Back to Vedas এর গীতা নিয়ে চুলকানির জবাব :
এরা প্রশ্ন তুলেছে, গীতার মধ্যে সঞ্জয় ও ধৃতরাষ্ট্র চরিত্রের উপস্থিতি কেনো ? কারণ, সঞ্জয় ও ধৃতরাষ্ট্রের মুখে যে সব কথাবার্তা বসানো হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিই উপনিষদের কথা নয়, যেহেতু গীতা মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে, গীতা হলো উপনিষদের সার, সেই উপনিষদরূপ গাভীর দোগ্ধা হলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন হলেন তার বাছুর। তাই গীতার সব কথা হতে হবে উপনিষদ থেকে, এখানে সঞ্জয় ও ধৃতরাষ্ট্রের মুখে বলা বাণীগুলো গীতার কথা নয়। এছাড়াও গীতার শেষ অধ্যায়ে নাকি বলা আছে যে- শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের মুখের কথাই কেবল গীতা, তাই গীতা হিসেবে সঞ্জয় ও ধৃতরাষ্ট্রের কথাগুলোকে তারা মানতে নারাজ। অথচ গীতার ১৮/৭০ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "যিনি আমাদের এই ধর্ম সংবাদ অধ্যয়ন করিবেন, তিনি জ্ঞান যজ্ঞ দ্বারা আমাকেই পূজা করিলেন, ইহাই আমি মনে করি।" এখানে কি বলা আছে যে, অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের কথাই শুধু গীতা ? আর অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের কথাই যদি শুধু গীতা হয়, তাতেই বা সমস্যা কী ?
একটা গল্প বলতে গেলে, তাতে নানা চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে গল্পটাকে রসমধুর করে উপস্থাপন করতে হয়, যাতে পাঠকরা সেটা সহজে বোঝে এবং পাঠকদের কাছে তা হৃদয়গ্রাহী হয়। শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনকে পাঠকদের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য এবং অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এইসব গুরুগম্ভীর কথাবার্তা কিভাবে শুরু হলো, সেটা বোঝানোর জন্যই ধৃতরাষ্ট্র এবং সঞ্জয়ের কথোপকথন দ্বারা কাহিনীর শুরু করা হয়েছে। অথচ -যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা- এর মতো, গীতাকে অপছন্দ ব'লে, আর্য সমাজীরা এর মধ্যে অযথা নানা কল্পিত ভুল তুলে ধ'রে, সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে গীতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, এদের উদ্দেশ্যটা কী ?
আমরা প্রায় সবাই ঈশপের গল্প সম্পর্কে জানি, তিনি পশু পাখির মাধ্যমে একটি গল্প ব'লে, শেষে একটা নীতি কথা দিতেন, যেটা ঐ গল্পের শিক্ষা এবং আমরা কথায় কথায় বা উদাহরণে শুধু সেই নীতিকথাটাই উল্লেখ করি, আর যাদের জানা আছে, তারা মূল গল্পটা বুঝে যায়। যেমন এক বাঘ স্রোতস্বিনী নদীর তীরে নেমে জল খাচ্ছিলো, তো তার ভাটিতে এক ভেড়াও জল খাচ্ছিলো, এমন সময় বাঘটি, ভেড়াটিকে বললো, তুই কিন্তু আমার খাওয়ার জল ঘোলা করছিস। ভেড়া উত্তর দিলো, আমি তো আপনার ভাটিতে অবস্থান করছি, তাহলে আমার ঘোলা করা জল আপনার দিকে যাবে কেনো ? এতে ক্ষেপে গিয়ে বাঘ বললো, তুই আমার সাথে ঝগড়া করছিস, এই বলে সেই বাঘ, ভেড়াটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাকে হত্যা করে তার মাংস খেলো। এই গল্পের নীতি কথা হলো- দুর্জনের ছলের অভাব হয় না।
খারাপ লোকের জন্য কারণের অভাব হয় না, এটা আমরা সবাই জানি, তারা চাইলেই যেকোনো একটি অজুহাত খাড়া করতে পারে। এই বিষয়টি বোঝানোর জন্য ঈশপ মহাশয় বাঘ ও ভেড়া নামক দুটি চরিত্রের আশ্রয় নিলেন কেনো ? আসলে তিনি চেয়েছেন গল্পটি এমনভাবে উপস্থাপন করতে, যাতে সবার হৃদয়গ্রাহী হয়, এবং গল্পটা মনে রাখা সবার জন্য সহজ হয়। একারণেই গীতার শুরুটা করা হয়েছে ধৃতরাষ্ট্র ও সঞ্জয়ের কথোপকথনের মাধ্যমে, যাতে গীতার জ্ঞান, অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ কোনো প্রেক্ষাপটে দিলেন, সেটা বোঝা সবার জন্য সহজ হয়। এই ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে আর্য সমাজীদের এত মাথা ব্যথা কেনো ? নাকি তারা ভাববার জন্য অন্য কোনো বিষয় পায় না ?
এরপর আর্য সমাজীদের মাথা ব্যথা হলো- শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ কে কে দেখেছে, সেটা নিয়ে!
তাদের বক্তব্য হচ্ছে- শ্রীকৃষ্ণ যেখানে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখানোর জন্য দিব্যদৃষ্টি প্রদান করেছে, সেখানে অর্জুন ছাড়া অন্য কেউ সেই বিশ্বরূপ দর্শন করে কিভাবে, যেখানে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, " ইহার পূর্বে তুমি ছাড়া অপর কেউ আমার এই রূপ দেখে নি (গীতা, ১১/৪৭) বা তুমি ছাড়া অপর কেহ আমার এই রূপ দর্শন করিতে সক্ষম নয় ( গীতা, ১১/৪৮) ? এ প্রসঙ্গে আর্য সমাজীদের অভিযোগ হলো- অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনের আগেই সঞ্জয় সেটা দেখতে শুরু করেছে, এটা কিভাবে সম্ভব হলো ?
টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যখন নাটক, সিরিয়াল ও সিনেমা দেখি, তখন সেখানে একটি দৃশ্যাবলি বা সিকোয়েন্সের পর আরেকটা দৃশ্যাবলি বা সিকোয়েন্স দেখি। কিন্তু বাস্তবে যে সিকোয়েন্সটা আগে দেখেছি, সেটা আগে এবং যে সিকোয়েন্সটা পরে দেখেছি, সেটা পরে ঘটেছে, না একই সাথে ঘটেছে ? বাস্তবে কোনো কাহিনীর অনেকগুলি ঘটনা একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঘটে থাকে বা ঘটতে পারে, দেখানোর এবং দর্শকদের কাহিনী বোঝার সুবিধার্থে একটির পর একটি সিকোয়েন্সকে সেট করা হয়, যা মোটেই সময়ের ভিত্তিতে বাস্তব নয়, কারণ প্রকৃতপক্ষে ঘটনাগুলো হয়তো একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঘটেছে, কিন্তু আমরা দেখছি বা দেখাচ্ছি একটির পর একটা।
পুস্তক আকারে কোনো গল্প পরিবেশন করতে গেলেও এই একই ঘটনা ঘটাতে হয়, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে একই সময়ে ঘটা ঘটনাগুলোকে একটির পর একটি লিখতে হয়, যেটা ঘটেছে গীতার ক্ষেত্রেও।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরুর মূহুর্তে বেদব্যাস যান হস্তিনাপুরের রাজ প্রাসাদে এবং সেখানে গিয়ে সঞ্জয়কে তিনি দিব্যদৃষ্টি প্রদান করেন, যাতে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সরাসরি দেখে ধৃতরাষ্ট্রকে তা বর্ণনা করতে পারে। ফলে কুরুক্ষেত্রে ঘটা সকল ঘটনা ই সঞ্জয়ের দেখার ক্ষমতার মধ্যে ছিলো। এই কারণে ১১/৮ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে বলেন, আমার যৌগৈশ্বর্য রূপ দেখো এবং তারপরই যখন তাঁর বিশ্বরূপ প্রদর্শন করতে শুরু করেন, ঠিক তখনই সঞ্জয়ও তা দেখতে শুরু করে। লিখন পদ্ধতির দুর্বলতার কারণে যেহেতু একই সাথে দুটি ঘটনার বর্ণনা করা যায় না, সেহেতু গীতায় সঞ্জয়ের বর্ণনাটা আগে করা হয়েছে, যেখানে সঞ্জয় একই সাথে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ এবং সেই বিশ্বরূপ দেখে অর্জুনের যে অভিব্যক্তি, সেই অভিব্যক্তিকেও বর্ণনা করেছে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। এর মানে হলো- সঞ্জয়- অর্জুনসহ শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখেছে, আর অর্জুন দেখেছে শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ। ফলে দুজনের দর্শিত বিষয় একই নয়, আলাদা; সঞ্জয় দেখেছে বেশি, অর্জুন কম। এই প্রসঙ্গে আর্য সমাজীরা যে বলেছে, অর্জুনের পূর্বেই সঞ্জয়, শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখেছে, ব্যাপারটা তেমন নয়, বিশ্বরূপ অর্জুনই দেখেছে, লাইভে যুক্ত থাকার কারণে একই সময়ে সেটা সঞ্জয় দেখেছে মাত্র এবং সঞ্জয় ঐ সময়ে যা দেখেছে, সেটার বর্ণনা গীতায় জাস্ট অর্জুনের বর্ণনার আগে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে মাত্র।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি উদাহরণ দিই- স্মার্ট ফোন আবিষ্কারের আগে টিভির লাইভ সম্প্রচার একটি বিশাল ব্যাপার থাকলেও স্মার্ট ফোনের কল্যানে যেকোনো অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচার এখন ছেলে খেলা মাত্র। ধরুন, পড়ার মোড়ে আপনি একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখছেন, সেখানে একটি মেয়ের নাচ ভালো লেগে যাওয়ায় তা আপনি ফেসবুকে লাইভ করা শুরু করলেন, তাহলে আপনার ফেসবুক আইডির সাথে যারা যুক্ত, তারা যদি ঐ মূহুর্তে অনলাইনে থাকে, তারা কিন্তু সবাই আপনার সাথে সাথেই ঐ মেয়েটির নাচ দেখতে পাবে। এখন বলেন, আপনি এবং আপনার বন্ধুরা একই সময়ে একই সাথে অনুষ্ঠানটি দেখলেন কি না ? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও এই একই ঘটনা ঘটেছিলো, যখন যেখানে যা ঘটেছে, সেই সবই একই সময়ে সঞ্জয়ও দেখেছে। এখানে কুরুক্ষেত্রের মাঠে উপস্থিত অর্জুন এবং হস্তিনাপুরের প্রাসাদে উপস্থিত সঞ্জয়ের দেখার মধ্যে কোনো আগে পরে নেই।
আর্য সমাজীদের এর পরের অভিযোগ হচ্ছে- যে বিশ্বরূপ অর্জুনের একার দেখার কথা, সেই বিশ্বরূপ অন্যরা দেখলো কিভাবে ?
-অন্যরা অর্থাৎ সঞ্জয় বিশ্বরূপ দেখেছে অর্জুনের সাথে লাইভে যুক্ত থাকার কারণে; যেমন কোনো একটি ঘটনা যদি লাইভ সম্প্রচার করা হয়, ঐ সময় যতজন ঐ চ্যানেলটির সম্প্রচার দেখবে, ততজনই ঐ ঘটনাটি দেখতে পাবে।
শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখে অর্জুন যে বলেছে, "তোমার ঐ অদ্ভূত উগ্ররূপ দেখিয়া ত্রিলোক ভীত হইতেছে এবং আমিও ভীত হইতেছি"(গীতা-১১/২০), এটা আসলে অর্জুনে ধারণা, যা সত্য নয়। কারণ, বিশ্বরূপে শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত অদ্ভূত ও উগ্ররূপ দেখে অর্জুন একইসাথে হতবিহ্বল এবং ভয় পেয়ে গিয়েছিলো, তাই অর্জুন সেই সময় মনে করেছিলো, সেই সময় সে যেমন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখছিলো, অন্যরাও হয়তো সেই বিশ্বরূপ দেখছে। আর আকস্মিক ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনায় মানুষের এরকম ভুল হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ফলে সরাসরি অর্জুন এবং সঞ্জয় ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বরূপ দেখে নি, তাই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত অন্য কেউ শ্রীকৃষ্ণের এই বিশ্বরূপ দর্শন করে নি, এজন্য কৌরবপক্ষের কারো এই বিশ্বরূপ দেখার কোনো প্রশ্নই নেই। তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং ঈশ্বর, এর প্রমাণ, পূর্বে- ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং দুর্যোধন নিজেও পেয়েছিলো, যখন শ্রীকৃষ্ণ শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে হস্তিনাপুর গেলে শকুনি ও দুর্যোধন মিলে শ্রীকৃষ্ণকে বন্দী করার চেষ্টা করেছিলো, তাতেও দুর্যোধনের হুঁশ ফিরে নি, তাই কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত দুর্যোধনও যদি শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখতো তাতে দুর্যোধন যে যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করতো, এর কোনো গ্যারান্টি ছিলো না।
তাই গীতায় যে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা আছে আর্য সমাজীদের মাথায়, সেটা আমার বন্ধুদেরকে উপরের প্রবন্ধ দ্বারা বোঝাতে পেরেছি বলে আমি মনে করছি।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment