Wednesday 20 May 2020

হরিবংশ, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাসলীলার প্রকৃত রূপ VS প্রকৃত সত্য :


হরিবংশ, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাসলীলার প্রকৃত রূপ VS প্রকৃত সত্য :

সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে কৃষ্ণের লীলাগুলোর মধ্যে বহুল চর্চিত বিষয় হলো রাস, এই রাস এতটাই জনপ্রিয় যে, লীলা কীর্তনের হরিবাসরে রাস একটা প্রধান বিষয় এবং রাস কতটা জমে বা কোনো নর্তকী রাস কতটা জমাতে পারে, তার উপরই নির্ভর করে হরিবাসরে সাফল্য বা সার্থকতা। যা হোক, হিন্দুসমাজের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব মতবাদের প্রভাবে হিন্দসমাজে এটা প্রচলন হয়ে গেছে যে রাসলীলার প্রধান নায়িকা রাধা এবং নায়ক হলেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু রাস প্রসঙ্গে রাধা ভক্তদের জন্য একটা চরম দুঃসংবাদ হলো- মূল সংস্কৃত ভাগবতে রাধার নাম তো নেই ই, তাই সেখানে রাস প্রসঙ্গে রাধাকে নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই, কিন্তু বাংলায় প্রচলিত বেণীমাধব শীলের পদ্য ভাবগত এবং সুবোধচন্দ্র মজুমদারের পদ্য ভাগবত, যেখানে রাধার অস্তিত্ব ইনিয়ে বিনিয়ে প্রমান করার চেষ্টা আছে, সেই ভাগবতগুলোতেও রাস অধ্যায়ে রাধার কোনো নাম নেই, যদিও এই দুই ভাগবতে রাস লীলার বর্ণনায় অশ্লীলতার ছাড়াছড়ি এবং রাস হলো একটা খোলামেলা সেক্স পার্টি, নিম্নে আমার কথার প্রমাণ আপনারা পাবেন-

যাকে রাসলীলা বলা হয়, হরিবংশে সেটার উল্লেখ আছে "হল্লীশক্রীড়া" নামে; আর এই হল্লীশক্রীড়া হয়েছিলো, শ্রীকৃষ্ণ যখন সাতদিন ব্যাপী নিজ বাম হাতের কণিষ্ঠা আঙ্গুলের উপর গোবর্ধন পর্বতকে ধারণ করে রেখে ইন্দ্রকে পরাজিত করেছিলেন, তার পর। শ্রীকৃষ্ণের এই গোবর্ধন ধারণ লীলা ছিলো- ইন্দ্রের উপর শ্রীকৃষ্ণের, তথা বৃন্দাবনবাসীর বিজয়; আর যেকোনো বিজয়ের পর মানুষের স্বভাব হলো আনন্দ উদযাপন করা, এই হল্লীশক্রীড়া ছিলো সেই আনন্দ উদযাপনের প্রকাশ, যাতে শ্রীকৃষ্ণ তার সমবয়সী বালক-বালিকাদের সাথে নৃত্যগীত, খেলা-ধুলা এবং আমোদপ্রমোদ করেছিলেন। এই সময় শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিলো সাত থেকে আটের মধ্যে। কিন্তু তার বয়স এবং তাঁর মহিমাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি না ক'রে হরিবংশ এবং ভাগবতের লিপিকারগণ, যাদের হাতে এই সব গ্রন্থ প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে কপি হতে হতে আমাদের হাতে এসেছে, সেই সব গ্রন্থে সেই লিপিকারগণ সাত/আট বছর বয়সী কৃষ্ণকে দিয়ে গোপনারীদের সাথে যৌনক্রিয়া করিয়েছেন, যেগুলো পড়ে সাধারণ হিন্দুরা বিভ্রান্ত হয়, হয়েছে, হচ্ছে এবং অহিন্দুরা কৃষ্ণ চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে বা তুলছে।

হরিবংশের হল্লীশক্রীড়াতেও কৃষ্ণের সাথে গোপকন্যাদের যৌনতার সামান্য ইঙ্গিত আছে, কিন্তু এগুলো যে হরিবংশের লিপিকারদের মাস্তানি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, হল্লীশক্রীড়ার সময় কৃষ্ণের বয়স ছিলো সাত বছর বা সাত বছরের কিছু বেশি, এই বয়সী একটি বালকের মধ্যে কি যৌনতার কোনো ব্যাপার থাকতে পারে ? পারে না।

হল্লীশক্রীড়ার এই যৌনতার ইঙ্গিত, মূল সংস্কৃতভাগবত, যে ভাগবতও সনাতন ধর্মের অন্যান্য গ্রন্থের মতো প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে অসংখ্য লিপিকারের হাতে কপি কপি হতে বর্তমান অবস্থায় এসে আমাদের হাতে পৌঁছেছে, সেই সংস্কৃত ভাগবতে আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে, যেখানে যুবতী নারীরা বাড়ির সকল কাজকর্ম ফেলে, পিতা বা স্বামীর বাধা উপেক্ষা করে কৃষ্ণের কা্ছে এসে তাদেরকে দৈহিকভাবে গ্রহণ করে তাদের দৈহিক কামবাসনাকে তৃপ্ত করার জন্য কৃষ্ণকে অনুরোধ করছে। যেগুলো দেখে বা পড়ে আমাদের সাধারণ হিন্দুরা বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং কেউ কেউ এসবের জন্য কৃষ্ণচরিত্র নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্যও করছে, কিন্তু এসব বলার সময় আমরা একটা বিষয় ভুলে যাই যে- সেই সময় কৃষ্ণের বয়স ছিলো মাত্র সাত বা আট; যা হোক, ঘটনার বর্ণনা থাকলেও সঙ্গী সাথীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের এই আমোদ প্রমোদ বা খেলা-ধূলা ও নৃত্যগীতের ঘটনা মূল সংস্কৃত ভাগবতে "রাস" নামে লিখিত বা খ্যাত হয় নি।

রাসলীলার বর্ণনা দিতে গিয়ে শ্রীবেণীমাধব শীল তার শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থের দশম স্কন্ধের শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা পর্বে বলেছেন,

"ভোলানাথ হন জয়ী কামে জয় করি।
গোপিকা রাসমণ্ডল জয়যুক্ত হরি।।
------
শ্রীরাসমণ্ডলে কৃষ্ণ করেন গমন।
যে মায়ায় মোহিত করেন জগত্রয়।।
------
ব্রজাঙ্গনা মন ধন হরণ করিতে।
করিলেন সুসঙ্গীত বাঁশির রবেতে।।
কামকলা বাড়ায় কৃষ্ণের সুসঙ্গীত।।
শুনি ব্রজাঙ্গনাগণ হৈল চমকিত।।
যথায় গোপিকান্ত নিকুঞ্জ কাননে।
তথা উপনীত হয় উল্লাসিত মনে।

বাড়ির সকল কাজ কর্ম ফেলে, জ্যেষ্ঠদের বাধা উপেক্ষা করে বৃন্দাবনের সকল গোপিকা রাসমণ্ডলে উপস্থিত হয়ে কৃষ্ণকে বলে-

ওহে কৃষ্ণ তোমার অধর সুধা দিয়া।
কামাগ্নি নির্বান কর করুণা করিয়া।।
তব হাস্য কটাক্ষ মধুর বংশীগানে।
জ্বলিতেছে কামানল ব্রজাঙ্গনা মনে।।
যদি শান্ত নাহি কর হইয়া নির্দয়।
বিরহ দহন দাহে দেহ ভস্ম হয়।।
--------
করপদ্ম দিয়া স্তনে করহ শীতল।
সবার মস্তকে দেহ শ্রীকরকমল।।

এরপর শ্রীকৃষ্ণ বলে-

"ঈষৎ হাসিয়া্ তুষ্ট কৈল গোপীগণে।
রমণ কারণ সুখ গোপিকার সনে।।"

এরপর রাসের ঘটনার বর্ণনা এরকম-

নারী শতমাঝে হরি করেন বিহার।
বৈজয়ন্তী মালা গলে শোভা পায় তাঁর।।
-------
বিহার করেন হরি গোপিকার সনে।
বাহু পসারিয়া ঘন আলিঙ্গন দানে।।
করে করে ধরাধরি করেন কৌতুকে।
সঘনে চুম্বন মুখে অলকা ঝলকে।।
ব্রজাঙ্গনা কুচ ধরি মনে উল্লাস।
নখরেখা দেখিয়া করেন উপহাস।
বিহার করেন ঘন রমন পণ্ডিত।
গোপিকার রতিমতি করেন উদিত।।
তুষিয়া গোপিকা মন রমন রসেতে ।
রাসরসে রসিকা তরল সকামেতে।।

খেয়াল করে দেখুন, বেণীমাধবের ভাগবতের রাস বর্ণনায় যৌনতা থাকলেও রাধার কোনো নাম নেই।

এরপর সুবোধচন্দ্র মজুমদারের ভাগবতে রাসের বর্ণনা এরকম :

বেণীমাধব শীলের বর্ণনামতোই কৃষ্ণের বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে সব গোপনারী সকল বাধা উপেক্ষা করে রাসমণ্ডলে চলে আসে, সেখানে কৃষ্ণ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

ভূতলে উদয় যেন হয় পূর্ণ চাঁদ।
মধ্যস্থলে কালশশী যেন কাম ফাঁদ।

এরপর নানা কথার পর গোপনারীরা শ্রীকৃষ্ণকে বলে-

মদনে পীড়িত মোরা সকল রমণী
কামানলে দহে প্রাণ শুন গুনমণি।।
মরমে দারুন জ্বালা হয় নিরন্তর।
নিদারুন কামাগ্নিতে দহিছে অন্তর।।
অতএব দয়াময় কর কৃপাদান।
অধর অমৃত দানে বাঁচাও পরাণ।।
যদি ইহা না করিবে ওহে প্রাণেশ্বর।
নিশ্চয় ছাড়িব প্রাণ শুন গুণকর।।

সাত/আট বছর বয়সী একজন বালকের কাছে শত শত যুবতী নারী একসঙ্গে, তাদের সাথে যৌনক্রিয়া করার জন্য প্রকাশ্যে আবেদন করছে, এমন দৃশ্যকল্প কোথাও কখনও সম্ভব কি না, সেটা একবার কল্পনা করুন, আর সুবোধচন্দ্রের মস্তিষ্ক্যের সুস্থতার বিষয়টি বিবেচনা করুন।

যা হোক, এরপর গোপনারীরা বলে-

গৃহ আদি সব ছাড়ি তোমার কারণ।
ও পদে কিঙ্করী মোরা জগৎ জীবন।।
পীড়িতের বন্ধু তুমি ওহে প্রাণধন।
আমাদের প্রতি কর কৃপা বিতরণ।।
উত্তপ্ত মোদের স্তন হইয়াছে আজ।
পরশে শীতল কর ওহে ব্রজরাজ।
-----------------
কিশোরীরে হেরে হরি সকাম অন্তরে।
মদনে পীড়িত তারা হল তদন্তরে।।
কৃষ্ণপানে গোপীগণ ঘন ঘন চায়।
কামানলে এককালে অধীরা সেথায়
কৃষ্ণরূপ নিরীক্ষণে ব্রজকূল সতী।
অনঙ্গে মোহিত হল কামাকূলা অতী।
------------
মনোহর সে পুলিনে প্রফুল্ল অন্তরে।
গোপীসহ ভগবান রাসলীলা করে।।
নগ্নবেশা এলোকেশী হইয়া গোপিনী।
শ্রীকৃ্ষ্ণের করে ধরে মধুর হাসিনী।।
-----------
সবাকারে ফুল শর হানে বার বার।
অচেতন কামশরে নন্দের কুমার।।
আনন্দে মাতিল হরি গোপিকার সনে।
করিল কুসুম শয্যা কুসুম কাননে।।
মনসুখে শ্রী হরিরে করিল আলিঙ্গন।
আনন্দে উন্মত্ত হল যত গোপীগণ।।
যত করি রতি তত আনন্দ উদয়।
কিঙ্কিণী নূপুর ধ্বনি ঘন ঘন হয়।।
অধরে দংশন হরি কৌতুক করিল।
নখাঘাতে কুচযুগে রুধির বহিল।।
বিদূরিত করি বস্ত্র শ্রীহরি তখন।
হৃদয়ে ধরিয়া সবা করেন চুম্বন।।
এই রূপে রতি শেষ করি যদুপতি।
শ্রী রাসমণ্ডলে তবে করিলেন গতি।
এই রূপে রাসলীলা নিশাতে হইল।
বৃন্দাবনে ব্রজবাসী কেহ না জানিল।।

-স্বামী, পিতা, পুত্রের বাধা উপেক্ষা করে সকল গোপনারী এসে কৃষ্ণের সাথে যৌনলীলা করছে, আর সেটা নাকি ব্রজবাসী কেহই জানে না !

যা হোক, বেণীমাধবের ভাগবতের দশম অধ্যায়ের ২৯ অধ্যায়ের এই সব বর্ণনার পর ৩২ অধ্যায়ে রাস সম্পর্কে বলা হয়েছে-

মাঝে কৃষ্ণ দুই দিকে রহ গোপনারী।
সবার গলেতে ধরে মুকুন্দ মুরারি।।
গোপী যত কৃষ্ণ তত হইল তখন।
নীলবাস মাঝে পীত রহিল বসন।।
হেনরূপে রহে কৃষ্ণ গোপীগণ মাঝে।
মদন-মোহন রূপ মনোহর সাজে।।
সব গোপী মনে ভাবে হয়ে আনন্দিত।
আমার নিকটে কৃষ্ণ আমাতেই প্রীত।।
----------------
শ্রীরাস মঞ্চতে সবে মণ্ডল আকার।
যত গোপী তত কৃষ্ণ তাহার মাঝার।।
কৃষ্ণসহ গোপী যত নাচিতে লাগিল।
মধুর নূপুর ধ্বনি তাহাতে হইল।।
---------------
এইরূপে গোপীগণ আনন্দে অপার।
কুচের কাঁচলি খসে যত গোপিকার।।
মন্দ মন্দ বহি ঘর্ম অলকা ধুইল।
কটির বসন তথা অমনি খসিল।।
----------------
কোন গোপী কৃষ্ণ কর ধরিয়া যতনে।
আদরে চুম্বন করে আনন্দিত মনে।।
কোন গোপী নৃত্য করে আনন্দ-হৃদয়।
শ্রীহরি কটাক্ষাঘাতে কামের উদয়।।
------------------
কোন গোপী সুখে কৃষ্ণমুখে মুখ দিয়।
চর্ব্বিত তাম্বুল ধরে অধরে করিয়া।।
সুধা হতে সুধা হয় তার আস্বাদন।
গোপীগণ হৃষ্টমনে খায় অনুক্ষণ।।
-----------
কোন গোপী হরিমনে উন্মত্ত হইল।
কেহ বা কামের শরে বিষম মাতিল।।
কৃষ্ণ কর ধরি হয়ে প্রফুল্ল অন্তর।
আনন্দে ধরায়ে দেয় পীন পয়োধর।।
------------------
হেনমতে রাসক্রীড়া করি নারায়ণ।
যত গোপী তত কৃষ্ণ চারু দরশন।।
সকল গোপিকাসহ শ্রীনন্দনন্দন।
ক্রীড়ারসে সবাকারে করয়ে রমণ।।
------------------
রমণের অবসানে অবশ হইল।
তখন রমণীগণে ঘর্ম্ম নিঃসরিল।।
-------------------
পদ্মকর স্পর্শে যত ব্রজের অঙ্গনা।
তখনি পাসরে সবে অঙ্গের বেদনা।।
------------------
জলকেলি করিবারে দেব জনার্দন।
যমুনা-পুলিনে সবে করিল গমন।।
যমুনার জলে নামে ত্যজিয়া বসন।
উলঙ্গিণী গোপবালা গোপিকা জীবন।।
------------------
যমুনার জলে সবে উলঙ্গিনী হয়ে।
গোপীসব সন্তরণ করেন কৃষ্ণ লয়ে।।
---------------
শ্রীকৃষ্ণ আনন্দে আসি ধরি গোপীকর।
কোলে করি হাসে কৃষ্ণ সানন্দ অন্তর।।
পুনঃ পুনঃ চুমে কৃষ্ণ গোপিকা আনন।
ধীরে ধীরে অধরেতে করেন দংশন।।
------------------
হেনমতে জল ক্রীড়া করি যদুরায়।
তীরেতে বসিল উঠি লয়ে গোপিকায়।।
নগ্নবেশে তীরদেশে উঠিয়া সকলে।
আপন আপনা বস্ত্র পরে কূতুহলে।।
হর্যযুত নন্দসুত বসন তুলিয়া।
গোপীগণ সযতনে দিল পরাইয়া।।
------------------
এইরূপে জনার্দন মত্ত সেই রাসে।
মাতিয়া মদনে আর লীলা যে প্রকাশে।।
রাসলীলা শেষে যত ব্রজনারীগন।
আপন আগন গৃহে করিল গমন।।
গোপগণ সুপ্ত ছিল কৃষ্ণের মায়ায়।
পত্নীদের এই কার্য্য জানিতে না পায়।।

অর্থাত এখানে সুবোধচন্দ্র মজুমদার বলতে চাচ্ছে বা প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে- কৃষ্ণ লম্পট, সে মায়ার দ্বারা ব্রজের পুরুষদেরকে আচ্ছন্ন রেখে তাদের স্ত্রী মা ও কন্যাদেরকে ভোগ করেছে, যেন তারা কৃষ্ণের এই লাম্পট্যের ঘটনাকে জানতে না পারে।

যা হোক, উপরের বর্ণনায় নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, বেণীমাধবের ভাগবতে রাসের বর্ণনায় অশ্লীলতা ছড়াছড়ি এবং কৃষ্ণকে এখানে লম্পট হিসেবে তুলে ধরা হলেও এখানেও কিন্তু রাধার কোনো নাম নেই। অথচ হরিবাসের রাসলীলায় রাধা ই হলো প্রধান নায়িকা !

সুবোধ এবং বেণীমাধবের ভাগবতে রাস অধ্যায়ে রাধার নাম না থাকলেও, রাস অধ্যায়ে রাধার নাম আছে এবং বেশ জমিয়ে আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে; ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৪৮৮ পৃষ্ঠায় শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রা পর্বে বলা হয়েছে, রাধার ২৭ জন সখী ৩৮ লক্ষ ৯ হাজার গোপিনীকে সাথে নিয়ে রাসমণ্ডলে উপস্থিত হয় এবং তারপর সেখানে যা ঘটে তার কিছু অংশ আপনাদের জ্ঞাতার্থে নিচে নিবেদন করছি-

পুষ্প মধুপানে মত্ত ভ্রমরী সহিত।
এ সময়ে রাধা রাসে হৈল উপনীত।।
----------------
দেখিয়া রাধারে কৃষ্ণ কামেতে মোহিতা।
সখীগণমধ্যে রত্ন ভূষণে ভূষিতা।।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখছি এবং আমার পাঠকদেরকে এই তথ্যটি আবারও মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করে স্মরণ রাখার জন্য অনুরোধ করছি যে রাসলীলার সময় কৃষ্ণের বয়স কিন্তু ছিলো মাত্র সাত বা আট। এই সাত/আট বছর বয়সী বালক কৃষ্ণকে দিয়ে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক কিভাবে যৌনলীলা করাচ্ছে, সেই বিষয়টি একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করবেন, আর ভাববেন এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনার আসলে উদ্দেশ্যটা কী ছিলো ?

যা হোক, ৮ বছর বয়সী কৃষ্ণ, রাধাকে দেখেই কামে মোহিতা হয়ে যায় এবং কৃষ্ণ এমন মদন বাণ ছাড়ে যাতে-

মূর্চ্ছিত হইল রাধা মদনের বাণে।
শ্রীঅঙ্গ পুলকিত কামে হতজ্ঞানে।।
-----------------
ক্ষণেক চেতনা পেয়ে শ্রীরাধা সদন।
আইলেন মনোল্লাসে মদনমোহন।।
রাধার করিলা কৃষ্ণ শ্রীমুখ চুম্বন।
কৃষ্ণ-অঙ্গ-সঙ্গে রাধা পাইল চেতন।।
প্রাণাধিক প্রাণকান্তে করি আকর্ষণ।
শ্রীরাধা করেন কামে বদন চুম্বন।।
বচনে হরিলা কৃষ্ণ মানস রাধার।
রসিকা আইল দেখি কামের আগার।।
--------------------
তদন্তর তথা কামে সুরতি উন্মুখে।
শুইলা রাধার অঙ্গে রতিকল্পে সুখে।।
শৃঙ্গার অষ্ট প্রকার বিপরীত মত।
করেন কোমল অঙ্গে নখ দন্তে ক্ষত।।
কামশাস্ত্রে সুগোপন অষ্টম প্রকার।
চুম্বন করেন কৃষ্ণ রণে পারাবার।।
অঙ্গে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে কামপরে।
কামুক কামুকীদ্বয় আকর্ষণ করে।

- চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবরা বলে এই রাধা কৃষ্ণের প্রেম নাকি- নিষ্কাম, অপার্থিব, অপ্রাকৃত ?! এরা কি কোনোদিন ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের এইসব বর্ণনা পড়ে দেখেছে ? আমার তো মনে হয় কোনোদিন পড়ে নি, পড়লে এইসব আজগুবি কথা কোনোদিন বলতে পারতো না।

যা হোক, তার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলা হয়েছে,

শৃঙ্গার কুশল কামশাস্ত্রে সুপণ্ডিত।
রতি যু্দ্ধ বিরাম না হয় কদাচিত।।
এইমত ঘরে ঘরে নানামূর্তি ধরি।
রমন গোপীর সঙ্গে রাস করে হরি।।
অভ্যন্তরে রতিক্রিয়া করিয়া সাদরে।
কত মত রাসক্রীড়া করেন বাহিরে।।
রাসেতে বিহার করে গোপ গোপীগণ।
নব লক্ষ গোপী নব লক্ষ গোপজন।।
এই অষ্টাদশ লক্ষ শ্রীরাস-মণ্ডলে ।
গোপ আর গোপীকার বিহার সে স্থলে।।
মুক্তকেশ নগ্নবেশ বিচ্ছিন্ন ভূষণ।
প্রমত্ত মূর্চ্ছিত সবে কামে অচেতন।।
-------------------
এই মত ক্রীড়া করি সবে কুতূহলে।
ততপরে বিহার করে যমুনার জলে।।
জলক্রীড়া করি পরিশ্রান্ত জনে জন।
উঠিয়া পরিল সবে স্বকীয় বসন।।

রাস মণ্ডলের এই বর্ণনার পর, "শৃঙ্গার রহস্য" পর্বে বলা হচ্ছে-

কেহ কামরসে, প্রেমের সাহসে,
নগ্ন করি শ্রীহরিরে।
কাড়ি পীতবাস, কৌতুকেতে হাস,
আনন্দে রতি মন্দিরে।
---------------
করি আকর্ষণ, বদন চুম্বন,
পুনঃ পুনঃ আলিঙ্গন।
আননে আনন, করি আরোপন,
ঘর্ষণ স্তন জঘন।
কোন গোপীগন, করান দর্শন,
বক্ষোপরি সুললিত।
কান্ত করে ধরি, রাখি তদুপরি,
করেন চূড়া নির্মিত।।
-------------
সব বরাঙ্গনা, কামে মত্তমনা,
কৌতূকের নাহি পার।
গোপে নিলে হরি, সেই ত মুরারী,
আনি দেয় পুনর্বার।।
কেহ নগ্ন করি, কানে কান্ত হারি,
ক্রোড়ে করে কুতূহলে।
কেহ রঙ্গভরে, সুখে নৃত্য করে,
কান্তে রাখি মধ্যস্থলে।।
সুনির্জন বনে, নাচে কোন জনে,
হরিয়া কৃষ্ণের বাস।
সেই বস্ত্র দ্বারে, নগ্না গোপিকারে,
সাজায়ে কৌতূকে হাস।
কৃষ্ণ কুতূহলে, নিজ বক্ষঃস্থলে,
বসাইল শ্রীরাধারে।
আনন্দে শ্রীহরি, রাধার কবরী,
নির্মায় স্বকর দ্বারে।।
-----------
স্তন শ্রেণীভাগে, কাম অনুরাগে,
নখেতে করেন চিত্রিত।
দন্তেতে দলন, করে ঘন ঘন,
বিম্বাধর সুললিত।
------------
শৃঙ্গার বাসরে, চেতন অন্তরে,
বরিয়া রাস বাসর।
নখদন্তাঘাত, করে অচিরাত,
কামশরে পরস্পর।।
গোপী স্তনোপরে, কৃষ্ণাঘাত করে,
কর কমলে সঘন।
শ্রেণীর উপরে, নখচিত্র করে,
হৈল অপূর্ব শোভন।।
কামে মত্তানন্দ, শ্লথ নীধিবন্ধ,
ক্ষুদ্র ঘন্টিকা কবরী।
বসন ভূষণ, রত্ন আভরণ,
গোপীর হরিল হরি।।
নবধা প্রকার, আলিঙ্গন আর,
অষ্টম মত চু্ম্বন।
ষোড়শ শৃঙ্গার, করে অনিবার,
রাসেশ্বর সনাতন।।
অঙ্গে অঙ্গে মিলে, ভিন্ন নহে তিলে,
ব্রজাঙ্গনা অঙ্গ সঙ্গ।
করে আলিঙ্গন, কামে মগ্ন মন,
নাহি তার ক্ষণভঙ্গ।।

-ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে এই হলো কৃষ্ণের রাসলীলা, যদিও আমি একে বলি ওপেন সেক্স পার্টি বা খোলামেলা যৌনলীলা।

যা হোক, এই পুরাণের যদিও এক জায়গায় বলা হয়েছে,

রাসেতে বিহার করে গোপ গোপীগণ।
নব লক্ষ গোপী নব লক্ষ গোপজন।।

-কিন্তু অন্য এক জায়গায় রাধার ২৭ জন সখী মিলে যতজন গোপিনীকে রাস মণ্ডলে নিয়ে এসেছে, তার সংখ্যা ৩৮ লক্ষ, ৯ হাজার। এখন এই সংখ্যাতত্ত্বের দিকে একটু খেয়াল করুন, এক জায়গায় বলা হচ্ছে মোট ১৮ আঠার লক্ষ, অন্য জায়গায় হিসেব দেওয়া হচ্ছে ৩৮ লক্ষের! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক যদি সত্য কাহিনী বর্ণনা করতো, তাহলে কিন্তু এমন হতো না। যা হোক, এই দু্ই হিসাবের মধ্যে ৩৮ লক্ষের হিসাবটাই নিচ্ছি; কারণ, রাধার ২৭ জন সখী মিলে এই ৩৮ লক্ষ ৯ হাজার জনকে রাসমণ্ডলে নিয়ে এসেছে এবং এই সংখ্যক যুবতী মেয়ে যদি সেই সময় বৃন্দাবনে থাকে, তাহলে আরও কমবেশি ৩৮ লক্ষ সক্ষম পুরুষ ছিলো বৃন্দাবনে, ছিলো তাদের বাপ মা মানে বৃদ্ধ বৃদ্ধা, এই সংখ্যা আরও কম বেশি ৩৮ লক্ষ; ছিলো ছেলে মেয়ে, ৩৮ লক্ষ যুবতী বধূর কম পক্ষে ৭৬ লক্ষ সন্তান থাকা সম্ভব, তাহলে সব মিলিয়ে সেই সময় বৃন্দাবনের লোক সংখ্যার হিসেব দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ কোটি, যা বর্তমানের ঢাকা বা দিল্লি বা মুম্বাইয়ের লোক সংখ্যার সমান; সেই ৫২০০ বছর আগে সারা ভারত মিলেও ২ কোটি লোক ছিলো না, আর এক বৃন্দাবনেই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক ২ কোটি জনসংখ্যার কথা বলছে, এই একটি তথ্য থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সব কথা মিথ্যা।

রাসলীলা সম্পর্কিত আলোচনার এই প্রবন্ধে দেখালাম যে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে বেণীমাধব এবং সুবোধের ভাগবতে এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কিভাবে লম্পট ও চরিত্রহীন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে; এসব বিষয় থেকে এটা স্পষ্ট যে কৃষ্ণকে লম্পট ও চরিত্রহীন হিসেবে তুলে ধরে শ্রীকৃষ্ণের স্বর্গীয় মহিমাকে ধ্বংস করে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করাই ছিলো এই সব ভাগবত এবং পুরাণের লেখক এবং পৃষ্ঠপোষকদের মূল উদ্দেশ্য, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা মোটেই তা নয়, ইন্দ্রের উপর বালক শ্রীকৃষ্ণের বিজয়ের পর বৃন্দাবনবাসী যে আনন্দ উতসব করে, হরিবংশে যেটা হল্লীশক্রীড়া নামে উল্লিখিত হয়েছে, সেই ঘটনায় পরবর্তীতে লিপিকার, যারা হাতে লিখে গ্রন্থ কপি করতো, তাদের হাতে কপি হতে হতে বর্তমান রাসের বর্ণনায় পরিণত হয়েছে, যেটা আমরা না বুঝে অজ্ঞান ও অন্ধের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে মাইক লাগিয়ে হরিবাসরে প্রচার করছি। তাই আমি আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে এই অনুরোধ করবো, এই সব গ্রন্থের সত্যটা আজ থেকে আপনারা জানলেন, এখন এর বিষয়বস্তু রাধা ও কৃষ্ণের অনৈতিক প্রেমের প্রচারের বিরুদ্ধে যে যেভাবে পারেন প্রতিবাদ জানান এবং কৃষ্ণের স্বর্গীয় মহিমাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে হিন্দুধর্মকে কলঙ্কমুক্ত করে সকল হিন্দুকে হিন্দুধর্ম নিয়ে গর্ব করতে শেখান, যেন সবাই গর্বভরে উচ্চারণ করতে পারে,

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
জয় হিন্দ।

No comments:

Post a Comment