Thursday 28 May 2020

সংস্কৃত রামায়ণ অনুসারে রাম-সীতা, লক্ষ্মণের মাংস খাওয়ার প্রমাণ


সংস্কৃত রামায়ণ অনুসারে রাম-সীতা, লক্ষ্মণের মাংস খাওয়ার প্রমাণ :

বাল্মীকি রামায়ণে বেশ কয়েক জায়গায় স্পষ্ট করে লিখা আছে যে, বনবাস কালে রাম সীতা লক্ষ্মণ বিভিন্ন প্রাণী হত্যা করে তার মাংস খেতেন, কিন্তু এই কথা বললেই কিছু কিছু দিব্যজ্ঞানীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, সত্য বোঝা ও বলার জন্য তারা আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে গালাগালি করে বা করবে; কিন্তু কুকুরের ঘেউ ঘেউ করা দেখে হাতি যেমন পাত্তা দেয় না, তেমনি আমিও ঐসব গালাগালিকে কেয়ার করি না; এ প্রসঙ্গে দিব্যজ্ঞানীরা জেনে রাখুক- কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি সত্য বলা এবং সত্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবো না; কারণ, আমি মনে করি সনাতন ধর্মের প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরার জন্য ঈশ্বর আমাকে তৈরি করেছেন, তাই সেই কাজ আমি করে যাবো। তবে দিব্যজ্ঞানীদের যদি সেই শাস্ত্রজ্ঞান থেকে, তাহলে হিন্দুধর্মের প্রামাণ্য গ্রন্থ থেকে রেফারেন্স দিয়ে আমার যুক্তি খণ্ডন করতে পারে বা আমার কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে, কোনো মনগড়া বিশ্বাস গ্রহনযোগ্য নয়।

যা হোক, শুরু করছি, আজকের মূল প্রসঙ্গ-

অযোধ্যাকাণ্ডের ১৪ নং উপাখ্যান (শৃঙ্গবেরপুর- নিষাদরাজ গৃহ) সর্গ : ৪৯-৫২ তে এক জায়গায় রাম তার পিতার প্রধানমন্ত্রী সুমন্ত্র, যে রামকে বনে ছাড়তে গিয়েছিলো, তাকে বলছে, “আবার আমি কবে পিতা মাতার সঙ্গে মিলিত হয়ে সরযুতটের পুষ্পিত বনে মৃগয়া করবো ?” (রাজশেখর বসুর রামায়ণ, পৃষ্ঠা ১০৬)

যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি- মৃগয়া মানে শিকার করা, আর এই শব্দটি এসেছে মৃগ থেকে যার অর্থ হরিণ। প্রাচীন কালের রাজারা শুধু হরিণকেই শিকার করতো, তাই হরিণের প্রতিশব্দ মৃগ থেকে মৃগয়া শব্দের উৎপত্তি। আর রাজারা অন্যান্য হিংস্র প্রাণী বীরত্ব দেখানোর জন্য শিকার করলেও তৃণভোজী প্রাণী কিন্তু শিকার করতো শুধু মাত্র খাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাহলে রামের মৃগয়া করার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ?  না পারলেও একটু পরেই সেটা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। কা্রণ, এই উপাখ্যানেরই শেষের দিকে, উল্লিখিত পুস্তকের পৃষ্ঠা ১০৯ তে, সীতা গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করে বলছে, আমরা যদি ঠিকঠাক মতো বনবাস শেষ করে রাজ্যে ফিরে যেতে পারি, তাহলে, “তোমাকে সহস্র ঘট সূরা এবং মাংসযুক্ত অন্নের ভোগ দেবো।”

যে মাংস খায় না, তার পক্ষে কি মাংসের ভোগ দেওয়া সম্ভব ?

এই পৃষ্ঠাতেই এই উপাখ্যানের একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে বলা আছে,

“কিছুকক্ষণ পর তারা সমৃদ্ধ শস্যসম্পন্ন বৎস্যদেশে উপস্থিত হলেন। সেখানে রাম লক্ষ্মণ- বরাহ (শুকর), ঋষ্য, পৃষত (কৃষ্ণসার হরিণ) এবং মহারুরু (শম্বর, এটা আমার অচেনা) এই চার প্রকার পশু বধ করে, তাদের পবিত্র মাংস নিয়ে ক্ষুধিত হয়ে সায়ংকালে বাসের নিমিত্তে বনে প্রবেশ করলেন।”

রাম-লক্ষ্মণ-সীতা যদি মাংসই না খায়,  তাহলে তারা এই পশুগুলো হত্যা করলো কেনো ?

এরপর অযোধ্যাকাণ্ডের ১৫ নং উপাখ্যান, উক্ত পুস্তকের পৃষ্ঠা নং ১১১ তে বলা আছে, “এক ক্রোশ গিয়ে দুই ভ্রাতা বহু প্রকার পবিত্র মৃগ বধ করে এনে যমুনা তীরস্থ বনে ভোজন করলেন।”

এবং পৃষ্ঠা ১১২ তে বলা আছে- রাম, লক্ষ্মণকে বলছে,

“অতএব তুমি মৃগ বধ কর নিয়ে এসো। লক্ষ্মণ পবিত্র মৃগ বধ করে এনে তার মাংস অগ্নিপক্ব ও শোনিত শূন্য করে রামকে দিলেন।”

শুধু যে রাম লক্ষ্মণ সীতা ই মাংস খেতো, তাই নয়, খেতো ভরতও, তার প্রমান আছে, পৃষ্ঠা ১২৯ এ; সেখানে, রামের সাথে দেখা করে তাকে রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ভরত বনের মধ্যে এলে, গুহ নামক একব্যক্তির জনপদের কাছে ভরত শিবির ফেলে বিশ্রামের জন্য, খবর এবং পরিচয় পেয়ে সেই গুহ, মৎস্য-মাংস-মধু উপহার নিয়ে ভরতের সাথ দেখা করতে যায়।

সেগুলো যদি না খাওয়া হয়, তাহলে সেগুলো উপহার নিয়ে যাবে কেনো ?

গুহ এর ওখান থেকে ভরত যায় ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে, সেখান ভরতের সাথের সকল সৈন্যসামন্তকে বলা হয়, “সূরাপায়িগন সূরা পান করো,  বুভূক্ষিতগণ পায়স ও সুসংস্কৃত মাংস যা ইচ্ছা হয় খাও”(পৃষ্ঠা-১৩২)।অনেক কিছুর সাথে এখানে ভরতের লোকজনের আপ্যায়ণের জন্য ছিলো- ছাগ ও বরাহের মাংস, মৃগ, ময়ূর ও কুক্কুটের(মুরগী) মাংস (পৃষ্ঠা-১৩৩)। এই তথ্যে এখানে পরিষ্কার যে, সেকালে ঋষিরাও মাংস খেতো, কেউ নিরামিষ ভোজী ছিলো না।

এরপর অরণ্যকাণ্ডের ১১ নং উপাখ্যান “মায়া মৃগ ও মারীচ বধ”, যে উপাখ্যানের ঘটনায় একটি সুন্দর হরিণ দেখে সীতা রামকে সেই হরিণ ধরে আনার জন্য বলেছিলো, সেই হরিণ ছিলো আসলেই একটি মায়া হরিণ, কিন্তু প্রচলিত ধারণা মতো সোনার হরিণ নয়, রামকে বিভ্রান্ত করার জন্য মারীচ এই হরিণের রূপ ধরেছিলো। যা হোক, এই উপাখ্যানের শেষে বলা আছে, শেষ পর্যন্ত সেই মায়া হরিণকে না পেয়ে “রাম অন্য মৃগ বধ করে মাংস নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন (পৃষ্ঠা-১৭৮)।”

রাম সীতা যদি মাংসই না খায়, তাহলে রাম, সীতার সেই পছন্দের হরিণকে ধরতে না পেরে অন্য হরিণ বধ করলো কেনো ?

শুধু তাই নয়, রাবন যখন সীতাকে অপহরণ করতে ছদ্মবেশে গেছে, তখন রাবনকে সীতা চিনতে না পেরে বলছে,

“আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমার স্বামী শীঘ্রই রুরু (হরিণ), গোধা (গোসাপ) বরাহ প্রভূতি পশু বধ করে নিয়ে আসবেন।”(পৃষ্ঠা-১৮২)

রাম সীতা যদি মাংসই না খায় তাহলে রাম এই পশুগুলো শিকার করবে কেনো এবং কেনো সীতা, একজন অতিথিকে মাংস খাওয়ানোর কথা বলবে ?

তাছাড়া,  সীতা যে হরিণ শিকারের জন্য রামকে পাঠায়, যে সময় সে রাবন কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলো, সেটা কিন্তু তারা খাওয়ার জন্যই শিকার করতে চেয়েছিলো; কারণ, হরিণ ধরে পোষার মতো শখ তো সেই সময় সীতার ছিলো না। কিন্তু সীতার হরিণ ধরতে চাওয়ার কারণ তো পাবলিককে নিরামিষ আকারে বোঝাতে হবে যে কেনো সীতা, রামকে হরিণ ধরতে পাঠিয়েছিলো ? তাই কৌশলে সেই মায়া হরিণকে নিরামিষবাদীরা সোনার হরিণ বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সোনার হরিণ বলে যে বাস্তবে কিছু হয় না, সেটা আমাদের বাঙ্গালি হিন্দুদের মাথায় গত ৫/৬ শ বছরেও ধরা পড়ে নি।

এরপর সুন্দরকাণ্ডের ৭ নং উপাখ্যান, ‘সীতা হনুমান সংবাদ’ এ, হনুমান, সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে রামের কী অবস্থা সেটা তাকে বোঝানোর জন্য বলছে, “তিনি মাংস খান না, মদ্য পান করেন না, কেবল বিহিত বন্য ফলমুল খান।” (পৃষ্ঠা-২৭৭)

সীতার শোকে রাম যে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সেই কথা ই হনুমান এখানে সীতাকে বোঝাচ্ছে।

আশা করছি, রাম-সীতা যে নিরামিষভোজী ছিলো না, সেই বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। তারপরও যদি দিব্যজ্ঞানীদের মতো আপনার এই ধারণা থাকে যে- না, রাম সীতার পক্ষে মাংস খাওয়া অসম্ভব। তাহলে রাজশেখর বসুর অনুবাদ করা এই রামায়ণটি আপনাকে কালেক্ট করে পড়তে হবে। কেউ কেউ এই প্রশ্নও তুলতে পারেন যে, রাজশেখর বসুই যে রামায়ণের সঠিক অনুবাদ করেছে, তার নিশ্চয়তা কী ? তাহলে তো আপনাকে এটা পড়তেই হবে। কারণ, পড়ার পরই আপনি বুঝতে পারবেন, অনুবাদ কী এবং অনুবাদ করা কাকে বলে ?

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment