Thursday, 17 September 2020

বিশ্বকর্মার বাহন হাতি কেনো ?


বিশ্বকর্মার বাহন হাতি কেনো ? 

এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিশ্বকর্মা পূজার মূল তত্ত্ব ও এই পূজা করার তাগিদ।

শিল্পী ও নির্মাতাদের দেবতা হলেন বিশ্বকর্মা, এজন্য বিশ্বকর্মাকে বলা হয় দেব শিল্পী, তিনি দেবতাদের প্রয়োজনীয় সকল অস্ত্রপাতি এবং যানবাহনও তৈরি করে দেন। বিশ্বকর্মার চার হাত, তিনি হাতির পিঠে বসে থাকেন, তার চার হাতের এক একটিতে থাকে- দাঁড়িপাল্লা, হাতুরি, ছেনী এবং কুঠার; এগুলোর তত্ত্ব জানলেই উপলব্ধি করা যাবে, বিশ্বকর্মার পূজা কী ও কেনো ?

ব্যবসায়ীরা যেমন বেশী করে গণেশ পূজা, তেমনি কারিগররা করে বিশ্বকর্মার পূজা, এর কারণ কী ?

দেব বিশ্বকর্মা হলেন নির্মান শিল্পী বা্ নির্মাতা, তাই যারা নির্মান পেশায় বা কারিগরী কাজে জড়িত, তারা এই দেবতার আশীষ কামনায় এনার পূজা করে থাকে, যাতে তারা তাদের পেশায় আরো দক্ষতা লাভ করতে পারে। নির্মাতা বা কারিগরদের যন্ত্রপাতির প্রতীক হলো হাতুড়ি, ছেনী ও কুঠার, তাই এগুলো হাতে ধরে থাকেন দেব বিশ্বকর্মা। কিন্তু তার হাতে দাঁড়িপাল্লা কেনো, দাঁড়ি পাল্লা তো ব্যবসায়ীদের প্রতীক ? 

যারা কোনো কিছু নির্মান করে বা বানায়, তারা তা বিক্রির জন্যই বানায়, এই হিসেবে নির্মাতাদেরও প্রধান উদ্দেশ্য ব্যবসা ই, এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বকর্মার হাতে দাঁড়িপাল্লা থাকতেই পারে, কিন্তু এর অন্য একটি ব্যাখ্যাও আছে।

দাঁড়িপাল্লা হলো ব্যালান্স বা ভারসাম্য বা সমতার প্রতীক। দাঁড়িপাল্লার দুই দিকে থাকে দুটো পাল্লা এবং এর পাল্লাকে ধারণকারী দণ্ডের মাঝখানে সমতাসূচক একটি কাঁটা থাকে, এই কাঁটা যখন ভূমির সাথে ৯০ ডিগ্রী কোন করে থাকে তখন পাল্লা দুটির সমতাকে নির্দেশ করে। 

দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা হলেন জ্ঞান ও কর্মের সমতার প্রতীক, সবাই জানেন যে, জ্ঞান ছাড়া কোনো কর্ম করা যায় না বা কোনো কিছু নির্মান করা যায় না; বিশ্বকর্মার হাতের দাঁড়িপাল্লার দুটো পাল্লা এটা নির্দেশ করে যে, তার এক পাল্লায় রয়েছে জ্ঞান এবং অন্য পাল্লায় রয়েছে কর্ম এবং তাতে জ্ঞান ও কর্মের একটা ব্যালান্সও রয়েছে। যে ব্যক্তির জীবনে এই জ্ঞান ও কর্মের ব্যালান্স রয়েছে, তার জীবনে উন্নতি হতে বাধ্য। কেউ যদি জ্ঞান অর্জন করে বসে থাকে অর্থাৎ জ্ঞানকে কাজে না লাগায় তার জীবনে যেমন উন্নতি হবে না, তেমনি যার জ্ঞান নেই, সেও কোনো কর্ম করতে পারবে না, এটা যেমন ধ্রুব সত্য, তেমনি এটাও চিরসত্য যে, যে ব্যক্তি কোনো একটি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন না ক'রে একাধিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে যায়, পরিশেষে সে আসলে সে কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারে না বা তার জ্ঞানকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না, এজন্যই প্রবাদ বাক্যের সৃ্ষ্টি হয়েছে- Jack of all trades, masater of none, এর মানে হচ্ছে যে ব্যক্তি সকল কাজ করতে চায় বা যায়, সে আসলে কোনো কাজই ঠিক মতো করতে পারে না; এটা ঘটে জ্ঞান ও কর্মের ভারসাম্যের অভাবে। যে জ্ঞান অর্জন করা হবে, সেটাকেই ঠিকমতো কাজে লাগাতে হবে, এটাই হলো জ্ঞান ও কর্মের ভারসাম্য, এই ভারসাম্যের আরেকটি ব্যাখ্যা হলো- অর্জিত জ্ঞানকে যথাযথভাবে কাজে না লাগিয়ে যদি আরও জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানের দিকে বেশী ঝুঁকে পড়ে, তাহলে কর্মকে অবহেলা করা হবে, পরিণামে আসবে দুঃখ, অভাব; আবার কর্মের দিকে বেশী ঝুঁকে পড়লে আসবে আধ্যাত্মিক অকল্যাণ । তাই জ্ঞান ও কর্মের ভারসাম্যহীনতা মানেই কোনো না কোনো সমস্যা। এই ভারসাম্যকে বজায় রাখার প্রতীকই হলো বিশ্বকর্মার হাতের দাঁড়িপাল্লা।

এবার নজর দিই বিশ্বকর্মার বাহন হাতির দিকে।

আমি আমার অনেক লেখায় আগেই বলেছি, দেব-দেবীরদের বাহন বলে কিছু হয় না; কারণ, দেব-দেবীরা এমনিতেই সুপার পাওয়ারের অধিকারী, এখানে সেখানে যাওয়ার জন্য তাদেরকে কারো উপর নির্ভর করতে হয় না। তাই দেব-দেবীদের বাহন বলে যাদেরকে আমরা মনে করি, সেগুলো আসলে বহন করে বিশেষ কিছু তথ্য, যা জানলে ও সেই মতো কাজ করলে মানুষের মঙ্গল বা কল্যান নিশ্চিত।

হাতি হচ্ছে স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, শক্তিশালী এবং মানুষ ছাড়া অন্যানী প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিমানও বটে। মানব সমাজে- নির্মাতা বা কারিগররাই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী শ্রেণী, যাদের কাছে অন্য সকল শ্রেণীর মানুষ আসতে বা প্রতীকি অর্থে নত হতে বাধ্য। আপনার পোষাক প্রয়োজন, আপনি দর্জির কাছে যেতে বাধ্য; আপনার ছুরি-বটি-দা প্রয়োজন, আপনি কামারের কাছে যেতে বাধ্য; আপনি বাড়ি বানাবেন, আপনি স্থাপত্য ইঞ্জিনিয়ার এবং রাজমিস্ত্রী, রং মিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির কাছে যেতে বাধ্য; আপনি ঘরের আসবাপত্র বানাবেন, আপনি সুতার বা কাঠমিস্ত্রির কাছে যেতে বাধ্য; আপনি গহনা বানাবেন, আপনি জুয়েলার বা সোনারের কাছে যেতে বাধ্য: আপনি সাইকেল, মোটর সাইকেল বা গাড়ি কিনবেন, আপনি এসবের নির্মাতা কোম্পানির কাছে যেতে বাধ্য; এভাবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আপনি কারিগর বা নির্মাতাদের কাছে জিম্মি। জীবনকে সহজ ও সুন্দর করতে হলে তাদের কাছে আপনাকে যেতেই হবে, এভাবে নির্মাতা বা কারিগর শ্রেণী হলো মনুষ্য সমাজে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শ্রেণী, যাদের জ্ঞান ও কর্মের কাছে আপনি মাথা নত করতে বাধ্য। মানব সমাজের এই শক্তিশালী শ্রেণীর প্রতীক হলো বিশ্বকর্মার সাথে থাকা হাতি, যে স্থলচরদের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী।

বিশ্বকর্মার থাকে চার হাত, এই চার হাত এই তথ্যও দেয় যে- শিল্পী, নির্মাতা বা কারিগড়রা, সাধারণ মানুষের মতো নয়, তারা বিশেষ শ্রেণীর এবং বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ, কেননা হাত হচ্ছে শক্তির প্রতীক, যার যত হাত তার তত বেশি শক্তি, এই সূত্রেই সর্বশক্তির প্রতীক হিসেবে দুর্গার দশ হাত।

প্রতিবছর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিন বিশ্বকর্মার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় যে- বিশ্বকর্মা, স্বর্গ, লঙ্কা নগরী, দ্বারকা নগরী এবং ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মান করেছেন। এছাড়াও বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিব এর ত্রিশূল, কুবের এর বিমান বা পুষ্পক রথ যা পরে রাবন ছিনাতাই করে, তা, ইন্দ্রের বজ্র এবং পুরীর প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মূর্তিও বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেছেন। 

ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলের ৮১ ও ৮২ নং সূক্তে বিশ্বকর্মা সম্পর্কে বলা আছে।

বিশ্বকর্মার পূজার মন্ত্র হলো-

"দেবশিল্পিন্ মহাভাগ দেবানাং কার্যসাধক।

বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টফলপ্রদ॥"

এবং বিশ্বকর্মার ধ্যান ও প্রণাম মন্ত্র হলো-

ওঁ দংশপালঃ মহাবীরঃ সুচিত্রঃ কর্মকারকঃ।

বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃকতঞ্চ বাসনামানো দণ্ডধৃক।। 

ওঁ বিশ্বকর্মণে নমঃ।

বিশ্বকর্মার মানস সন্তান- শিল্পী, কারিগর ও নির্মাতারা- বিশ্বকর্মার পূজা করে, বিশ্বকর্মার আশীর্বাদ ধন্য হয়ে, সমাজ সংসার ও সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে আরো ভূমিকা রাখুক, এই কামনায় বলছি-

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় হোক বিশ্বকর্মা এবং তার মানস সন্তানদের।

জয় হিন্দ।

No comments:

Post a Comment