Sunday, 24 May 2020

শিব কে এবং শিবরাত্রি কী ?


শিব কে এবং শিবরাত্রি কী ?

আমাদের হিন্দু সমাজে- কেউ শিবের ভক্ত, কেউ কালীর ভক্ত, কেউ দুর্গার ভক্ত, কেউ কৃষ্ণের ভক্ত, কেউ বিষ্ণুর ভক্ত, কেউ লোকনাথের ভক্ত, কেউ রামকৃষ্ণের, কেউ বিবেকানন্দের, কেউ বা প্রণবানন্দের; কে যে কার ভক্ত, তার ঠিক নেই; এই শতধা বিভক্ত ভক্ত এবং তাদের ভক্তিমার্গের ভিন্ন পথের জন্যই হিন্দু সমাজে আজ- এত মত পথ, এত অনৈক্য, এত বিশৃঙ্খলা।

হিন্দু সমাজে এত মত পথের আরেকটা কারণ হলো, যে যার ভক্ত বা উপাসক, সে আসলে তার Root বা মূলটা জানে না, যদি তারা জানতো যে সকল নদীর জল একই হয় এবং তারা সমুদ্ররূপ একই জলধারে গিয়ে পড়ে, তাহলে তাদের মধ্যে এই মত বা পথ থাকতো না, তারা বুঝতে পারতো, আমরা আসলে সবাই একই ঈশ্বরের সন্তান এবং সকল দেব-দেবীর মাধ্যমে আসলে এক ঈশ্বরেরই পূজা করি।

দেবতা সম্পর্কে সাধারণ হিন্দুদের এই তত্ত্ব বুঝতে না পারার কারণ হলো, হিন্দু সমাজে প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চার অভাব এবং বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থের আধিপত্য এবং এই পৌরাণিক জালের মধ্যে পড়ে, বেশির ভাগ হিন্দু সারাজীবন জানতেই পারে না যে তাদের প্রকৃত ঈশ্বর আসলে কে ? একটা অস্পষ্টতা নিয়েই তাদের সারাটা জীবন কাটে। যেমন- কোনো শিব ভক্তকে যদি বলা হয়, শিব আসলে কে ? সে শুধু বলতে পারবে, শিব হলো দেবাদিদেব মহাদেব; সতী, দুর্গা বা কালীর স্বামী, কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতীর বাপ; আর ? আর কোনো তথ্য তার জানা নেই, দু চার জন বাদ দিয়ে প্রত্যেক হিন্দুর অবস্থা এই, আর এই হিন্দুরা যা জানে, আপনাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য যে, এর বেশির ভাগই ভুল বা বিকৃত।

আজকের আলোচনা শিবকে নিয়ে, তাই আলোচনার যতই ডাল পালা গজাক, ঘুরে ফিরে শিবের কাছেই ফিরে আসার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই দেখা যাক শিবরাত্রি কী এবং এর উৎপত্তি বা প্রচলন হলো কিভাবে ?

ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথির রাত্রিকে বলা হয় শিবরাত্রি। সব কিছুরই যেমন একটা বিশেষ দিন বা তিথি থাকে, যে সময়ে ঐ বিশেষ ঘটনার গুণ-গান বা আলোচনা করা হয়; যেমন- একুশে ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস, ছাব্বিশে মার্চ; তেমন আবার বিশেষ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেও বিশেষ বিশেষ প্রিয়দিন বা তিথি আছে, এই রকমই, শিবের একটি প্রিয় সময় হলো ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি। শিব পুরান মতে, এই দিন শিবের আরাধনা করলে তিনি যতটা খুশি হন, সারা বছরের অন্যদিনগুলোতে করলে ততটা খুশি হন না এবং এই রাতে শিবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যা কিছু করা হয়, তাকে বলে শিব রাত্রির ব্রত।

ব্রতের আগের তিথি অর্থাৎ ত্রয়োদশীতে নিরামিষ খেতে হয় এবং চুতর্দশীতে উপবাস থাকতে হয়। শিবরাত্রির রাতে সারারাত জেগে শিব মাহাত্ম্য শ্রবণ ও কীর্তন এবং বিভিন্ন উপাচার দিয়ে শিবের পূজা করে কাটাতে হয়, একান্তই ঘুম পেলে বিছানায় না ঘুমিয়ে মাটিতে সন্ন্যাসীর মতো ঘুমাতে হয়।

শিবরাত্রির উৎপত্তি হিসেবে শিবপুরাণে বলা হয়েছে,

অতি প্রাচীনকালে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করত । সে প্রচুর জীব হত্যা করত । একদিন শিকারে বেরিয়ে, ফেরার পথে ক্লান্ত হয়ে সে এক গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে এবং যখন সে জাগে, তখন রাত হয়ে যাওয়ায় আর বাড়ি ফিরতে না পেরে হিংস্র জীবজন্তুর ভয়ে গাছে উঠে রাত কাটায়; ঘটনাক্রম সেটা ছিলো শীতের রাত, যে সময়ে সাধারণভাবে প্রচুর শিশির পড়ে, এবং তিথি ছিলো ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী, যেটা শিবের প্রিয় তিথি; ব্যাধ যে গাছে উঠেছিলো, সেটা ছিলো বেল গাছ এবং সেই বেল গাছের নিচে ছিলো শিবের প্রতীক একটি শিবলিঙ্গ। এখানে আর একটা তথ্য জানিয়ৈ রাখি, তুলসী গাছে যেমন স্বয়ং বিষ্ণু বাস করে, তেমনি বেল গাছে বাস করে শিব। যা হোক, সারাদিন শিকার করার পর ব্যাধ ছিলো অভূক্ত অর্থাৎ উপবাসী, শিশিরে ভিজে এবং শীতের প্রকোপে ব্যাধ গাছে উঠে কাঁপছিলো, যেই কাঁপুনির প্রভাবে বেলের গাছ থেকে দু্ একটি ঝরা পাতা শিব লিঙ্গের উপর পড়েছিলো এবং ব্যাধের দেহ থেকেও শিশিরের জল শিবলিঙ্গের উপর পড়েছিলো। এইভাবে সারারাত কষ্ট করে জেগে থেকে ব্যাধ নিজের অজান্তেই শিবরাত্রির ব্রত পালন করে ফেলে।

যা হোক, ব্যাধ পরের দিন বাড়ি ফিরে যায় এবং যথা সময়ে তার মৃত্যু হলে, তার প্রাণী হত্যার পাপ স্বরূপ যমরাজ তাকে যমলোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপস্থিত হয়, কিন্তু শিবের অনুচরেরা তাকে শিবলোকে নিয়ে যায়; এর কারণ জানার জন্য যমরাজ শিবের কাছে উপস্থিত হলে, শিব বলে, এই ব্যাধ প্রাণী হত্যা করে শত পাপ করলেও নিজের অজান্তেই সে একবার শিবরাত্রির ব্রত করেছিলো, সেজন্য সে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়েছে।

শিবপুরানের মাধ্যমে এই কাহিনী পরে পৃথিবীতে প্রচলিত হয় এবং শিবরাত্রির ব্রত চালু হয়।

এটি একটি পৌরাণিক গল্প, যে গল্পগুলো সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য  রচনা করা হয়েছিলো, যে গল্পগুলোর কোনো মাথা মুণ্ডু নেই, যে গল্পগুলো পরে নানাভাবে বিকৃত হয়ে গেছে এবং একই বিষয়ের গল্প একেক পুরাণে একেক রূপ ধারণ করেছে, যেসব গল্পের সাপেক্ষে কোনো প্র্শ্ন করলে বাস্তবতার ভিত্তিতে তার কোনো সন্তোষজনক জবাব দেয়া যায় না; তাই পৌরাণিক গল্পগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, শোনার দরকার হলে এগুলো শুধু শুনবেন, এগুলো নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না বা এর উপর ভিত্তি করে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা চাইবেন না।

পৌরাণিক গল্পগুলোর উপর ভিত্তি করে শিবকে যদি চেনা না যায় তাকে ব্যাখ্যা করা না যায়, তাহলে শিব আসলে কে ?

হিন্দুশাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”
এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)

পরমব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমরা স্থূল দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে বিভক্ত করে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে এই তিনভাগে বিভক্ত করেছি এবং এই তিনটি সত্ত্বাকে আলাদা আলাদা তিনটি রূপ দান করেছি। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, এগুলো জাস্ট তিনটি নাম এবং এই তিনটি নাম পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের তিনটি কার্যকরী রূপের নাম মাত্র।

তবে কার্যকারিতার দিক থেকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর সমশক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও, সৃষ্টির মূল হলেন বিষ্ণু বা নারায়ণ, যিনিই ব্রহ্ম নামে পরিচিত; এই বিষ্ণু থেকেই ব্রহ্মার এবং ব্রহ্মা থেকে মহেশ্বর বা শিবের উৎপত্তি। যেহেতু সৃষ্টির মূল ব্রহ্ম এবং সকল দেবশক্তি ব্রহ্মেরই অংশ এবং অধীন, সেহেতু ব্রহ্মা ও মহেশ্বরকে, বিষ্ণু নিজের সমশক্তি হিসেবে এবং অন্যান্য দেবশক্তিকে অধীনস্থ হিসেবে গ্রহণ করে সৃষ্টিকার্য পরিচালনা করছেন।

যা হোক, কার্যকারিতার দিক থেকে ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী। ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি যখন যে কাজ করেন, তখন সেই রূপের নামে কাজটি করেন, সেই তিনটি নামই হলো- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।

এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন, বিষ্ণু পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিষ্ণুর আংশিক অবতার রাম কি যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে- কংস, শিশুপালকে হত্যা করে নি ? কৃষ্ণ কি ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? কৃষ্ণ, পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে তাঁর অবতারগণ কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকারা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলে পৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তো আলাদা কেউ নয়। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তারই নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তারই নাম বিষ্ণু এবং যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তারই নাম শিব বা মহেশ্বর; যে কথা বলা আছে গীতার এই শ্লোকে-

“অবিভক্তংচ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।
ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।”

অর্থ- পরমেশ্বরকে যদি যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবু তাঁকে সংহার কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

এতক্ষণে পাঠক-পাঠিকাদেরকে নিশ্চয় এটা বোঝাতে পেরেছি যে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কেউ নয়, তারা একই ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ; তাহলে লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুর্গা বা কালী কে ?

ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করেন তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা, আর যেহেতু যেকোনো কিছু সৃষ্টি করতেই লাগে জ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে, সেহেতু প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে মনে করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই, এমন কি ব্রহ্মা বলেও আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই, লেখক কর্তৃক গল্প-উপন্যাসে, একাধিক চরিত্র সৃষ্টির মতো সবই ব্রহ্মের খেলা, এখানে ব্রহ্মই সবকিছু ।

আবার, কোনো কিছু তৈরি বা সৃষ্টি করতে হলে যেমন লাগে জ্ঞান, তেমনি সৃষ্টিকে নিখুঁত করার জন্য নজর রাখতে হয় চারেদিকে, এই চারিদিকে দৃষ্টি রাখার জন্যই কল্পনা করা হয়েছে ব্রহ্মার চারটি মাথা এবং তার নারীশক্তি সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে।

বিষ্ণুকে কল্পনা করা হয়েছে পালনকর্তা রূপে, কাউকে পালন করত লাগে ধন সম্পদ, এজন্যই বিষ্ণুর নারী শক্তিকে হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে।

এবার আসি শিব বা মহেশ্বরে। ব্রহ্মের ধ্বংকারী রূপের নাম শিব, মহেশ্বর বা রুদ্র। সৃষ্টি বা পালন করতে যেমন লাগে নারী শক্তি, তেমনি ধ্বংস করতেও লাগে নারী শক্তি। একারণেই রামায়ণের সীতা ও মহাভারতের দ্রৌপদীর জন্ম। এছাড়াও বিখ্যাত, গ্রীস ও ট্রয়ের মধ্যকার যুদ্ধের কারণও ছিলো এক নারী, নাম হেলেন। নারী শক্তি যেমন ধ্বংসের কারণ হতে পারে, তেমনি নারী নিজেও ধ্বংস করতে পারে। প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দিতেই ব্রহ্মের ধ্বংসকারী রূপ মহেশ্বর বা শিবের নারী শক্তি হলো দুর্গা, যার আরেক রূপের নাম কালী।

আবার আমরা অনেকেই কোনো কোনো দেব-দেবীকে ছোট আবার কোন দেব-দেবীকে বড় বলে মনে করি, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কী ?

আমরা দেবাদিদেব মহাদেব বলে আদি দেব হিসেবে শুধু মাত্র শিবকে বুঝলেও, আসলে আদি দেব তিন জন, তারা হলেন- ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর বা শিব। সাধারণভাবে এই তিন দেবতাকে বড় বলে মনে করা হলেও আসলে দেবতাদের মধ্যে কোনো ছোট বড় নেই, সকল দেবতাই গুরুত্বের দিক থেকে সমান। ভূমিকার দিক থেকে কাউকে কাউকে আমরা ছোট বড় বলে ভাবতে পারি, কিন্তু কোনো দেবতাই যে ছোট বা বড় নয়, এটা আমরা বুঝতে পারবো যদি গীতার বাণীর অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে পারি।

যেমন- দেবতা হিসেবে কার্তিকের খুব বেশি ভূমিকা নেই, সে বিখ্যাত দেবতাও নয়, সমগ্র বাংলায় আলাদা হিসেবে কার্তিক পূজা হয় শুধু পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায়; দুর্গা পূজার বিশালত্বে কার্তিক খুবই ছোট একটি দেবতা, কিন্তু এই কার্তিক সম্পর্কে গীতার ১০ম অধ্যায়ের ২৪ নং শ্লোকে বলা আছে,

"সেনানীনামহং স্কন্দঃ"

আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন যে, কার্তিকের অন্য নাম স্কন্দঃ এবং স্কন্দপুরাণেই কার্তিকের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। "সেনানীনামহং স্কন্দঃ" এই কথার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, আমিই কার্তিক। তার মানে কার্তিক মানেই শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণ মানেই শ্রীবিষ্ণু, শ্রীবিষ্ণু মানেই পরম ব্রহ্ম, অর্থাৎ কার্তিকই হলেন পরমব্রহ্ম বা সৃষ্টিকর্তা। এখন চিন্তা করুন, আপাতদৃষ্টিতে কার্তিককে আমরা ছোট দেবতা বলে বিবেচনা করলেও, আসলে তিনি কে ?

আবার শ্রীকৃষ্ণ, বিষ্ণুর অবতার হলেও তাকে আমরা অবতার বলে গণ্য করি না; যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার, তাই কৃষ্ণকে আমরা ভগবান এবং পরমেশ্বর মনে করি। এখানে একটা বিষয় বলা প্রয়োজন যে, ভগবান এবং ঈশ্বর কিন্তু একই অর্থ বহন করে না। ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য-এই ছয়টি গুণ যার মধ্যে থাকে তাকে বলে ভগবান এবং সকল গুন যার মধ্যে থাকে তাকে বলে ঈশ্বর। এই ঈশ্বরের কোনো ধ্বংস নাই, ধ্বংস নাই বলেই তার নাম ঈশ্বর, আর যার ধ্বংস আছে তাকে বলে নশ্বর। যা হোক, যার মধ্যে উপরের ছয়টি গুন আছে, তাকে বলা হয় ভগবান। কিন্তু এই ছয়টি গুন অর্জন করা মানব রূপে জন্ম নেওয়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, এই ছয়টি গুন শুধু মাত্র অবতার রূপে জন্ম নেওয়া মানুষ এবং দেবতাদের মধ্যেই থাকা সম্ভব। একারণেই বিষ্ণুর আংশিক অবতার হিসেবে মানবরূপে জন্ম নেওয়া- রাম, বলরাম ও পরশুরামকে বলা হয়- ভগবান রাম, ভগবান বলরাম এবং ভগবান পরশুরাম; আবার শ্রীকৃ্ষ্ণকেও আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলি; কারণ পূর্ণ অবতার বা ঈশ্বর হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে শুধু ৬টি নয়, সকল গুণই আছে; একারণেই শ্রীকৃষ্ণ একই সাথে ভগবান এবং ঈশ্বর। ব্যাপারটা এমন- কিছু সরকারি ক্ষমতা থাকলে কেউ কেউ মন্ত্রী, কিন্তু যার সকল ক্ষমতা আছে সে প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীও একজন মন্ত্রী। অর্থাৎ সকল মন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রী নয়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মানেই যেকোনো মন্ত্রী। সেইরকম ঈশ্বর মানেই ভগবান, কিন্তু সকল ভগবান ঈশ্বর নয়।

উপরের এই আলোচনায় আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ বড় এবং রাম ছোট; যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ, বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার এবং রাম আংশিক অবতার। কিন্তু গীতার ১০/৪১ শ্লোকে বলা আছে,

"রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্"

অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমিই রাম। তার মানে হলো- রাম ও যা, শ্রীকৃষ্ণও তাই। অর্থাৎ দুজনেই সমান।

আবার আপাত দৃষ্টিতে একজন ছোট দেবী হলো লক্ষ্মী; কারণ লক্ষ্মী পূজার আয়োজন ও ফোকাস সরস্বতী পূজার চেয়েও কম। কিন্তু উপরেই জেনেছেন, লক্ষ্মী আসলে বিষ্ণুর নারী শক্তি, অর্থাৎ লক্ষ্মী মানেই বিষ্ণু এবং বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম, সুতরাং লক্ষ্মী কে, সেটা নিশ্চয় এবার বুঝতে পারছেন ?

একই ভাবে সরস্বতী, ব্রহ্মার নারী শক্তি এবং দুর্গা বা কালী, শিবের নারী শক্তি। তার মানে লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা, কালী, কার্তিক গনেশসহ যে দেব-দেবীরই পূজা করেন না কেনো, তা আল্টিমেটলি পরম ব্রহ্ম বা ঈশ্বরেরই পূজা, তাই কোনো দেব-দেবী ই ছোট নয় বা কেউই বড় নয়, সবাই সমান এবং চুড়ান্ত বিচারে সবাই এক, সবাই পরমেশ্বর ব্রহ্মের এক একটি রূপ।

এই সব তত্ত্ব যখন কোনো হিন্দু জানবে, তখন সে আর নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট দেবতার ভক্ত বলে মনে করবে না; কারণ, সে তখন নিজেকে চিনতে পারবে এবং জানতে পারবে যে, সে যে দেবতারই ভজনা করুক না কেনো, তার প্রার্থনা আসলে পৌঁছায় একজনেরই কাছে, যেটা হলো রুট বা মূল; এই মূলটাকে সে চেনেনা বলেই, ক্ষুদ্র গণ্ডীতে নিজেকে আটকে রেখে নিজের পরিচয় দেয়, আমি অমুকের ভক্ত বা অমুকের অনুসারী বলে! কিন্তু এটা মনে করে, নিজে সমুদ্রের সন্তান হয়ে, সে যে নিজেকে কোনো নদীর সন্তান বলে পরিচয় দিচ্ছে, যেটা সে নিজেই জানে না।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment