুনাম) দুস্কৃতকারীদের বিনাশ করে (বিনাশায়ঃ চ দুস্কৃতম্) ধর্ম সংস্থাপন করি আমি যুগে যুগে (ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে)এখানে আপনি হয়তো ভাবছেন, আমাদের তো চার যুগ অতএব প্রতি যুগে তিনিই এসে ধর্ম সংস্থাপন করেন।
কিন্তুু উপরের পর্যালোচনা অনুযায়ী এখানে আমাদের কিছু কাকতালীয় রয়েছে আর এটাই করেছে সনাতনের মহাসর্বনাশ।প্রকৃত অর্থে এখানে ভগবান বোঝাতে চেয়েছিলেন যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মবৃদ্ধি হয় তখনই সাধুদের পরিত্রান ও দুস্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য তাহাদিগের অর্থাৎ মনুষ্যদিগের আত্মাদিগকে সৃজন করেন অর্থাৎ ন্যায় অন্যায় বুঝার জ্ঞান দান করেন। আর এভাবেই যুগ যুগ ধরে তিনি ধর্ম সংস্থাপনকরে আসছেন।"
- বিক্রমকে বলছি, বাজারে যেসব গীতা পাওয়া যায়, সেসব গীতার মাধ্যমে তুমি তোমার এই কুঅর্থকে, লোকজনকে বিশ্বাস করাতে পারবে না, তুমি নিজেই তোমার মতো করে গীতা অনুবাদ করো, তাহলে হয়তো তো তোমার মতো দুচারজন বলদাকে তা বিশ্বাস করাতে পারবে। আর হ্যাঁ, এখানে আরেকটা কথা, তুমি তো শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বা ঈশ্বর বলে মনে করো না, তাহলে এই প্যারায় শ্রীকৃষ্ণকে বোঝাতে ভগবান শব্দ ব্যবহার করলে কেনো ?
অবতারবাদের পোস্টে বিক্রমের শেষ আক্রমন হলো- শাস্ত্র বলতেই নাকি শ্রীকৃষ্ণ বেদকে বুঝিয়েছেন, এ প্রসঙ্গে বিক্রমের বকবকানি হলো-
"শাস্ত্র গ্রন্থ না পড়ে অন্ধবিশ্বাসী পৌরাণিক মিথ্যা কাহানি পড়ার ফল এগুলো । কৃষ্ণ কে গীতায় বেদ এবং অন্যান্য শাস্ত্রর কথা এতবার বলেছে সেগুলো তাদের চোখে পড়েনা !
গীতা ১৬ অধ্যায়
যঃ শাস্ত্রবিধিম্ উত্সৃজ্য বর্ততে কামকারত ॥
ন সঃ সিদ্ধিম্ অবাপেনাতি ন সুখেন ন পরাম্ গতিম্ ॥২৩॥
অর্থ-কিন্তু শাস্ত্রবিধি ( বেদ) পরিত্যাগ করে যে কামাচারে বর্তমান থাকে সে সিদ্ধি বা সুখ বা পরা গতীলাভ করতে পারে না।
তস্মাত্ শাস্ত্রম্ প্রমানম্ তে কার্য অকার্য ব্যবস্থিতৌ ॥
জ্ঞাতা শাস্ত্র বিধান উত্তম্ কর্ম কর্তুম্ ইহ অর্হসি ॥২৪॥
অর্থ-অতএব কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই একমাত্র প্রমাণ। অতএব শাস্ত্রিয় বিধি নিষেধের স্বরুপ জেনে কর্ম করা উচিত যাতে পারমার্থিক উন্নতি লাভ করা যায়।
-এই শ্লোক দুটোতে আসলেই কী শাস্ত্র বলতে বেদকে বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে আমি আর কিছু বলবো না, আপনাদের প্রত্যেকের বাড়িতে নিশ্চয় একটি করে গীতা আছে, সেই গীতা খুলে এই শ্লোকগুলো দেখুন তো সেখানে শাস্ত্র বলতে বেদকে বোঝানো হয়েছে কি না ?
এই দুটো শ্লোকের আলোচনায় শ্রী জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, তার গীতায় বলেছেন, "শাস্ত্র বলিতে শ্রুতি, স্মৃতি পুরাণাদি সকলই বোঝায়।" আমিও মনে করি তাই- শাস্ত্র বলতে শুধু বেদকে বোঝায় না, শাস্ত্র বলতে- বেদ থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি সকলকেই বোঝায়। কিন্তু বিক্রম, শাস্ত্র বলতে শুধু বেদকেই বোঝে, যার কোনো শাস্ত্রীয় স্বীকৃতি নেই।
তারপর বিক্রম গীতার ৮/২৮ নং শ্লোক এবং অর্থ বলেছে-
"বেদেষু যজ্ঞেষু তপষু চ এব
দানেষু যত্ পুন্য ফলম্ প্রদিষ্টম্ ।
অত্যেতি তত্ সর্বমিদম্ বিদিত্বা
যোগী পরম্ স্থানম্ উপৈতি চ আদ্যম্ ।।
অর্থ-ভক্তিযোগ অবলম্বন করলে তুমি কোন কালেই বঞ্চিত হবে না। বেদপাঠ, যজ্ঞ, অনুষ্ঠান, তপস্যা,দান ইত্যাদি যত প্রকার জ্ঞান কর্ম আছে সে সমুদয়ের যে ফল তুমি তা ভক্তিযোগ দ্বারা লাভ করে আদি ও পরম ধাম প্রাপ্ত হও।
কিন্তু জগদীশ চন্দ্র ঘোষের গীতা অনুযায়ী এই শ্লোকের প্রকৃত অর্থ হলো- বেদাভ্যাসে, যজ্ঞে, তপস্যায় এবং দানাদিতে যে সকল পুণ্যফল নির্দিষ্ট আছে, এই তত্ত্ব জানিয়া যোগী পুরুষ সে সকল অতিক্রম করেন এবং উতকৃষ্ট আদ্যস্থান (মোক্ষ) প্রাপ্ত হন।
এই শ্লোকের মধ্যে যে বেদপাঠ এবং যজ্ঞের কথা বলা আছে, সেটা নিয়েই বিক্রমের যত ফড়ফড়ানি, বেদপাঠ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যজ্ঞ বলতে আসলে শ্রীকৃষ্ণ কোনধরণের যজ্ঞকে প্রাধান্য দিয়েছেন, গীতার আলোকেই সেটা এবার দেখা যাক-
গীতার ৪/৩৩ নং শ্লোকে বলা আছে-
"শ্রেয়ান্ দ্রব্যময়াদ্ যজ্ঞাজ্ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ।
সর্বকর্মখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।।"
এর অর্থ হলো- হে পরন্তপ, দ্রব্যসাধ্য দৈবযজ্ঞাদি হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ; কেননা ফলসহিত সমস্ত কর্ম নিঃশেষে জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয়।
আর এই জ্ঞানযজ্ঞ যে কী, সেটা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতার ১৮/৭০ নং শ্লোকে, এভাবে-
"অধেষ্যতে চ য ইমং ধর্ম্যং সংবাদমাবয়োঃ।
জ্ঞানযজ্ঞেন তেনাহমিষ্টঃ স্যামিতি মে মতিঃ।।
এর অর্থ- যিনি আমাদের এই ধর্মসংবাদ (গীতাশাস্ত্র) অধ্যয়ন করিবেন, তিনি জ্ঞানযজ্ঞ দ্বারা
আর এই গীতাশাস্ত্র অধ্যয়নকারী এবং ব্যাখ্যাকারী ব্যক্তিই যে শ্রীকৃষ্ণের সবচেয়ে প্রিয়পাত্র, সে কথা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতার ১৮/৬৯ নং শ্লোকে, এভাবে-
"ন চ তস্মান্মনুষ্যেষু কশ্চিন্মো প্রিয়কৃত্তমঃ।
ভবিতা ন চ মে তস্মাদন্যঃ প্রিয়তরো ভুবি।"
এর অর্থ- মনুষ্যমধ্যে গীতাশাস্ত্র ব্যাখ্যাকারীর চেয়ে আমার অধিক প্রিয় আর কেহ নাই এবং এই জগতে তাঁহার চেয়ে অধিক প্রিয় আমার কেহ হইবে না।
সুতরাং গীতার ৮/২৮ নং শ্লোকের কথা উল্লেখ করে বিক্রম বেদপাঠ ও যজ্ঞের বিষয়টা ফোকাস করে যে বেদকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সেখানে আসলে যজ্ঞ বলতে জ্ঞানযজ্ঞকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যে জ্ঞানযজ্ঞ হচ্ছে গীতাশাস্ত্র আলোচনা এবং গীতার আলোচনা যে বেদের আলোচনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সে কথা তো শ্রীকৃষ্ণ গীতার ১৮/৬৯ নং শ্লোকেই বলে দিয়েছেন।
বিক্রম তার পোস্টের একেবারে শেষ লিখেছে,
"হিন্দুরা মানুষ হও । আর বুদ্ধির মধ্যে যে অন্ধবিশ্বাস এর তালা মারা আছে তা খুলে দেও তাহলেই ধর্ম কে ঠিক জানতে পারবেন তার আগে নয়"
-হিন্দুরা চিরদিনই মানুষ এবং তারা মুসলমান, খ্রিষ্টান বা আর্যদের মতো কোনো এক কাল্পনিক ঈশ্বরে অন্ধবিশ্বাসী নয়, আর আর্যরা সনাতন ধর্মকে যে কতটা সঠিকভাবে বুঝে, তার প্রমাণ বিক্রমের কয়েকটি পোস্টের জবাব দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি, এটাতেও দিলাম।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:
Post a Comment