Thursday 28 May 2020

মহাভারত যুগের খাদ্যাভ্যাস


মহাভারত যুগের খাদ্যাভ্যাস :

বৈষ্ণব সমাজের বহুল মিথ্যা প্রচারণার ফলে প্রায় সব হিন্দুই বিশ্বাস করে যে, ধর্ম কর্ম করতে হলে নিরামিষ খেতে হবে বা মাছ মাংস খেলে ধর্ম কর্ম হবে না বা ধর্ম কর্ম করা যাবে না। কিন্তু আল্টিমেট বিচারে নিরঙ্কুশ নিরামিষ খাওয়া যেহেতু একটি অবাস্তব থিয়োরি, সেহেতু কোনো গৃহী হিন্দুর পক্ষেই সম্পূর্ণ নিরামিষী হওয়া সম্ভব নয়, তাই তারা বাস্তব কারণেই মাছ মাংস খেতে বাধ্য হয় এবং পূজা পার্বন উপলক্ষ্যে বা একাদশীর উপবাস উপলক্ষ্যে দুই একদিন নিরামিষ খেয়ে ভণ্ডামী করে, পরে আবার মাছ মাংস খায় এবং অপরাধবোধে ভোগে; এভাবে বৈষ্ণব সমাজ, পুরো হিন্দু সমাজকে একটি দ্বিধা-সংকোচের মধ্যে ফেলে রেখেছে।

হিন্দু শাস্ত্রে যে নিরামিষ খাওয়ার কোনো বিধান নেই, এই কথা আমি আমার বহু পোস্টে বহুবার বলেছি, শাস্ত্র থেকে তার প্রমাণও দিয়েছি, রামায়ণ ঘেঁটেও দেখিয়েছি রাম-সীতা-লক্ষ্মণ, বনবাসকালে বনে পশু শিকার করে তার মাংস খেতো, কিন্তু তারপরও কিছু দিব্যজ্ঞানীর মাথায় এটা ঢোকেই না, তারা হিন্দু জাতিকে নিরামিষই খাওয়াবে, আর মুসলমানদের হাতে হিন্দুদের ধন-সম্পদ ঘর বাড়ি আর নারী তুলে দেওয়াবে।

গীতায় বর্ণিত সাত্ত্বিক মানে যে নিরামিষ খাবার নয় এবং রামায়ণেও যে নিরামিষ খাবারের কোনো ব্যাপার নেই, এসব ব্যাপারে আগে আমি আলোচনা করেছি; প্রসঙ্গ উপস্থিত হওয়ায়, আজ আলোচনা করে দেখাচ্ছি মহাভারত যুগের খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে-

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসকৃত মহাভারতের গদ্য অনুবাদক রাজ শেখর বসু, তার গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন,  "ভীম মাংসলোভী পেটুক ছিলেন", সুতরাং ভীমের অন্যান্য ভাই যে মাংস খেতো এবং রাজ পরিবারে যে মাংস রান্না হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এছাড়াও হস্তিনাপুরের রাজ মাতা সত্যবতী ছিলেন জেলের মেয়ে, আর জেলের মেয়ে যে মাছ খাবে, সেটা তো নরম্যাল ব্যাপার।

মহাভারতের সভাপর্বের "ধৃতরাষ্ট্র-শকুনি-দুর্যোধন-সংবাদ" অধ্যায়ে ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধনকে বলছে-

"পুত্র, তোমার শোকের কারণ কী? মহৎ ঐশ্বর্য আর রাজচ্ছত্র তোমাকে আমি দিয়েছি, তোমার ভ্রাতা আর বন্ধুরা তোমার অহিত করেন না, তুমি উত্তম বসন পরছো, সমাংস অন্ন খাচ্ছো, উৎকৃষ্ট অশ্ব, মহার্ঘ শয্যা মনোরমা নারীবৃন্দ, উত্তম বাসগৃহ ও বিহারস্থানও তোমার আছে, তবে তুমি দীনের ন্যায় শোক করছো কেনো ?"

এখানে খেয়াল করুন, ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধনকে বলছে- "সমাংস অন্ন খাচ্ছো", তার মানে হস্তিনাপুরের রাজ পরিবারে মাংস খাওয়া ছিলো সাধারণ বিষয়।

বনপর্বে "যুধিষ্ঠিরাদির তীর্থযাত্রা" অধ্যায়ে বলা আছে-
"উপস্থিত সকল লোককে যুধিষ্ঠির বললেন, ' যে ব্রাহ্মণ ও যতিগণ ভিক্ষাভোজী, যারা ক্ষুধা তৃষ্ণা পথশ্রম আর শীতের কষ্ট সইতে পারেন না, তাঁরা নিবৃত্ত হন, যারা মিষ্টভোজী, বিবিধ পক্বান্ন লেহ্য পেয় মাংস প্রভৃতি খেতে চান, যাঁরা পাচকের পেছনে থাকেন, তাঁরাও আমার সঙ্গে যাবেন না।"

খেয়াল করুন, যুধিষ্ঠির বলছে, "বিবিধ পক্বান্ন লেহ্য পেয় মাংস প্রভৃতি যারা খেতে চান", এর মানে হলো মহাভারতের যুগে মাংস খাওয়া কোনো ব্যাপারই ছিলো না।

যা হোক, উপরে বর্ণিত এই ধরণের ছোটখাটো ঘটনা ছাড়াও মহাভারতে বর্ণিত দুটি বড় ঘটনার দিকে তাকালে মহাভারত যুগের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে আমরা কিছু ধারণা পাবো।

মহাভারতের সভাপর্ব, যে পর্বে যুধিষ্ঠির, ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করাকালে রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলো, সেই সময়ের খাবার দাবারের বর্ণনাতে বলা হয়েছে-

"যুধিষ্ঠির ঘৃত ও মধু মিশ্রিত পায়স, ফলমূল, বরাহ ও হরিণের মাংস, তিল মিশ্রিত অন্ন প্রভূতি বিবিধ ভোজ্য দিয়ে দশ হাজার ব্রাহ্মণ ভোজন করালেন এবং তাদের উত্তম বসন, মাল্য ও বহু সহস্র গাভী দান করলেন। তারপর গীত বাদ্য সহকারে দেবপূজা ও বিগ্রহ স্থাপন করে সভায় প্রবেশ করলেন।… নানাদেশ থেকে আগত ঋষি ও নৃপতিদের সঙ্গে পাণ্ডবগণ সেই সভায় আনন্দে বাস করতে লাগলেন।"

এখানে লক্ষ্যণীয় যে ঋষিরাও কিন্তু বরাহ ও হরিণের মাংস খেতো।

এটা ছাড়াও খাবার-দাবারের আরেকটি বর্ণনা আছে মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের কন্যা উত্তরার সাথে অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর বিবাহের ঘটনায়, সেখানকার বর্ণনা এরকম-

"অর্জুনের প্রস্তাবে বিরাট সম্মত হলেন, যুধিষ্ঠিরও অনুমোদন করলেন। তারপর সকলে বিরাটরাজ্যের অন্তর্গত উপপ্লব্য নগরে গেলেন এবং আত্মীয় স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে পাঠালেন। দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ বলরাম কৃতবর্মা ও সাত্যকি, সুভদ্রা ও অভিমন্যুকে নিয়ে এলেন। ইন্দ্রসেন প্রভূতি ভৃত্যরাও পাণ্ডবদের রথ নিয়ে এল। এক অক্ষৌহিনী সৈন্যসহ দ্রুপদ রাজা, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন এলেন। মহাসমারোহে বিবাহের উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। শত শত মৃগ ও অন্যান্য পশু নিহত হলো।.. জনার্দন কৃষ্ণের সম্মুখে অভিমন্যু ও উত্তরার বিবাহ যথাবিধি সম্পন্ন হলো।"

এই দুটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে মহাভারত যুগের মানুষের খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিলো এবং সেই সাথে এটাও প্রমাণিত যে সেই সময় নিরামিষ খাবার বলে কিছু ছিলো না; আর সেই সাথে এটাও স্পষ্ট যে- উপরে বর্ণিত দুটি বড় ঘটনায় যেহেতু কৃষ্ণ উপস্থিত ছিলেন সেহেতু তিনিও সকলের মতো সকলের সাথে একই ধরণের খাবার খেয়েছেন, সুতরাং কৃষ্ণ নিরামিষ খান নি, তিনিও সকলের মতো আমিষ খাবারও খেয়েছেন। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণ যে বনে পশু শিকারও করেছেন সেটাও আছে মহাভারতের আদি পর্বের সুভদ্রাহরণপর্বাধ্যায়ে, সেখানে বলা আছে,

"সৈন্যদল বেষ্টিত হয়ে যদুবীরগণের সঙ্গে কৃষ্ণ বলরাম নানাবিধ মহার্ঘ যৌতুক নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন। অনেক দিন আনন্দ যাপন করে সকলে ফিরে গেলেন, কেবল কৃষ্ণ রইলেন। তিনি যমুনা তীরে অর্জুনের সঙ্গে মৃগয়া করে মৃগ বরাহ মারতে লাগলেন।"

সুতরাং কৃষ্ণ যে অহিংস নয়, সেটা তার জীবনের নানা ঘটনায় যেমন প্রমাণিত, তেমনি কৃষ্ণ যে নিরামিষী ছিলেন না, সেটাও মহাভারত যুগের খাদ্যাভ্যাস দ্বারা প্রমাণিত; অথচ এই কৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন প্রসঙ্গে দিব্যজ্ঞানীরা প্রশ্ন করে- ভগবানকে কি মাছ মাংস নিবেদন করা সম্ভব ?

ভগবানকে মাছ মাংস নিবেদন করা সম্ভব কি না, আশা করছি সেই প্রশ্নের জবাব আমার বন্ধুরা পেয়েছে।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment